আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের নেগেটিভ আবেগগুলো


আমরা বাংলাদেশীরা মানুষের প্রশংসা করতে জানিনা। এতো ঢালাওভাবে হয়তো বলা ঠিকনা, কিন্তু আমাদের এতো বড় একটা অংশ এই সমস্যায় ভোগে যে মোটামুটিভাবে বলা যায় আমরা বাংলাদেশীরা মানুষের প্রশংসা করতে পারিনা। এই ব্যাপারটা আমি সবসময় খেয়াল করে এসেছি, কিন্তু এটা আরো বেশি করে আমার মাথায় এসেছে ডক্টর ইউনুসকে আওয়ামীলীগ সরকারের হেনস্থা করার পর। সারা পৃথিবীতে যদি একজন বাংলাদেশীর জন্যে মানুষ আমাদেরকে চেনে, আমাদের সুনাম করে, তবে সেই মানুষটি হচ্ছে ডক্টর ইউনুস। দুর্নীতি, দারিদ্র্য এবং ধর্মের নামে জঙ্গীপনার কারণে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের মর্যাদা খুব বেশি একটা কখনো ছিলো না, কিন্তু ডক্টর ইউনুস প্রায় এককভাবে সেই মর্যাদা অনেকটা ফিরিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশকে।

কিন্তু আওয়ামীলীগ এর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কোপানলে পড়ে সেই মানুষটিকে এতোটা হেনস্থা হতে হবে সেটা কখনো আমি ভাবিনি। তো ডক্টর ইউনুস এর সাথে বাংলাদেশের মানুষের অন্যকে প্রশংসা করতে না পারার সম্পর্ক কী? ডক্টর ইউনুসকে দিয়েই শুরু করি। এমনকি হাসিনা সরকার তাঁকে হেনস্থা শুরু করার আগেও তাঁকে নিয়ে আমরা নানারকম সমালোচনা করতাম। তাঁর নোবেল পুরষ্কারকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছি অনেকে। অনেকেই বলেছিলো নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার মতো কোনো কাজ তিনি করেন নাই, আমেরিকা এবং পুঁজিবাদী পশ্চিমা দেশগুলো ষড়যন্ত্র করে তাঁকে এই পুরষ্কার দিয়েছে।

আমরা সবসময় সবকিছু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করি, সবকিছুতে ষড়যন্ত্র দেখি। গরীব দেশগুলো থেকে কেউ নোবেল না পেলে বলি আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব ষড়যন্ত্র করে সব নোবেল নিজেরা নিয়ে যায়। আবার আমাদের কেউ পেলে বলি সেটাও একটা ষড়যন্ত্রের একটা অংশ! ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে কেউ ডানে গেলে আমরা ভাবি কেনো সে ডানে গেলো বামে যায় নাই, আবার সে বামে গেলে সাথে সাথেই ভাবি কেনো সে ডানে না যেয়ে বামে গেলো, নিশ্চয়ই তার কোনো মতলব আছে! ধরুন কেউ একটা নতুন গাড়ি কিনলো। আমাদের ততক্ষনাৎ প্রতিক্রিয়া কী হবে? মোটামুটি সবাই সাথে সাথে ভাববো "ব্যাটা অনেক দুই নাম্বারি টাকা কামাইছে, সেই অসৎ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনছে", কিংবা "গাড়ি কিনছে লোক দেখানোর জন্যে", "মানুষ ভাত খাইতে ভাত পায়না আর উনি গাড়ি কিনছেন", ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ ভদ্রলোক হয়তো কিছু টাকা জমিয়ে চলাফেরার সুবিধার জন্যে গাড়িটা কিনেছেন, এই যা।

কেউ হয়তো একটা বড়ো বেতনের চাকরি পেয়েছে, কিংবা চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছে, আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় "ব্যাটা একটা চাটুকার লোক", কিংবা "সে খুবই চাল্লু, বসদের ভাঁজ করে প্রমোশন বাগাই নিছে"। খুব কম মানুষই ভাববো সে হয়তো অনেক পরিশ্রম করে চাকুরীটা পেয়েছে কিংবা প্রমোশনটা পেয়েছে। ইদানিং আরেকটা সমালোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে কর্পোরেট কম্পানীগুলো, বিশেষ করে টেলিকম কম্পানীগুলো। কথায় কথায় ওদেরকে গালি দিয়ে আমরা কেমন যেনো একটা সুখ পাই। ওরা দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায় এমন বিজ্ঞাপন, অনুষ্ঠান করলেও ওদেরকে আমরা গালি দিই, বলি যে দেশপ্রেমের বানিজ্যিকিকরণ হচ্ছে।

আবার দেশের জন্যে কিছু না করলে বলি যে ওদের কর্পোরেট সোশাল রেস্পন্সিবিলিটি বলতে কিছু নাই। আরে ভাই, ওরা তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চ্যারিটি না। ওদের প্রধান কাজ হচ্ছে ব্যবসা, এর ফাঁকে ওরা ওদের মতো করে দেশপ্রেমমূলক বিজ্ঞাপন বানায়, অনুষ্ঠান করে এটাই বা কম কিসের? আপনার পছন্দ না হলে বলেন কিভাবে করলে আপনার পছন্দ হবে। কিংবা আপনি একটা কম্পানী বানান এবং দেখিয়ে দেন কিভাবে বিজ্ঞাপন বানাতে হবে কিংবা অনুষ্ঠান বানাতে হবে। আমাদের সমালোচনার আরেক নির্বিচার টার্গেট হচ্ছে বিনোদন জগতের মানুষজন।

বাংলাদেশে প্রায় সবাই নিয়মিত টিভি দেখে, অনেকেই সিনেমা দেখে, গান দেখে, কিন্তু আমরা প্রায় সবাই নিয়ম করে অভিনয় কিংবা গানের শিল্পীদের সম্পর্কে অনেক বাজে কথা বলি, কটুক্তি করি। "ওই নায়ক কোনো অভিনয় পারে নাকি?", "ওই নায়িকাটার স্বাস্থ্য দেখেছিশ?", "আরে ওই মেয়ে তো একটা রাস্তার মেয়ে ...", "ওই ছেলে মদ-গাঞ্জা খেয়ে বেড়ায়", "ওই মাইয়া তো খালি স্টেইজে উঠে লাফালাফি করে, ও আবার গান গাইতে জানে নাকি" ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে বাবা, আপনি যদি এতোই বিনোদন বোদ্ধা হয়ে থাকেন, আপনার কোন গুনটা আছে আমাদের বলেন এবং দয়া করে গান গেয়ে বা অভিনয় করে আমাদের বিনোদন জগতকে সমৃদ্ধ করেন। ধন্যবাদ। জাফর ইকবাল স্যার এবং অন্যরা মিলে যে গণিত অলিম্পিয়াড করে এটা নিয়ে জামাত-শিবিরের লোকজন বলে যে স্যার নাকি আসলে পলিটিক্স করছেন গণিত অলিম্পিয়াডের নামে।

গণিত অলিম্পিয়াড যে কতো গুরুত্মপূর্ণ একটা জিনিস এইটা এইসব জামাতী ব্রেইনে ঢুকার আগে পৃথিবীর মানুষ মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি ছেড়ে অন্য গ্যালাক্সির দিকে যাত্রা করবে। দেশে মাঝে মাঝে বিদেশী শিল্পীরা আসে, অনুষ্ঠান করে। এতেও আমাদের অনেকের সমস্যা। শাহরুখ খান এসেছিলো, এটা নিয়ে তো ব্লগ, ফেইসবুক, পত্রিকাজুড়ে সমালোচনার বন্যা। "দেশটা ভারতের দখলে চলে গেলো রে", "দেশের মানুষ ঠিক মতো খেতে পায়না, সেখানে এতো টাকা টিকেট কেটে অনুষ্ঠান দেখা একেবারে অনুচিত" ইত্যাদি।

আচ্ছা, বাংলাদেশের রুনা লায়লা বা জেমস যদি ভারতে বা আমেরিকা যেয়ে গান গায় তাহলে বাংলাদেশ ভারত কিংবা আমেরিকা দখল করে ফেলে? আর আমার কষ্ট করে উপার্জন করা দশ হাজার টাকা দিয়ে আমি যদি একটা অনুষ্টান দেখতে যাই, তাতে আপনার সমস্যাটা আসলে কোথায়? আপনার কি ঈর্ষা হচ্ছে আমি অনুষ্ঠান দেখছি বলে? আমাদের দেশের শতকরা চল্লিশ ভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এখান থেকে উপরে উঠতে হলে আমাদের আরো অনেকদূর যেতে হবে। আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি - আমাদের মোটামুটি একটা চলনসই গণতন্ত্র আছে, আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে, আমরা ষোল কোটি মানুষের খাবার উৎপাদন করতে পারি, দেশের বেশির ভাগ মানুষ জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করে। আমাদের উন্নতির পথে এখনো অনেকদূর যেতে হবে, কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদেরকে বিনোদন থেকে বঞ্চিত করবো কেনো? কিছুদিন আগে কোন একটা ভারতীয় শিল্পী আসলো ঢাকায়, এক বন্ধু দেখলাম সেটা নিয়ে লিখলো যে দেশে মানুষ যেহেতু এখনো লাইন দিয়ে সস্তায় চাল কিনে সেহেতু আমাদের এইসব অনুষ্ঠানে এতো টাকা টিকেট কেটে যাওয়া ঠিক না। ব্লগেও দেখি মানুষজন পোস্ট দিচ্ছে, এইসব অনুষ্ঠানে না যেয়ে একটা গরীব শিশুকে সাহায্য করতে।

এই ধরনের কথাবার্তায় আমি আসলে কোনো যুক্তি দেখিনা। আমার ধারণা এটা অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত আবেগ। একটা সুস্থ্য জীবনের জন্যে চিত্ত-বিনোদন খুবই দরকারী। আমরা যদি যারা টাকার অভাবে বিনোদন করতে পারছেনা তাদের কথা ভেবে আমাদের নিজেদের বিনোদন করা থেকে বিরত থাকি তাহলে আমাদের কর্মক্ষমতা এবং সৃষ্টিশীলতা কমে যাবে, এবং আমরাও দেশের অর্থনৈতিক অবনতিতে ভুমিকা রাখা শুরু করবো। দেশের দারিদ্য সীমার নিচের মানুষের সংখ্যা তখন আরো বেড়ে যাবে।

এইটা একটা নেগেটিভ ফিডব্যাক লুপ। একজন দূর্বল মানুষ আরেকজন দূর্বল মানুষকে সাহায্য করতে পারেনা। অন্যকে সাহায্য করতে হলে আগে নিজেকে শক্ত হতে হবে। আর আমার ধারণা যারা মানুষকে এইসব অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করে তাদের অনেকেই সুযোগ পেলে সেখানে যেতো এবং তারা নিজেরা ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশি উপকারী মানুষ হয় না। সম্প্রতি একটা লেখা পড়লাম - "যেসব মানুষের নিজের উপর শ্রদ্ধা কম তারা বেশি (কু)সংস্কারে ভোগে"।

অর্থাৎ যেসব মানুষ আসলে নিজের যোগ্যতা নিয়ে খুশি নয়, নিজের উপর নিজের খুব বেশি শ্রদ্ধা নাই, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে, তারা সাধারণত মানুষকে নিয়ে বেশি নেগেটিভ কথা বলে। অন্যের ভালো কিছু দেখলে তারা সহজে খুশি হতে পারেনা, তাদের প্রথম চিন্তাটি হয় নেগেটিভ। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে পারেনা এরা। বাংলাদেশকে উন্নত করতে হলে আমাদেরকে, বিশেষ করে তরুন সমাজকে, অনেক প্রাণশক্তির অধিকারী হতে হবে। বেশ কিছুদিন আগে "প্রাণশক্তি" নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম, যেটার কিছু কথা এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারেঃ "প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ কৌতুহলী হয়, আগ্রহী হয়, সবসময় কিছু একটা করতে চায়, যেকোনো জিনিসের ভালো দিকটা দেখে প্রথমে, নিজের ভুল/দোষ হলে সেটা স্বীকার নেয় সহজে, অন্যের সফলতা দেখে হিংসা করেনা, সবকিছুর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়ায়না, অন্যরা কী করছে সেটা না ভেবে নিজেই এগিয়ে আসে যেকোনো কাজে, ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বসে থাকেনা, এবং আশেপাশের সবার মধ্যে নিজের প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করে।

একজন সফল মানুষ আরেকজন সফল মানুষকে হিংসা করবেনা। যে ছেলেগুলো হরতাল-বিক্ষোভ এর সময় নির্বিচারে অন্যের গাড়ি ভাংগে, সেই ছেলেগুলোর প্রত্যেকের একটা করে গাড়ি থাকলে ওরা কখনো এই কাজটি করতো না। অসফল মানুষ স্বভাবতই কিছুটা হীনমন্যতাবোধে ভোগে, এবং সুযোগ পেলেই তার দুঃখ-কষ্টের কারণ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। " মানুষকে বিশ্বাস করা খুবই দরকারী একটা জিনিস। মানুষের মঙ্গল চিন্তা করা, মানুষের খুশিতে নিজে খুশি হওয়া এগুলো খুব চমৎকার ব্যাপার।

মানুষ যতোদিন থাকবে ঈর্ষা ব্যাপারটা ততোদিন থাকবে মানুষের মধ্যে, কিন্তু এটাকে একটা খারাপ বিষয় ভেবে নিজের ভেতরে মেরে ফেলতে হবে। ঈর্ষাকে শক্তিতে রুপান্তরিত করতে হবে। কেউ একটা চমৎকার ফ্ল্যাট কিনেছে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার নামে বদনাম না করে বরং ঈর্ষান্বিত হয়ে বেশি বেশি পরিশ্রম করে নিজে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলুন না। সেও সুখি তার ফ্ল্যাটে, আপনিও সুখি আপনার ফ্ল্যাটে! মানুষের প্রশংসা করলে সে প্রশংসা আপনিই ফিরে পাবেন। মানুষের সুখে আপনি সুখী হলে সে সুখ একদিন আপনিও পাবেন।

অন্যথায় ঈর্ষা, বদনাম, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ইত্যাদি নেগেটিভ ভাবাবেগ আপনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে, সুখ সোনার হরিণ হয়েই অধরা থেকে যাবে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।