আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবিধানে আমরাও কিছু চাই



আর দু'দিন পর বাংলাদেশের ৪০তম স্বাধীনতা দিবস। দিনটা হাসি-কান্নায় মেশানো থাকে। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে। শহীদ হয়েছেন অগণিত মানুষ। এই শহীদদের পরিবার-পরিজন স্বাধীনতা দিবসেও নীরবে স্মরণ করেন সেই স্বজনদের, যারা নিহত বা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন নৃশংস পাকিস্তানি হানাদারদের দখল থেকে দেশকে মুক্ত করতে।

অন্যদিকে একই সময়ে সবাই মিলে আনন্দ করি দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে। অবশ্য একই সঙ্গে অনেকেই চিন্তা করি, স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমাদের দেশ কতটা এগিয়েছে, দেশের পরিস্থিতি কেমন, আমরা এ মুহূর্তে ভালো আছি নাকি কোন সমস্যা বা জটিলতার মধ্যে পড়ে গেছি। সব সময় তো সমান যায় না। যে কোন মানুষের জীবনের মতো কখনও ভালো আর কখনও মন্দ, কখনও সুখ আবার কখনও দুঃখ, কখনও আনন্দ, কখনও কষ্ট- এভাবেই চলে সব দেশ। আমাদের বাংলাদেশও এ রীতির বাইরে নয়।

তবে আজকাল একটা বিষয় লক্ষ্য করছি, সেটি দুঃখের বা দুশ্চিন্তার নাকি কৌতুককর বা পরিহাসময় তা ঠিক করে উঠতে পারছি না। সুপ্রিমকোর্টের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা হওয়ার পর সেই রায় অনুযায়ী সংবিধান কেটেছেঁটে সাফ-সুতরো করে নতুন করে সংবিধানের যে বইটি সরকার ছেপেছে, তা নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথাটা স্রেফ গুজব নয়। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগে চেয়েও নতুন ছাপা ও বিশুদ্ধকৃত সংবিধানের কপি পাননি। বিরোধী দলের আরও দুই নেতা এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একই অভিযোগ করেছেন।

যতদূর মনে পড়ে, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুব হোসেনও একই অভিযোগ করেছেন। সরকার পক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমন একজনের কাছেও শুনেছি সংবিধানের নবসংস্করণটি তিনি হাতে পাননি। এরকম পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দাবি করেছেন, দেশে এখন পর্যন্ত কোন সংবিধান নেই। তার অভিমত হল, সুপ্রিমকোর্টের রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে সংবিধানের যে অংশ অবৈধ বলা হবে, তা সংবিধান থেকে বাদ পড়বে। কিন্তু সংবিধানে ওরকম রায়ের জোরে বা অজুহাতে নতুন কিছু জুড়ে দেয়া যাবে না।

নতুন সংযোজন বা প্রতিস্থাপন হতে হবে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনী পাস করে। আর তা করা হয়নি। কী বিপদের কথা! সংবিধান যদি না থাকে তাহলে দেশ চলছে কোন উপায়ে? জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসছে কিভাবে ও আইন পাস করছে কেমন করে? সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ 'ঐতিহাসিক' রায়গুলো দিচ্ছেন কোন মৌলিক আইনের জোরে? সরকারই বা রয়েছে কিভাবে আর নানা হুকুম দিচ্ছে কোন অধিকারবলে! নির্বাচন কমিশন নানা ধরনের নির্বাচনের ব্যবস্থা করছে কেমন করে? সিটি কর্পোরেশন আমার জন্ম সার্টিফিকেট দিল কোন অধিকারে? এত যেসব কাজ হচ্ছে, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর কি কোন আদালত তার সবই অবৈধ ঘোষণা করে দেবেন? নাকি এমতাবস্থায় বিচার বিভাগই দেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়ে নেবে, কারণ আজকাল তো মাঝে মাঝে কোন রায়ে লেখা দেখছি বা কোন মামলার শুনানি সম্পর্কে পত্রিকার খবরে পড়ছি, মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, আদালতের হাত অনেক লম্বা। অথবা আমরা কি কোন অজানা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা রাষ্ট্রপতির শাসনের দিকে পা বাড়িয়েছি? অজানাকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা তো আমাদের দারুণ! এই যেমন সংবিধানবহির্ভূত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে (দুষ্ট লোকে বলে সেনাশাসনকে) আমরা বেমালুম হজম করে নিলাম, কোন হজমি বড়ি বা ক্যান্ডি না খেয়েও। তবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দাবি করেছেন, সবই ঠিক আছে।

বেঠিক হচ্ছে যারা বলছেন, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এসব মিলিয়ে সংবিধান সংক্রান্ত পরিস্থিতি খুবই অস্পষ্ট। আর এত কথার পরও যে ঘোলাটে বিষয়টা স্পষ্ট হচ্ছে না, সেটা আমার কাছে আমাদের জন্য ভাগ্যের বিয়োগান্ত কৌতুক বলে মনে হচ্ছে। খবরের কাগজ পড়ে বা টেলিভিশনে নানা মন্তব্য শুনে মনে ধারণা জন্মেছে যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টে যে রায় হয়েছিল তাতে ওই সংশোধনীর সিংহভাগই আদালত বৈধ করে দিয়েছিলেন 'মার্জনা করা গেল' এমন একটা নির্দেশের মাধ্যমে। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে 'লিভ টু আপিল' শুনানি শেষে আপিল বিভাগ আপিল করার অনুমতি না দিলেও বিবেচনাধীন রায়ের সঙ্গে নিজেদের কিছু মতামত দেন।

এই দুই রায় অনুসারে সংবিধান সংস্কার করা হয়েছে নতুন মুদ্রিত সংস্করণে। এখন কথা উঠেছে জাতীয় সংসদকে পাশ কাটিয়ে সরকারের সংবিধান সংস্কার করার বৈধ ক্ষমতা আছে কী নেই। আমি এক অতি সাধারণ মানুষ। আমি আইনজীবী নই। কোন আইন বিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নও করিনি।

কিন্তু আমি জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক। আমি বাংলাদেশী। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলছে যে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সংবিধানের যে সংস্কার সরকার করেছে, তার পূর্ণ বিবরণ জাতীয় সংসদের এই অধিবেশনেই অবিলম্বে পেশ করা হোক। অতঃপর তা জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা হোক। ওই বিবরণীতে পরিষ্কারভাবে দেখানো থাকুক যে, বর্তমান সংবিধানে তর্কিত অনুচ্ছেদের পাঠ কী, এ সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশ কী এবং সেই নির্দেশের আলোকে সংস্কার করা অনুচ্ছেদের বর্তমান রূপ কী।

এ কাজটি করা সরকারের জন্য আদৌ কঠিন নয়। তবে উপরে প্রস্তাবিত পন্থায় সরকার ব্যবস্থা নিলেও সমস্যাটির বা বিতর্কের অবসান এখনই হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় সম্পর্কে আপিল আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টে তার 'রিভিউ' বা পর্যালোচনা চেয়ে আবেদন পেশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। কাজেই এই কাহিনীর বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প সম্পর্কে যা বলেছিলেন তাই- 'মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ'। অবশ্য আমরা শুনেছি যে, সংসদের আগামী অধিবেশনে সরকার পক্ষ থেকে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সব সংশোধনী আনা হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য যে কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন, সেই কমিটির সুপারিশক্রমে সংবিধানে সংশোধনী আনা হবে। ওই কমিটির দ্বিতীয় প্রধান সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বরাত দিয়ে পত্রিকায় এ খবর বেরিয়েছে। আশা করি, তখন এখনকার অস্বস্তি দূর হবে। সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে মাননীয় আইন প্রণেতাদের বরাবরে আমার একটি সবিনয় আবেদন আছে। সম্প্রতি বিচার বিভাগ নিয়ে বেশ কিছু কথা হয়েছে।

সুপ্রিমকোর্ট জাতীয় সংসদের চেয়েও বড় বা তার এখতিয়ারের বাইরে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ যে কারাবাস ও জরিমানা দণ্ড দিয়েছিলেন, সেই আদালত অবমাননা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় সাত মাস পরে অবশেষে ঘোষণা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তরা পূর্ণ মেয়াদ জেল খেটে বের হয়ে এসেছেন। তারা জরিমানা দিতে অস্বীকার করায় তার পরিবর্তে আদালত কর্তৃক নির্দেশিত সময়ও জেল খেটেছেন। তবে তারা এখনও মনে করেন যে, দেশে আদালত অবমাননার বিচার ও শাস্তি বিধান করে যে আইন বিদ্যমান, তাদের সাজা তথা জরিমানা তার চেয়েও বেশি বিধায় তাদের ওই রায়ের 'রিভিউ' চাওয়া প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চ রহমান ও নোমানের বিচার করায় তাদের জন্য আর কোথাও আপিল করার সুযোগ ছিল না। আছে রিভিউ পিটিশন করার সুযোগ, যা গ্রহণ করা তাদের নয়, দায়িত্বপ্রাপ্তদের কর্ম সম্পাদনে সময় লাগায় হয়েছে বিলম্বিত। এই মামলার পূর্ণ রায়ে বিজ্ঞ বিচারপতিরা বলেছেন, আদালত অবমাননা বিষয়ে আপিল বিভাগের 'Internal power' অথবা 'অন্তর্নিহিত ক্ষমতা' (আমাদের কাছে যা অলিখিত ক্ষমতা বলে প্রতীয়মান) আছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার আবেদন যে, জাতীয় সংসদ সংবিধানে অস্পষ্ট বা উহ্য কিন্তু বিদ্যমান অথবা থাকা উচিত এমন সব বিষয় পরিষ্কার করে দিক। তাতে বিচার বিভাগের ক্ষমতার একটা সীমারেখা হয়তো স্পষ্ট হবে কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত বিতর্ক কমবে।

আমি মনে করি, ১) দেশে কোন বিষয়ে আইন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সেই আইন অতিক্রম করে কোন আদালত, নিম্ন, মধ্য বা উচ্চতম, কাউকে শাস্তি দিতে পারবে না, সংবিধানে নাগরিকদের জন্য এই সুরক্ষা লিখিতভাবে নিশ্চিত করা হোক ২) আদালতের ইন্টারনাল পাওয়ার বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সংজ্ঞা সংবিধানে লেখা হোক এবং মাননীয় আদালত (আপিল বিভাগসহ) সেই ক্ষমতা কি কি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন তা সংবিধানে বলা থাকুক ৩) একইভাবে রাষ্ট্রপতির 'residuary power' বা সংবিধানে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহে অনুপস্থিত বিষয় কখনও দেখা দিলে তিনি আইনসম্মতভাবে কোন বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারবেন কিনা, জাতীয় সংসদ তাও বিবেচনা করুক ৪) সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে 'সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার' (complete justice) বলে বর্ণিত একটি বিষয় উত্থাপন করা আছে, সংবিধান সংশোধনের সময় এই 'সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার' বিষয়টির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা সংযোজন করা হোক ৫) সংবিধানের ১১১ ধারায় বর্ণিত 'আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন' (the law declared by the appellate division) নামে যে আইনের কথা বলা হয়েছে, সংবিধানে তার সংজ্ঞা সংযোজন করা হোক এবং ৬) জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত করা হোক। আর তা করা হোক সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে লিখিত 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ' এই শব্দগুলোর যথার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। বাংলাদেশ ফার্স্টডটকম সংবিধানে আমরাও কিছু চাই আর দু'দিন পর বাংলাদেশের ৪০তম স্বাধীনতা দিবস। দিনটা হাসি-কান্নায় মেশানো থাকে। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে।

শহীদ হয়েছেন অগণিত মানুষ। এই শহীদদের পরিবার-পরিজন স্বাধীনতা দিবসেও নীরবে স্মরণ করেন সেই স্বজনদের, যারা নিহত বা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন নৃশংস পাকিস্তানি হানাদারদের দখল থেকে দেশকে মুক্ত করতে। অন্যদিকে একই সময়ে সবাই মিলে আনন্দ করি দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে। অবশ্য একই সঙ্গে অনেকেই চিন্তা করি, স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমাদের দেশ কতটা এগিয়েছে, দেশের পরিস্থিতি কেমন, আমরা এ মুহূর্তে ভালো আছি নাকি কোন সমস্যা বা জটিলতার মধ্যে পড়ে গেছি। সব সময় তো সমান যায় না।

যে কোন মানুষের জীবনের মতো কখনও ভালো আর কখনও মন্দ, কখনও সুখ আবার কখনও দুঃখ, কখনও আনন্দ, কখনও কষ্ট- এভাবেই চলে সব দেশ। আমাদের বাংলাদেশও এ রীতির বাইরে নয়। তবে আজকাল একটা বিষয় লক্ষ্য করছি, সেটি দুঃখের বা দুশ্চিন্তার নাকি কৌতুককর বা পরিহাসময় তা ঠিক করে উঠতে পারছি না। সুপ্রিমকোর্টের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা হওয়ার পর সেই রায় অনুযায়ী সংবিধান কেটেছেঁটে সাফ-সুতরো করে নতুন করে সংবিধানের যে বইটি সরকার ছেপেছে, তা নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথাটা স্রেফ গুজব নয়।

জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগে চেয়েও নতুন ছাপা ও বিশুদ্ধকৃত সংবিধানের কপি পাননি। বিরোধী দলের আরও দুই নেতা এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একই অভিযোগ করেছেন। যতদূর মনে পড়ে, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুব হোসেনও একই অভিযোগ করেছেন। সরকার পক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমন একজনের কাছেও শুনেছি সংবিধানের নবসংস্করণটি তিনি হাতে পাননি। এরকম পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দাবি করেছেন, দেশে এখন পর্যন্ত কোন সংবিধান নেই।

তার অভিমত হল, সুপ্রিমকোর্টের রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে সংবিধানের যে অংশ অবৈধ বলা হবে, তা সংবিধান থেকে বাদ পড়বে। কিন্তু সংবিধানে ওরকম রায়ের জোরে বা অজুহাতে নতুন কিছু জুড়ে দেয়া যাবে না। নতুন সংযোজন বা প্রতিস্থাপন হতে হবে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনী পাস করে। আর তা করা হয়নি। কী বিপদের কথা! সংবিধান যদি না থাকে তাহলে দেশ চলছে কোন উপায়ে? জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসছে কিভাবে ও আইন পাস করছে কেমন করে? সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ 'ঐতিহাসিক' রায়গুলো দিচ্ছেন কোন মৌলিক আইনের জোরে? সরকারই বা রয়েছে কিভাবে আর নানা হুকুম দিচ্ছে কোন অধিকারবলে! নির্বাচন কমিশন নানা ধরনের নির্বাচনের ব্যবস্থা করছে কেমন করে? সিটি কর্পোরেশন আমার জন্ম সার্টিফিকেট দিল কোন অধিকারে? এত যেসব কাজ হচ্ছে, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর কি কোন আদালত তার সবই অবৈধ ঘোষণা করে দেবেন? নাকি এমতাবস্থায় বিচার বিভাগই দেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়ে নেবে, কারণ আজকাল তো মাঝে মাঝে কোন রায়ে লেখা দেখছি বা কোন মামলার শুনানি সম্পর্কে পত্রিকার খবরে পড়ছি, মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, আদালতের হাত অনেক লম্বা।

অথবা আমরা কি কোন অজানা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা রাষ্ট্রপতির শাসনের দিকে পা বাড়িয়েছি? অজানাকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা তো আমাদের দারুণ! এই যেমন সংবিধানবহির্ভূত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে (দুষ্ট লোকে বলে সেনাশাসনকে) আমরা বেমালুম হজম করে নিলাম, কোন হজমি বড়ি বা ক্যান্ডি না খেয়েও। তবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দাবি করেছেন, সবই ঠিক আছে। বেঠিক হচ্ছে যারা বলছেন, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এসব মিলিয়ে সংবিধান সংক্রান্ত পরিস্থিতি খুবই অস্পষ্ট। আর এত কথার পরও যে ঘোলাটে বিষয়টা স্পষ্ট হচ্ছে না, সেটা আমার কাছে আমাদের জন্য ভাগ্যের বিয়োগান্ত কৌতুক বলে মনে হচ্ছে।

খবরের কাগজ পড়ে বা টেলিভিশনে নানা মন্তব্য শুনে মনে ধারণা জন্মেছে যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টে যে রায় হয়েছিল তাতে ওই সংশোধনীর সিংহভাগই আদালত বৈধ করে দিয়েছিলেন 'মার্জনা করা গেল' এমন একটা নির্দেশের মাধ্যমে। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে 'লিভ টু আপিল' শুনানি শেষে আপিল বিভাগ আপিল করার অনুমতি না দিলেও বিবেচনাধীন রায়ের সঙ্গে নিজেদের কিছু মতামত দেন। এই দুই রায় অনুসারে সংবিধান সংস্কার করা হয়েছে নতুন মুদ্রিত সংস্করণে। এখন কথা উঠেছে জাতীয় সংসদকে পাশ কাটিয়ে সরকারের সংবিধান সংস্কার করার বৈধ ক্ষমতা আছে কী নেই। আমি এক অতি সাধারণ মানুষ।

আমি আইনজীবী নই। কোন আইন বিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নও করিনি। কিন্তু আমি জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক। আমি বাংলাদেশী। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলছে যে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সংবিধানের যে সংস্কার সরকার করেছে, তার পূর্ণ বিবরণ জাতীয় সংসদের এই অধিবেশনেই অবিলম্বে পেশ করা হোক।

অতঃপর তা জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা হোক। ওই বিবরণীতে পরিষ্কারভাবে দেখানো থাকুক যে, বর্তমান সংবিধানে তর্কিত অনুচ্ছেদের পাঠ কী, এ সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশ কী এবং সেই নির্দেশের আলোকে সংস্কার করা অনুচ্ছেদের বর্তমান রূপ কী। এ কাজটি করা সরকারের জন্য আদৌ কঠিন নয়। তবে উপরে প্রস্তাবিত পন্থায় সরকার ব্যবস্থা নিলেও সমস্যাটির বা বিতর্কের অবসান এখনই হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় সম্পর্কে আপিল আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টে তার 'রিভিউ' বা পর্যালোচনা চেয়ে আবেদন পেশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

কাজেই এই কাহিনীর বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প সম্পর্কে যা বলেছিলেন তাই- 'মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ'। অবশ্য আমরা শুনেছি যে, সংসদের আগামী অধিবেশনে সরকার পক্ষ থেকে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সব সংশোধনী আনা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য যে কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন, সেই কমিটির সুপারিশক্রমে সংবিধানে সংশোধনী আনা হবে। ওই কমিটির দ্বিতীয় প্রধান সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বরাত দিয়ে পত্রিকায় এ খবর বেরিয়েছে। আশা করি, তখন এখনকার অস্বস্তি দূর হবে।

সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে মাননীয় আইন প্রণেতাদের বরাবরে আমার একটি সবিনয় আবেদন আছে। সম্প্রতি বিচার বিভাগ নিয়ে বেশ কিছু কথা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট জাতীয় সংসদের চেয়েও বড় বা তার এখতিয়ারের বাইরে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ যে কারাবাস ও জরিমানা দণ্ড দিয়েছিলেন, সেই আদালত অবমাননা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় সাত মাস পরে অবশেষে ঘোষণা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তরা পূর্ণ মেয়াদ জেল খেটে বের হয়ে এসেছেন।

তারা জরিমানা দিতে অস্বীকার করায় তার পরিবর্তে আদালত কর্তৃক নির্দেশিত সময়ও জেল খেটেছেন। তবে তারা এখনও মনে করেন যে, দেশে আদালত অবমাননার বিচার ও শাস্তি বিধান করে যে আইন বিদ্যমান, তাদের সাজা তথা জরিমানা তার চেয়েও বেশি বিধায় তাদের ওই রায়ের 'রিভিউ' চাওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চ রহমান ও নোমানের বিচার করায় তাদের জন্য আর কোথাও আপিল করার সুযোগ ছিল না। আছে রিভিউ পিটিশন করার সুযোগ, যা গ্রহণ করা তাদের নয়, দায়িত্বপ্রাপ্তদের কর্ম সম্পাদনে সময় লাগায় হয়েছে বিলম্বিত। এই মামলার পূর্ণ রায়ে বিজ্ঞ বিচারপতিরা বলেছেন, আদালত অবমাননা বিষয়ে আপিল বিভাগের 'Internal power' অথবা 'অন্তর্নিহিত ক্ষমতা' (আমাদের কাছে যা অলিখিত ক্ষমতা বলে প্রতীয়মান) আছে।

এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার আবেদন যে, জাতীয় সংসদ সংবিধানে অস্পষ্ট বা উহ্য কিন্তু বিদ্যমান অথবা থাকা উচিত এমন সব বিষয় পরিষ্কার করে দিক। তাতে বিচার বিভাগের ক্ষমতার একটা সীমারেখা হয়তো স্পষ্ট হবে কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত বিতর্ক কমবে। আমি মনে করি, ১) দেশে কোন বিষয়ে আইন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সেই আইন অতিক্রম করে কোন আদালত, নিম্ন, মধ্য বা উচ্চতম, কাউকে শাস্তি দিতে পারবে না, সংবিধানে নাগরিকদের জন্য এই সুরক্ষা লিখিতভাবে নিশ্চিত করা হোক ২) আদালতের ইন্টারনাল পাওয়ার বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সংজ্ঞা সংবিধানে লেখা হোক এবং মাননীয় আদালত (আপিল বিভাগসহ) সেই ক্ষমতা কি কি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন তা সংবিধানে বলা থাকুক ৩) একইভাবে রাষ্ট্রপতির 'residuary power' বা সংবিধানে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহে অনুপস্থিত বিষয় কখনও দেখা দিলে তিনি আইনসম্মতভাবে কোন বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারবেন কিনা, জাতীয় সংসদ তাও বিবেচনা করুক ৪) সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে 'সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার' (complete justice) বলে বর্ণিত একটি বিষয় উত্থাপন করা আছে, সংবিধান সংশোধনের সময় এই 'সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার' বিষয়টির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা সংযোজন করা হোক ৫) সংবিধানের ১১১ ধারায় বর্ণিত 'আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন' (the law declared by the appellate division) নামে যে আইনের কথা বলা হয়েছে, সংবিধানে তার সংজ্ঞা সংযোজন করা হোক এবং ৬) জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত করা হোক। আর তা করা হোক সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে লিখিত 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ' এই শব্দগুলোর যথার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। বাংলাদেশ ফার্স্টডটকম সংবিধানে আমরাও কিছু চাই আর দু'দিন পর বাংলাদেশের ৪০তম স্বাধীনতা দিবস।

দিনটা হাসি-কান্নায় মেশানো থাকে। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে। শহীদ হয়েছেন অগণিত মানুষ। এই শহীদদের পরিবার-পরিজন স্বাধীনতা দিবসেও নীরবে স্মরণ করেন সেই স্বজনদের, যারা নিহত বা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন নৃশংস পাকিস্তানি হানাদারদের দখল থেকে দেশকে মুক্ত করতে। অন্যদিকে একই সময়ে সবাই মিলে আনন্দ করি দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে।

অবশ্য একই সঙ্গে অনেকেই চিন্তা করি, স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমাদের দেশ কতটা এগিয়েছে, দেশের পরিস্থিতি কেমন, আমরা এ মুহূর্তে ভালো আছি নাকি কোন সমস্যা বা জটিলতার মধ্যে পড়ে গেছি। সব সময় তো সমান যায় না। যে কোন মানুষের জীবনের মতো কখনও ভালো আর কখনও মন্দ, কখনও সুখ আবার কখনও দুঃখ, কখনও আনন্দ, কখনও কষ্ট- এভাবেই চলে সব দেশ। আমাদের বাংলাদেশও এ রীতির বাইরে নয়। তবে আজকাল একটা বিষয় লক্ষ্য করছি, সেটি দুঃখের বা দুশ্চিন্তার নাকি কৌতুককর বা পরিহাসময় তা ঠিক করে উঠতে পারছি না।

সুপ্রিমকোর্টের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা হওয়ার পর সেই রায় অনুযায়ী সংবিধান কেটেছেঁটে সাফ-সুতরো করে নতুন করে সংবিধানের যে বইটি সরকার ছেপেছে, তা নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথাটা স্রেফ গুজব নয়। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগে চেয়েও নতুন ছাপা ও বিশুদ্ধকৃত সংবিধানের কপি পাননি। বিরোধী দলের আরও দুই নেতা এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একই অভিযোগ করেছেন। যতদূর মনে পড়ে, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুব হোসেনও একই অভিযোগ করেছেন।

সরকার পক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমন একজনের কাছেও শুনেছি সংবিধানের নবসংস্করণটি তিনি হাতে পাননি। এরকম পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দাবি করেছেন, দেশে এখন পর্যন্ত কোন সংবিধান নেই। তার অভিমত হল, সুপ্রিমকোর্টের রায়ে সুনির্দিষ্টভাবে সংবিধানের যে অংশ অবৈধ বলা হবে, তা সংবিধান থেকে বাদ পড়বে। কিন্তু সংবিধানে ওরকম রায়ের জোরে বা অজুহাতে নতুন কিছু জুড়ে দেয়া যাবে না। নতুন সংযোজন বা প্রতিস্থাপন হতে হবে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনী পাস করে।

আর তা করা হয়নি। কী বিপদের কথা! সংবিধান যদি না থাকে তাহলে দেশ চলছে কোন উপায়ে? জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসছে কিভাবে ও আইন পাস করছে কেমন করে? সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ 'ঐতিহাসিক' রায়গুলো দিচ্ছেন কোন মৌলিক আইনের জোরে? সরকারই বা রয়েছে কিভাবে আর নানা হুকুম দিচ্ছে কোন অধিকারবলে! নির্বাচন কমিশন নানা ধরনের নির্বাচনের ব্যবস্থা করছে কেমন করে? সিটি কর্পোরেশন আমার জন্ম সার্টিফিকেট দিল কোন অধিকারে? এত যেসব কাজ হচ্ছে, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর কি কোন আদালত তার সবই অবৈধ ঘোষণা করে দেবেন? নাকি এমতাবস্থায় বিচার বিভাগই দেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়ে নেবে, কারণ আজকাল তো মাঝে মাঝে কোন রায়ে লেখা দেখছি বা কোন মামলার শুনানি সম্পর্কে পত্রিকার খবরে পড়ছি, মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, আদালতের হাত অনেক লম্বা। অথবা আমরা কি কোন অজানা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা রাষ্ট্রপতির শাসনের দিকে পা বাড়িয়েছি? অজানাকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা তো আমাদের দারুণ! এই যেমন সংবিধানবহির্ভূত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে (দুষ্ট লোকে বলে সেনাশাসনকে) আমরা বেমালুম হজম করে নিলাম, কোন হজমি বড়ি বা ক্যান্ডি না খেয়েও। তবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দাবি করেছেন, সবই ঠিক আছে। বেঠিক হচ্ছে যারা বলছেন, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।

এসব মিলিয়ে সংবিধান সংক্রান্ত পরিস্থিতি খুবই অস্পষ্ট। আর এত কথার পরও যে ঘোলাটে বিষয়টা স্পষ্ট হচ্ছে না, সেটা আমার কাছে আমাদের জন্য ভাগ্যের বিয়োগান্ত কৌতুক বলে মনে হচ্ছে। খবরের কাগজ পড়ে বা টেলিভিশনে নানা মন্তব্য শুনে মনে ধারণা জন্মেছে যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টে যে রায় হয়েছিল তাতে ওই সংশোধনীর সিংহভাগই আদালত বৈধ করে দিয়েছিলেন 'মার্জনা করা গেল' এমন একটা নির্দেশের মাধ্যমে। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে 'লিভ টু আপিল' শুনানি শেষে আপিল বিভাগ আপিল করার অনুমতি না দিলেও বিবেচনাধীন রায়ের সঙ্গে নিজেদের কিছু মতামত দেন। এই দুই রায় অনুসারে সংবিধান সংস্কার করা হয়েছে নতুন মুদ্রিত সংস্করণে।

এখন কথা উঠেছে জাতীয় সংসদকে পাশ কাটিয়ে সরকারের সংবিধান সংস্কার করার বৈধ ক্ষমতা আছে কী নেই। আমি এক অতি সাধারণ মানুষ। আমি আইনজীবী নই। কোন আইন বিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নও করিনি। কিন্তু আমি জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক।

আমি বাংলাদেশী। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলছে যে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সংবিধানের যে সংস্কার সরকার করেছে, তার পূর্ণ বিবরণ জাতীয় সংসদের এই অধিবেশনেই অবিলম্বে পেশ করা হোক। অতঃপর তা জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা হোক। ওই বিবরণীতে পরিষ্কারভাবে দেখানো থাকুক যে, বর্তমান সংবিধানে তর্কিত অনুচ্ছেদের পাঠ কী, এ সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশ কী এবং সেই নির্দেশের আলোকে সংস্কার করা অনুচ্ছেদের বর্তমান রূপ কী। এ কাজটি করা সরকারের জন্য আদৌ কঠিন নয়।

তবে উপরে প্রস্তাবিত পন্থায় সরকার ব্যবস্থা নিলেও সমস্যাটির বা বিতর্কের অবসান এখনই হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় সম্পর্কে আপিল আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টে তার 'রিভিউ' বা পর্যালোচনা চেয়ে আবেদন পেশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। কাজেই এই কাহিনীর বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প সম্পর্কে যা বলেছিলেন তাই- 'মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ'। অবশ্য আমরা শুনেছি যে, সংসদের আগামী অধিবেশনে সরকার পক্ষ থেকে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সব সংশোধনী আনা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য যে কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন, সেই কমিটির সুপারিশক্রমে সংবিধানে সংশোধনী আনা হবে।

ওই কমিটির দ্বিতীয় প্রধান সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বরাত দিয়ে পত্রিকায় এ খবর বেরিয়েছে। আশা করি, তখন এখনকার অস্বস্তি দূর হবে। সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে মাননীয় আইন প্রণেতাদের বরাবরে আমার একটি সবিনয় আবেদন আছে। সম্প্রতি বিচার বিভাগ নিয়ে বেশ কিছু কথা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট জাতীয় সংসদের চেয়েও বড় বা তার এখতিয়ারের বাইরে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।

আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ যে কারাবাস ও জরিমানা দণ্ড দিয়েছিলেন, সেই আদালত অবমাননা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় সাত মাস পরে অবশেষে ঘোষণা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তরা পূর্ণ মেয়াদ জেল খেটে বের হয়ে এসেছেন। তারা জরিমানা দিতে অস্বীকার করায় তার পরিবর্তে আদালত কর্তৃক নির্দেশিত সময়ও জেল খেটেছেন। তবে তারা এখনও মনে করেন যে, দেশে আদালত অবমাননার বিচার ও শাস্তি বিধান করে যে আইন বিদ্যমান, তাদের সাজা তথা জরিমানা তার চেয়েও বেশি বিধায় তাদের ওই রায়ের 'রিভিউ' চাওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চ রহমান ও নোমানের বিচার করায় তাদের জন্য আর কোথাও আপিল করার সুযোগ ছিল না।

আছে রিভিউ পিটিশন করার সুযোগ, যা গ্রহণ করা তাদের নয়, দায়িত্বপ্রাপ্তদের কর্ম সম্পাদনে সময় লাগায় হয়েছে বিলম্বিত। এই মামলার পূর্ণ রায়ে বিজ্ঞ বিচারপতিরা বলেছেন, আদালত অবমাননা বিষয়ে আপিল বিভাগের 'Internal power' অথবা 'অন্তর্নিহিত ক্ষমতা' (আমাদের কাছে যা অলিখিত ক্ষমতা বলে প্রতীয়মান) আছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার আবেদন যে, জাতীয় সংসদ সংবিধানে অস্পষ্ট বা উহ্য কিন্তু বিদ্যমান অথবা থাকা উচিত এমন সব বিষয় পরিষ্কার করে দিক। তাতে বিচার বিভাগের ক্ষমতার একটা সীমারেখা হয়তো স্পষ্ট হবে কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত বিতর্ক কমবে। আমি মনে করি, ১) দেশে কোন বিষয়ে আইন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সেই আইন অতিক্রম করে কোন আদালত, নিম্ন, মধ্য বা উচ্চতম, কাউকে শাস্তি দিতে পারবে না, সংবিধানে নাগরিকদের জন্য এই সুরক্ষা লিখিতভাবে নিশ্চিত করা হোক ২) আদালতের ইন্টারনাল পাওয়ার বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সংজ্ঞা সংবিধানে লেখা হোক এবং মাননীয় আদালত (আপিল বিভাগসহ) সেই ক্ষমতা কি কি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন তা সংবিধানে বলা থাকুক ৩) একইভাবে রাষ্ট্রপতির 'residuary power' বা সংবিধানে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহে অনুপস্থিত বিষয় কখনও দেখা দিলে তিনি আইনসম্মতভাবে কোন বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারবেন কিনা, জাতীয় সংসদ তাও বিবেচনা করুক ৪) সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে 'সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার' (complete justice) বলে বর্ণিত একটি বিষয় উত্থাপন করা আছে, সংবিধান সংশোধনের সময় এই 'সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার' বিষয়টির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা সংযোজন করা হোক ৫) সংবিধানের ১১১ ধারায় বর্ণিত 'আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন' (the law declared by the appellate division) নামে যে আইনের কথা বলা হয়েছে, সংবিধানে তার সংজ্ঞা সংযোজন করা হোক এবং ৬) জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত করা হোক।

আর তা করা হোক সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে লিখিত 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ' এই শব্দগুলোর যথার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। বাংলাদেশ ফার্স্টডটকম

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.