আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে

ইতিহাস, নেই অমরত্বের লোভ/ আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ...

তখন নেদারল্যান্ডে গিয়েছি একটা কোর্স করতে। বিভিন্ন দেশ থেকে ছেলে মেয়েরা এসেছে- নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, জাম্বিয়া, ভারত ইত্যাদি। সবাই সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শোনার পর অনেকের কাছ থেকেই উন্নাসিকতা মিশ্রিত কৌতূহল পেয়েছি। ভারত থেকে আসা সরকারী অফিসারের প্রশ্ন শুনে তো মাথায় রক্তই চেপে গেল- "তোমরা তো উর্দুতে কথা বল, তাইনা?" এই প্রশ্ন অবশ্য এর আগেও অনেক ভারতীয়র কাছে শুনতে হয়েছে।

পরে এর কারণ জেনেছি- সাধারণভাবে উর্দুকেই ভারতের সব মুসলমানের ভাষা মনে করা হয়। কারণ ভারতের বেশিরভাগ জায়গায় মুসলমানরা উর্দুতেই কথা বলে, দক্ষিণ ভারত ছাড়া। এমনকি পশ্চিম বঙ্গের অনেক মুসলমান উর্দুভাষী। যাই হোক, প্রথম একটু হালে পানি পেলাম যখন আমাদের প্রথম reading assignment টা সবাই মিলে পড়তে বসলাম। সেখানে কাকতালীয়ভাবে আমার প্রতিষ্ঠান James P Grant School of Public Health, BRAC University র কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং south globe এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

নাইজেরিয়ানদের এই প্রথম অবিশ্বাসী চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকাতে দেখলাম। আর ভারতীয় বন্ধুদের দেখলাম ঈর্ষাভরা চোখে তাকাতে। একটু লাই পেয়ে শুরু করলাম সুযোগ মত দেশের ইতিহাস, ভাষা আর সংস্কৃতির গৌরবজনক দিকগুলো তুলে ধরতে। খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হলনা। পাত্তা একটু দিল যেদিন প্রফেসর ইয়ান হেনড্রিক রিচার্ডাস আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে আই. সি. ডি. ডি. আর. বি.'র মতলব উপজেলাস্থ বিশ্বের বৃহত্তম demographic and health surveillance system (DHSS) এর প্রসঙ্গ তুলে বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের বিমুগ্ধ কৃতজ্ঞার কথা জানালেন।

এভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে আফ্রিকার বন্ধুদের কাছে আমার সোনার বাংলাদেশ পরিচিত হয়ে উঠতে লাগল। মনে পড়ে, কোর্সের শেষ দিকে নেদারল্যান্ডসের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের Health Governance and Management বিভাগের অধ্যাপিকা ডক্টর মিউরস, যিনি সুদীর্ঘকাল সেদেশের পার্লামেন্টের সিনেটরও ছিলেন, স্বাস্থ্য সুশাসন ও ক্ষমতায়ন বিষয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে ব্র্যাকের (BRAC) ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের Village Organization (VO) meeting এর ছবি দেখাচ্ছিলেন। ওটা দেখানর সময় জিজ্ঞেস করলেন বাংলাদেশ থেকে কেউ ক্লাসে আছে কিনা। রুনা আপু আর আমি হাসি হাসি মুখ করে হাত তুললাম। আর ভারতীয় আর আফ্রিকান বন্ধুদের থোতা মুখ আরেকটু ভোতা হয়ে গেল।

কোর্সের শেষ দিন, আমাদের ফাইনাল প্রেজেন্টেশনের শেষে যখন একপাল নাইজেরিয়ান, বেশকিছু ভারতীয় আর অন্যান্য দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্য থেকে আমার প্রজেক্ট টা প্রথম পুরষ্কার পেল, তখন আবার ভারতীয়দেরকে খুশি হতে দেখেছি। তারা গিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে প্রথম পুরস্কার এসেছে বলে আফ্রিকানদের কাছে বেশ একখানা ভাব নিয়ে আসলো। যেন বাংলাদেশের কারো পুরষ্কার পাওয়া আর তাদের পুরষ্কার পাওয়া একই কথা। আর নাইজেরিয়ার সবচেয়ে উন্নাসিক স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ চার্লস এজেনডুকা চিবিয়ে চিবিয়ে আমাকে প্রশ্ন না করে পারলোনা- "এতই যখন তোমাদের অর্জন, তাহলে কাল রাতে ইন্টারনেটে যে দেখলাম প্রায় সবগুলো আর্থসামাজিক নির্ণায়কে তোমরা পৃথিবীর তলানির দিকে, তার ব্যাখ্যা কি?" তার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য একটা কথাই আমার মাথায় আসল- যা কিছু অর্জন সব এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর নিজের ভাগ্যকে বদলে ফেলার অসম সমরের ফলাফল। আর পিছিয়ে থাকা যে ইন্ডিকেটরগুলো তুমি দেখেছ- সেটা দেশপ্রেম বিবর্জিত আমাদের মাথামোটা রাজনীতিবিদদের অপার কৃপার নিদর্শন।

আমি এসব কথা বলতে গিয়েও গিলে ফেললাম- officially এই অথর্ব রাজনীতিবিদগুলোই তো আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তাই দোষটা চাপিয়ে দিলাম আমাদের জনসংখ্যার অস্বাভাবিক আধিক্যের ওপর। যেদিন দেশে ফিরে আসব, হেগ থেকে আমস্টার্ডামগামী ট্রেনে দেখা হয়ে গেল আমাদের কোর্সের সুন্দরী লেকচারার তানয়া হাওলিংয়ের সাথে। ও আমাকে বলল, "তোমাকে ক্লাসের ফাঁকে প্রায়ই তোমার দেশের কথা, বাংলা ভাষার গৌরবের কথা অন্যান্য ক্লাসমেটদের বলতে দেখেছি। তখন তোমার চোখ মুখ অদ্ভুত ভালোবাসার ঔজ্বল্যে ঝলমল করতো।

" তানয়া যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করত তখন একটা গবেষণা প্রকল্পের কাজে মাস তিনেক তাকে ঢাকায় কাটাতে হয়েছিল। সে বলল, "আশ্চর্য ব্যাপার হল তোমার মুখের এই ঔজ্বল্য শুধু তোমার মত শিক্ষিত মানুষের মাঝেই নয়, বাংলাদেশের রিকশাঅলা থেকে শুরু করে ছাত্র, আমলা, সাধারণ মানুষ সবার মধ্যেই লক্ষ করেছি, যখনি তারা দেশের কথা বলে, ভাষার কথা বলে। তোমরা তোমাদের দেশকে এত ভালোবাসো! এই অপরিসীম জাতীয় চেতনা বাংলাদেশের ব্যাপারে আমাকে বারবার আপ্লুত করেছে। আমি আর কোথাও এমনটা দেখিনি। " আমার চোখে পানি চলে এল।

আমার গলা ধরে এলো বলতে, "তানয়া, এত ভালোবাসা যে জাতির দেশের প্রতি, সেই দেশ বেশিদিন পিছিয়ে থাকতে পারেনা। এ আমার ধর্ম বিশ্বাসের মতই এক অবুঝ বিশ্বাস। দেখে নিও, এ দেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে। "

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.