আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারীর ক্ষমতায়নে জীবনযোদ্ধা একজন খাদিজা

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

নারীর ক্ষমতায়নে জীবনযোদ্ধা একজন খাদিজা “এ সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে একজন নারীকে কত যে কষ্ট সইতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। নারীর অসহায়ত্বকে যে সমাজ হেলা ভরে দেখে-তাকেই আবার মাথায় তুলে নাচে-যদি তিনি মর্যাদাপূর্ণ কোন অবস্থানে যেতে পারেন”-নিজের অতীত ও বর্তমানের অভিজ্ঞতা থেকে এমন মন্তব্যই করলেন একজন ইউপি মেম্বার খাদিজা বেগম। কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার কেগলা গ্রামের বিধবা গৃহবধূ খাদিজা। ১১ নং দোল্লাই নোয়াবপুর ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার তিনি। খাদিজা বেগম জানান ‘গৃহবধূ থেকে জনপ্রতিনিধি’ হয়ে ওঠার কথা।

নিজের কথা বলতে গিয়ে আনমনে অতীতে ফিরে যান। একটি টেক্সটাইল/স্পীনিং মিলের অন্যতম সিনিয়র ফোরম্যান পদে চাকরি করতেন খাদিজার স্বামী মোঃ ওবায়দুল্লাহ্। সামান্য জমি আর নিজের চাকরির টাকায় এক ভাই ও মা-বাবার সাথে তার নিজের সংসারও চলছিল বেশ। প্রায় হঠাত করেই ওবায়দুল্লাহর শরীরে ধরা পড়ল দুরারোগ্য ফুসফুস ক্যান্সার। কোম্পানীর পুরনো এবং অনেস্ট টেকনিক্যাল স্টাফ হিসেবে ওবায়দুল্লাহর কর্ম দক্ষতায় খুশী ছিলেন মালিক পক্ষ।

তাই চিকিতসার জন্য মিল কর্তিপক্ষ শ্রম আইনের বাইরেও বিরাট রকম আর্থীক সাহায্য করেন এবং এক পর্যায়ে চিকিতসার সমস্ত ব্যায়ভার ব্যাক্তিগত ভাবে বহন করেন ত্রয়ী মিল মালিকদের একজন মালিক। কিন্তু চিকিতসার বাইরেও অনেক খরচ আছে-যা বহন করতে ওবায়দুল্লাহর পরিবার সামান্য জমির সবটুকুই বিক্রি ও বন্ধক দিতে বাধ্য হয়। যখন শুধু ভিটেবাড়িটা বেচে দেয়া বাকি রইল-তখনি চিকিতসকদের সকল চেস্টার অবশান ঘটিয়ে বিধবা হলেন খাদিজা। একমাত্র রোজগেরে পুত্রের মৃত্যুর শোকে মারা গেলেন খাদিজার শ্বশুর এবং আরো কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেলেন তার শাশুড়ী। স্বামী যখন মারা যান তখন খাদিজার সংসারে এক মেয়ে আর দুই ছেলে।

গর্ভে চারমাসের আর একটি সন্তান। স্বামীশোকে মূহ্যমান খাদিজা অভাবে-অনটনে দিশেহারা। খাদিজার দেবরটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। সেও যেন আরেকটা শিশু। সংসারে এতগুলো মানুষের খাওয়া-পরার সংস্থান হবে কী করে!মিল মালিকদের অনুগ্রহে মিল শ্রমিক কোয়ার্টারে একবছর থাকার অনুমতি মিললো।

মিল মালিকেরা খাদিজাকে যোগ্যতানুযায়ী চাকুরী দিতে চাইলেও গর্ভবতী বলে কাজ করা সম্ভব না খাদিজার। মিল মালিকদের একজন দ্বায়িত্ব নিলেন একবছর খাদিজাকে প্রতি মাসে ১০০০ টাকা আর্থীক সাহায্য দেয়ার। অন্য দুই মালিকও মাঝে মাঝে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন-তাতে চলে যাচ্ছিল খাদিজার সংসার। কিন্তু সাহায্যের নামে ভিক্ষা/দানে এতগুলো পেট কতদিন খাওয়ানো যায়!এদিকে কতিপয় মিল শ্রমিক/শ্রমিক নেতাদের অশ্লীল ইংগিত, অনৈতিক প্রস্তাবে দিশেহারা খাদিজা। এখানে মিল মালিকপক্ষেরও খাদিজাকে রক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।

আত্মমর্যাদায় বলীয়ান খাদিজা সিদ্ধান্ত নেয় স্বামীর ভিটেমাটিতে ফিরে যাবার। আবার এগিয়ে আসেন তিনজন মিল মালিক। তিন মালিক ৪৫ হাজার এবং মিল শ্রমিক কল্যাণ সংস্থার দেয়া ৫ হাজার মোট ৫০ হাজার টাকা হাতে নিয়ে চার সন্তান এবং প্রতিবন্ধী দেবরসহ শ্বশুরবাড়িতে উঠে ভাংগা ঘরটা আগে সংস্তকার করে নিদারুণ কায়ক্লেশে সংসার চালাতে থাকলেও বাড়তি অনেক বিপত্তি দেখা দিল খাদিজার জীবনে। গ্রামীণ ব্যাকং, প্রশিকা সহ কয়েকটি এন জি ও'র ইউনিয়ন সংগঠকের কাজ করেও কিছু উপার্জনের চেস্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সমাজের চোখে খাদিজার 'দোষ'-সে এন জি ও করে গ্রামের মহিলা/তরুণীদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে! সেই সংগে তরুণী বিধবাকে এখানেও কখনো কু-প্রস্তাব, কখনোবা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে উত্যক্ত করতে থাকল গ্রামের দুস্ট "রসু খা"র দল।

কেউ কেউ খাদিজাকে বিয়েও করতে চায়। খাদিজার বাবা-মাও বিয়েতে মত দিয়েছেন। মিল মালিক কর্তিপক্ষের সাথে খাদিজা সৌজন্য যোগাযোগ রক্ষা করেন বিপদে আপদে। খাদিজার বর্তমান, ভবিষ্যত ভালো-মন্দ বুঝিয়ে “নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার একান্তই খাদিজার নিজের”-এটাই মিল মালিকের জবাব। বাডি ফিরে সবাইকে নিজের স্থির সিদ্ধান্ত জানান খাদিজা-“বিয়ে তিনি করবেন না”।

একজন মিল মালিকের বন্ধু চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের সহায়তা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানায়-খাদিজার জন্য কিছু করার জন্য। ঐ সময়ে খাদিজার ইউনিয়নে উপ-নির্বাচনের আয়োজন চলছিল। এন জি ও'র সহকর্মীরা, জেলা প্রশাসক সাহেবের পরমর্শে এবং শ্বশুরবাড়ির শুভার্থীরা ইউপি মেম্বার পদে নির্বাচনে দাঁড়াবার জন্য পরামর্শ দেন নবম শ্রেণী পাস খাদিজাকে। সবাইকে চমকে দিয়ে নির্বাচনে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন খাদিজা।

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকার যৌতুক, দাম্পত্য অমিল, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অন্যায় আচরণ প্রভৃতি নিয়ে উদ্ভূত সামাজিক সমস্যা সমাধানে কাজ করতে শুরু করেন। ৩৫/৩৬ বছরের জীবনে অনেক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন। নারী বলে অনেক প্রতিকূলতার মোকাবেলা করেছেন খাদিজা। তিনি বোঝেন-দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের দুঃখ, বিশেষ করে অসহায় নারীর দুর্দশা। তাই বিপন্ন মানুষের দুঃখে সাধ্যমত ঝাঁপিয়ে পড়েন খাদিজা।

গ্রামের, ইউনিয়নের মানুষও তাকে ভালবাসে। নারীরা তাদের সমস্যা নিয়ে খাদিজার কাছেই আসেন। তাকে বন্ধু ভাবেন। জনপ্রতিনিধি খাদিজা প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দেন নারীদের। দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ে।

‘আগামীতেও নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে তাকে, তবে এবার মেম্বার পদে নয়-চেয়ারম্যান পদে’-ভোটারদের এমনই দাবী বলে জানান খাদিজা। ইউপি মেম্বার হিসেবে খাদিজা এখন নিজের ওয়ার্ডে বিলি করেন ভিজিডি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড। সহনশীল আন্তরিক অনুভূতি দিয়ে অন্যের দুঃখ বোঝার এবং ঘোচানোর চেষ্টা করেন তিনি। সাধ্য অনুযায়ী দুস্থদের উপকার ও সহযোগিতা করেন। বঞ্চিত নারীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে মনটা তার কেমন করে ওঠে।

মানুষের কাছাকাছি গিয়ে ব্যক্তিগত দুঃখ ভুলে থাকেন। দরিদ্রের সন্তানকে স্কুলে পাঠাবার, যত্ন নেবার পরামর্শ দিতে গিয়ে আনমনা হয়ে ভাবেন-তার নিজের ছোট সন্তানটি পিতাকে চোখে দেখেনি…! বিধবা ভাতা দিতে গিয়ে, সংসারী নারীদের সমস্যা মেটাতে গিয়ে ভুলে থাকেন-নিজে অল্প বয়সে বিধবা হবার কস্ট হয়েছেন। এখন আর কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে জ্বালাতন করে না খাদিজাকে। কেউ কেউ আড়ালে-আবডালে নিন্দা করলেও ওসবে পাত্তা দেন না তিনি। তার অভিজ্ঞতা বলে জীবন অনেক বড়।

ওসব তুচ্ছ জিনিস পরোয়া করলে চলে না। আড়ালে যারা নিন্দা করে সামনে পড়লে তারাই সম্মান করে পথ ছেড়ে দেয়। খাদিজা দেখা করতে এসেছে-তার স্বামীর মালিকদের সাথে। দোয়া চায়-এবার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নয়, চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার জন্য। স্বামীর মৃত্যুর পর নয় বছর কেটে গেছে।

এরমধ্যে অনেক সংগ্রাম করে ধীরে সুস্থে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন জীবনযোদ্ধা খাদিজা। এখন তার বাচ্চারা স্কুলে যায়। রীতিমত পড়াশুনা করে। খাদিজার সন্তানদের মধ্যে মেয়েটি সবার বড়। কিছুদিন পুর্বে খাদিজা তাঁর সন্তানদের নিয়ে মিল মালিকের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন-"বড় মেয়েটি এস এস সি পরীক্ষা দিবে-স্যারের দোয়া চাই"।

প্রার্থনা-খাদিজার মেয়েটি এস এস সি পাশ করুক অনেক ভালো ফলাফল নিয়ে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। মেয়েটি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক, সমাজের সকল কুতসিত ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।