আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিছু হটছে রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র



এককালে যা ভাবা যেত না, সন্দেহ করার তেমন অবকাশও ছিল না_তাই আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে আফ্রিকা ও এশিয়ার আরবিভাষী অঞ্চলে। অবিশ্বাস্য গণবিদ্রোহে তিউনিসিয়া ও মিসরে বহু যুগের দুই স্বৈরাচারী শাসকের বিদায়ের পর উত্তাল হয়ে উঠেছে এবার অন্যান্য আরবিভাষী দেশ। বাহরাইন, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, ইয়েমেনের সড়কগুলো দ্রুত দখল করে নিচ্ছে গণতন্ত্রকামী, স্বাধীনতাকামী মানুষ। তারা 'স্বাধীনতা, আত্মসন্মান ও সুবিচার' চায়। তারা সেই মানুষ, যারা যুগের পর যুগ রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে নিপীড়িত হয়েছে।

যুগের পর যুগ ধর্ম ও রাজতন্ত্রের নামে অধিকারহীন হয়ে নিজ মাটিতে বন্দি, পরবাসী থেকেছে। কাজেই এ মানুষগুলোর নব-উত্থান মানবসভ্যতার জন্য বড় এক শুভলক্ষণ তা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমার। শৃঙ্খল ভাঙার বিস্ময়কর সব খবর আসছে প্রতিদিন! তথাকথিত 'লৌহমানব'দের দেশ ছেড়ে পালানোর খবর আসছে। রাজবিদ্রোহের বাণী নিয়ে রাজপথে নেমেছে সাধারণ মানুষ, যুব-তারুণ্য, নারী ও পুরুষ। যা কখনো ভাবা যেত না_তাই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে আজ।

স্বাধীনতার যে চেতনা ও স্বপ্নকে তারা যুগের পর যুগ বুকে আগলে রেখেছিল, সেই সুপ্ত চেতনা ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আরবিভাষী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে নিজেদের দেশের সড়কে। সৌদি আরব লাগোয়া রাজতন্ত্রী বাহরাইন কেঁপে উঠছে বিক্ষোভে। সীমান্ত পেরিয়ে সে আগুন শেষ পর্যন্ত আর কোথায় ছড়িয়ে পড়ে কে জানে। তিউনিসিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার সৌদি আরবে আশ্রয় পাওয়া পলাতক স্বৈরশাসক বেন আলীকে অবিলম্বে ফেরত চেয়েছে। লিবিয়ার মানুষ পরিবর্তনের দাবিতে প্রাণ দিচ্ছে।

ইয়েমেনের মানুষ হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমেছে। বেনগাজি থেকে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে ত্রিপোলি পর্যন্ত। জর্ডান ও মরক্কোর রাজারা পরিস্থিতি সামলাতে নানা কৌশল অবলম্বন করেও সামাল দিতে পারছেন না। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে, রাজারা_যা কোনো দিন ভাবা যেত না। এসব মানুষ অসহনীয় রাজতন্ত্রের অবসান চায়।

ধর্ম ও রাজতন্ত্রের নামে শাসন-শোষণের শেষ চায়। স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র চায়। চায় যুগ প্রাচীন, পরিবারতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের আশু পরিবর্তন। সেই সঙ্গে চায় রাজপরিবারের যে দাসশ্রেণী যুগের পর যুগ ধরে তাদের শোষণ করেছে, নিপীড়ন করেছে, যুগের পর যুগ ধর্মের নামে মানুষের মৌলিক অধিকার লুণ্ঠন করেছে, একই সঙ্গে চায় তাদেরও উৎখাত ও বিচার। মোট কথা, মধ্যপ্রাচ্য বা যাকে আমরা পশ্চিম এশিয়া বলি, একই সঙ্গে আফ্রিকার মুসলমান প্রধান দেশ সমৃদ্ধ বিস্তৃত অঞ্চলটি একবিংশ শতাব্দীতে জেগে উঠেছে।

ঐতিহাসিক পরিবর্তনের যে দমকা হাওয়ার সূত্রপাত করেছে তিউনিসিয়ার, মিসরের লড়াকু মানুষ, প্রচণ্ড সেই বাতাস দ্রুত ছাপিয়ে দিচ্ছে গোটা আরব জগৎ। এমনকি কুয়েত ও জিবুতির মতো দেশেও পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠছে। এ দেশগুলোর স্বৈরশাসকরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলছে। তিউনিসিয়ার বেন আলী তাঁর দুই যুগের স্বৈরতন্ত্র অবসান করে জনতার হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেশত্যাগ করে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বৈরশাসক বেন আলী সহজে দেশ ছেড়ে পালালেও হোসনি মুবারক তা করেননি।

বরং ভয় দেখিয়ে, নিপীড়ন চালিয়ে আরো কিছুদিন তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালানোর ইচ্ছা ছিল মুবারকের। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। তাৎপর্যময় ঘটনাটি হচ্ছে, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুগ যুগ ধরে হোসনি মুবারকের প্রধান রক্ষক বা সমর্থক, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিনিময়ে তিন দশকের স্বৈরশাসক যে মুবারক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অতি-কাছের মানুষ, সেই মুবারককে পর্যন্ত প্রকাশ্যে পরিত্যাগ করতে হয়েছে ওয়াশিংটনকে! দূতিয়ালি করতে হয়েছে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে। চরম নাখোশ হওয়ার পরও ইসরায়েলকে মেনে নিতে হয়েছে হোসনি মুবারকের সকরুণ বিদায়।

আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনবহুল দেশটির সেনাবাহিনী আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা আগ্রহ ভরে দেখার বিষয় হলেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই মিসরের। সে নির্বাচনে আন্দোলনকারীদের স্বপ্ন কতটা পূরণ হবে জানি না, কিন্তু স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের যে বাতাস একবার বইতে শুরু করেছে তা থেকে সম্ভাব্য নতুন স্বৈরাচারীদের শেষ রক্ষা হওয়ার কোনো কারণ দেখি না আমি। আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, একমাত্র লিবিয়া ছাড়া আরববাসীর এসব গণবিক্ষোভ সার্বিক অর্থেই শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা সহিংস পথ অবলম্বন করছেন না কোথাও।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছে। স্বৈরশাসকদের বিদায় দাবি করছে। লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির সৈন্যদের হাতে অসংখ্য গণতন্ত্রকামী মানুষের মৃত্যু ঘটেছে ইতিমধ্যে। বিক্ষোভকারীরাও কোথাও কোথাও সহিংসতা অবলম্বন করছে বলে খবর আসছে। চার যুগেরও বেশি ক্ষমতাসীন গাদ্দাফি নিজে মুখ খোলেননি এখনো।

অসমর্থিত খবর আসছে, তিনি পালাবেন বা ইতিমধ্যেই পালিয়েছেন। শক্তি প্রয়োগে গণমানুষের জোয়ার দমাতে এ স্বৈরশাসক ইতিমধ্যেই দমন-পীড়ন শুরু করেছে। তাঁর ছেলে সাইফ-আল ইসলাম গাদ্দাফি পশ্চিমি দেশগুলোর ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। 'সিভিল ওয়ার' ঘটিয়ে লিবিয়াকে টুকরো করার কথা বলেছেন। কিন্তু সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগে সে যুদ্ধ ঠেকানো হবে বলেও হুংকার দিয়েছেন।

স্বদম্ভে বলেছেন, তাঁর পিতার শাসনকে হটানোর চেষ্টা করা হলে 'রক্তের নদী' বইবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত দুই শর ওপর বিক্ষোভকারী গুলিতে মারা গেছে। হাসপাতাল সূত্রগুলো মৃতের সংখ্যা আরো বেশি বলছে। কোনো বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না লিবিয়ায়। ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে।

এর পরও বেনগাজি থেকে মিসরাতার মতো নগরী থেকে লাগাতার গণবিক্ষোভের খবর আসছে। খুন-জখমের খবর আসছে অন্যান্য শহর থেকে। রাবাত, কাসাব্লাংকার সড়কে সড়কে হাজার হাজার মানুষের গণবিক্ষোভ কখনো দেখা যাবে কেউ কি ভেবেছিল কখনো? কিন্তু সেটিই ঘটছে। ইয়েমেনের সানা ও এডেন নগরীতে হাজার হাজার ছাত্র নেমে এসেছে সড়কে। নিপীড়ন চালাচ্ছে আলী আবদুল্লাহর স্বৈর সরকার।

পুলিশের গুলিতে মারা গেছে গণতন্ত্রকামী তরুণ। কিন্তু বিক্ষোভ থামেনি। এশিয়া ও আফ্রিকার এসব দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরতান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের অবসান মানবসভ্যতার স্বাথেই জরুরি। দুর্ভাগ্যক্রমে এদের বেশির ভাগ টিকে আছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবিদার কিছু পশ্চিমি মুরবি্বর সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এদের দ্বৈতনীতি অবস্থানের কারণেই গণমানুষের অধিকার, সার্বিক অর্থে মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকার থেকে আরবিভাষী মানুষ বঞ্চিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ।

এর সঙ্গে কৌশলে যুক্ত করা হয়েছে ধর্ম এবং ধর্মকেন্দ্রিক শোষণ। কাজেই যে পরিবর্তনের দাবি নিয়ে নিপীড়িত মানুষ আজ রাস্তায় নেমেছে সে মানুষের প্রতি সমর্থন জানানো আজ প্রতিটি সভ্য মানুষের নৈতিকতার দাবি। পরিবর্তনের যে হাওয়া আজ আরব বিশ্বে বইতে শুরু করেছে তাকে স্বাগত জানানোর মাঝে মানবসভ্যতার গর্ব আছে। আমরা যেন সে গর্ব থেকে নিজেদের বঞ্চিত না করি। আমি জানি না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত কোন ভূমিকা গ্রহণ করবে, বিশেষ করে বাহরাইন, জর্ডান ও কুয়েতের মতো দেশের ক্ষেত্রে।

এসব ক্ষেত্রে তেলসম্পদ এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ অবশ্যই আমেরিকাকে ভাবাতে শুরু করেছে। এটিও এখন চটজলদি বলা যাবে না_পশ্চিম এশিয়ার এ গণবিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবের রাজতন্ত্রকে কতটা আঘাত কিংবা অস্থিতিশীল করবে। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, মিসরের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন যে ভূমিকা রেখেছে তা এসব দেশের ক্ষেত্রে সে নেবে না। এর প্রধান কারণ মিসরের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী স্বার্থ রক্ষায় আমেরিকার নীতি-অবস্থানের নতুন সমীকরণ দরকার। আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন নির্ঘাৎ জানে, এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গোটা অঞ্চলে যে নতুন বাতাস বইতে শুরু করেছে সে বাতাস ইসরায়েলের নীতি-অবস্থানেও পারিবর্তন ঘটাতে বাধ্য।

কাজেই ফিলিস্তিন প্রশ্নে নতুন আপসরফার চেষ্টা হবে। আমার বিশ্বাস, এ পরিবর্তন ফিলিস্তিন প্রশ্নে নতুন সমীকরণ আনবে ইসরায়েল এবং পশ্চিমা বিশ্বে। আমি নিশ্চিত, চলতি এ গণবিদ্রোহের শুভ ফল দেখতে পাবে আরব বিশ্বের বন্দি মানুষ_আজ অথবা আগামীকাল। মানুষের মনোজগতে এ বিদ্রোহ যে বীজ রোপণ করেছে তা থেকে অসংখ্য-অগণিত চারাগাছ হবে_সে গাছ বৃক্ষ হয়ে নিত্যনতুন বিদ্রোহের সূত্রপাত করবে_অচলায়তন গুঁড়িয়ে মানুষের প্রার্থিত সভ্যতার নতুন সোপান তৈরি করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারসম্পন্ন আরব বিশ্ব রাজতন্ত্রী কিংবা স্বৈরাচারী আরব বিশ্বের চেয়ে আরো বেশি ক্ষমতাধর হবে।

আমরা সেই পথের দিকেই তাকিয়ে আছি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।