আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খেলনা

নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই

ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লিরা বিস্মিত হল যে রাতে কখনো বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তায় পানি। কেউ বাড়ি ফিরে গেল। পাকা ঈমানদারেরা কাদা পায়েই মসজিদে ঢুকল। নয়াটোলার রাস্তাটা নিচু আর বহুদিন ধরেই ভাঙা। জলাবদ্ধ অবস্থায় অফিসগামী মানুষগুলো হাটু অব্দি প্যাণ্ট মুড়িয়ে জুতাস্যাণ্ডেল মুঠোয় ধরে এগোচ্ছিল।

মামা ভাগ্নে বিল্ডিং এর তিন তলা নিবাসী আবু বকর সাহেবের একমাত্র সন্তান ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্যদের বিপদ দেখছিল, ব্রাশটা চিবাচ্ছিল আর তিন তলা থেকে পেস্ট ফেলছিল। কনফেকশনারীর মালিক মন্টু আর ফোনের দোকানের ফিরোজ দোকান পর্যন্ত ইট বিছিয়ে দিয়েছিল তাদের স্বার্থে । দুটো করে ইট ফেলার পর দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার উপায় হল। অবশ্য ইটগুলোর দুরত্ব বেশি বলে লাফিয়ে চলতে হল । দুটো রিকশা এসে খেয়া পারাপার শুরু করল।

পাড়ার মুরব্বীরা তখন সরকারকে গালি দেয়, কয়েকটা টোকাই এসে জলকেলি খেলতে থাকে, মাংসের দোকানের নেড়ী কুকুরটা মানুষের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে ঝুপ করে মৃদু শব্দ তুলে জয়নাল নামে একটা কিশোর তিনটা ডিমের ঠোঙা সহ উল্টে পড়েছিল। হার্ডওয়্যারের দোকানের মকবুল যখন দেখল কাজের ছেলে পড়েছে সে উদ্ধার না করে অসতর্কতার জন্য তিরষ্কার করল। ছেলেটা উঠে পড়ল। সৌভাগ্যক্রমে তার ডিমগুলো ভাঙল না।

মামা ভাগ্নে বিল্ডিং এর সিঁড়ির অন্ধকারে উদাম হয়ে ভেজা শার্ট আর প্যাণ্ট চিপে নিল জয়নাল। ভেজা প্যান্ট আর হাফহাতা শার্ট মুছতে মুছতে সে তিন তলায় উঠতেই দেরী হবার জন্য আবু বকরের মুখরা স্ত্রী বকা ঝকা করতে থাকল। ডিমগুলো ফেটে কুচি কুচি করে পেয়াজে লবনে তাওয়ায় ঢেলে দেয়া হল। আবু বকর এর ভেতর কয়েকবার স্মরণ করে দিয়েছিল যে যথেষ্ট দেরী হয়েছে। আগে জানলে সে অফিসের পাশের ক্যান্টিনে খেয়ে নিত।

স্ত্রীর বহু কষ্টে বানানো নাস্তাটা না খেলে পরিস্থিতির অবনতি হবে এই ভেবে কোন মতে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া সেদ্ধ আটার রুটিতে অমলেট ছিঁড়ে গ্লাসের পানিটা সপাত গলায় ঢেলে কোমরের বেল্ট চেক করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে আসল আবু বকর। আজকের মিটিংটা খুব জরুরী। অফিসে পৌঁছানোর জন্য "খালি" বলে রিকশাদের ডাকলেও রিকশাগুলো গম্ভীর ভাবে চলে গেল। রিকশায় বসে থাকা যাত্রীরা ইস্ত্রি করা প্যাণ্টে, ভাল জুতায় একজন লোককে অসহায় ভাবে চেঁচামেচি করতে দেখে আড় চোখে তাকাল। কাজের ছেলেটাকে আবারও নিচে রিকশা আনতে পাঠানো হয়, আবু বকর অফিসে দেরী হতে পারে সেটা মোবাইলে জানিয়ে দেয়।

অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করে সকাল ৯ টা ২১ মিনিট একটা বৃদ্ধ চালক মগবাজার যেতে রাজি হল। রিকশাটাও রদ্দি মার্কা । ঝাঁকিতে রিক্শার চেইন পড়ে যায়, প্যাডেলে জোর নেই। নয়াটোলা বিদ্যা নিকেতনের মোড়ে গর্তে রিকশা আটকে গেলে, বুড়োটা ঠেলে তুলতে পারল না। পেঁয়াজুর দোকানের এক ছোকরা দু'টাকার বিনিময়ে পিছনে ঠেলে দেয়।

আব বকরের চোখ ঘড়িতে থামে। ১০.৩০ এর মধ্যে তার পৌঁছা দরকার। এর মধ্যে হঠাৎ করে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়তে থাকল। বৃষ্টিটা ক্রমাগত বাড়ল। বড় বড় ফোটায় রেক্সিনের নিল পর্দায় নিজেকে তড়ি ঘড়ি ঢেকে নিল আবু বকর।

কিন্তু হুডের ফাঁকে বৃষ্টি আসতে থাকল। সীটে বসা দায় হল। বুড়োটা হাল ছেড়ে এক দোকানের পাশে দাড়াল। আবু বকরও তখন পুকুরে ব্যাং লাফের মতো তিন লাফে জেনারেল স্টোরের দরজায় আশ্রয় নিল। **** অনেক লোকের বর্ষাবাদলা দিনের অস্থায়ী আশ্রয় এই মনোহারী দোকানটা।

সাইজে বেশ বড়। দুটো অল্পবয়সী ছেলে দোকানের মূখে। টাইট জিন্সের প্যান্ট, হাতে রূপালি বালা। একটার হাতে চালো দিল্লি সিনেমার ডিভিডি। অন্যটার হাতে কুকুর বাঁধার চেইন।

প্রকাশ্যেই বিড়ি টানছিল এরা। মুরব্বী বয়সী আবু বকরকে দেখে পথ ছাড়ল, কিন্তু বিড়ি লুকালো না । গোটা পাঁচেক লোক বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। ছিপছিপে গোঁফের একটা ছেলে ক্যাশে বসে ছিল। কাজ ছিল না বলে সাজানো জিনিসকে আরো বেশী করে সাজাচ্ছিল।

ছেলের ধোঁয়াতে তারও বিরক্ত হচ্ছিল কিন্তু সে রহস্যজনক কারণে কাউকে কিছু বলল না। দোকানের সবচেয়ে ভিতরে চিকন বেঞ্চ। সেখানে একজন মহিলা বসে আছে। প্রতিবেশীর স্ত্রীকে চিনতে পেরে আবু বকর জিজ্ঞেস করল, স্লামালেকুম, ভাবি, চিনতে পারেন নাই? মহিলা বয়সে আবু বকরের চেয়ে অনেক ছোট। সে আবু বকর কে চিনতে পেরে হাসল।

ভাই, আর বলবেন না। এমনই ঝামেলার দিন! রুম্মনের আব্বা নাই তিন দিন। ছেলেটা বিছনায় পড়ে ছিল জ্বরে। খাওয়ার রুচি নাই। ডাক্তার দেখাতে গেলাম।

মুখোমুখি তিনতলায় ফ্ল্যাটে থাকা মহিলার স্বামী পুলিশের চাকরি করে। পাঁচ বছরের রোগা শিশুটা আবু বকরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল। আবু বকর বলল, কোন ডাক্তারের কাছে গেলেন? জলিল ক্লিনিকের যে ডাক্তার বসে উনাকে দেখান। রুম্মনের মা তখন একটা অজ্ঞাত ডাক্তারের নাম বলল। কেন দুটো ডাক্তার পাল্টে এই ডাক্তারের কাছে গেল সেটাও ব্যাখ্যার করল।

যেহেতু বৃষ্টি বাড়ছে, গল্প করার সঙ্গীও জুটেছে, আবু বকর অফিসে যাবার তাড়া ভুলে গেল। মহিলার সন্তানটিকে দু একবার খেলতে দেখেছে । আজকে নেতানো কদু গাছের মতো মায়ের শাড়িতে মাথা ডুবিয়ে আছে। হাতে জুসের প্যাকেট, কিন্তু টানছে না। মহিলা দোকানদারের দিকে তাকিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাটটা দিতে বলল।

আব্বু, ব্যাট লাগবে? দেখো কি সুন্দর সাদা বল। প্যাকেটটা হাতে পেয়ে রুম্মন ফিরিয়ে দিল। পছন্দ হয় নি। আবু বকরের মনে হল পিছনের মাঠটা ভরাট করে দালান উঠেছে। ও ব্যাট বল দিয়ে খেলবে কোথায়? দোকানদার এই মধ্যে দুটো খেলনা দেখাচ্ছিল রুম্মনের মা বলল, আপনার কাছে স্টিকার আছে? নিনজা বা টম এন জেরি? দোকানদারের কাছে পাওয়ার রেঞ্জারের স্টিকার ছিল।

ছেলেটা চুপ থাকল। তার মা বলল, এসব তার এসব সবই আছে। দোকানদার বিন্দুমাত্র হতাশ না হয়ে জানায় তাদের খেলনা সব বাচ্চাদের পছন্দ। ভিতর থেকে রিমোট কন্ট্রোলড গাড়ি আনল। দামটা যে বিষয় না দোকানী তা বুঝে গিয়েছিল।

অসুস্থ চোখে ছেলেটা খেলনাটা ছুঁয়ে দেখল। তারপর কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, না, আম্মু। বাসায় চল। আবু বকরের খুব মায়া হল রুম্মনকে দেখে। কচি মুখ, চোয়াল বসে গেছে, শীর্ণ পাংশুল তার চেহারা ।

লোকটার মধ্যে কিছুটা স্নেহ কাজ করে। আবদ্ধ দিনে রুম্মনের খেলনা নির্বাচনে সে অংশগ্রহণ করল। কিন্তু অফিসের মিটিং এর উদ্বেগে সে বাইরের দিকে নজর রাখছিল। **** ঠিক এমন সময় "ওরে নীল দরিয়া" গান বেজে প্লাস্টিকের কেসের ভিতর বকরের ফোনটা বেজে উঠল। অফিসের নম্বর দেখে চটজলদি ফ্ল্যাপ খুলল আবু বকর।

ওপাশ থেকে একটা নারী কণ্ঠ বলল, বকর স্যার, এমডি স্যার মেসেজ দিয়েছেন, আপনার আজকে না আসলেও হবে। ওয়েদার খারাপ দেখে জরুরী মিটিং ক্যানসেল হয়েছে। আবু বকর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে বৃষ্টিটাই ভাল লাগছে। বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করবে।

তার মন এত ফুর ফুরে হয়ে যায় যে তার খেয়াল হয় রুম্মনের জন্য খেলনার দামটা সেই দিতে পারে। সে উঠে গেল। কিন্তু বাচ্চাটা পছন্দ নেই। কাচে সাজানো সীমিত খেলনাগুলো থেকে একটা সবুজ রঙের একটা প্যারট নিয়ে ফিরে এস আবু বকর। প্যারটটা রুম্মনকে দেখাতে সে অন্য দিকে মাথা ঘুরাল।

তার মা আবু বকরকে মানা করল, বলল, ভাই, কিছু মনে করবেন না । ওগুলোতে ওর লাভ নেই। ওর বাবা ডিউটিতে যেদিন গেল সে দিন থেকেই মুখে হাসি নেই। আর এবার ডিউটি চুয়াডাঙায়, আসতে দেরী হবে। ওকে নিয়ে অনেক মুশকিল।

দোকানদার ছোকরাটার আন্তরিকতার অভাব নেই। সে ক্লান্তিহীন ভাবে একটার পর একটা খেলনা দেখাতে থাকল যেটা নিশ্চিত ভাবে বাচ্চাদের পছন্দ হবে। বিক্রি হলে তার লাভ। স্পাইডারম্যানের মুখোস, ইয়ো ইয়ো, পিস্তল, খেলনা ফোন এবং সবশেষে কাউবয় হ্যাট। প্লাস্টিকের তলোয়ার কিংবা গান গাওয়া ঘড়িও দেয়া হল কিন্তু রুম্মন ফিরিয়ে দিল দুর থেকেই।

আবু বকরের ছেলে বুলবুল যখন রুম্মনের বয়সী সে সময় তার নতুন চাকরি। নতুন বেতনের পয়সায় একটা কাঠের ঘোড়া কিনে দিয়েছিল। সেটাই ছেলেটা বহু বার খেলেছে। বাবুবাজার মাঠে ঈদুল ফিতরের মেলায় নিয়ে যেত বুল বুল কে। একটা কাগজের কুমির বা সুতো টানা ইদুর কিনে দিলে বুলবুলের আনন্দের সীমা থাকত না।

বৃষ্টি পুরো দিনের হিসাব পাল্টে দিয়েছে। এতক্ষণে তার মিটিং চলত। ফাইল পত্র নিয়ে অফিসে ব্যস্ত হয়ে যেত। কোম্পানীর লাভ লোকসানের রিপোর্ট, ভাউচারগুলো ক্রসচেক করা, গতদিনের ভাউচারগুলো জার্ণালে এন্ট্রি করা। ক্যালকুলেটর চেপে চেপে হিসাব মেলানোর কাজে বহুদিন নতুন কিছু পাওয়া যায় না।

পাঁচটা পর্যন্ত অফিস থাকে। ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ গিয়েছে জানে না। বৃষ্টি থেমে গেছে। দোকানের ভিড় কমে গেছে। বখাটে ছেলেটাও চলে গেছে।

মহিলাটিও তখন চলে যেতে উদ্যত হয়। হয়তো সৌজন্য রক্ষার্থেই আবু বকরকে অনুরোধ করে যাতে সে যেন সস্ত্রীক তাদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। আবু বকর জবাবে একই ভাবে বেড়াতে বলে। **** রুম্মনের মা শাড়িটা গুছিয়ে তার ছেলের জুতার ফিতেটা ঠিক করছিল, তখন আবু বকরের হঠাৎ নিজের শৈশব মনে পড়ে যায়। রুম্মনের মাকে সে এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলে।

এরপর দেখা গেল আবু বকরের হাতে কয়েক তা সাদা কাগজ। বেঞ্চের উপর কাগজটা রেখে সমান দুই ভাঁজ করে। রুম্মন চোখ বড় বড় করে দেখতে থাকল কাগজটা যাদুর মতো চারকোনা হল, আবার ভাঁজ হল। ছেলেটার মুখে অনেক কৌতুহল। তিনকোনা ভাঁজে কাগজটা যাদুর মতো একটা নৌকা হয়ে গেল।

রুম্মনের মা আবু বকরের কাণ্ড দেখে হাসল। ওকে আমার কাছে দেন, ভাবী - একথা বলে জবাবের অপেক্ষা না করে রুম্মনকে ডান হাতে বসিয়ে ঝট করে কোলে তুলে আবু বকর। দোকানের সামনে এসে কাগজের নৌকাটাকে বৃষ্টির পানিতে ভাসিয়ে দেয় সে। আর তখুনি বহুদিন পর নির্মল খুশিতে উল্লসিত হয় রুম্মন। মৌনতা, বিষাদ ভেঙে হাত তালি দিয়ে মাকে ডাকে , আম্মা, আম্মা তাড়া তাড়ি আস।

রুম্মনের মা কিশোরীর মতো নেচে নেচে ছুটে আসে। দোকানদার নিজেও কাজ ভুলে পিছন এসে দাড়ায়। একজন শ্রমিক ছিল - সেও। কিছু ক্ষণের মধ্যে অনেকগুলো কাগজের নৌকা ভেসে যেতে থাকল বৃষ্টি স্নাত শহরের ঘোলা তরঙ্গে। রুম্মন নিজেই একটা নৌকা বানালো।

আবু বকর যত্ন করে শেখালো। সে শুধু ভাবছিল এত সহজ একটা খেলনার কথা কেন তার মাথায় আগে আসে নি। --- ড্রাফট ১.২ / উল্লেখযোগ্য কাহিনী ছাড়াই লিখে যাওয়া

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।