আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নৈশব্দ অথবা স্মৃতির অন্তরালে... ( পর্ব- ৫)



আকাশে ঘন কালো মেঘ। প্রচন্ড বাতাস বইছে । দূরে কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে । বাতাসটা তাই প্রচন্ড ঠান্ডা । ঘন মেঘের ফাঁকে ফাঁকে বিকালের রোদের আলো লালচে হয়ে দেখা যাচ্ছে ।

আমি এক পা দুই পা করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু বাতাসের ঝাপটায় সামনের দিকে এগোতেই পারছি না, এদিকে চারপাশ আরো অন্ধকার হয়ে আসছে । আমি বারবার দিক ভূল করে অন্যদিকে চলে যাচ্ছি । ঠিক এই সময় জ্বলে উঠলো একট আলো, ভালো করে তাকিয়ে দেখি এটা তো সমুদ্রের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটহাউসটা থেকে আসছে । অন্ধকারের বুক চিরে তীব্র আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে এই চরাচরে; যেন পথ দেখাচ্ছে আমার মতো পথহারা মানুষকে, যারা এগোতে গিয়ে ছিটকে পড়ছে তাদের পথ থেকে । আমি লাইটহাউস এর আলো বরাবর এগিয়ে যাচ্ছি , ওইতো সামনেই সমুদ্র।

কালো জলরাশি অবিরাম ঢেউ এর আকারে আছড়ে পড়ছে তীরে, আমি বাতাসের বাধাঁ পেরিয়ে দৌড় দিলাম তীরের দিকে, হঠাৎ পায়ে কিসের যেন ধাক্কা লাগলো,আমি ছিটকে পড়ে গেলাম আর তারপর তলিয়ে যেতে লাগলাম গভীর থেকে আরও গভীরে । হঠাৎ এলার্মের শব্দ। আমি বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসলাম । ও...তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম...!!! স্বপ্নটা এতই বাস্তব মনে হচ্ছিল যে চোখ থেকে তার রেশ -ই কাটছিল না । আমি প্রায়ই এই লাইটহাউসটাকে স্বপ্নে দেখি।

কিন্তু কখনই সেখানে পৌছাতে পারিনা । আমি উঠে এলার্ম বন্ধ করলাম। তারপর রেডী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম মর্নিং ওয়াকের উদ্দেশ্যে। ডিসেম্বরের এই মাঝামাঝিতে শীতের তীব্রতা বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাইরে বের হয়ে আসতেই শীতের এক ঝলক বাতাস কান ছুঁয়ে গেল, আমি শীতের পোশাকটা আরও ভালমত জড়িয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।

দুপুরে বাজার, রান্নাবান্না সেরে tired লাগছিল বলে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলাম, হঠাৎ মনে পড়লো গত দুই সপ্তাহ ধরে নিলয় এর সাথে আমার দেখা হয়নি, ও আসেনি, আর আমিও ওকে ফোন করিনি। ওইদিন ওই ঘটনার পরে আমি ওকে বলেছিলাম, আমাকে ভাবার জন্য কিছুটা সময় দাও, ততদিন কেউ কারও সাথে দেখা করবো না বা কথাও বলবো না। আমার কথাগুলো শুনে ও মুখ নিচু করে চুপচাপ এখান থেকে চলে গিয়েছিল। তারপর নানা অফিশিয়াল কাজের ব্যস্ততায় আমি চিন্তা-ভাবনা করার সময়ই পাইনি। তাছাড়া আমি বেশ দ্বিধাদন্ধে ভুগছিলাম।

যে অতীতকে আমি চৌদ্দো বছর পেছনে ফেলে এসেছিলাম, তাকে আবার বর্তমানে অন্তর্ভূক্ত করে নতুন করে কোন কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে কিনা তা মনকে বোঝাতে পারছিলাম না। কাজের ব্যস্ততা মানুষের সময়কে সংক্ষিপ্ত করে ফেলে, এটা সত্য। কিন্তু মনের গহীনে থাকা শূন্যতাকে পূরণ করে দিতে পারে না । এই মূহুর্তে আমি সেই শূন্যতাকে অনুভব করলাম, তাই আর বেশীকিছু চিন্তা না করে চটপট রেডী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এ রাস্তায় আগে কখনও আসিনি।

তবুও রাস্তার ঠিকানাটা খেয়াল করে এগিয়ে গেলাম । কিছুদূর এগিয়ে বামে টার্ন নিয়ে একটা ছাইরঙ্গা তিনতলা এপার্টমেন্ট হাউসের সামনে এসে দাঁড়ালাম । নিলয় বলেছিল, ও এই বাসার দোতলায় থাকে। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে প্রথম ডানদিকের flat এর দরজায় কলিং বেল টিপলাম, কিন্তু দুইবার বাজানোর পরেও কেউ খুলতে এলো না। আমি ভাবলাম, ও বোধহয় বাসায় নেই।

একটু নিরাশ হয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি, আর ঠিক তখনই খুলে গেল দরজাটা। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি, নিলয় দাঁড়িয়ে। ওর দুই চোখে গভীর বিস্ময়। চোখদুটো ভীষণ লাল হয়ে আছে। আমি বললাম, তোমার কি হয়েছে? ও দরজা ছেড়ে রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো, আর বললো, ও কিছুনা, সামান্য জ্বর এসেছে ঠান্ডা লেগে গিয়ে।

আমি রুমের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে ওর বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম, তারপর কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলাম। বললাম, এই তোমার সামান্য জ্বর? জ্বরে তো গা একদম পুড়ে যাচ্ছে, কবে থেকে এই অবস্থা? ও ফিসফিস্ করে বললো, গত দুই দিন ধরে। আমি আর দেরী না করে একটুকরো কাপড় দিয়ে ওর শরীর স্পঞ্জ করে দিলাম। তারপর রান্নাঘর থেকে খুঁজে খুঁজে একটু সূ্প বানিয়ে এনে খাইয়ে দিলাম। নিলয় এর শরীর এত দূর্বল হয়ে ছিল যে ও উঠে বসতে পর্যন্ত পারছিলনা ।

আমি ওকে শোয়া অবস্থাতেই আমার ব্যাগে থাকা ওষুধও খাইয়ে দিলাম। এখন বাজে রাত আটটা। নিলয় গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছে। আমি ওর ঘরের দিকে চোখ দিলাম। ঘরটা সুন্দর ছিমছাম করে গোছানো।

ঘরের একদিকে টেবিলের উপর প্রচুর বই রাখা। ছোটবেলা থেকেই ওর খুবই গোছানো স্বভাব। আজও একইরকম আছে। তাইতো অচেনা রান্নাঘরে প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে নিতে আমার মোটেও সময় বেশী লাগেনি। আমি রাতে খাওয়ার জন্য চটপট দুইটা আইটেম বানিয়ে ফেললাম।

তারপর ফিরে বিছানার কাছে এসে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখি বিন্দু বিন্দু ঘাম। আর জ্বরটা বোধহয় কেবল ছেড়েছে। আমার হাতের স্পর্শে নিলয় চোখমেলে তাকালো, তারপর দূর্বলকন্ঠে বললো, এখন কয়টা বাজে? আমি বললাম, সাড়ে দশটা, এখন একটু কি ভালো লাগছে? উঠে বসতে পারবে? তাহলে রাতের খাবার দিয়ে দিতাম…। ও মাথা নেড়ে সাই জানালো। আমি খাবার নিয়ে আসলাম, ও বিছানায় আধা শোয়া হয়ে বসতেই আমি খাইয়ে দিতে লাগলাম।

খাওয়ানোর পরে ও আবার শুয়ে পড়লে আমি নিজেও খাবার নিয়ে একটু খেয়ে নিলাম। রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে ফিরে আসছি, তখন নিলয় বলে উঠলো, আজকে তুমি না এলে আমার যে কি হতো? জ্বরের কারণে উঠে গিয়ে রান্নাও করিনি, আর খাওয়াও হয়নি। আর জ্বর যে হারে বাড়ছিল, তাতে তুমি এসে ওষুধ না খাওয়ালে হয়তো মারাই যেতাম. . .!!! আমি কৃত্তিম রাগ দেখিয়ে বলে উঠলাম, তুমি চুপ করে থাকোতো, এইসব seasonal fever এ মানুষ মারা যায়না, বুঝলে? রাতে নিলয় ঘুমিয়ে পড়লে আমি ওর সামনের দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । আজকের রাতে হয়তো আর ঘুম হবেনা । কিন্তু কিভাবে সময়টা পার করা যায়, ভাবছি ।

আচ্ছা, ছোটবেলার কথা ভাবলে কেমন হয়? আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠি, তখন নিলয়রা আমাদের বাসার নিচতলায় ভাড়া নিয়ে থাকতে আসে, তখন থেকেই ওর সাথে আমার পরিচয় । বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাক- এইসব দিনগুলোতে আমরা সবাই মিলে নাটক এর আয়োজন করতাম। আর আমাদের দর্শক ছিল আশেপাশের বাসার বড়রা । এক ক্লাস উপরে পড়তো বলে বছর শেষে বই, নোটপত্র – সব পেতাম আমি । ওর বাসার ছোট্ট লাইব্রেরির আমি ছিলাম একমাত্র মনোযোগী আর নিয়মিত পাঠক ।

ওর বাবার কাছে আমরা একসাথে বসে ইংরেজী grammar পড়া দেখিয়ে নিতাম। ছোটবেলার এরকম অনেক স্মৃতির কথা চিন্তা করছি, এইসময় চিন্তার বাঁধা পড়লো শব্দে। আমি ঘরে ঢুকে দেখি, নিলয় উহ্ উহ্ শব্দ করছে ঘুমের ঘোরে। তারমানে ওর আবারও জ্বর এসেছে …!!! আমি ওর মাথায় ঠান্ডা পানি দেওয়া কাপড় দিয়ে পট্টি লাগিয়ে দিলাম। সেইসাথে আরও একটা ওষুধ খাইয়ে দিলাম ।

এভাবে জেগেই আমার সারারাত কেটে গেল । ভোরবলা হালকা কিছু নাস্তা বানিয়ে আমি নিলয়কে ডেকে তুলে বললাম, এখনতো আর জ্বর নেই দেখছি । তুমি ধীরে সুস্থে উঠে নাস্তাগুলো খেয়ে নিও, আমি এখান থেকে বাসায় গিয়ে রেডী হয়ে অফিস চলে যাবো । ও বললো, তুমি আর আসবে না ? আমি বাইরের দরজা লাগাতে লাগাতে বললাম, না এসে কি আর উপায় আছে ? তোমার সাথে গিয়ে Arlington এর বাসাটার booking দিতে হবে না, নাকি? ওর রোগাক্রান্ত মুখটায় এক ঝলক আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো, আর আমি সেই আলোর মিষ্টি রেশ মেখে পা বাড়ালাম আমার গন্তব্যের উদ্দ্যেশ্যে । চলবে....


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।