আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আপনিও পারলেন ‘মোহিত ভাই’?

ক্লিন'স অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড

..................নিচের লেখাটি প্রায় দু'মাস পুরনো। ব্লগে এতদিন আসি নি বলে পোস্ট করা হয় নি। ''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''' আপনিও পারলেন ‘মোহিত ভাই’? উপরের প্রশ্নটা ড. ইউনুসের পক্ষ থেকে করা। গত দু’দিন ধরে দেশের ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত যে অসম্পূর্ণ বা অসত্য বক্তব্য দিয়ে চলছেন, সেগুলো পড়ে নিজের মনেই হয়তো এই প্রশ্নটি করেছেন ড. ইউনুস। হয়তো অগোচড়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে থাকবে তার চোখ থেকে।

অথবা নীরব কান্নায় হয়তো আরো বেশী বেদনার্ত করেছেন হৃদয়। এসবই আমার কল্পনা। জানি না, সত্যিই এরকম ঘটেছে কি-না ড. ইউনুসের ক্ষেত্রে। সত্যিই তিনি অশ্রুসিক্ত হয়েছেন কি-না তার এত কাছের মানুষগুলো তার ব্যাপারে এভাবে মিথ্যাচার করছে বলে। জানি না, তিনি কী করেছেন।

তবে গত শনিবার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত ২০১০ সালের ১৫ মার্চ অর্থমন্ত্রীর কাছে ড. ইউনুসের লেখা চিঠিটি পড়ে সত্যিই আমার চোখ সজল হয়েছে। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা মন্ত্রীত্বকে এতই উপভোগ করেন যে, এই পদের লোভের কাছে আর সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়- সম্পর্ক, আবেগ, ন্যায়নীতি, বিবেচনাবোধ- সবকিছু। নইলে এতদিনের সম্পর্ককে পদদলিত করে, এত ভালোবাসার সম্পর্ককে অপমানিত করে কীভাবে অর্থমন্ত্রী পারলেন ড. ইউনুসের সম্বন্ধে এভাবে বক্তব্য রাখতে। ১৫ মার্চ নিজ হাতে লেখা চিঠিতে ড. ইউনুস শুরু করেছিলেন এভাবে- “প্রিয় মোহিত ভাই, আপনার হাত দিয়েই গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়েছিল। এখন এই ব্যাংকের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশের সময় এসেছে।

আমাকে এর পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে আসতে হবে। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে এর দায়িত্বভার তুলে দিতে হবে। এটা মসৃণভাবে হতে হবে। এ কাজটা আপনাকেই করে দিতে হবে। আমি সৌভাগ্যবান যে এই দায়িত্বটা আপনার ওপর বর্তিয়েছে।

” এই চিঠিটির পরের অংশে ড. ইউনুস তার সরে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেছেন, কাদেরকে তার স্থলাভিষিক্ত করলে ভালো হয় সে সম্বন্ধে অভিমত দিয়েছেন। অথচ গত দু’দিন ধরে কী শোনালেন অর্থমন্ত্রী? এতো ভালাবাসা আর আস্থা যার ওপর, সেই ‘মোহিত ভাই’ মন্ত্রীত্ব রক্ষার মোহে এতটাই হিতাহিতবোধশূন্য যে, তিনি বলছেন- ড. ইউনুসকে তারা একটি সম্মানজনক প্রস্থানের পথ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ড. ইউনুস সেটা নিতে পারেন নি। অথচ গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে- ড. ইউনুস এর আগেও একাধিকবার তার পদ ছাড়তে চেয়েছেন, কিন্তু পরিচালনা পরিষদ প্রতিবারই তাকে অনুরোধ করেছে থেকে যাবার জন্য। আর নিজের হাতে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি যাতে হঠাৎ কোন অস্থিরতার মুখে না পড়ে সেজন্য ড. ইউনুসও চেয়েছেন ধীরে ধীরে একটি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে সরে আসতে।

সে পরিকল্পনায় সহযোগী হিসেবে জনাব মুহিতকে পেয়ে তিনি অনেকখানি নির্ভার ছিলেন। তার চিঠির ভাষায় সে ছাপ সুস্পষ্ট। আমরা যদি ড. ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণের ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও বুঝতে পারবো জনাব মুহিতের সাথে তার সখ্য আসলেই অন্য পর্যায়ের ছিলো। নরওয়ের টিভি চ্যানেলে প্রথমবার ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন আরো একধাপ এগিয়ে ড. ইউনুসকে ‘রক্তচোষা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন, তখন অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত অনেক সাবধানী এবং সংযত মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। গত দু’দিনও তিনি যে একেবারেই অসম্মানজনক কথা বলছেন ড. ইউনুসকে নিয়ে তা নয়- বরং তার কথায় সবসময় একটা দ্বৈত সুর ভেসে উঠেছে।

মনে হচ্ছে তিনি তাই বলছেন, যা তিনি বলতে চান না। একবার তিনি বলছেন- “ড. ইউনুস বাংলাদেশের গর্ব”, “তাকে এভাবে নাজেহাল করায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ে নি” (ড. ইউনুসকে নাজেহাল করলে ভাবমূর্তি বাড়বে এমন আশা তারা কীভাবে করলেন সে প্রশ্ন তোলা অবান্তর), আবার পরক্ষণেই তিনি বলছেন- যা ঘটলো তার জন্য তিনি নিজেই (ড. ইউনুস) দায়ী। ড. ইউনুস কী করেছেন, তার কারণে কত সংখ্যক মানুষ দরিদ্র হয়েছে (?), ভিটে-মাটি ছাড়া হয়েছে (?) তা সরকারের মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে। সরকার এজন্য ড. ইউনুসকে যত খুশি শাস্তি দিক। সে অধিকার সরকারের আছে, এবং সেটা তার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে।

কিন্তু সেসবের কোন লক্ষণ আমরা দেখলাম না। আমরা দেখলাম কেবল প্রতিহিংসা আর ব্যক্তিগত খেয়াল খুশির নগ্ন ব্যবহার। দেশের একটি বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সরকারী হস্তক্ষেপের এ যথেচ্ছ ব্যবহার সবার মাঝেই একটি ভীতি তৈরী করবে নিশ্চয়। আমরা এমনই অভাগা- আমাদের সকল অর্জন আমাদের উন্নতির সোপান না হয়ে অধোগতির রাজপথ তৈরী করে দেয়। যেমন দিলো ড. ইউনুসের নোবেল প্রাপ্তি।

এখন মনে হচ্ছে তিনি যদি নোবেল পুরষ্কার না পেতেন তবেই আমাদের জন্য ভালো হতো। অন্তত আমাদের জাতীয় ক্ষুদ্রতাবোধের এ খবরটি বহির্বিশ্বে এভাবে ফলাও প্রচার পেতো না। খুবই অসহায়ভাবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার এ প্রবণতা দেখে গেলো সকল বিবেকবান মানুষ। সরকারকে বোঝানো গেলো না তাদের গোড়ামীর কারণে কী অপূরণীয় ক্ষতির মুখে বাংলাদেশের ইমেজ। ড. ইউনুস নিয়ে সরকারের এ প্রহসন শুরু হয়েছে অনেক আগ থেকেই।

বাংলাদেশে ব্যাংকের অভাব নেই। সরকারী অনেক ব্যাংক সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হচ্ছে। কয়েকটি মৃত্যুপথযাত্রী। সরকার সেদিকে নজর না দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকে কেন নিজেদের করায়ত্বে নিতে চাচ্ছে তা অনুধাবন করা খুব একটা কঠিন নয়। ইতোপূর্বেও আমরা বেশ কয়েকটি এনজিওকে সরকারের বশংবদ লোকের মাধ্যমে করায়ত্ত্ব করার অপচেষ্টা দেখেছি।

ড. ইউনুস থাকলে সে চেষ্টাটা হয়তো করা যাচ্ছে না। এটা একটা কারণ। তবে ড. ইউনুসের প্রতি ব্যক্তিবিদ্বেষকেই অবশ্য সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন অভিজ্ঞমহল। বিশেষ করে তার রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশী সমালোচনামুখর ছিলেন। সরকারের নানা কর্মকান্ড ও বক্তব্যে ড. ইউনুসও হয়তো অনুমান করে থাকবেন গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়তে হবে তাকে।

সে জন্যই হয়তো অর্থমন্ত্রীকে চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি, ২০১০ সালের ১৫ মার্চ। এখন থেকে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ড. ইউনুসের সে চিঠির ব্যাপারে কোন রকম উদ্যোগ দেখা যায় নি সরকারের পক্ষ থেকে। ড. ইউনুসের পছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে সরকার মোজম্মেল হককে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। অনেকেই প্রশ্ন করবেন- সরকার তো ড. ইউনুসের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য নন।

এ প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়েও বলা যায়- যে প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে নিজের জীবন ও স্বপ্নকে লালন করছেন ড. ইউনুস সেখানে তার পছন্দকে গুরুত্ব দিলে সরকারের এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। বরং প্রতিষ্ঠানটি ও ড. ইউনুসের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ পেত। সে সৌজন্যটুকু দেখানোর মতো উদরতা সরকারের মধ্যে ছিলো না। বরং নানাভাবে তাকে হেনস্তা করার কোন পন্থাই তারা বাকি রাখে নি। একের পর এক মামলা করে তাকে নাজেহাল করেছে।

ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদকে যখন এদেশে এনে প্রধানমন্ত্রী একুশের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করিয়েছেন, তখন আমাদের নিজেদের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদকে আদালতে জামিন নিতে অস্থির থাকতে হয়েছে। সরকারের এ বৈরিতার মাঝেও জনাব মুহিতের মাঝে হয়তো একটা আস্থার সম্ভাবনা খুঁজেছিলেন ড. ইউনুস। হয়তো ভেবেছিলেন এতদিনের ‘প্রিয় মোহিত ভাই’ তার অবস্থান ও প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে একটা সম্মানজনক সমাধান বের করবেন। কিন্তু সে আশা বাস্তবায়ন হলো না ড. ইউনুসের। রাজনীতির কাছে অন্য সকল ন্যায়নীতিই যে বিসর্জনীয়- সে চিরসত্যটাই অত্যন্ত বিকট হয়ে দেখা দিলো ড. ইউনুসের কাছে।

তার ‘প্রিয় মোহিত ভাই’ তার জন্য কোন সম্মানজনক পথ খুজে দিতে পারলেন না। রাজনীতি আর ক্ষমতার মোহের কাছে বুঝি সবই অর্থহীন হয়ে গেলো। সরকার একেবারে মরিয়া হয়ে ড. ইউনুসকে তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে উচ্ছেদ করলো। দেশের এবং দেশের বাইরের অনেক সমালোচনাও সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারলো না। বাংলাদেশকে যাদের সমর্থনে বিশ্বে চলতে ফিরতে হয় তারা একজোট হয়ে অর্থমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাদের উদ্বেগের কথা জানালেন আনুষ্ঠানিকভাবে।

তাদের এই জোটবদ্ধ উদ্যোগই প্রমাণ করে এর আগেও তারা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করেও নিশ্চয়ই তাদের ভাবনাটা সরকারের কাছে পৌছে দিয়েছেন। এরফলে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হতে পারে, আন্তর্জাাতিক মহলে কী ধরনের মূল্য দিতে হতে পারে তাও নিশ্চয়ই হুমকি হোক বা অনুরোধ হোক- দু ভাষাতেই অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু সরকার অত্যন্ত অবিচলভাবে ড. ইউনুসকে অপদস্ত করতে বদ্ধপরিকর। তাকে সম্মানজনকভাবে সরে দাড়াবার সুযোগটি তারা দিলেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে নিশানা ভেদ করলেন ড. ইউনুসকে আর সারা বাংলাদেশকে।

আদালতে গিয়েছেন ড. ইউনুস। বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের আদালতের অবস্থা বিবেচনা করে বুঝা যায় রায় কী ধরনের রায় আসবে। খুব অস্বাভাবিক কিছু না হলে ড. ইউনুস তার প্রিয় গ্রামীণ ব্যাংকে আর কখনোই ফিরবেন না হয়তো। এত যত্ন করে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি হয়তো সরকারী লুটপাটের শিকার হবে। সেসব নিয়ে খুব একটা আক্ষেপ করি না।

কেবল বারবার মনে হচ্ছে, যার কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে নতুন একটি পরিচয় পেয়েছে, একটি উঁচু আসনে অভিষিক্ত হয়ে দেশের এবং দেশের বাইরের বাংলাদেশীদের গর্বিত হবার সুযোগ করে দিয়েছে তাকে এভাবে নাজেহাল করার অধিকার সরকারের নেই। সরকারের এ পদক্ষেপের কারণে স্বাধীনতার পর আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতদিন যে মানুষগুলো আমাদের দেখে সমীহ করতো তারাই এখন বাকা চোখে তাকাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী একজন অর্থনীতিবিদকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করে নিজেদের শেষ ভরসার জায়গাটুকুকে আমরা বিনষ্ট করেছি। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নাগরিকদের এ অপূরণীয় ক্ষতি সাধনের জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করার অধিকার আমাদের রয়েছে নিশ্চয়ই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।