আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুঃখজনক অভিজ্ঞতা

জনারণ্যে নির্জনতায় আক্রান্ত। নির্জনতাই বেশী পছন্দ, নিজের ভেতরে ডুবে থাকতেই ভাল লাগে। কিছুটা নার্সিসিস্টও।

চাকুরিজনিত কারনে আমাকে কয়েক মাস চট্টগ্রাম থাকতে হয়েছিল । নিউমার্কেট এলাকায় যে হোটেলে থাকতাম (কয়েক মাসের হোটেলজীবনএর অভিজ্ঞতা পরে শেয়ার করার ইচ্ছা রইল) সেখানেই রতনদার সাথে পরিচয়।

হোটেলে আমার পাশের রুমেই থাকতেন। খুবই হাসিখুশি ছেলে। অফিসের কাজে তিন মাসের জন্য চট্টগ্রামে এসেছেন। তার বাসাও ঢাকায়। আমার মত প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরেন।

ঢাকায় যখনই ফিরতাম, একসাথে ফিরতাম। চট্টগ্রামে থাকাকালীন একবার রোজার ঈদ পড়েছিলো। ঈদের কযেকদিনের লম্বা ছুটির আগে দুজনই একসাথে ফিরব। রতন দাকে বললাম, আমার তো আজ কাজ শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে, আমরা না হয় নাইটকোচেই ঢাকা ফিরে যাব। কোন কারনে যদি আজ না ফিরতে পারি কাল সকাল বেলা ফিরব।

কাল ঈদ। তিনি রাজি হলেন না অতিরিক্ত একদিন চট্টগ্রমে থাকতে। আমারও একবার মনে হচ্ছিল কাজ ফেলে রেখে তার সাথেই ঢাকায় ফিরে যাই। আবেগ আর বাস্তবতার লড়াইয়ে বাস্তবতা জয়ী হল। আমি রয়ে গেলাম।

নিজের ঝামেলায় ব্যস্ত থাকায় তাকে পুনরায় অনুরোধ করলাম না। মন খারাপ করে তাকে বিদায় দিলাম। দুজনেরই অগ্রিম এস.এ. পরিবহনের বিকেল ৪ টার টিকেট কাটা ছিল। তাকে বলে দিলাম আমার টিকেট টি কাউন্টারে জমা দিয়ে রাত ১০টার একটি টিকেট করে কউন্টারের পূর্বপরিচিত ছেলেটির কাছে রেখে যেতে। ঈদের কারনে সবাই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে, খুব কম লোকই ঢাকায় আসছে।

তাই টিকেট পেতে সমস্যা হবে না। কাজ সেরে সেই দিনই রাত ১০টার গাড়ীতে ঢাকা ফিরেছিলাম। ঢাকায় ঈদের ছুটি কাটিয়ে যথাসময়ে চট্টগ্রামে ফিরেছি। যথারীতি রতনদার অফিসে ফোন করেছি তার খবর নিতে, আর ঢাকায় ছুটিতে তার বাসায় যাইনি কেন এর কারন দর্শাতে। সেখান থেকে বলা হল রতন সাহেব তো অসুস্থ, তিনি ছুটির পর ঢাকা থেকে ফিরেন নি।

তারা এর বেশি জানাতে পারল না। মনটাও খারাপ হয়ে গেল, তাছাড়া ছুটিতে তার বাসায় যাইনি বলে একধরনের অপরাধবোধে ভুগছিলাম। পরের সপ্তাহে ঢাকায় ফিরেই তার বাসায় গেলাম। পরের ঘটনার শুরুটা রতনদার কাছে শোনা, কিছুটা তার বাসার লোকদের কাছে শোনা, আর বাকিটা এখন নিজের চোখে দেখছি। রতনদাকে একটি প্রাইভেট কিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।

২ সপ্তাহের মত আছেন। এখনও কাউকে চিনতে পারেন না। সেদিন তিনি নির্দিষ্ট বাসেই ঢাকায় ফিরছিলেন। পাশের সিটের 'ভদ্রলোকে'র সাথে একটি দুটি কথায় পরিচয় হয়ে যায় । রতনদা বাসে ওঠার আগে আঙ্গুর কিনেছিলেন, নিজে খাওয়ার সময় সহযাত্রীকে খেতে দিলেন।

কুমিল্লায় এসে বাস যাত্রাবিরতী নেয়। সহযাত্রী সেখানে নেমে দুটি জুস প্যাক কিনে নিয়ে আসেন। নিজে একটি খেয়ে রতনদাকে আরেকটি খেতে দেন। 'না' বলতে না পারার কারনে খেতে হল। কিছুক্ষন পরই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

বাস যথারীতি সায়েদাবাদ হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। তার বাসা হল আরামবাগ এলাকায়। মতিঝিলে তিনি নামবেন। তিনি কিছুই টের পাননি। মিরপুর ছিল বাসের লাষ্ট স্টপেজ।

সোবহানবাগ এলাকায় বাসা, তার এক টিউশনির ছাত্র ঈদের আগের রাত হওয়ায় চুল কাটাতে বের হযেছিল। সে ছাত্র রাত প্রায় ১ টার দিকে সোবহানবাগ এলাকায় তাকে রাস্তায় মাতালের মত ঘুরতে দেখে পথচারিদের সহায়তায় তাদের বাসায় নিয়ে যায়। তিনি তখন তার সেই ছাত্রকেও চিনতে পারেননি। কোন কথারও উত্তর দিতে পারেননি। পরে সেখান থেকে রতনদা'দের বাসা হযে হসপিটালে।

তিনি কিভাবে সোবহানবাগ এলাকায় এসেছিলেন তা জনাতে পারেননি। তার কাছে ছিল প্রায় ১৫ হাজার টাকা এবং অন্যান্য দরকারী কাগজপত্রসমেত ব্যাগ। উদ্ধারের সময় কিছুই তার সাথে ছিল না। একাধারে ৫ মাসের উপরে হাসপাতালে ছিলেন। সেদিন যদি ভাগ্রক্রমে তার সেই ছাত্র তাকে না পেত, তাহলে তার যে কি অবস্থা হতো , আমরা তা ভাবেতেও পারি না।

হয়তো বেওয়ারিস হিসেবে চিকিৎসার অভাবে পাগল হয়ে যেতেন বা মারা যেতেন। ইতিমধ্যে কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে তিনি অনেকটাই সেরে উঠেছেন। তবে ১০০% সুস্থ্য হয়ত আর কোনদিন হবেন না। নাম না জানা ভয়ংকর ধরনের অচেতনকারী পদার্থের প্রভাবে তার মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ন কয়েকটি নার্ভের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেছে।

যারা তাকে পূর্ব থেকে চিনে তাদের কাছে আগের তিনি এবং বর্তমানের তিনির মাঝে বিস্তর ফারাক। সারাদিন নিজের মাঝে ডুবে থাকেন। কি যেন ভাবেন। কেউ কিছু বললে চমকে তাকান। এই একসিডেন্টের কিছুদিন পূর্বে বিয়ে করেছিলেন।

মানবিক কারনে চাকুরীটি যায়নি। কিন্তু চাকুরী জীবনে শারীরিক কারনে আজীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেলেন। সেই হাসিখুশি মানুষটিকে আমরা হয়ত আর কোনাদিন পাব না। তার এই বর্তমান অবস্থার জন্য আমি নিজেকে কিছুটা দায়ী করি। আমি যদি সেদিন তার সাথে ঢাকা আসতাম তাহলেতো আজ রতনদার এই অবস্থা হতো না।

যে সমস্ত অমানুষের হাতে প্রতিনিয়ত যাত্রাপথে অনেক হতভাগ্য যাত্রী এভাবে শারীরিক ও মানষিকভাবে বিপর্যস্ত হন, তাদের কষ্ট এভাবে নিজের চোখে না দেখলে হয়তো কোনদিন বুঝতে পারতাম না। আর্থিক ক্ষতির কথাকে এখানে বাদই দিলাম, কেননা আর্থিক ক্ষতি পূরনযোগ্য। বি:দ্র: এলেখাটি আমার পুর্বের নিকে একবার প্রকাশ করা হয়েছিলো, যে নিকটি অনিবার্যকারনবশতঃ আমি ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।