আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। বাকি সবাই তাদের সেবক। জনগণকেই মাথায় তুলে রাখতে হবে



সাহিত্যিক, লেখক এবং কলামিস্ট অধ্যাপক আনিসুল হকের একটি লেখা এখানে না দিলে হয়তো অন্যায় হবে, তাই ভেবে কপি পেষ্ট করলাম, লেখাটি প্রথম-আলো পত্রিকা থেকে নেয়া........... সোনিয়া গান্ধী নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের একজন? তিনি নাকি ভারতের কিংমেকার, ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সভাপতি! রাহুল গান্ধী নাকি কংগ্রেস দলের সাধারণ সম্পাদক? তাঁর বাবা নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, পিতামহীও ছিলেন, এমনকি তাঁর দাদির বাবাও ছিলেন! তিনি নাকি যুব কংগ্রেস আর ছাত্র শাখারও প্রধান! কিসের প্রধান? কিসের ক্ষমতা? এতই যদি ক্ষমতা থাকে রাহুলের, রাহুলের মায়ের, তাহলে তাঁরা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের একটা ভিআইপি টিকিট জোগাড় করতে পারলেন না? ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানি তো ঠিকই কাচঘেরা রুমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে খেলা দেখলেন, করমর্দন করলেন, কূটনীতি সারলেন। মায় আমাদের উৎপল শুভ্রও তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, মুম্বাইয়ের মিডিয়া বক্সে শীতের প্রচণ্ডতায় তাঁর হাত-পা জমে যাচ্ছে, আর এই মুম্বাইয়া গরমে, যেখানে খেলোয়াড়দের মাথা তো মাথা, হেলমেট থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে, সেখানে কিনা রাহুল গান্ধী সাধারণ খোলা গ্যালারিতে সাধারণ মানুষের কাতারে বসে গরমের মধ্যে ঘামছেন? মোহালিতে মায়ে-পুতে আবার পাশাপাশি বসেছিলেন। আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, সোনিয়া গান্ধী-রাহুলের পেছনের সারিতে সম্ভবত নিরাপত্তারক্ষীরা বসা, কিন্তু তার পরের সারিতেই শিশু-কিশোরেরা সোনিয়া গান্ধীর পেছন বরাবর দাঁড়াচ্ছে, আর সামনের দিক থেকে মোবাইল ক্যামেরায় অন্য দর্শকেরা তাঁদের ছবি তুলে দিচ্ছে! এসবের কোনো মানে হয়? নিরাপত্তার কথাটা সোনিয়া-রাহুল ভুলে থাকতে পারলেন? রাহুলের কি একবারও মনে এল না যে তাঁর বাবা কীভাবে মারা গেছেন? তাঁর দাদি কীভাবে মারা গেছেন? মনে ছিল না যে ভারত-পাকিস্তান খেলায় নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় আর মুম্বাইয়ে মাত্র কিছুদিন আগেই কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছিল পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে আসা কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী? আচ্ছা, নিরাপত্তা তো নিরাপত্তা, কিন্তু মানসম্মানের একটা ব্যাপার আছে না? এত বড় ক্ষমতাধরেরা কেন ভিআইপি গ্যালারিতে না বসে সাধারণ গ্যালারিতে বসবেন? আমরা বাংলাদেশে মিরপুরে বা চট্টগ্রামেই তো দেখেছি, গ্যালারির নানা রকমের ইতরবিশেষ আছে। দক্ষিণমুখী গ্যালারিতে দর্শকদের মুখে রোদ পড়ে, সেটার দাম সবচেয়ে কম। উত্তরমুখী গ্যালারিতে তার চেয়ে দামটা একটু বেশি।

তারপর আছে গ্রান্ডস্টান্ড, ক্লাব হাউস। কিন্তু এসবই তো আসল নয়। আছে করপোরেট হসপিটালিটি বক্স, যেটা কিনা বিজ্ঞাপনদাতা বড় বড় কোম্পানির অতিথিদের জন্য, যেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র থাকে, যত খুশি খাও খাবার আর শীতল পানীয় থাকে। এর বাইরেও আছে ভিভিআইপিদের জন্য হসপিটালিটি বক্স, প্রেসিডেন্টস হসপিটালিটি বক্স। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভিতরে রাস-উৎসব, অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ-পরা ফর্সা রমণীরা কত রকম আমোদে হেসেছে, আমার দিকে তারা কেউ ফিরেও চায়নি।

’ মিথ্যা কথা বলব না, এবার বিশ্বকাপে সাধারণ গ্যালারিতে খেলা দেখেছি, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করে গলা ফাটিয়েছি, কিন্তু একদিন বড় শখ হলো, হসপিটালিটি বক্সের ভেতরটা কেমন, দেখে আসি। স্পনসরের কাছ থেকে টিকিট জোগাড় করে ঢুকেও পড়েছিলাম ওই সব বক্সের একটায়। পাঁচ মিনিটেই দম বন্ধ হয়ে এল। সহদর্শকেরা অতিভদ্র, অতি অভিজাত, তাঁরা তালি দেন দুই হাতের ছয় আঙুলে মেপে মেপে, চিৎকার করেন না, লাফানোর তো প্রশ্নই আসে না। একজন ভদ্রলোক একজন যুবককে প্রশ্ন করছেন, ব্যাট করছে কে? ওই প্রান্তে ব্যাট করছে কে? বল করছে কে? ওই প্রান্তে বল করছে কে? একই সঙ্গে দুই ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে যে দুজন বল করেন না, এটা তাঁকে বোঝানোর আগেই আমি বেরিয়ে আবার খোলা গ্যালারিতে চলে এলাম।

গ্যালারির জনসমুদ্রের অংশে পরিণত হয়ে গেলাম। গ্যালারি, সে তো খেলারই অংশ। ঠিক এ কথাটাই বলছিলেন টেলিভিশনের বিশ্বখ্যাত ধারাভাষ্যকারেরা যে ভিআইপি বক্সে কাচের আড়ালে জনসমুদ্রের গর্জনটা শোনা যায় না, খেলার উষ্ণতাটা অনুভব করা যায় না, তাই সোনিয়া আর রাহুল সাধারণের কাতারে এসে বসেছেন, খোলা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন। তাঁরা খেলা দেখতে এসেছেন, ক্ষমতা দেখাতে আসেননি, তাঁরা তাঁদের দেশকে সমর্থন দিতে এসেছেন, নিজের দলকে এগিয়ে নিতে আসেননি। হতে পারে, এটা তাঁদের একটা ছোট্ট রাজনৈতিক চালই।

তাঁরা সাধারণ গ্যালারিতে জনতার সঙ্গে মিশে একটা রাজনৈতিক মাইলেজ অর্জন করলেন। মানুষকে দেখালেন, দেখো, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক। মানুষের কাছাকাছি হলেন। মানুষের ভালোবাসা একটুখানি বেশি পেলেন। তাও যদি হয়, সেটাই বা কম কী! মানুষের কাছে আসার চালটুকুও চালতে তো আমরা এই দেশে তেমন দেখি না।

আরেকটা জিনিসও তাঁরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তা হলো প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারের অংশ, তাঁরা প্রটোকল পাবেন, কিন্তু কংগ্রেসের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক তো সরকারের কেউ নন, তাঁরা তো প্রটোকল পাবেন না, কাজেই তাঁদের ভিআইপি গ্যালারিতে নয়, আমরা দেখলাম, সাধারণের গ্যালারিতে, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানি যথাযথ প্রটোকল ও নিরাপত্তা চাদরের আড়ালে বসে ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তো লোকসভার নির্বাচিত সদস্য। তাহলে? আর আমরা? সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ এখানে বেশি! মন্ত্রী-এমপিদের দাপট তবু সয়, মন্ত্রী-এমপিদের ছেলে, ভাগনে, ভাস্তেদের দাপটে জীবন আমাদের ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। কেউ বা মোবাইল ফোন কিনতে গিয়ে দাম না দিয়ে চলে যাওয়ার অধিকার কায়েম করতে গিয়ে রিভলবার বের করে গুলি চালিয়েছে, কেউবা রাজউকের জমি বেদখল করে মার্কেট বানানোর চেষ্টা করে খদ্দেরদের পথে বসিয়েছে। আর ভাইয়াদের কথা কী বলব? তাঁরা যেখানে যাবেন, সেখানে পথে পথে হাজারটা তোরণ, যুবরাজের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।

প্রটোকল তো প্রটোকল, প্রটোকলের বাপ তাঁরা পেয়েছেন। ডিসি-এসপি সবার ঘুম হারাম, পান থেকে যদি চুন খসে যায়...কী সব দিনই না আমরা পার করেছি! না, এমন নয় যে রাহুল গান্ধী বা সোনিয়া গান্ধীকে নিয়ে ভারতে কোনো বিতর্ক নেই। সুইস ব্যাংকে গান্ধী পরিবারের নামে টাকা রাখা না-রাখা নিয়ে বিতর্ক আছে। বোস্টন এয়ারপোর্টে রাহুল গান্ধীকে ১০ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল কেন, এই প্রশ্ন উঠেছিল ভারতে! সম্প্র্রতি উইকিলিকসের ফাঁস করে দেওয়া তথ্য থেকে প্রশ্ন উঠেছে, মনমোহন সরকার পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের বৈতরণী পার হতে সদস্যদের কিনে নিয়েছেন কি না! এসব তথ্য আমাদের রাজনীতিবিদদের নিশ্চয়ই উৎসাহিত করবে। কিন্তু তাই বলে এই রকম ক্ষমতাওয়ালা ভারতীয় নেতারা ক্রিকেট খেলা দেখবেন সাধারণ গ্যালারিতে, সেটা ঠিক আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

বরং ভারতীয় রাজনীতিবিদেরাই শিক্ষা নিতে পারেন আমাদের নেতাদের কাছ থেকে। কেন বিরোধী নেতার নামে মাত্র একটা আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হলো, তিনি কি একা যাবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে, আর পাঠানোই যখন হলো, কেন উপযুক্ত সম্মান দিয়ে তাঁকে দাওয়াত করা হলো না, কাজেই তিনি যাবেন না। তিনি দেশের বাইরে যাবেন, অবশ্যই ভিআইপি টার্মিনাল তাঁর জন্য খুলে দেওয়া হবে, কিন্তু তিনি তো একা ভিআইপি টার্মিনালে ঢুকবেন না, তাঁর সঙ্গে লটবহর যত আছে, সবাইকে ঢুকতে দিতে হবে, একটুখানি বাধা এল তো ভাঙো কাচের দরজা-জানালা! গণতন্ত্র মানে না জনতার তন্ত্র। এখানে না প্রতিটা মানুষের মূল্য সমান? এখানে না প্রতিটা মানুষের একটা করে ভোট? সে নারী হোক পুরুষ হোক, সে রাজার ছেলে হোক আর ঘুঁটে কুড়োনির ছেলে হোক। তাহলে আপনি কেন ভিআইপি আর আমি কেন পারসন অব নো ইম্পর্টেন্স! এই দেশে ভিআইপির সংখ্যা এত বেশি! তার ঠেলা কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে বিসিবি।

কত টিকিট যে ভিআইপিদের জন্য রেখে দিতে হয়েছিল। ‘নট সো ইম্পর্টেন্ট’ অথবা ‘নট ইম্পর্টেন্ট এট অল’ দর্শকেরা ব্যাংকের কাউন্টারে দিনের পর দিন, রাতের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও যে অনেকে টিকিট পাননি, তার কারণ বহু টিকিট ভিআইপিদের জন্য রেখে দিতে হয়েছিল। একটা মজার অভিজ্ঞতা বলি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষে খেলোয়াড়দের নিয়ে বাসগুলো বের হবে ভিআইপি গ্যালারির কাছ থেকে। কিছুতেই বের হতে পারছে না।

কারণ, রাস্তা ভরা ভিআইপি। ভিআইপিরা নিজেরা বেরিয়ে ওই রাস্তাটাকে অচল করে রেখেছেন। তারপর তাঁদের গাড়িগুলো বের হতে শুরু করল। দেশ-বিদেশের খেলোয়াড়দের বহনকারী বাস আর তাঁদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত বাহিনী অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এত ভিআইপি এই দেশে! জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।

বাকি সবাই তাদের সেবক। জনগণকেই মাথায় তুলে রাখতে হবে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষকে মাথায় তুলে রাখা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। তাই আমরা একটা বুদ্ধি বের করেছি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আমরা মাথায় করে রাখব।

তাঁদেরকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে আমরা আসলে এই দেশের ১৬ কোটি মানুষকেই সম্মানিত করে থাকি। তাঁদেরকে আমরা সবকিছুতে অগ্রাধিকার দিই। তাঁদের জন্য বাসে-ট্রেনে-বিমানে টিকিট রেখে দিই, যাতে তাঁরা চাইলে বিফলমনোরথ না হন। তাঁদের জন্য আমরা এলাকার স্কুল-কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদটা রেখে দিই, যাতে সব কিছুতেই গণতন্ত্রায়ণ ঘটে। আমরা এমনকি কাকে টেন্ডার দেওয়া হবে না-হবে, কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে না-হবে, সে বিষয়েও তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দিই, কারণ তাঁদের মত তো জনগণেরই মত।

সোনিয়াজি, আপনি এই সহজ সূত্রটা বুঝলেন না! রাহুল গান্ধী, আপনিও যুবরাজের মতোন আচরণ করলেন না! এই রকম বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আপনারা গণতন্ত্রের পথে আমাদের চলার পথকে বন্ধুর করে তুলবেন না। দয়া করে সঠিক পথে চলুন। নিজের দাম বুঝুন। ভিআইপি আসনে বসুন, ভিআইপি রুমে থাকুন, ভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে চলুন, ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখুন। ভিআইপি রেস্তোরাঁয় বসে ভিআইপি খাবার খান।

(রাহুল নাকি মুম্বাইয়ে খেলা শুরুর সোয়া ঘণ্টা আগে বিমানবন্দর থেকে স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে বন্ধুদের নিয়ে নিউইয়র্কার নামের রেস্তোরাঁয় ঢুকে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন, দুই হাজার ২৩৩ রুপি বিল আট বন্ধু ভাগ করে দিয়েছেন! যাহ, রাহুল, এই অঙ্কের বিল এলে আমি পুরোটাই দিয়ে দিতাম!) আপনারা ১২১ কোটি মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করেন। নিজের দামটা নিজেরা বুঝবেন না? আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। সূত্র: প্রথম আলো

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.