এই পথে আলো জ্বেলে, এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে
ঘর-সংসার সামলেও যে রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএর মতো জটিলতর বিষয় নিয়ে গবেষণা করা যায় তার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ। শিগগিরই হয়তো তার গড়ে তোলা গবেষণাগার হতে উপকূলের চাষীদের হাতে পৌঁছে যাবে লবণসহনশীল নতুন জাতের ধান।
এই সাক্ষাতকারটির পরিবর্তিত অংশ কালের কন্ঠের সন্ধানীতে প্রকাশিত হয়েছে।
১. আমাদের সমাজে সাধারণত স্নাতকের পরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। তারা গৃহিণী হয়ে যান।
আপনি কেন ভিন্ন পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলেন?
- প্রায়ই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে তা হয় নি। আমার পড়াশুনা করতে ভালো লাগতো। আমার বাবা ছিলেন উদ্ভিদবিদ্যার প্রফেসর। আমার পড়াশুনায় আগ্রহের তিনিও বুঝতেন।
তাই বিয়ের প্রস্তাব আসলে উনি নাকচ করে দিতেন। তিনি আমাকে অনেক সহায়তা এবং উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাছাড়া আমি যখন পড়াশুনা করছি তখন পৃথিবীতে ডিএনএ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ ইত্যাদি প্রযুক্তি তখন নতুন ছিলো। জীববিজ্ঞানের এই বিশেষ সময় এবং বাবার সহায়তার ফলে আমার পক্ষে ভিন্ন পথে হাঁটা সম্ভব হয়েছে।
২. আপনার পরিবার, চারপাশের মানুষজন কি আপনাকে উৎসাহিত করেছিলো?
- মা-বাবা বিশেষ করে উৎসাহিত করেছিলেন। উৎসাহিত করেছিলেন আমার শিক্ষকেরাও। তখন শিক্ষকতাকে অত্যন্ত সম্মানীত পেশা বলে সকলে মনে করতেন। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম তাই সকলে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
৩. আমাদের সময় এখন অনেকের সামনেই আপনি ভিন্নভাবে জীবন-জীবিকা গড়ার ক্ষেত্রে আপনি, হাসিনা আপা আদর্শ বলে বিবেচিত হন।
ভিন্নভাবে নিজের জীবিকা গড়ে তোলার জন্য আপনার সামনে কি কোন দৃষ্টান্ত ছিলো?
- সুনির্দিষ্টভাবে কেউ না। আমাদের শিক্ষকেরা খুব অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। কোন একক ব্যাক্তি প্রভাবিত করেছিলেন বলে মনে পড়ছে না।
৪. আমাদের অধিকাংশ মেয়ে স্নাতকের পরে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন না। গৃহে সময় দেন।
এটা কি আমাদের সমাজের জন্য ক্ষতি নয়?
- অবশ্যই তা একটা ক্ষতি। কিন্তু মেয়েরা যাতে কর্মজীবন গড়তে পারেন সেজন্য আমাদের সবারই সহায়তা করা উচিত। আমার এক ছাত্রী পিএইচডি করছেন। তার একটি বাচ্চা – বাসায় দেখার মতো কোন লোক পাচ্ছেন না। এ দিকে তার স্বামীও খুব ব্যাস্ত মানুষ।
সারাক্ষণই তিনি চিন্তার মধ্যে থাকেন। বিদেশে ডে-কেয়ার আছে। সেখানে পিতা-মাতারা সারা দিনের জন্য বাচ্চাদের নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিতে পারেন। বাংলাদেশে এই ধরনের ডে-কেয়ার প্রতিষ্ঠান কিন্তু নেই। মেয়েদেরকে কর্মস্থলে দূর্ভাবনাহীন সময় দেয়া নিশ্চিত করতে হলে এই ধরনের পৃষ্টপোষকতাও কিন্তু করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ডে-কেয়ার আছে। কিন্তু তারা মাত্র দুপুর তিনটা পর্যন্ত বাচ্চাদেরকে রাখতে পারে। আমার ক্ষেত্রে আমি শ্বশুরবাড়ির পূর্ণাঙ্গ সহায়তা পেয়েছি।
৫. বিয়ের পর মেয়েদের একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় কোথায় ছাড় দেব – সংসার নাকি পেশায়। আপনি এই দ্বন্দ্ব কিভাবে মোকাবেলা করেছেন?
- দুই জায়গাতেই ভারসাম্য আনা সম্ভব।
সেক্ষেত্রে নিজের আয়েশের জায়গাগুলোতে একটু ছাড় দিতেই হবে। আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকে বাচ্চার যত্ন নেয়ার পর ঘুম বাদ দিয়ে পরবর্তী দিনে ক্লাসের বক্তৃতা তৈরি করতাম।
৬. পরিবারেরর স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবী হলে সংসারেরর কাজকর্ম গুছিয়ে নেয়াটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে?
- পরিবারের সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি শ্বাশুরীর অনেক সহায়তা পেয়েছি। আমার শ্বাশুরীও শিক্ষক ছিলেন।
তবে আমার বক্তৃতার প্রস্তুতি তো আমাকেই নিতে হতো। আমি যৌথ পরিবারের মধ্যে ছিলাম তাই বাচ্চারা মায়ের আদর কম পাচ্ছে বলে আমাকে চিন্তা করতে হয় নি। সবকিছুই সম্ভব যদি দায়িত্ব আর সচেতনতাটা যদি সবার মধ্যে থাকে। আমার মনে হয়, মা যদি স্বাবলম্বী হন তাহলে বাচ্চারাও অনেক কিছু শিখতে পারে। বাচ্চারাও নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে শেখে, নিজেদের জীবনের পরিকল্পনাটাও তারাই করে।
নিজেদের দায়িত্বটা নিজেরাই নিতে শিখে। অনেক মাকে দেখি বড়ো ছেলেমেয়েদেরকে এখনো খাইয়ে দেন, এখনো নিজেরা গিয়ে স্কুল-কলেজে পৌছে দিয়ে আসেন। আমার মনে হয় এই যত্নটা বেশি বেশি। অবশ্য অভিভাবকেরাও অনেকসময় ছেলেমেয়েদেরকে একা ছেড়ে দেয়া নিরাপদ মনে করেন না। তবে স্কুলবাস, নিজেদের এলাকাতেই ভালো স্কুল ইত্যাদি সুবিধাগুলো গড়ে উঠতে হবে।
৭. এদেশে মেয়েদের জন্য উপযোগী পেশা বলতে ডাক্তার, শিক্ষকতা, ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা, এনজিও ইত্যাদি ভাবা হয়। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ অর্থাৎ মাথা খাটানোর কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের একটু অনুপযুক্ত হিসেবে ধরা হয়। এ ধারণার কি কোন ভিত্তি আছে?
- এটা একদম ভুল ধারণা। আমার ল্যাবে মেয়ে বেশি। এবং তারাই বেশি ভালো করছে।
আমার নিজের মেয়েরাও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
৮. জীববিজ্ঞানকে ভাবা হয় মেয়েদের বিষয় হিসেবে। কারণ এখানে মুখস্ত করতে হয় বেশি। অনেক সময় জীববিদ্যাকে ‘লিপস্টিক’ বিষয় হিসেবে ধরা হয়। জীববিদ্যাকে এভাবে লিঙ্গভেদ করাকে কিভাবে দেখেন?
- না।
একেবারেই না। জীববিদ্যা এখন গণিতের উপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে গেছে। জিনোম সিকুয়েন্সিং, বায়োইনফরমেটিকস ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন প্রযুক্তির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। এখন জীববিদ্যার বিভিন্ন কাজে কম্পিউটার প্রোগ্রাম, সফটওয়্যার ব্যাবহৃত হচ্ছে। সুতরাং জীববিজ্ঞান মেয়েদের কিংবা মুখস্থের বিষয় এটা একদমই ভুল ধারণা।
৯. কর্মস্থলে মেয়েরা শিক্ষক হিসেবে আমাদের সমাজে যতটা গ্রহণযোগ্য, গবেষণার ক্ষেত্রে তা একেবারেই না। গবেষণাজীবনের শুরুতে আপনার কর্মস্থলের পরিবেশ কেমন ছিলো?
- কর্মজীবনের শুরুতে আমি কাজ করেছি আমার শিক্ষকদের সাথে। সুতরাং আমার কোন সমস্যা হয় নি। সবাই খুব উৎসাহিত করতেন।
১০. আপনার গবেষণাজীবনের শুরুটা কিরকম ছিলো?
- আমি পিএইচডি করি ইংল্যান্ডের গ্ল্যাসগোউ ইউনিভার্সিটিতে।
সেখানে আমার প্রকাশনা কম ছিলো। দেশে আসার পর এ নিয়ে একটা ক্ষোভ ছিলো। তখন মনে হলো আচ্ছা এখানে আমি গবেষণা করতে পারি কিনা। তখন বিভিন্ন গবেষণা প্রস্তাব তৈরি করে আবেদন করতাম। গবেষণার জন্য গ্রান্টও এভাবে পেয়ে গেলাম।
তাছাড়া গবেষণার সময় বাবার উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের টিস্যু কালচার ল্যাবের সহায়তা পেয়েছি। আস্তে আস্তে আমার নিজের ল্যাব গড়ে উঠেছে।
১১. এখন আপনি কি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন?
- মূলত কাজ করছি লবণ সহনশীল উন্নত ধান উদ্ভাবন নিয়ে। বিরি, ইরির সাহায্যে একটি লবণসহনশীল সংকর লাইন বিরি ধান ৪৭ উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু একটি ধান যথেষ্ট না।
কারণ বাংলাদেশের উপকূলে বিভিন্ন অঞ্চলে লবণাক্ততার মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে। তাই আমাদের লবণ সহনশীল অনেকগুলো ধান দরকার। আমরা যে পদ্ধতিতে কাজ করছি তা হলো মার্কার এসিস্টেড ব্রিডিং টেকনোলজি। লবণসহনশীলতা আসলে অনেকগুলো জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ কারণে কাজটা অনেক জটিল।
লবণসহনশীল ধানের সাথে উন্নত প্রজাতির ধানের সংকরায়ণ করার পর ইতোমধ্যে বিরি সল্টল (BRII saltol) বিরিকে দেয়া হয়েছে। তারা এর উপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। এছাড়া পরিচিত জিন ব্যবহার করে আমরা ট্রান্সজেনিক ধান তৈরি করেছি। এই পরিচিত জিনের কোনটি তৈরি করতে হয়েছিলো, কোনটি বাইরে থেকে আনতে হয়েছিলো।
১২. পাটের জিনোম সিকুয়েন্স কিভাবে উন্নত পাট উদ্ভাবনে সাহায্য করতে পারে?
- দেখুন আমরা ধান নিয়ে এতো বিভিন্ন কাজ করতে পারছি তার কারণ হলো ধানের পুরো ডিএনএ সিকুয়েন্স আমাদের জানা।
এজন্য ধানের উন্নতজাত উদ্ভাবন, লবণ সহনশীল ধান, গোল্ডেন রাইস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করা এখন অনেক সহজ। এখন পাটের জিনোম যদি আমাদের জানা থাকে তাহলে তার উপর ভিত্তি করে পাটের উপর অনেক গবেষণা করা সম্ভব।
১৩. আপনার স্বপ্ন কি?
- বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের জন্য যদি কিছু লবণসহনশীল ধান দিয়ে যেতে পারি।
১৪. বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী মুক্তি কিভাবে সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
- শিক্ষা এবং সচেতনতা দরকার। সমাজের সবার মধ্যেই।
আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে সমস্যা আছে অনেক। আমরা অনেক তথ্য শিখি কিন্তু কিভাবে তা ব্যবহার করতে হবে সেই পদ্ধতিটা শিখি না। তাছাড়া আমাদের বই পরনির্ভরশীল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমাদের বিদেশী বইয়ের উপর নির্ভর করে চলতে হয়। আমরা প্রয়োগ শিখছি না, কাজে কাজে লাগানো তো দূরের কথা।
আমাদের স্কুল কলেজে হাতে কলমে শিক্ষা অনুপস্থিত। এখন হাতে কলমে শিক্ষার জন্য যে মাইক্রোস্কোপ টেস্টটিউব যুক্ত দামী ল্যাবরেটরী লাগবে এমন ধারনা কিন্তু ভুল। পুরো পৃথিবীটাই কিন্তু একটা বড় ল্যবরেটরী। পিঁপড়ে, মৌমাছি কিভাবে ঘর তৈরি করে তা থেকে কিন্তু অনেককিছু দেখার আছে। একটা পুকুরের মধ্যে কিভাবে একটা বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠে তাও একটা ব্যাবহারিক শিক্ষা হতে পারে।
চিন্তা করানো শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। উপযুক্ত শিক্ষা এবং সচেতনতা গড়ে উঠলে সমাজের অনেক কুসংস্কার, ভুল ধারণা দূর হয়ে যাবে। দেশের উন্নয়নের জন্য আমাদের শিক্ষায় কি দরকার তা নিয়ে চিন্তাভাবনা খুব কম হয়। আব্দুল্লাহ আল-মুতী স্যার কিছু চিন্তাভাবনা করে গেছেন। আমাদের ধর্মগ্রন্থকেও ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে উপস্থাপন করা হয় খুব কম। কোরআন কয়জন বুঝে পড়ে? কোরানের কোথাও কিন্তু মেয়েদেরকে ছোট করে দেখা হয় নি। কর্মস্থলে একটি মেয়ে থাকলে তার পরিবেশই বদলে যায়। পরিবেশে কোমলতা আসে। মেয়েদের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছেলেদের চাইতে বেশী।
কর্মস্থলের মধ্যে একটা ভারসাম্য আসে।
১৫. আপনার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলুন।
- আমার দুই মেয়ে দেশের বাইরে পড়াশুনা করে। আগে শ্বশুর-শ্বাশুরী সহ আমি এবং আমার স্বামী একই বাসায় থাকতাম। এখন আমরা দুইজন বাড়ির তিনতলায় এবং শ্বশুর-শ্বাশুরী নিচতলায় থাকেন।
-----------------------------------------------------------------
বিজ্ঞান ব্লগ
.................................................................................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।