আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাইরের চাপ, ভোটের হিসাব নাকি বার্ধক্যের জয়?


ভোরের কাগজ : বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট ২০১৩ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল গঠনের পর থেকে সরকার বলে আসছে যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে বাইরের কোনো চাপ নেই। এমনকি প্রায়শই এটাও বলতে শোনা গেছে এই ট্রাইবুনাল স্বাধীনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করছে এ ব্যপারে সরকারের পÿ থেকেও কোনো প্রকার চাপ বা হ¯Íÿেপ নেই। যদি না থাকে তবেই ভালো। কিন্তু অতি সম্প্রতি গোলাম আযমের বিচারের যে রায় প্রদান করা হয়েছে তাকে ঘিরে সর্বমহলে যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে এবং ইতোমধ্যেই অনেকে তাদের লেখনিতে যে বিষয়টি তুলে এনেছেন। এমনকি অনেকে সরাসরি ইঙ্গিত করে বলেছেন- মার্কিন কূটনীতিকের বাসায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এবং জামাতের প্রতিনিধিদের বৈঠকেই এই রায়ের চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হয়েছে।

যার ফলেই সকল অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও এমন একটি অপ্রত্যাশিত রায় দেওয়া হয়েছে। এটা আরো স্পষ্ট হয়েছে যখন দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ এ রায় শুনে সংÿুব্ধ, হতবাক এবং প্রতিবাদ-মুখর হয়েছেন ঠিক তখনই একে একে আইনমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের মুখপাত্র এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এই রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কষ্টটা লাগে তখনই যখন ভোটের রাজনীতি এসে আঘাত করে স্বাধীনতার চেতনায়, লাল-সবুজের পতাকায়। একদল যখন ভোটের হিসাব মিলাতে দেশের স্বাধীনতাকে কলঙ্কিত করতে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অপমান করতে, লাল-সবুজের পতাকাকে অবমূল্যায়ন করতে স্বাধীনতা বিরোধী চিহ্নিত রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে আমার ভাইয়ের রক্ত-ভেজা পতাকা উড়ানোর ব্যবস্থা করে, অন্যদিকে আরেক দল যারা স্বাধীনতার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে তারাও কম যায় না। জামায়াতে ইসলামী আমন্ত্রিত হওয়ার কারণে যে দলটি বিএনপি’র ইফতার পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়েও যায়নি, তারা ঠিকই জাতির সাথে প্রতারণা করে মার্কিন কূটনীতিকের বাসায় জামাতের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়।

কিছু জ্ঞানপাপী উপদেষ্টারা যেমন তাদের কৃতকর্মের মাধ্যমে জনমুখী এই মহাজোট সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন, এবারো উলেøখিত বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে জাতীর কাছে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। গোলাম আযমের রায়টিকে যদি আমরা একটু বিশেøষণ করি দেখব তার বিরোধ্যে উত্থাপিত পাঁচটি অভিযোগের সবক’টি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও কেবলমাত্র বয়স বিবেচনায় তাকে বিভিন্নভাগে সর্বমোট ৯০ বছরের জেলদÐ দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালত। আদালতের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছিÑ কিছুদিন আগে ঘোষিত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের ÿেত্রে আদালত খুব গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টি হাইলাইট করেছেন তাহলো, আদালতের ভাষায়, এখানে যে সাঈদীর বিচার হচ্ছে তিনি হচ্ছেন আজ থেকে ৪২ বছর আগের সাঈদী। সেই ১৯৭১ সালের দেইল্যা রাজাকারের বিচারই সেদিন করেছেন আদালত এবং তাকে মৃত্যুদÐ দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

অথচ কিছুদিনের ব্যবধানে একই ট্রাইব্যুনাল অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বার্ধ্যকের অজুহাতে রাজাকারদের শিরোমণি বলে খ্যাত গোলাম আযমকে ৯০ বছরের জেলদÐ দিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে এই রায়ের পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না? খুব সাধারণভাবে পাবলিক সেন্টিমেন্ট হলো গোলাম আযমের যদি সর্Ÿোচ্চ শা¯িÍ না হয় তাহলে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য যতো ধরনের অপকর্ম সেই সময়ে সংগঠিত হয়েছিল সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই গোলাম আযম। যেই গোলাম আযমের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে রাজাকার আলবদর আল শামস বাহিনী দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল, আমাদের মা-বোনদের নির্বিচারে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে তুলে দিয়েছিল এমনকি সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান, তাদের কর্মপরিকল্পনা পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেয়া, মুক্তিযুদ্ধাদের পরিবারকে পাকি¯Íানি সেনাদের চিনিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করতে তারা পাকি¯Íানি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছিল। স্বাধীনতার এমন প্রত্যÿ বিরোধিতাকারীদের প্রধান হোতা রাজাকার শিরোমনি মাস্টারমাইন্ড গোলাম আযমের যদি সর্বোচ্চ শা¯িÍ না হয় তবে এই বিচার নিয়ে বিতর্ক যুগ যুগ ধরে চলতেই থাকবে এবং বর্তমান ÿমতাসীন সরকার এর দায় এড়াতে পারবে না।

এই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল ছয়টি রায় প্রদান করেছে। রায়ে যথেষ্ঠ বৈচিত্র্য আছে। প্রথম রায়ে বাচ্চু রাজাকরের ফাঁসি, যদিও সে পলাতক। দ্বিতীয় রায়ে কাদের মোলøার যাবজ্জীবন। এই রায়ের পরেই জেগে উঠে তারুণ্য।

একটি অনলাইন সংগঠনের আহবানে সাড়া দিয়ে গঠিত হয় গণজাগরন মঞ্চ। একে একে দেশের সর্ব¯Íরের মানুষ তাদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও এ থেকে বাদ যায়নি। কাদের মোলøার সর্বোচ্চ শা¯িÍ ফাঁসির দাবি সেই সাথে সকল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শা¯িÍর দাবিতে রাতদিন জেগে থাকে শাহবাগের প্রজন্ম চত্ত¡র। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্র।

আন্দোলনের উদ্যোক্তা বøগারদের বিরোধ্যে আনা হয় মহানবী (সাঃ) কে কট‚ক্তি করার অভিযোগ। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বøগার রাজিবকে। তাদের বিরোধ্যে না¯িÍকতার অভিযোগ তুলে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে এই আন্দোলন সম্পর্কে একধরনের নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে ভাসান দেয় হেফাজতে ইসলাম। ভোটের হিসাব মাথায় রেখে সরকার হেফাজতকে খুশি করতে সরকার গ্রেপ্তার করে দুই/তিনজন বøগারকে। ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে প্রজন্মের উচ্ছ¡াসকে দমিয়ে দিতে ইসলামকে হেফাজতের নামে বায়তুল মোকারমের সামনে পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ানো থেকে শুরু করে যে তাÐবলীলা চালানো হলো দেশবাসী তা প্রত্যÿ করেছে।

তৃতীয় রায়ে দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরোধ্যে ফাঁসির আদেশ। চতুর্থ রায়ে কামারুজ্জামানের বিরোধ্যে ফাঁসির আদেশ। পঞ্চম রায়ে রাজাকার শিরোমণি মাস্টারমাইন্ড গোলাম আযমের বিরোধ্যে ৯০ বছরের জেলদÐ এবং সর্বশেষ ষষ্ঠ রায়ে আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় প্রদান করা হয়েছে। কাদের মোলøার রায়ের পর যখন স্বাধীনতার চেতনায় তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠেছিল এবং দেশপ্রেমিক সচেতন জনগনের চাপে সরকার বাধ্য হয়েছিল আইন সংশোধন করে দুই পÿকেই আপিলের সুযোগ করে দিতে। সেই সংশোধিত আইনের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র এবং আসামীপÿ যদি মনে করে তারা কোনো রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি তারা চাইলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে।

কিন্তু এবার যখন গোলাম আযমের রায়ে পুরো জাতি হতবাক হয়েছে তখনো সরকার আপিলের কথা না বলে বরং উল্টো সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। সরকারের এহেন আচরণ দেশপ্রেমিক মানুষকে আরো বেশি মর্মাহত করেছে। এ লেখাটি লেখা পর্যন্ত সরকার আপিল করেনি। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ৯১ বছরের কোনো বৃদ্ধকে ৯০ বছরের জেলদÐ বাঁকা চোখে দেখার সুযোগ নেই। তবে যদি মানুষটি হয় এমন কোনো মানুষ যে কিনা মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করে একটি দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে শুধু লিপ্তই থাকেননি বরং নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে।

মানুষটি যদি হয় গোলাম আযম যে কিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা না চাইলেও স্বাধীন বাংলাদেশে বীরদর্পে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে। তার ÿেত্রে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো কতোটা যৌক্তিক? যদিও বিভিন্ন মহলে একটি খবর চাউর হয়েছে যে গোলাম আযমের রায়ের ÿেত্রে ওআইসিসহ বিভিন্ন ÿমতাধর রাষ্ট্রের চাপকে সরকার অবজ্ঞা করতে পারেনি বলেই এমন অপ্রত্যাশিত একটি রায় জাতিকে দেখতে হলো। সবকিছুর পরেও সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাবো যে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে হলেও এমন একটি স্পর্শকাতর এবং ঝুঁকিপুর্ণ বিচারের কাজে নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী হাত দিয়েছে এবং ইতিমধ্যেই ছয়টি রায় ঘোষিত হয়েছে। আরো বেশ কয়েকটি মামলার বিচার প্রক্রিয়াধীন আছে। দেশবাসী প্রত্যাশা করে আগামী নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হলেও এই বিচার প্রক্রিয়াটি ব্যহত হবে না।

আরেকটি বিষয় সবারই স্মরণ রাখা উচিত ভোটের হিসাব মাথায় রেখে এই বিচারের রায় নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি করা হলে জনগণ তাদের নির্বাচনী আদালতে ব্যালটের রায়ে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করবে। কাজেই সাধু সাবধান। ভুললে চলবে না কোনো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। জনগণ চাইলেই তাদের প্রয়োজনে শাসক বদলাতে পারে।

কাজেই মুক্তিযুদ্ধের পÿের দাবিদার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ কলঙ্কিত হয়, দেশপ্রেমিক আত্মদানকারী এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত হয় নেহায়েত কিছু ভোটের হিসাব কষতে গিয়ে কিংবা বাইরের কোনো প্রভুর ভয়ে বা প্ররোচণায় গোলাম আযমের বিরুদ্ধে এমন একটি অপ্রত্যাশিত রায়কে মেনে নেবে তা অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোনো মানুষ খুব স্বাভাবিক চোখে দেখবে না। সরকারের কাছে দেশবাসীর পÿ থেকে আকুল আবেদন সরকার যেন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। গাজী মহিবুর রহমান : কলাম লেখক।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.