আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‌‌'ক্রিকেটে মনস্তত্ত্ব' - সাপ্তাহিক ২০০০

ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...

ক্রিকেট শুধু শারীরিক ফিটনেস আর বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিংয়ের কলাকৌশলের প্রদর্শনী নয়, একই সঙ্গে এটি ‘মাইন্ড গেম’ও। ক্রিকেটীয় জ্ঞানের সঙ্গে শারীরিক সুস্থতা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি সাফল্যের জন্য প্রয়োজন মানসিক সি’তি। তাই তো, খেলা-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রস্তুতি, অনুশীলনের পাশাপাশি অধিনায়ক-কোচকে উত্তর দিতে হয় দলের বা নির্দিষ্ট কোনো ক্রিকেটারের মানসিক অবস্থা সংক্রান্ত প্রশ্নেরও। সেই মানসিক অবস্থার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আত্মবিশ্বাস একটি ইতিবাচক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি, সাফল্যের অন্যতম অনুষঙ্গ।

আত্মবিশ্বাসী খেলোয়াড় যে কোনো পরিস্থিতিতে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করেন, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত এবং উদ্দীপ্ত থাকেন, নিজের প্রতি এবং কাজের প্রতি তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকে। তিনি মাঠে তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালান, সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, আত্মবিশ্বাসহীন ক্রিকেটারের অবস্থা হয় সম্পূর্ণ উল্টো। নেতিবাচক ভাবনা, উদ্বেগ-ভীতি মনে গেড়ে বসে। ফলে, প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতা সঙ্গী হয়।

কোনো পরিস্থিতি সরাসরি আত্মবিশ্বাসের ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা, মূল্যায়ন এবং প্রত্যাশার ফলেই তৈরি বা ধ্বংস হয় আত্মবিশ্বাস। খেলোয়াড়ের দক্ষতার ভিত্তিতে নির্ধারিত বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ও তার বাস্তবায়নে সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে ওঠে আত্মবিশ্বাস। শতক বা অর্ধশতক যেমন ব্যাটসম্যানকে, উইকেট প্রাপ্তি বোলারকে, ক্যাচ ধরা বা রান-বাঁচানো দুর্দান্ত ফিল্ডিং ফিল্ডারকে আত্মবিশ্বাসী করে, জয় আত্মবিশ্বাসী করে পুরো দলকেই। অন্যদিকে পরাজয় শক্তিশালী দলের আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে করে দেয়। চার-ছয়ের বাড়ি খাওয়ার পর বোলারের লাইন-লেনে’র ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো, ক্রমাগত ওয়াইড-নো বল করা নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস নড়ে যাওয়ার ফলেই ঘটে।

চোটও খেলোয়াড়ের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিতে পারে। সাফল্যের জন্য যে কোনো অবস্থায় নিজের দক্ষতার ওপর আস্থা রাখার শিক্ষা দেওয়া হয় ক্রিকেটারদের। আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার জন্য ব্যর্থতার স্মৃতি ভুলে অতীতের ভালো পারফরম্যান্সের স্মৃতিচারণ করতে উপদেশ দেওয়া হয় ক্রিকেটারদের। এছাড়াও খেলার মাঠে সম্ভাব্য নানা পরিস্থিতি ইতিবাচকভাবে মোকাবেলার কাল্পনিক চিত্র মনের মাঝে ভাসানোও নিজের প্রতি আস্থা তৈরির একটি কৌশল। একে বলা হয় ‘মেন্টাল ইমেজারি’ কৌশল।

নেতিবাচক ভাবনা ও ব্যর্থতার ভয় সাফল্যের পথে অন্যতম অন্তরায়। ব্যাটসম্যান যদি ক্রিজে যাওয়ার আগেই চিন্তা করেন ডেল স্টেইন বা শন টেইটের বলের যে গতি তাতে রান করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কিংবা মালিঙ্গার ইয়র্কার বা কেমার রোচের ইনকাটারে দ্র্বতই তার উইকেট উপড়ে যাবে, তাহলে তা-ই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তেমনি বিরেন্দর শেবাগ বা স্ট্রাউস তার বলকে সীমানা ছাড়া করবে ধরে নিয়েই যদি কোনো বোলার বল করেন, তাহলে পিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনা তার-ই বেশি। ব্যাটের কোনায় লেগে আকাশে ওঠা কোনো বল ক্যাচ করতে ছোটা কোনো ফিল্ডার যদি ভাবতে থাকেন, বলটা তো হাত ফস্কে যাবে, তবে ক্যাচ ড্রপ হওয়ার সম্ভাবনাই সেক্ষেত্রে বেশি। অন্যদিকে আউট হওয়া যাবে না কোনোমতেই- প্রতিটি বল খেলার আগে এ চিন্তাই যদি ঘুরপাক খায় ব্যাটসম্যানের মনে, তাহলে হয়তো ২-৪ রান করবেন তিনি, তারপরই আউট অথবা অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক খেলার পরিণতি ৪০ বলে ১০ রান! তাই মনোবিদরা পরামর্শ দেন, ব্যাটিংয়ের সময় যখন শট খেলা হচ্ছে, তখন সেই শট ও বলের ওপরই কেবল মনোযোগ দিতে, এভাবে আউট হওয়া সংক্রান্ত যে কোনো চিন্তা দূরে রাখতে।

যে কোনো কাজের সাফল্যের জন্য সেই কাজের প্রতি পূর্ণ ও গভীর মনোযোগ অন্যতম পূর্বশর্ত। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য। একজন ক্রিকেটার যতই প্রতিভাবান বা শারীরিক ও কৌশলগত দক্ষতার অধিকারী হোন না কেন, নির্দিষ্ট কাজটির- তা হোক ব্যাটিং, বোলিং বা ফিল্ডিং- প্রতি মনোযোগী না হলে মাঠে তার দক্ষতার যথাযথ অনুবাদ হবে না, তিনি চিহ্নিত হবেন ব্যর্থ খেলোয়াড় হিসাবে। মাঠের ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন কারণেই মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটতে পারে। এবারের বিশ্বকাপে দলগতভাবে ক্রিকেট থেকে মনোযোগ হারানোর মতো সর্বোচ্চ কারণ সম্ভবত রয়েছে পাকিস্তান দলের।

স্বাগতিক হওয়ার সুযোগ হারানো, স্পট ফিক্সিং বিতর্ক, নিয়মিত একাদশের তিন খেলোয়াড়ের নিষেধাজ্ঞা, খেলোয়াড় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক, অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ- যে কোনোটিই খেলোয়াড়দের মনোযোগ সরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ কারণেই এবার পাকিস্তানের সাফল্যের ব্যাপারে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ও সমর্থক সন্দিহান। তাই পাকিস্তান দলের কোচ-অধিনায়ককে নিয়মিত তাদের জবাব দিতে হয়েছে এই বলে যে, তার দলের খেলোয়াড়দের মনোযোগ খেলার মধ্যেই রয়েছে। প্রথম দু খেলার সাফল্যে অবশ্য তারা সেটা প্রমাণও করেছেন। মাঠে যেসব কারণে খেলা থেকে মনোযোগ বিঘ্নিত হতে পারে তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছে- উদ্বেগ, ক্লান্তি, আবহাওয়া, দর্শক, সহ-খেলোয়াড়, প্রতিপক্ষ, নেতিবাচক চিন্তা, অতীত ব্যর্থতার স্মৃতি প্রভৃতি।

খেলোয়াড়দের প্রতিনিয়তই মানসিক চাপ মোকাবেলা করে চলতে হয়। দল হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বা ওয়ানডের এক নম্বর দলের তকমা বজায় রাখার চাপ, স্বাগতিক দল হওয়ায় ভারত-শ্রীলংকা-বাংলাদেশের ওপর দর্শক-প্রত্যাশার চাপ, হল্যান্ড-কেনিয়া-আয়ারল্যান্ডের মতো দলগুলোর ভালো খেলে আইসিসির পরবর্তী বিশ্বকাপ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জের চাপ, ছোট দলের বিপক্ষে বড় দলের ‘ফেভারিট’-তত্ত্বের চাপ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাদেশ দলে আশরাফুলের নিজস্ব অবস্থান তৈরির চাপ, ড্যারেন স্যামির আকস্মিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্ব প্রাপ্তির চাপ- ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে বিভিন্ন চাপের মুখোমুখি ক্রিকেটাররা সর্বদাই। এসব চাপ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে মানসিক দৃঢ়তা দেখাতে পারেন যারা, ক্রিকেটীয় সাফল্যও তাদের মুঠোবন্দি হয়। আবেগ একজন ক্রিকেটারের খেলায় প্রভাব ফেলে। আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা ভালো খেলার জন্য অবশ্য প্রয়োজন।

ব্যর্থতার জন্য দায়ী অন্যতম আবেগীয় অবস্থা হচ্ছে উদ্বেগ ও ক্রোধ। স্বাভাবিক মাত্রার উদ্বেগ ও উদ্দীপনা সাফল্যের জন্য দরকারি। কিন্তু অতিরিক্ত উদ্বেগ নেতিবাচক। অতি উদ্বিগ্ন ক্রিকেটার শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের উপসর্গ বোধ করতে পারেন। গলা শুকিয়ে আসা, তৃষ্ণা, অতিরিক্ত ঘাম, বুক ধড়ফড় করা, বমি বমি ভাব, হাত-পায়ে কাঁপুনি, ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি উদ্বেগের শারীরিক বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।

ভীতি, নেতিবাচক ভাবনা, মনোযোগহীনতা প্রভৃতি হতে পারে মানসিক উপসর্গ। অতিরিক্ত উদ্বেগ কমানোর জন্য প্রয়োজনে ‘রিলাক্সেশন’ কৌশল শেখানো হয় ক্রিকেটারদের। ক্রোধ বা রাগ মূল কাজ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়, মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয় ক্রোধের নেপথ্যের কারণটায়। ফলে পারফরম্যান্স খারাপ হয়। প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারকে ক্রোধান্বিত করে তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে স্লেজিংকে কৌশল হিসাবেই ব্যবহার করেন অনেক খেলোয়াড়।

বলতে গেলে স্লেজিং ক্রিকেটের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অস্ট্রেলিয়ার মতো কোনো কোনো দেশ স্লেজিংকে তো প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের ক্রিকেটীয় দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে স্লেজিংও নিয়মিতই মোকাবেলা করতে হয় একজন ক্রিকেটারকে। শারীরিক ফিটনেস ও খেলার কৌশলের পাশাপাশি মানসিক সুস’তা ও দৃঢ়তার গুরুত্ব অনুধাবন করছে এখন প্রতিটি দলই। ফলে প্রতিটি দলই শরণাপন্ন হচ্ছে মনোবিদের।

দলগত বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো খেলোয়াড়ের মানসিক উৎকর্ষের জন্য মনোবিদের পরামর্শ নেয়া এখন দলীয় কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ....................................................................... সাপ্তাহিক ২০০০, ১১-৩-২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত। লিংক - ক্রিকেটে মনস্তত্ত্ব

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।