আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাটিচাপা ছিল বারোবাজারের পনেরো মসজিদ



বেশ বড় বাজার বারোবাজার। যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে। ট্রেনলাইন পার হয়ে তাহেরপুর সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে এগোই। বসতি বেশি নেই। সিকি কিলোমিটার পর উত্তরের গলিপথ ডিঙিয়েই সামনে পাঠাগার মসজিদ।

লাল রঙের, বেশি বড় নয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি সংস্কার করেছে। মসজিদের পাশেই পিঠেগড়া পুকুর। এত কাল মসজিদটি মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। ধারণা করা হয়, সুলতানি আমলে নির্মিত এ মসজিদে সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার ছিল।

তারপর আবার তাহেরপুর সড়ক ধরে এগোতে থাকি সামনে। বাঁক ঘুরলেই বিরাট দিঘি। এর নাম পীরপুকুর। পুকুরের পাশ দিয়ে হাঁটাপথে মাঝ বরাবর অদ্ভুত সুন্দর পীরপুকুর মসজিদ। বেশ বড়।

এটিও মাটির নিচে ছিল। ১৯৯৪ সালে খুঁড়ে বের করা হয়েছে। ছাদ নেই। মানুষসমান দেয়াল। মসজিদের ভেতরে মহিলাদের জন্য আলাদা ঘর আছে।

মাঝখানে বড় একটি মিম্বর। মসজিদের পাঁচটি দরজা ও ছয়টি জানালা। প্রধান দরজা পাঁচ ফুট চওড়া। আট ইঞ্চি বাই সাড়ে সাত ইঞ্চি ইট দিয়ে মসজিদটি নির্মিত। এরপর পাকা সড়ক ধরে সামান্য পথ এগিয়ে দেখতে পাই আরেকটি মসজিদ।

নাম গোড়া মসজিদ। এখানে বড় একটি মাটির ঢিবি ছিল। ১৯৮৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঢিবি সরিয়ে এর হদিস পায়। এখন মুসলি্লরা এখানে নামাজ পড়েন। মসজিদের মিহরাবের পোড়ামাটির ফলকে লতাপাতা, ফলের নকশা দেখে তাজ্জব বনে যাই।

এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির দেয়াল পাঁচ ফুট চওড়া। আট কোনার চারটি মিনার, তিনটি মিহরাব, চারটি খিলানযুক্ত দরজা মসজিদটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই মসজিদটি মাটির নিচ থেকে বের করার সময় একটি কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। জনশ্রুতি রয়েছে, কবরটি গোড়াই নামের এক দরবেশের। আরো ২০০ গজের মতো সামনে এগিয়ে একটি সাইনবোর্ড পাই।

তাতে লেখা গলাকাটা মসজিদ। পাশের বিরাট দিঘিটির নামও গলাকাটা দিঘি। রাস্তা থেকে প্রায় ২০ ফুট নিচে এই মসজিদ। আর মসজিদের সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা, 'শহর মোহাম্মদাবাদ'। মাটি খুঁড়ে পাওয়া ১৫টি প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনের মানচিত্রও আছে এই বোর্ডে।

মসজিদের ভেতর ঢুকলে হিম লাগে। খাদেম রোস্তম আলী বললেন, মসজিদটি খুবই ঠাণ্ডা। দেয়াল যে পাঁচ ফুট চওড়া, ঠাণ্ডা না হয়ে উপায় আছে? ১৯৯৪ সালে মাটি খুঁড়ে বের করা এই মসজিদটি ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া। ছয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব। মসজিদের মাঝখানে লম্বা দুটি কালো পাথর।

জনশ্রুতি রয়েছে, বারোবাজারে এক অত্যাচারী রাজা ছিল। সে প্রজাদের বলি দিয়ে ওই দিঘির মধ্যে ফেলে দিত। এ কারণে গলাকাটা নাম হয়। শহর মোহাম্মদাবাদের ভেতরের খবর জানতে আগ্রহী হই। তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে ১৫টি প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন এতকাল কেন মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল? কারা এসব নির্মাণ করেছিলেন? জানা যায়, একসময় বারোবাজারের নাম ছিল ছাপাইনগর।

এ নগর ছিল হিন্দু আর বৌদ্ধ শাসকদের রাজধানী। খানজাহান আলী এখানে আসেন বারোজন অলি নিয়ে। যুদ্ধ কিংবা মহামারিতে বারোবাজার ধ্বংস হয়ে যায়। স্থাপনাগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে। গলাকাটা মসজিদ রেখে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে আরেকটি মসজিদ।

এর নাম জোড় বাংলা। মসজিদের উত্তর দিক থেকে একটি সিঁড়ি মাটির নিচে চলে গেছে। সেই সিঁড়িটি একপর্যায়ে রাস্তার ওপারে একটি দিঘিতে গিয়ে মিশেছে। এই দিঘি থেকে মুসলি্লরা ওজু করে মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন। ১৯৯৩ সালে খননের সময় এখানে একটি ইট পাওয়া যায়।

সেই ইটে আরবি হরফে লেখা ছিল, 'শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইন, আটশো হিজরী'। তাহেরপুরের দিকে দুই কিলোমিটার গিয়ে সাতগাছিয়া গ্রাম। পাকা সড়ক থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামের পথে কিছু দূর এগোলেই সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ। গ্রামের মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে মাটির নিচ থেকে মসজিদটি বের করে অর্ধেক অংশ সংস্কারের পর এখন সেখানেই নামাজ পড়া হচ্ছে। কঙ্কালসার এক পুরাকীর্তি।

পাটকাঠি দিয়ে মেপে দেখি, ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫৬ ফুট চওড়া। মসজিদের ৪৮টি পিলারও একে একে গুনি। গুনে ফেলি ৩৫টি গম্বুজ। পশ্চিম দেয়ালে অদ্ভুত সুন্দর তিনটি মিহরাব। তার মধ্যে লতাপাতার নকশা।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সাদা বক উড়ে এসে ঠাঁই নেয় সাতগাছিয়ার বাঁশবাগানে। ৬০০ বছরের পুরনো মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসে। নোটবুক মিলিয়ে দেখি, ঘোপের ঢিবি কবরস্থান, নামাজগাঁ কবরস্থান, মনোহর মসজিদ, জাহাজঘাটা, দমদমা, শুকুর মলি্লক মসজিদ, খরের দিঘি কবরস্থান, নুনগোলা মসজিদ, বাদেডিহি কবরস্থান দেখা বাদ রইল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।