আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে

তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা-মেঘনা-যমুনা জীবনের বহু বহু ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের সময়ই হয় না নিজেকে একটু একান্ত করে দেখার। আমি কে, কী, কেন, কোথায়, কিভাবে, এ প্রশ্নগুলো করার। অথচ সামান্য এ ক’টা প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের সবটুকু রহস্য, ঠিকানা, পরিচয় এবং অস্তিত্বের অনিবার্য শর্তগুলোও। প্রশ্নের এই স্বচ্ছ আয়নায় নিয়ত বদলে যাওয়া জীবনের জলছবিগুলোই আমাদের প্রতিটা যাপন-মুহূর্ত, চলমান জীবন। অসংখ্য সমস্যার গেরোয় জট পাকিয়ে যাওয়া আমাদের জটিল জীবনযাত্রার জট খোলার চাবিটাও যে রয়ে গেছে সেখানেই, কেউ কেউ ঠিকই জানেন, আর অনেকেই তার খোঁজ রাখি না আমরা।

এই প্রশ্নের সূত্র ধরেই এগুতে এগুতে অন্তর্ভেদী দার্শনিক ব্যক্তি যাঁরা, একসময় পৌঁছে যান ঠিকই জীবন ছাড়িয়ে মহাজীবনের বিপুল রহস্যের উজ্জ্বলতম দোরগোড়ায় এক অভূতপূর্ব বিস্ময় নিয়ে ! কিন্তু আমরা যারা অতি সাধারণ জন, খুব সাধারণ দেখার চোখ নিয়েও তারা কি পারি না এই অগুনতি যাপনের ভিড়ে শুধু একটিবার নিজের দিকে ফিরে তাকাতে ? যে আমাকে নিয়ে আমি নিত্যদিনের কর্মশালায় খাচ্ছি-দাচ্ছি-হাসছি-খেলছি-ঘুরছি আর মগ্ন হচ্ছি চিন্তায় বা দুঃশ্চিন্তায়, আমাদের সে ‘আমি’টা দেখতে কেমন, তা কি জানি আমরা ? আপনি কি জানেন, ঠিক এ মুহূর্তে আপনি কেমন আছেন ? কিংবা কেমন দেখাচ্ছে আপনাকে ? আসুন না, নিজস্ব আয়নাটার সামনে খুব একান্তে দাঁড়াই একটু ! এবার নিজেকে উন্মোচিত করুন। কেমন দেখাচ্ছে আপনাকে ? ওই আয়নায় যেটা দেখছেন, সেটা আপনার দৈহিক অবয়ব। এই দেহই আমাদের ধারক, বাহক, এবং চালক। এই দেহকে ঘিরে, দেহের মাধ্যমে, এবং দেহের জন্যই আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড। মন বলে যে বিমূর্ত ধারণাপিণ্ড কল্পনা করি আমরা, তাও এই দেহনির্ভর।

দেহ ছাড়া মন বিকৃত, অসম্পূর্ণ, অচল। দেহের বিনাশ ঘটলে মনের আর কোন অস্তিত্ব নেই, থাকে না। এ জন্যেই প্রাচীন যোগশাস্ত্রেও উক্ত হয়- ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম’। আপনি যা কিছুই সাধন করতে চান না কেন, এই দেহ ছাড়া গতি নেই, উপায়ও নেই। দৃশ্যমান এই দেহের অস্তিত্ব মানেই বাস্তবে আপনার অস্তিত্ব।

দেহ নেই, আপনি নেই। দেহ ছাড়া কেউ থাকে না। দেহত্যাগের পরেও আপনার যে নামটা থেকে যাবে কিছুকাল আপেক্ষিক সময় জুড়ে, তাও এই দেহেরই অবদান। এই দেহ ধারণ করে দেহের মাধ্যমে করে যাওয়া কৃতকর্মই তার আপেক্ষিক স্থায়িত্বের মাধ্যমে আপনার অবর্তমানে আপনার নামটাকে বাঁচিয়ে সম্ভাব্য আপেক্ষিক স্থায়িত্ব দিতে পারে। অতএব, ভালো করে দেখুন- যে দেহটা এ মুহূর্তে ধারণ করে আছেন আপনি।

হতে পারেন আপনি নারী বা পুরুষ, এবার বলুন তো, আয়নায় আপনার যে মানবদেহের অবয়ব দেখছেন, তা কি যেমনটা হওয়ার বা থাকার কথা তেমনই আছে ? চোখ, মুখ, নাক, কান, মুখমণ্ডল, গলা, কাঁধ, বাহু, হাত, বুক, পেট, পিঠ, কোমর, উরু, পা, আঙুল, নিতম্ব, জঙ্ঘা, জননেন্দ্রিয় তথা গোটা দেহকাঠামো সম্পূর্ণ, সুঠাম, সুস্থ, সবল, নিরোগ, অবিকৃত, নিখুঁত, স্বাভাবিক সুন্দর, সক্রিয় ও সাবলীল ? এবার অন্তর্চক্ষু উন্মিলিত করুন। কল্পনা করুন আপনার দেহের ভেতরে অবস্থিত আভ্যন্তরীন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-তন্ত্রিগুলোর কথা। মস্তিষ্ক, স্নায়ুরজ্জু, বিবিধ হরমোন গ্রন্থি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, ধমনী, শিরা-উপশিরা, পাকস্থলি, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র, মাংস-পেশী-অস্থি-মজ্জা-মেরুদণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র, রক্তসংবহনতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র, বিপাকক্রিয়াদিসহ ইত্যাদি সমূহ সিস্টেম বা প্রক্রিয়া কি সুস্থ, স্বাভাবিক, সক্রিয় ও সাবলীল আছে ? আরো আছে আপনার স্বপ্ন-কল্পনা-ভাবনার বিস্ময়কর বিমূর্ত সেই জগত, যেখানে গ্রন্থিত হয় সৃজনের অবিরল স্রোত। সেও কি শারীরিক ও মানসিক বাধামুক্ত সতেজ উদ্যমে গতিমান ? এসবের উত্তর যদি ‘হাঁ’ হয়, শুধু আমি নই, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সবাই আপনাকে স্যলুট বা অভিবাদন জানাবে। উত্তর যদি হয় ‘না’, তাহলে দেরি নয়, এখনই ভাবুন, এক অসম্পূর্ণ অপভ্রংশ দৈহিক ও মানসিক অস্তিত্ব নিয়ে কতদূর যেতে পারেন আপনি ? আর আপনার এ চলার পথই বা কতোটা নিরাপদ, উদ্বেগহীন, ইচ্ছা-স্বাধীন ? কথায় বলে- সুস্থ দেহ সুন্দর মন।

কথাটা সর্বাংশেই সত্য। দৈহিক সুস্থতার কোন বিকল্প নেই। একটা নিরোগ সুস্থ-সুঠাম সতেজ কর্মঠ দেহের সাথে মানসিক ভ্রান্তিহীন চাপ নিরপেক্ষ সুডোল মনের রাখীবন্ধন ঘটলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবনের নিশ্চয়তা মেলে। কিন্তু আমাদের জীবন-বাস্তবতায় তা কতোটা অর্জন সম্ভব ? দৈহিক সুস্থতার জন্যে প্রয়োজন সুষম খাবার গ্রহণের পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম। কিন্তু পরিশ্রম পরিকল্পিত না হলে দৈহিক সৌন্দর্য ও সুস্থতা নিশ্চিত হয় না।

দেহের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিমিত সঞ্চালন ও সক্রিয়তা না হলে দেহবিন্যাস সুষম ও সুগঠিত হতে পারে না। এজন্যেই দেহের জন্য দরকার হয়ে পড়ে পরিকল্পিত শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের। আমাদের এ নাগরিক সভ্যতায় মাঠ-ঘাট-খোলা জায়গা এখন যেভাবে ধীরে ধীরে কল্পজগতের বস্তু হয়ে ওঠছে তাতে করে শরীরচর্চার পরিসর ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। কিন্তু দেহের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পেশী হাড় অস্থিসন্ধি ও রক্তসংবহনতন্ত্রের পরিমিত সঞ্চালন ও সক্রিয়তা রক্ষার অনন্য মাধ্যম হিসেবে ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম এখানে তুলনাহীন। যোগ-ব্যায়ামের বিভিন্ন আসনগুলো চর্চার জন্য আপনার ঘরের স্বল্পপরিসর মেঝে বা আপনার বিছানাটাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট।

দেহের জ্বালানী হলো খাদ্য। তা পেলেই দেহ তার অভ্যন্তরস্থ বিশেষ বিশেষ দেহযন্ত্রের মাধ্যমে পরিবহন পরিবর্তন রূপান্তর করে নিজেকে সচল ও সবুজ সতেজ বৃক্ষের মতো পল্লবিত করে তোলে। কিন্তু খাওয়ার নামে প্রতিনিয়ত যা গিলছি আমরা তা কি আদৌ খাদ্য ? বিষাক্ত ভেজালের যুগে এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না আর। অতএব আমাদের দেহযন্ত্রের কারখানায় বিষ থেকে অমৃত সৃজনের প্রযুক্তি যতকাল রপ্ত না হবে, ততকাল ক্রমে ক্রমে নিঃসার হয়ে আসা দেহগহ্বরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সচল ও সক্রিয় রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা না নিয়ে কোন উপায় আছে কি ? তার শ্রেষ্ঠ উপায়ই হচ্ছে ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম। স্নায়ু গ্রন্থি রক্তনালী শিরা-উপশিরা ও দেহের অভ্যন্তরস্থ প্রতিটা দেহযন্ত্রের যথাযথ ব্যায়ামের মধ্য দিয়ে এগুলোকে পরিপূর্ণ সতেজ ও কার্যকর রাখতে ইয়োগাই অনন্য মাধ্যম।

এ ক্ষেত্রে যোগাসনগুলো ছাড়াও বিভিন্ন মুদ্রাগুলোর সমকক্ষ কোন পদ্ধতি একমাত্র ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম ছাড়া অন্য কোন ব্যায়ামে এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। যেভাবে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের সক্রিয় সুস্থতা রক্ষার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে ইয়োগার শ্বাস-ব্যায়াম প্রাণায়াম। এমনকি অত্যাবশ্যকীয় ইন্দ্রিয়গুলোর কার্য়কর সুরক্ষার জন্যেও ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খাবার গ্রহণ করলেই দেহের কাজ শেষ হয়ে যায় না। এই খাদ্য থেকে বিপাক ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খাদ্য-উপাদান ও খাদ্যরস সংগ্রহ শেষে পরিত্যক্ত খাদ্যবর্জ্যগুলো মল-মূত্র ঘাম বা কফ হিসেবে শরীর থেকে বের করে দিতে হয়।

এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হলেও শরীর অসুস্থ হয়ে পড়তে বাধ্য। এই প্রক্রিয়াটাকে সুস্থ সচল রাখতে অন্য সাধারণ ব্যায়ামে কোন উপায় না থাকলেও ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়ামে প্রয়োজনীয় ধৌতিগুলো খুবই কার্যকর উপায়। জীবন যাপনের চলমান বাস্তবতায় যে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি রাষ্ট্র পরিবেশ ও পরিস্থিতি উদ্ভুত স্ট্রেস বা মনো-দৈহিক চাপের মধ্য দিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত পার করতে হয় আমাদের, তা থেকে পরিত্রাণের যে ছটফটানি, এটা আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। সেই দুঃসহ চাপের উৎস পরিবর্তনের সুযোগ বা সামর্থ হয়তো আমাদের নেই। কিন্তু সেই অসহনীয় চাপ সফলভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে স্নায়ুরোগসহ যে মনো-দৈহিক সমস্যা বা রোগের বিস্তার ঘটে, প্রয়োজনীয় শিথিলায়ন ও প্রয়োজনীয় নিরাময়ের ব্যবস্থা না নিলে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে যাবে।

এই মনো-দৈহিক সমস্যা উত্তরণে অনন্যোপায় আমাদেরকে এ জন্যেও ইয়োগার আশ্রয়ই নিতে হবে। প্রিয় পাঠক, চিন্তা বা ধারণা স্বচ্ছ না হলে আয়নায় নিজের অবয়ব দেখেও স্পষ্ট করে বুঝার উপায় নেই যে, বস্তুত যা হওয়ার কথা, নিজের সাথে তার কোথায় কেন কিভাবে কতটুকু তফাৎ বা পার্থক্য পরিদৃষ্ট হচ্ছে এবং কিভাবে তার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। সেজন্যই আমাদের জানার আগ্রহটাকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দেহ-মনের সার্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে সুস্থ-সুন্দর জীবন-যাপনের এ যাবৎ শ্রেষ্ঠ উপায় যেহেতু ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম চর্চা, তাই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি জানার সাথে সাথে পরিপূর্ণভাবে অভ্যাসের সুবিধার্থে ইয়োগা দর্শনটাকেও জানা আবশ্যক বিবেচনা করি। আমি কেন ইয়োগা চর্চা করবো তা যেমন বুঝতে হবে, তেমনি জানতে হবে ইয়োগা কী বা এর ইতিহাস, আধুনিক ইয়োগার জনক হিসেবে চিহ্ণিত গুরু পতঞ্জলি কেন তাঁর অভ্রান্ত অষ্টাঙ্গযোগ মানব সভ্যতাকে উপহার দিয়েছেন এবং সম্পূর্ণ প্রায়োগিক ও মনো-দৈহিক স্বাস্থ্য দর্শন হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই এটাকে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক দর্শন ভেবে ভুল করে ফেলেন কেন ? কিসের ভিত্তিতে আমরা ইয়োগা অনুশীলন করবো এবং অন্য ব্যায়ামের সাথে এর মৌলিক ভিন্নতা কোথায় তা যেমন জানতে হবে, তেমনি এর জ্ঞাতব্য বিষয়গুলোও মনোযোগ সহকারে ধারণ করে নিতে হবে।

এসব বিষয় আগ্রহে বিশ্বাসে অনুধাবন করে নিজের প্রতি আস্থা ফিরে পেলেই কেবল নিজেকে ইয়োগা চর্চায় প্রস্তুত বলে গণ্য করতে হবে। এবং এ জন্য আপনাকে প্রতিদিন কেবল নিজের জন্য তিরিশটি মিনিট ব্যয় করতে প্রতিজ্ঞ হতে হবে। ইয়োগা একটি পরিপূর্ণ দর্শন। অমিত ধৈর্য্য, প্রয়োজনীয অনুশীলন ও ধাপে ধাপে উত্তরণের মধ্য দিয়ে মনো-দৈহিক স্বাস্থ্য ও সামর্থ অর্জনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানবসত্তার চরম উৎকর্ষতা অর্জনের উপায়ই এই দর্শনের অভীষ্টতা। ব্যক্তি তার চেষ্টা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ফললাভ করে থাকেন।

সাধক যোগী পুরুষ যেমন প্রয়োজনীয় তপস্যার মাধ্যমে নিজেকে আধ্যাত্মিক শিখরে আরোহন করতে পারেন, তেমনি ব্যক্তি-সাধারণের দৈহিক সুস্থতা ও সামর্থ অর্জনের জন্য এখানে উল্লেখ রয়েছে প্রচুর আসন, মুদ্রা, প্রাণায়াম ও ধৌতি অভ্যাসের। যোগশাস্ত্রিরা এগুলোর প্রতিটার কার্য-কারণ, সতর্কতা ও ফললাভের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সুন্দরভাবে। এমনকি প্রচলিত রোগ-বালাই নিরাময় কিংবা তা থেকে মুক্ত থাকার উপায়ও বাৎলে দিয়েছেন। দেহগঠন, বয়স কিংবা রোগ বিবেচনায় নিজ প্রয়োজনে ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যচর্চা নির্বাচনের কৌশলও বর্ণিত হয়েছে এতে। একমাত্র ইয়োগা ছাড়া মানবদেহ ও মনের এমন পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য দর্শন আদৌ আর আছে কিনা জানা নেই।

যদি আমরা আমাদের অবিকল্প এই দেহটিকে সকল কর্মকাণ্ডের কার্য ও কারণ বলে বিশ্বাস করতে সক্ষম হই, তাকে সুস্থ সবল সক্রিয় ও সুন্দর রাখতে উদ্ভুত প্রশ্নটি ‘আপনি কেন ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম চর্চা করবেন’ এভাবে না হয়ে হওয়া উচিৎ- আপনি কেন ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম চর্চা করবেন না জীবনের বহু বহু ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের সময়ই হয় না নিজেকে একটু একান্ত করে দেখার। আমি কে, কী, কেন, কোথায়, কিভাবে, এ প্রশ্নগুলো করার। অথচ সামান্য এ ক’টা প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের সবটুকু রহস্য, ঠিকানা, পরিচয় এবং অস্তিত্বের অনিবার্য শর্তগুলোও। প্রশ্নের এই স্বচ্ছ আয়নায় নিয়ত বদলে যাওয়া জীবনের জলছবিগুলোই আমাদের প্রতিটা যাপন-মুহূর্ত, চলমান জীবন। অসংখ্য সমস্যার গেরোয় জট পাকিয়ে যাওয়া আমাদের জটিল জীবনযাত্রার জট খোলার চাবিটাও যে রয়ে গেছে সেখানেই, কেউ কেউ ঠিকই জানেন, আর অনেকেই তার খোঁজ রাখি না আমরা।

এই প্রশ্নের সূত্র ধরেই এগুতে এগুতে অন্তর্ভেদী দার্শনিক ব্যক্তি যাঁরা, একসময় পৌঁছে যান ঠিকই জীবন ছাড়িয়ে মহাজীবনের বিপুল রহস্যের উজ্জ্বলতম দোরগোড়ায় এক অভূতপূর্ব বিস্ময় নিয়ে ! কিন্তু আমরা যারা অতি সাধারণ জন, খুব সাধারণ দেখার চোখ নিয়েও তারা কি পারি না এই অগুনতি যাপনের ভিড়ে শুধু একটিবার নিজের দিকে ফিরে তাকাতে ? যে আমাকে নিয়ে আমি নিত্যদিনের কর্মশালায় খাচ্ছি-দাচ্ছি-হাসছি-খেলছি-ঘুরছি আর মগ্ন হচ্ছি চিন্তায় বা দুঃশ্চিন্তায়, আমাদের সে ‘আমি’টা দেখতে কেমন, তা কি জানি আমরা ? ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম’- এর পথ হলো সুপ্রাচীন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধ্যাত্ম দর্শনের অন্তর্ভূক্ত যোগশাস্ত্রের একটি বিশেষ পথ। যাকে হঠযোগ বলা হয়। দেহকে গঠন করে, তাকে রোগমুক্ত করে, দীর্ঘায়ু করে তবেই যোগের কঠিন সাধনায় এগুতে হবে। নইলে ভঙ্গিল দেহ অসুস্থ কায়াযোগের নিত্য নতুন সম্পদ গ্রহণে সমর্থ হবে না। যোগফল লাভের পূর্বেই সে-দেহ বিনষ্ঠ হয়ে পড়বে।

প্রাচীন যোগশাস্ত্রের সামগ্রিক ভাবনার এবং পরিকল্পনার একটা নির্দিষ্ট অংশ হলো এই হঠযোগ। যদিও এই সমৃদ্ধ দর্শনের উৎপত্তি ও লালন-পালন প্রাচীন ভারতেই, কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এসে এর ব্যাপক চর্চা এখন ছড়িয়ে গেছে দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা মানববিশ্বে। পার্থক্য কেবল এর আধ্যাত্মিক বীক্ষণের রূপান্তরটুকুতেই। যা বহুবিধ ধারায় বিভক্ত হয়ে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সূত্র সমন্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পারফরমিং আর্ট বা মনোবীক্ষণিক পদ্ধতি হিসেবে একই সাথে অধ্যয়ন ও জনপ্রিয় চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। জুডো, ক্যারাটে, সু, জুজুৎসু, কুংফু ইত্যাদি মার্শাল আর্ট বা সম্মোহন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মেডিটেশন, হিলিং, কোয়াণ্টাম ম্যাথড, যোগব্যায়াম ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কতো কী পোশাকী নাম ! মোদ্দা কথা এই সবগুলোরই চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মন নামক এক অদৃশ্য চেতনাগত অবস্থার অভাবনীয় ক্ষমতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে দৃশ্যমান মাধ্যম এই দেহটাকে ইচ্ছেখুশি আজ্ঞাবাহী করে তোলার অভূতপূর্ব অবস্থায় উন্নীত করা।

আর তাই যন্ত্রসভ্যতার এক বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশকালের গণ্ডিহারা বিচ্যুত ও একাকী হয়ে যাওয়া মানবসত্ত্বার কাছে হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন আজ কার্যকর এক প্রায়োগিক দর্শনে রূপান্তরিত হয়ে গোটা বিশ্বে দিনকে দিন অত্যন্ত আগ্রহের ও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। এতোই যখন অবস্থা, তখন প্রশ্ন আসে, তাহলে এই ইয়োগা আসলে কী ? কী এর রহস্য ? এবং এর উৎসই বা কোথায় ? ‘ইয়োগা’ কি? ‘ইয়োগা’ (Yoga) মূলত সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় ‘যোগ’। যার অর্থ গ্রন্থিভূক্ত করা বা সমন্বয় সাধন করা। কীসের সমন্বয় সাধন ? হটযোগ শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেহযন্ত্রগুলোর কর্মক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে স্নায়ুতন্ত্রের পূর্ণ পরিচর্যার মাধ্যমে মনোদৈহিক সম্পর্কসূত্রগুলোকে প্রকৃতিগতভাবেই একাত্ম করা।

এর মৌলিক ধারণা হচ্ছে ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম্। শুরুতেই যা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘হঠযোগ’ হঠাৎ কোন আবিষ্কার বা অভ্যাসশ্রুতি নয়। প্রাচীন মুনি ঋষিরা যোগীশ্বর মহাদেবকে হঠযোগের ৮৪০০০ আসনের প্রকাশক বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর ধ্যানে এই দুঃসাধ্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করতেন। অনুমিত ৫০০০ বছরেরও পূর্বে সিন্ধু নদীর তীরবর্তী ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতায় বা তারও আগে থেকে ইয়োগার অস্তিত্ব যে ছিলো তা প্রাপ্ত ইয়োগা-আসনের প্রত্ন-নিদর্শন থেকেই ধারণা করা হয়।

এছাড়া প্রাচীন গ্রন্থ বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতার মতো শাস্ত্রীয় পুরাণগুলোতেও এর বহু উল্লেখ রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট সময়কাল চিহ্ণিত করা না গেলেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রীষ্ট শতকের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে ভারতীয় আর্যঋষি পতঞ্জলিকে আধুনিক যোগশাস্ত্রের জনক বলে ধরা হয়। একটি আদর্শ ও নৈতিক জীবন যাপন চর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ জ্ঞানানুসন্ধানের নিহিত লক্ষ্য অর্জনে The Yoga Sutra of Patanjali বা 'যোগসূত্রে'র ১৯৫ টি সূত্র সংকলনের মাধ্যমে তিনি যোগশাস্ত্র সম্পর্কিত অর্জিত জ্ঞান পরিকল্পনা ও যাবতীয় ভাবনাগুলোকে কতকগুলো আবশ্যকীয় নীতিমালা বা গাইড লাইন আকারে প্রকাশ করেন। এগুলোই যোগসাধনার মৌলিক উৎস হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। যাকে পতঞ্জলি লক্ষ্যনিহিত সুষ্টু জীবন যাপন পদ্ধতির নিয়মাবলী হিসেবে চিহ্নিত করেন।

তাঁর মতে ইয়োগা বা যোগসাধনা প্রচলিত বা উদ্দেশ্যহীন জাগতিক কর্মপ্রবাহে নিজেকে নিয়োজিত করতে প্রয়োজনীয় সামর্থ অর্জনের লক্ষ্যে গুরুগৃহে শুধুমাত্র কিছুক্ষণ আসন বা শরীরচর্চা করা নয়। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ইয়োগা হচ্ছে নিহিত লক্ষ্য নিয়ে দেহ মন ও আত্মশক্তিকে উৎকর্ষতায় উন্নীত করার একটি কার্যকর মাধ্যম। পতঞ্জলি এই যোগসাধনাকে আবার আটটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করেছেন, যেগুলোকে প্রাথমিক অবস্থায় পর্যায়ক্রমিক অনুশীলন এবং সাফল্য অর্জিত হলে পরে সমন্বিত চর্চার মাধ্যমে একটি উন্নত জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব বলে তিনি প্রস্তাব করেন। এই আটটি পর্যায়কে The eight limbs of Patanjali বা ‘পতঞ্জলির অষ্টঅঙ্গ যোগ’ বলা হয়।

ত্বড়িৎ ফলপ্রাপ্তির তাড়াহুড়ো পদ্ধতি এগুলো নয়। নিরবচ্ছিন্ন চর্চা ও দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই তা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে হয়। পতঞ্জলির অষ্ট যোগাঙ্গগুলো হচ্ছে- ওঁম (Yama), নিয়ম (Niyama), আসন (Asana), প্রাণায়াম (Pranayama), প্রত্যাহার (Pratyahara), ধারণ (Dharana), ধ্যান (Dhyana) ও সমাধি (Samadhi)। বন্ধনী বেষ্টনিতে মূল সংস্কৃত নামগুলো ইংরেজি উচ্চারণে দেখানো হয়েছে। পতঞ্জলির এই অষ্টাঙ্গ-যোগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শরীর ও মনের গূঢ় সম্পর্ক সূত্রগুলো।

এবং তার উপর ভিত্তি করেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ‘সুস্থ দেহ সুস্থ মন’ নির্ভর মনোদৈহিক সম্পর্ক বিশ্লেষণী ইয়োগা সেণ্টারগুলো বহু বিচিত্র পদ্ধতি ও নামে দেহমনের প্রাকৃতিক চিকিৎসার মাধ্যমে এক স্পিরিচ্যুয়াল আন্দোলনে সুস্থ থাকার প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে ব্যাপৃত করার চেষ্টা করছে। যেহেতু দেহের সাথে মনের সম্পর্কসূত্রগুলোকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই আজ, তাই সুদেহী মনের খোঁজে পরম সুস্থ থাকার অদম্য ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করতে ইয়োগা চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করার আগে পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গ-যোগগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক একটু ধারণা নিয়ে রাখা ইয়োগাচর্চার জন্যই সুবিধাজনক হবে বলে মনে করি পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গ যোগ আগেই বলা হয়েছে, ইয়োগা শাস্ত্রে The eight limbs of Patanjali বা ‘পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গ যোগ’গুলো হচ্ছে- ওঁম (Yama), নিয়ম (Niyama), আসন (Asana), প্রাণায়াম (Pranayama), প্রত্যাহার (Pratyahara), ধারণ (Dharana), ধ্যান (Dhyana) ও সমাধি (Samadhi)। এবং বলা হয়ে থাকে যে, পতঞ্জলির এই অষ্টাঙ্গ-যোগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শরীর ও মনের গূঢ় সম্পর্ক সূত্রগুলো। কীভাবে ? তা বুঝতে হলে পতঞ্জলির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই প্রথমে আমাদেরকে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ১.০ ওঁম (Yama): অষ্টাঙ্গ যোগের প্রথম অঙ্গ ‘ওঁম’ হচ্ছে মূলত কিছু মরাল কোড (moral codes)।

এগুলো সেই সূত্র যেখানে ব্যক্তি তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে কীরকম আচরণ করবে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এজন্য ‘ওঁম’-কে ব্যক্তির সামাজিক আচরণ সূত্র বা নৈতিক আচরণবিধিও বলা হয়। ওঁম পাঁচ ধরনের- ১.১ অহিংসা (ahimsa) বা Nonviolence : মানুষ, প্রাণী, প্রকৃতি বা সৃষ্টিজগতের কোন সৃষ্টির প্রতিই চিন্তায় বা কর্মে আঘাত বা কোনরূপ ক্ষতি করার মানসিকতা পোষণ না করা। অর্থাৎ সব সময় নিজের ভেতরে বিদ্বেষহীন চিন্তা ও চেতনা ধারণ করে থাকা। ১.২ সত্য (satya) বা Truth and honesty : মিথ্যাকে সম্পূর্ণ বর্জন করে সত্যবাদিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে যে কোন প্রতারণামূলক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

সর্বেক্ষেত্রে সততার চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করা। ১.৩ আস্থা (asteya) বা Nonstealing : কোন অনৈতিক সুবিধায় প্রলুব্ধ না হয়ে বা চিন্তায় ও কাজে পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলায় মনোযোগী হওয়া। নিজস্ব ক্ষমতার উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে নির্ভরযোগ্য করে গড়ে তোলা। ১.৪ ব্রহ্মচর্য (brahmacharya) বা Nonlust : ব্রহ্মচর্য মানে কিন্তু চিরকৌমার্য পালন নয়। বরং অপ্রত্যাশিত কাম-লালসায় আক্রান্ত না হয়ে সম্পর্কের পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখার নামই ব্রহ্মচর্য।

যোগচর্চাকারীরা স্বাভাবিক নিয়মেই পরিবার গঠন করতে পারেন। তবে তাকে কলুষমুক্ত স্বর্গীয় আভায় রাঙিয়ে তোলায় নিজেকে বিশ্বস্ত রাখার চর্চা করে যেতে হবে। ১.৫ অপরিগ্রহ (aparigraha) বা Nonpossessiveness : অপরিগ্রহ অর্থ হচ্ছে অগ্রহণ বা মুক্ত থাকা। অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু সংগ্রহ, মজুত বা ভোগের লিপ্সা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। এখানে ‘প্রয়োজন’ শব্দটা যদিও একটা আপেক্ষিক বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, তবু যা না হলেই নয় সেটুকু বিবেচনায় রেখে যতটুকু সম্ভব সহজ সরল একটা অনাড়ম্বর জীবন গড়ে তোলে নিজেকে জটিলতামুক্ত রাখা।

২.০ নিয়ম (Niyama): অষ্টাঙ্গ যোগের দ্বিতীয় অঙ্গ নিয়ম হচ্ছে মূলত আত্মশুদ্ধি ও অনুশীলনের (self-purification and study) সেই সব প্রণিধান, যার মাধ্যমে ব্যক্তি তাঁর অন্তর্গত শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে আত্মশুদ্ধ করে তোলে। নিয়মও পাঁচ ধরনের- ২.১ শৌচ (shauca) বা Purity : পাঁচটি ‘ওঁম’ চর্চার মাধ্যমে নিজের ভেতরে ধারণ করে রাখা নেতিবাচক মনোদৈহিক চেতনাগুলো বর্জন করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তোলার পাশাপাশি নিজেকে এবং নিজের পরিচ্ছদ ও পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ ইত্যাদি নিরাপদ অভ্যাস গড়ে তোলা। নিয়মের মূল কথা হচ্ছে শরীরকে পূত পবিত্র আরাধনালয়ের মতো যোগ্য করে তোলা। ২.২ সন্তোষ (santosha) বা Contentment : সন্তোষ মানে হচ্ছে পরিতৃপ্তি। যখন যে অবস্থায় থাকা যায় সে অবস্থাকে সুখকর মনে করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরিতৃপ্ত ও শান্তিদায়ক পরম সুখাবস্থার আত্মিক অন্বেষণ করা।

২.৩ তাপস (tapas) বা Austerity : তাপস মানে আত্ম-সংযম। এর মাধ্যমে দেহ মন ও বাক্যে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা প্রদর্শন করা। এই আত্ম-শৃঙ্খলা উন্নয়নের লক্ষ্য এই নয় যে কঠোর তপস্বী বা যোগী বনে যাওয়া। বরং দেহ ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চতর আত্মিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রস্তুত করে তোলা। ২.৪ স্বাধ্যায় (svadhyaya) বা Study of sacred text : স্বাধ্যায় হচ্ছে আত্মোন্নয়নে সহায়তাকারী ও অনুপ্রেরণাদায়ী প্রাসঙ্গিক গ্রন্থাদি থেকে পাঠ গ্রহণ করা।

কেননা শিক্ষা ও অধ্যয়নই পারে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ করে গড়ে তুলতে। একজন স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তির মধ্যেই এ উপলব্ধির উন্মেষ ঘটা সম্ভব যে কেবল ভোগ নয়, শ্রদ্ধার মধ্য দিয়েই যাবতীয় সৃষ্টি হয়ে উঠে আরো বেশি অর্থবহ। সৃষ্টি পবিত্র, স্বর্গীয়। এবং গোটা মহাবিশ্বপ্রকৃতি যে মহাশক্তি ধারণ করে আছে, সেই একই শক্তি বয়ে গেছে তাঁর মধ্যেও, মহাসৃষ্টির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই। ২.৫ ঈশ্বর-প্রণিধান (ishvara-pranidhana) বা Living with an awarness of the Divine : আপতিক বিশ্বাসে সৃষ্ট সেই স্বর্গীয় সত্ত্বার প্রতি নিজেকে এক পরম আধ্যাত্মিক আনন্দে বিলিয়ে দেয়া।

৩.০ আসন (Asana):অষ্টাঙ্গ যোগের তৃতীয় অঙ্গ আসন হচ্ছে দেহকে নির্দিষ্ট বা বিশেষ ভঙ্গিতে বিন্যস্ত বা স্থাপিত করা (posture)। এর মাধ্যমে দেহকে ধ্যান বা মেডিটেশনের জন্য সুস্থ ও উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। শারীরিক এই চর্চা দেখতে সহজসাধ্য হলেও তা পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে দেহকে রোগমুক্ত, কর্মক্ষম ও অসীম প্রাণশক্তি ধারণের উপযোগিতায় উন্নীত করার কর্তৃত্বসম্পন্ন একটি পদ্ধতি। গভীর ধ্যানস্থ অবস্থায় একই আসনে অভিন্ন ভঙ্গিতে দীর্ঘসময় ধরে বসে থাকতে হয়। এজন্য দেহকে অত্যন্ত নমনীয় ও সহনশীল হতে হয় বলে প্রাচীন যোগী-ঋষিরা বিভিন্ন আসন চর্চার মাধ্যমে দেহকে ধ্যানের জন্য প্রস্তুত করে তুলতেন।

বিক্ষিপ্ত দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই মনকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পতঞ্জলির মতে, নিয়মিত যোগাসন চর্চা দেহ ও মনকে প্রচণ্ড চাপ ও বিশ্রামহীনতার ক্লান্তি থেকে সহজেই মুক্তি দিতে পারে। ৪.০ প্রাণায়াম (Pranayama): অষ্টাঙ্গ যোগের চতুর্থ অঙ্গ প্রাণায়াম হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ (breath control)। এই শ্বসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি দেহধারী প্রাণী প্রকৃতি থেকে প্রয়োজনীয় প্রাণশক্তি আহরণ করে। প্রাণের আয়াম অর্থাৎ প্রাণের দীর্ঘতাই প্রাণায়াম।

সঠিক নিয়মে এই শ্বাস গ্রহণ, ধারণ এবং বর্জন বা ত্যাগকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূলত অফুরন্ত প্রাণশক্তির ধারক ও বাহক হিসেবে দেহের অকল্পনীয় স্থিতিশীলতা আনয়ন সম্ভব বলে পতঞ্জলি মনে করেন। তাঁর মতে যোগীর জীবনকাল দিন গণনা দিয়ে নয়, বরং শ্বাস প্রশ্বাসের সংখ্যা দিয়েই নির্ধারিত হয়। বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণ এবং গভীর শ্বসন প্রক্রিয়ায় শরীরের দুষিত বাতাস ত্যাগের মাধ্যমে ভেতরের সব রোগ জ্বরা বিদেয় করে দীর্ঘজীবী দেহ ও এক আলোকোজ্জ্বল মনকে ধারণ করার কৃতিত্ব অর্জন করার প্রচেষ্টাই এই প্রাণায়াম চর্চা। ৫.০ প্রত্যাহার (Pratyahara): অষ্টাঙ্গের পঞ্চম অঙ্গ। যোগশাস্ত্রে প্রত্যাহার মানে হচ্ছে ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ (sense control)।

স্পর্শ, ঘ্রাণ, শ্রবণ, স্বাদ, দর্শন বা ইন্দ্রিয়সমূহকে তাদের কর্মক্ষম অবস্থা থেকে মনের একাগ্র ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নেয়া বা ফিরিয়ে নেয়ার কৌশল। যাতে যোগী না চাইলে এইসব ইন্দ্রিয়গুলো কোনরূপ সংবেদনশীলতায় কোন সাড়া না দেয়। ধ্যান, প্রাণায়াম বা যোগাসন চর্চাকালীন যে কোন সময় বিক্ষিপ্ত মনকে বহির্মূখী অবস্থা থেকে অন্তর্মূখী করার একাগ্রতাই প্রত্যাহার। ক্রমাগত এই চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে এমন পর্যায়ে উন্নীত করা যেন ধ্যানস্থ অবস্থায় বাইরের কোন সংবেদনশীলতাই দেহমনকে আর অনাহুত আক্রান্ত করতে না পারে। ৬.০ ধারণ (Dharana): অষ্টাঙ্গের ষষ্ট অঙ্গ হিসেবে যোগশাস্ত্রে ‘ধারণ’ মানে মন-সংযোগ বা একাগ্রতা (concentration)।

ধারণ বা একাগ্রতা হচ্ছে কোন একটা বিশেষ বস্তু, বিন্দু বা ইমেজের উপর মনকে স্থিত করার অনুশীলন। পতঞ্জলির মতে কোন একটি বিশেষ জায়গায় চিন্তাগুলোকে আবদ্ধ করাই একাগ্রতা। মোমের শিখা বা কোন একটি ফুল বা কোন একটি মন্ত্রের উপর দৃষ্টি বা চিন্তাকে স্থাপন করে আরো বেশি মনোযোগ স্থাপন করা এবং সমস্ত ভাবনা একমুখী করে সুনির্দিষ্ট ঐ বিষয়ের দিকে শান্ত সমাহিতভাবে পরিচালিত করা, যাতে মন ঐ নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতেই পূর্ণ সংবদ্ধ হয়ে উঠে। মনের উপর কোনরূপ বলপ্রয়োগহীন অনায়াস একাগ্রতায় মনঃসংযোগই ‘ধারণ’। সময়প্রবাহের বোধশূণ্যতাই মনঃসংযোগকে একাগ্র করে তোলে।

৭.০ ধ্যান (Dhyana): অষ্টাঙ্গ যোগের সপ্তম অঙ্গ ধ্যান হচ্ছে একটা গভীর বিবেচনাশীল অবস্থা (meditation)। অর্থাৎ কোন বস্তু বা বস্তুনিচয়ের সহায়তা ছাড়া অব্যহত মেডিটেশন বা প্রশান্তিময় অবস্থার নামই ধ্যান। মনকে পরিপূর্ণ ইচ্ছাশক্তি দিয়ে কোন অতীন্দ্রিয় লক্ষ্য বা ভাবের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা। ‘ধারণ’ বা একাগ্রতাই পরবর্তীধাপে মেডিটেশনের দিকে পরিচালিত হয়। মেডিটেশনের লক্ষ্য কোন অসার (nothingness) বা নির্জ্ঞান অবস্থা (unconsciousness) প্রাপ্তি নয়।

বরং এক অন্তর্গত অতিচেতন অবস্থায় এই মহাপ্রকৃতির (universe) সাথে গভীর একাত্মবোধে (oneness) উন্নীত হওয়া। ‘ধারণ’ অবস্থা বা একাগ্রতার (concentration) সাথে ধ্যান বা মেডিটেশনের পার্থক্য হচ্ছে, মন বা সত্ত্বা যতক্ষণ পর্যন্ত বিক্ষেপ প্রবণ (awareness of distraction) থাকে ততক্ষণ প্রয়োজন হয় একাগ্রতার। আর তার পববর্তী ধাপে অস্থির জীবনযাত্রায় উত্তেজনাময় ব্যক্তিসত্ত্বার একান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে মেডিটেশন যে প্রশান্তিময় গভীর উপলব্ধির বাড়তি মাত্রা এনে দেয়, তা সত্যি এক অভূতপূর্ব অর্জন ! ৮.০ সমাধি (Samadhi): সমাধি হচ্ছে পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য পরম সুখাবস্থা (absolute bliss)। এটা একটা অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির (superconsciousness) চূড়ান্ত ভাবগত অবস্থা (pure contemplation), যেখানে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উপলব্ধি আর এই মহাবিশ্বপ্রকৃতি মিলেমিশে এক হয়ে যায়। যোগশাস্ত্র মতে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এক তূরীয় আনন্দময় মিলনই সমাধি অবস্থা।

এর লক্ষ্য হলো এই মহাবিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটা অণুপরমাণুর চেতনাগত অবস্থার সাথে জীবাত্মার নিজেকে আধ্যাত্মিক বিলীন করে দেয়া। যোগ সাধনার মৌলিক দর্শনই হচ্ছে কঠিন সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির মিলেমিশে একাকার হয়ে পরমানন্দময় অবস্থায় উন্নীত হওয়ার মোক্ষলাভ। পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গযোগের লক্ষ্যও তাই। সাধনার চূড়ান্ত অবস্থায় এই অষ্টাঙ্গের সবগুলো অঙ্গই একইসাথে ক্রিয়াশীল থাকে। তবে অনুশীলনকালীন চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিটা পর্যায় ধাপে ধাপে সফলভাবে সাধনলাভের মধ্য দিয়ে এগুতে হয়।

এই আটটি ধাপের প্রথম পাঁচটি অর্থাৎ ওঁম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম এবং প্রত্যাহার হচ্ছে যোগশাস্ত্রের প্রাথমিক ধাপ যা সফলভাবে অর্জিত হলেই কেবল আধ্যাত্ম চেতনার ভিত্তি স্থাপিত হয় বলে ধরে নেয়া হয়। এই প্রাথমিক ধাপের সাফল্যে দেহের সাথে চেতনার এক আত্মিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথম পাঁচটি ধাপ যথাযথ ও পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না এলে পরবর্তী ধাপে উত্তরণ কখনোই সম্ভব নয়। কেননা পরবর্তী ধাপেই রয়েছে একজন যোগীর জন্য আধ্যাত্মিক একাত্মতা উপলব্ধির, যাকে বলে, আলোকপ্রাপ্তিযোগ। এই আলোকপ্রাপ্তি হচ্ছে এক ঐশ্বরিক আলোর চিরায়ত দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠার এমনই এক কলকুণ্ডলিনী অবস্থা, অতি নগন্য কোন বিচ্যুতিও পরবর্তী পর্যায়গুলোর জন্য সাধ্যের অতীত অসাধ্যের অসাধ্য হয়ে থাকে।

সাধারণ ব্যক্তিমানুষের জন্য সাধনার চূড়ান্ত অর্জন আদৌ কি সম্ভব ? হয়তো তা এক কাল্পনিক অবস্থা। কিন্তু এই ধারাবাহিক চর্চা সেই অসাধ্য সাধন করতে না পারলেও সাধারণকে অসাধারণ করে তোলার অকল্পনীয় ক্ষমতা যে মানুষের মনোদৈহিক আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে লুক্কায়িত রয়ে গেছে, তা আজ আর কেউ অস্বীকার করেন না। অনুশীলনের মাধ্যমে ফললাভের ব্যবহারিক গুরুত্ব বিবেচনায় একটা সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের আধ্যাত্মিক দর্শন কীভাবে প্রায়োগিক দর্শন হিসেবে মানববিশ্বের সর্বস্তরে ছড়িয়ে যেতে পারে, তারই নিদর্শন এই ইয়োগা।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.