আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে.....

ভালবাসা মানে অন্যের ভালত্বে বাস করা

আজ সুমনা একলা বাসায় মা বাড়ি নেই,নিউমার্কেট গেছেন । সুমনার ও আজ অফিস নেই.এ ঘর ও ঘর নিজের ঘরে এসে হাত এ নিল একটি কবিতার বই.ছাপার অক্ষর গুলো পড়া হচ্ছেনা অনেক দিন আগের কিছু ছবি ভেসে উঠছে মানস পটে । সুমনা সবে চাকরি তে ঢুকেছে ঠিক সময় মত যেতে চেষ্টা করত অফিস কাছেই দুপুরে ফিরে খেয়ে আবার যায়..সে আর মা দুজনের ছোট্ট সংসার বেশ আছে ওরা । সেদিন ও অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মা কে না পেয়ে নিজে খেয়ে নিল মা কাছেই এক জায়গায় গেছে। অফিস যেতে একটুও ইচ্ছে করছেনা জানিয়ে দিল আজ শরীর খারাপ.।

তার নিজের ঘর জুড়ে বিরাট আলমিরা শুধু বই আর বই । একটা বই খুঁজে হাতে নিয়ে রকিং চেয়ারে বসলো মৃদু দোল খাচ্ছে আর পাতা উল্টাচ্ছে কিছু গোলাপ পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ল কোলের উপর আর ওই লাইন টা ... "হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে" সুমনার চোখে ভেসে উঠলো একটি মুখ অরুন, যাকে খুব খুবই ভালবাসত সে এই আলমারি জুড়ে প্রায় সব অরুনের দেয়া কত যে কবিতার বই..গপ্লের বই নতুন কিছু বের হলেই নিয়ে আসত ও। . অরুন একজন ইঞ্জিনিয়ার ওদের পাশের বিল্ডিং এর যখন কাজ চলছিল ও থাকত দুটো রুম ও আর ওর বন্ধু । অফিস যাওয়ার আসার পথে দেখা হত, কথা হত না তেমন । এমনি একদিন কি কাজ এ যেন তাদের বিল্ডিং এ এলো অরুণ, সুমনা ওদের গার্ড এর সাথে কথা বলছিল ।

ও তাকে একটা সিডি দিয়েছিল সামনের দোকানে রেকর্ড করতে দিতে ওটা আনতে । ওর প্রিয় কিছু গান সুমনা খেয়াল করেনি অরুণ ওর সব কথাই শুনছিল । গার্ড এর সাথে কথা বলেই বাসায় ঢুকলো সুমনা। তার কিছু দিন পড়.সবে ফিরেছে সে । তখন সন্ধ্যে গুন গুন করতে করতে সিড়ি ভাঙ্গছিল সুমনা ।

থমকে দাঁড়াতে হলো সামনেই অরুণ হাত এ একটা সিডি সুমনা কে বলল ,নিন । সুমনা অবাক চোখে তাকালো হাত টি বাড়িয়ে দিল অরুণ বলল, আমার ও কিছু প্রিয় গান আছে শুনবেন । কি বলবে সুমনা যাকে চেনেনা কি করে নেয় তবুও নিল । ছোট্ট একটি ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরল । যে মনের আঙ্গিনায় ছিলনা , যা কে সে কল্পনাও করেনি তার এই অযাচিত উপহারে অবাক সে।

আর মনে মনে গাল দিচ্ছে গার্ডকে। রাত এ খেয়ে নিয়ে শুনবে ঘরে রেখে এলো । এর পড় অনেক টা সময় চলে গেল.মার সাথে গল্প করে। ঘুমাতে গেল সুমনা মনে পড়ল গান গুলো শোনা হয়নি তো । একাকী ঘরে সে সিডি টা সিডি প্লেয়ারে দিয়ে জানালার ধরে বসলো তার খুব খুব প্রিয় গান সব গুলো।

প্রথম গান টা এত ভাল লাগল তার। অনেক কথা যাও যে ব'লে কোনো কথা না বলি। তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি॥ যে আছে মম গভীর প্রাণে ভেদিবে তারে হাসির বাণে, চকিতে চাহ মুখের পানে তুমি যে কুতূহলী। তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি। আমার চোখে যে চাওয়াখানি ধোওয়া সে আঁখিলোরে-- তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।

তোমার মনে কুয়াশা আছে, আপনি ঢাকা আপন-কাছে-- নিজের অগোচরেই পাছে আমারে যাও ছলি তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি॥ এমনি করেই দিন চলতে লাগলো আরো পরিচিত হলো ওরা, তার পড় প্রেম যে কখন হলো টের পায়নি ওরা দুজন । প্রায় অরুণ ওদের বাড়ি আসত ওর ,বাড়ি ফেরার পথে। ওরা ছাদে বসে গল্প করত.। মা নেই কাছে তাই সুমনার মা ও আদর করত অরুণ কে উনিও মেনে নিয়েছেন ছেলেটিকে এমনি করে হাসি আনন্দে কাটতে লাগলো সুমনার দিন। .ওরা বাড়ির সামনে বাগানে দুষ্টমি করত হাসতে হাসতে ছুটতো ঘাস ফড়িং ধরার জন্য।

একটা গান সুমনা বার বার শুনত, আজও শুনে সে যখনি একা লাগে তার । "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাইনি " অরুণ খুব বই পড়ত সেই সুবাদে সুমনা কেও দিত। সুমনাও অরুনকে অনেক কিছু উপহার দিত মা কিছুই বলত না শুধু সুমনাকে দেখে রাখতেন বাপ মরা মেয়ে কখন কি করে বসে। এভাবেই ওদের দিন যেতে থাকলো হাসি আনন্দে আর ভালবাসায় আর বন্ধুত্বে । এর মাঝেই একদিন অরুণ মায়ের আড়ালে সুমনা কে আংটি পরিয়ে দিল বলল এ আমার ভালবাসার উপহার।

যা এখন আছে সুমনার কাছে মাঝে মাঝেই দেখে ও। সেদিন সুমনা আনমনা হয়ে গান শুনছিল দখিনা হওয়ার মাতাল অনুভবে তার শিরায় শিরায় বাজছিল গানটি" ভালবাসি ভালবাসি.".. নিস্তব্দ দুপুর দরজায় বেল সেদিন ছুটির দিন,মা ঘুমাচ্ছে কাজের মেয়েটিও। দরজা খুলে সুমনা অবাক,অরুণ!! অসময়ে !! ওকে নিয়ে বসলো নিজের ঘরে এর মাঝে মা উঠে পড়লেন চা দিলেন। অনেক কথার পড় অরুন জানালো সে যাবে বাড়িতে তার বাড়ি গোপালগঞ্জ সুমনা অত চেনেনা কিন্তূ ওর মন খারাপ হয়ে গেল.। কতদিন দেখা হবে না ওদের।

কদিন পরেই অরুণ চলে গেল বিদায় ক্ষণে বলে গেল খুব শিগগির ও আসবে নিয়ম মাফিক,মা বাবা কে নিয়ে । এর পড় দিন যায় অরুণ এর চিঠি আসে, লেখে আসছি আর কদিন পরেই একেকটা চিঠি একেকটা ফোন যেন সুমনার প্রাণ এ বসন্তের দোলা জাগায় । আসন্ন সুখের কল্পনায় দিন যায় তার একেক টা দিন একেক টা বছর । এক দিন অরুন জানায় ও আসছে। সেদিনেই সকালের সুমনা খুব হাসি খুশি আজ খুব আনন্দ্দ লাগছে মন হচ্ছে কখন আসবে ও।

এই সময় পেপার ওয়ালা পেপারটা দিয়ে গেল.. একটি খবর রে সুমনা স্তব্দ হয়ে যায় একটি লন্চ ডুবি !!!গোপাল গঞ্জের কাছেই সুমনার মা আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন পেপারে খবরটা একটি নাম দেখে চমকে উঠেন মৃতদের লিস্ট এ । একি সত্যি অরুণ !!!!!!!!!!! সেই অরুণ যে হাসি মুখে বিদায় নিয়েছে সে আর নেই !!! আরো নিশ্চিত হলেন ওর অফিস এ খবর নিয়ে। তারপর অনেক দিন চলে গেল কিন্তূ মুছে যায়নি অরুণ সুমনার মন থেকে. আজ বহুদিন পড় কবিতার লাইনটা মনে করিয়ে দিল সেই দিনের কথা !!!!.... সুমনা কে তাঁর আর বলতে হয়নি নাস্তার টেবলে পেপার পড়েই রইলো সেদিনের পড় থেকে আজ পর্যন্ত সুমনা একটি বারের জন্য কাঁদেনি, কোনো আক্ষেপ করেনি। কেবল নির্বাক হয়ে গিয়েছিল কিছু দিনের জন্য। তার পর আবার সব আগের মতন কিন্তূ সুমনা আজও পারেনি অরুণ কে ভুলতে।

আজ ও সুমনা নিজের ঘরে বসে দেখতে পায় এই তো সেদিন সে আর অরুণ,হাসছে গল্প করছে,অরুণ কবিতা পরছে খুব সুন্দর পড়ত ও। আজ দখিনা হাওয়া নিশ্চুপ খেলে যায়,উড়িয়ে দিয়ে যায় তার চুল,এলোমেলো করে তাকে উদাস করে মনটাকে .তার কেবলি মনে হয়, ঘরের সব কিছু সবেই আছে আগের মতন শুধু নেই সে,যে আসার কথা ছিল । আজও সুমনা খুঁজে বেড়ায় অরুণ কে মন এ মনে তার মনের গোপন কুঠুরিতে সংগোপনে আছে তার ভালবাসা যা সে সকলের অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে যেমনি আমরা অতি যত্নে বেনারসির ভাঁজে গন্ধ খুঁজে বেড়াই , ভালবাসা, তার লুকিয়ে আছে ঝিনুকে মুক্তর মতন। আজ সুমনা অনেক বড়, সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে আজ সে পরিনত একজন নারী। তার সব আছে নেই শুধু ভালবাসা আজ অনেক বন্ধু আছে সকলের সাথে কথা বলে, হাসে।

একেক সময় মনে হয় এই বুঝি অরুণ এলো ঠিক আগের মতন কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে । যদি এমন হয় কি বলবে সুমনা যদি শোনে আবৃত্তি করছে অরুণ সেই কবিতাটা , অনেক বছর পরে তোর কাছে এসেছি, মল্লিকা! বহুদিন আপিসের কাজে-কন্মে ডুবুরির মতো বহুদি মেশিনের যন্ত্রপাতি হয়ে বহুদিন বাবুদের গাড়ির টায়ার হয়ে সুদুরে ছিলাম। তোর পাশে চাঁপা ছিল, টগর, ঝুমকো-জবা ছিল। তারা কই ? মারা গেছে ? সে কি ? কবে ? সাতাত্তর সালে ? এত মৃত্যু ঘটে গেল একাত্তর বাহাত্তর তিয়ত্তর সালে এত হত্যা ঘটে গেল চুয়াত্তর পঁচাত্তর ছিয়াত্তর সালে। আজ আর ধ্বংস, হত্যা, মৃত্যু কারো হৃদয়ের ভুমিকম্প নয়।

মল্লিকা ! দুঃখের কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা বল। মল্লিকা ! নিজের স্বপ্ন-শরীরের গল্প-টল্প বল। চাঁদের আলোর নিচে আমাদের আশাতীত খেলাঘর ছিল সেই বাল্যকাল, সেই হরিণশিশুর কথা বল। অরুণ চলে গেছে অনেক দূর যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনা কিন্তূ সুমনার দিন তার নিজের মতই চলতে থাকে । কেবল ভোলে না, কিছু কথা কিছু স্মৃতি।

আজ সে তেমনই আছে যেমন রেখে গেছে অরুণ। এটি কাল্পনিক কিছু নয় । একটি জীবন এর গল্প।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।