আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লালন রবীন্দ্রনাথ মুজিবনগর; রাজমিস্ত্রির খপ্পরে কুষ্টিয়ার তিন অনাথ আশ্রম

মাহবুব লীলেন

প্রায় দশ বছর পর কুষ্টিয়া গেলাম। শুকনা গড়াই নদী হেঁটে পার হয়ে নসিমনে চড়ে প্রথমেই শিলাইদহ ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়িতে কেন যেন যেতে যত ভাল্লাগে যাবার পরে আর তত ভাল্লাগে না। উঠানে ঢোকার পর তাও যতটুকু ভালোলাগার রেশ থাকে; বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই তা একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকে। বহুবারই তো গেলাম।

কিন্তু সেই একই অনুভূতি; অন্ধকার ঘরে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা ছবি আর ঘুণে ধরা ঠাকুরবাড়ির পুরোনো কিছু ফার্নিচার... বাড়িটাকে কি অন্যভাবে সাজানো যায় না? রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক বাড়ি বলেই কি আমরা শুধু পারিবারিক পুরোনো খাটপালঙ্ক চেয়ার আর সব জায়গায় সহজলভ্য কয়েকটা ছবি দেখব? ওখানে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে দেখানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায় না? প্রতিদিন ওখানে যাওয়া হাজার হাজার স্কুলশিশু আর দর্শকদের জন্য ওটাকে কি একটা রবীন্দ্রকেন্দ্র বানানো যায় না? কে জানে। আমি জানি না। জাদুঘরের নিয়ম নীতি আমার জানা নেই। তার চেয়ে বাউন্ডারির বাইরে পুকুরপাড়ের বকুলতলাটা আমার বরং বেশি ভাল্লাগে। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হবার জন্য গেটের দিকে আগালেই উঠানের ডান কোনায় সামনের আর ডানের দেয়ালের বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে একটা মঞ্চ আর একটা অফিসঘর।

অফিসঘরটা জুড়ে রেখেছে উঠানের বেশ কিছু অংশ আর দুই ফুট উঁচু মঞ্চটা জুড়ে রেখেছে আড়াইফুট উঁচু বাউন্ডারির দুই কোনার বেশ কিছু জায়গা। এই অফিসঘরে বসে ঠাকুরবাড়ির দেখাশোনা করেন সরকারি কর্তাবাবুরা। আর মঞ্চটা? ওটা হু.মু এরশাদ সাহেবের। তিনি বাংলাদেশে বহু কিছু করার অংশ হিসেবে একবার বড়োসড়ো করে রবীন্দ্রনাথকেও স্মরণ করার জন্য ঠাকুরবাড়িতে আসেন। বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তাকে ঠাকুরবাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয়েছিল।

এবং সেজন্য দরকার ছিল উঁচু একটা মঞ্চ। এটা সেই মঞ্চ। ইট সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা বক্তৃতার মঞ্চ... এরশাদকে উঁচু করার জন্য ঠাকুরবাড়ির নাকেমুখে এরকম একটা স্থায়ী মঞ্চ চাপিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিশ্বাস বন্ধ না করলে কি একেবারেই চলত না? ঠাকুরবারিড় বকুলতলায় বাউলদের রবীন্দ্রসংগীতের আসর ০২ বারো কি তেরো বছর পর এলাম মেরেপুরের মুজিবনগর। ঠা ঠা রোদের ঘাম-ধুলা সব এক ঝটকায় মুছিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নতুন স্ট্যাচুগুলো মনটা ভালো করে দিলো। মূর্তিগুলো মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একেকটা কম্পোজিশন।

মুজিবনগর সরকারের শপথ থেকে শুরু করে নিয়াজির আত্মসমর্পণ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সবগুলো ঘটনাই একের পর এক চুনাপাথরের রংয়ে সাজানো। অদ্ভুত সুন্দর এবং নিখুঁত। আমরা মুক্তিযুদ্ধের যেসব ঘটনার ছবি দেখে অভ্যস্ত। এগুলো সেইসব ছবিরই স্ট্যাচু। কিন্তু একটা একটা করে সবগুরো ঘুরে দেখার পর মনে হলো সার্বিক কম্পোজিশন থেকে কিছু একটা যেন মিসিং... মুজিবনগর সরকারের শপথ এবং প্রথম গার্ড অব অনারের কম্পোজিশনের সামনে ক্ষুদে পর্যটক জয়িতা অনেকক্ষণ তাকানোর পরে মনে হলো মুক্তিযুদ্ধের এই মূর্তিময় উপস্থাপনার মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃতিটা নেই।

মেহেরপুরের আম্রকাননে করা এই কম্পোজিশনের সাথে কি একটা দুইটা কিংবা কয়েকটা প্রাকৃতিক গাছকে অংশ করা যেত না? স্বাভাবিক গাছগুলোকে কেটে পুরোটাই কি ইট দিয়ে মুড়িয়ে দেবার দরকার ছিল? কম্পোজিশনগুলোর পেছনে স্টেডিয়ামের মতো একটা গ্যালারি। তিন তলা সমান উঁচু। চারদিকে গোল। স্টেডিয়ামের মাঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের থ্রিডি মানচিত্র। সবুজ জমিনের মানচিত্রের বিভিন্ন জায়গায় মিনিয়েচার মডেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কম্পোজিশন।

দেখতে দেখতে মনে হলো সিমেন্টের উপর প্লাস্টিক পেইন্ট ছাড়া প্রাকৃতিক সবুজ দিয়েও হয়ত মানচিত্রটাকে সবুজ করা যেত... গ্যালারি থেকে নেমে চলে আসি উল্টো দিকের আম বাগানের ভেতরে মুজিবনগর সরকারের শপথ মঞ্চের উপর বানানো স্মৃতিসৌধে। চমৎকার এবং চমৎকার একটা স্মৃতিসৌধ। মুজিবনগর সরকারের শপথ মঞ্চ যেখানে বানানো ছিল সেখানটাতেই স্মৃতিসৌধটি। আশপাশে আম বাগানও নিখুঁত অবস্থায় আছে। আর মঞ্চের ঠিক ডান কোনায় একটা বিশাল মেহগনি গাছ... - গাছটার বয়স সাড়ে তিনশো বছর।

একটুখানি হেসে কথাটা জানালেন স্মৃতিসৌধের বর্তমান কেয়ারটেকার আর ৭১এ শপথমঞ্চ নির্মাণের একজন কর্মী মুক্তিযোদ্ধা সুভাস মল্লিক... শপথের আগের রাতে বন্য শুকর আর শেয়ালের অবাধ বিচরণভূমিতে মঞ্চ বানানো আর পাশের চার্চ থেকে চেয়ার টেবিল এনে নেতাদের বসার ব্যবস্থা করার বর্ণনা দিতে দিতে বাঁশি বাজিয়ে সৌধের দিকে ধেয়ে গেলেন সুভাস মল্লিক। জুতা মোজা স্যান্ডেল নিয়ে সৌধের স্তম্ভ বেয়ে বেয়ে উঠছে কয়েকটা তরুণ। ধমকে সবাইকে নামিয়ে আবার ফিরে এলেন- সাধারণ নিয়মটাও এদেরকে শেখানোর কেউ নেই। বুঝলেন? সত্যি সত্যি ভালো লাগার মতো একটা স্মৃতিসৌধ। সৌধ থেকে নেমে গেট দিয়ে বের হবার মুখেই চোখে পড়ল বামপাশের দেয়াল ঘেঁষে দুই ফুট উঁচু একটা সিমেন্টের মঞ্চ।

দেখার জন্য এগিয়ে যেতেই একটা ধাক্কা খেলাম। এই মঞ্চটার নাম শেখ হাসিনা মঞ্চ। সামনের দিকে শেখ হাসিনার নাম ধারণ করে স্মৃতিসৌধের দিকে পাছা ঠেকিয়ে দাঁড়ানো মঞ্চটা সম্ভবত তিনি যখন স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন তখন বানানো হয়... স্মৃতিসৌধের সামনে নিজের নামে স্থায়ী মঞ্চ বসিয়ে শেখ হাসিনা কি নিজেকে সম্মানিত করলেন নাকি বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথকে অসম্মান করলেন? সুভাস মল্লিক পর্যটকদের বর্ণনা করছেন সেদিনের শপথমঞ্চ তৈরির কাহিনী ০৩ নিচে বারো চৌদ্দফুট ফাঁকা রেখে উপরে দালান তোলার যে মডেল; বাংলাদেশে তার নাম সাইক্লোন সেন্টার। গোরস্থানে সিমেন্টের কারুকাজ করা ঢিবি জাতীয় যে কবর তা দেখলেই বোঝা যায় কোনো পিরের কবর। আর মসজিদের মডেল তো সকলেরই জানা... সিমেন্টের একতারাওয়ালা একটা গেটের ওইপারে একটা সাইক্লোন সেন্টার বানিয়ে তার সামনে ছোট একটা মসজিদ তুলে সেই মসজিদের ভেতর একটা পিরের কবর ঢুকিয়ে দিলে যে অবস্থা দাঁড়ায় সেটাই হলো সরকারি হেফাজতে লালন সাঁইয়ের বর্তমান চেহারা।

দেখলেই মনে হবে লালন নামে একজন পির এখানে সিমেন্টের মসজিদে বসে আল্লাবিল্লা করে বৃক্ষবিহীন সিমেন্টের উঠান পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে সাইক্লোন সেন্টারে উঠে গিয়ে ঘুমাতেন... ডানের মসজিদে লালন বন্দী। সামনে সিমেন্টচাপা তার শিষ্যের দল আজকের স্থাপত্যপ্রকৌশল দিয়ে কালিগঙ্গার পাড়ে ছেউড়িয়ায় লালনকেন্দ্রকে লালনের পরিবেশের মতো সাজানো কি খুব বেশি কঠিন হতো? আর রাজনৈতিকভাবে খুব কি অসুবিধা হতো মৃত লালনকে মসজিদে ঢুকিয়ে না দিলে? ২০১১.০৩.২৪


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.