আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে মাতৃভাষার বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি



প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে মাতৃভাষার বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি গোলাম কিবরিয়া পিনু প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। প্রায় সব দেশে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় বা একমাত্র ভাষার মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত দেশসমূহে বিশেষত ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানীতে প্রাথমিক স্তরে প্রথম ভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের দেশে ভাষা বিষয়ে বিভিন্নমুখী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলাভাষাকে সর্বেেত্র প্রতিষ্ঠিত না করার মানসিকতা অনেক েেত্র আমরা ল করছি।

শিক্ষা ও অন্যান্য েেত্র ভাষা বিষয়ক নীতি বারবার পরিবর্তনের ফলে জনসাধারণের মধ্যেও এ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। এরফলে প্রাথমিক শিক্ষা েেত্রও বাংলাভাষাকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া ল করা যাচ্ছে। এ এক বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। শিাকে আজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে - লাগামহীন ঘোড়ায় পরিণত করে।

আর এ ঘোড়ায় চড়ে শিশুরা কোথায় যাচ্ছে? মুনাফালোভী কায়েমী স্বার্থবাদীদের আওতায় নানামুখী ভিন্ন-ভিন্ন শিা-পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন পরিধিতে বিভিন্ন ভাবে। প্রাথমিক শিাায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে কোথাও কোথাও ইংরেজি ও আরবি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। নানা রকমের প্রাথমিক শিা বাণিজ্য ভেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। ‘ইংরেজি মাধ্যম’, ‘কিন্ডারগার্টেন’, ‘প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসা’ নামের তথাকথিত প্রাথমিক শিালয় নগরে-শহরে-বন্দরে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিতে গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগই প্রাথমিক শিার মূল দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে।

এসব শিালয়ের পাঠ্যসূচির কেনো সামঞ্জস্য নেই, নেই শিশু মনস্ততে¦র প্রতি ল রেখে শিা । এসব তথাকথিত শিালয়ে বাংলাভাষাকে অনেকাংশে অবজ্ঞা আর অবহেলায় টেনে নিয়ে এক কোণায় রাখা হচ্ছে। শিাার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এক উদ্ভট পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী আমাদের অবৈজ্ঞানিক এবং অযুক্তিপূর্ণ মন-মানসিকতা। ভাষাবিজ্ঞানী, শিাাবিদ ও শরীর-বিজ্ঞানীরা বহু পরীা করে অভিমত দিয়েছেন যেÑ প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষাই শিাার একমাত্র বাহন হওয়া উচিত।

জাতিসংঘের ইউনেস্কোর প থেকে প্রাথমিক শিাার ওপর অনেক গবেষণা ও সমীা করা হয়েছে। ্এসব গবেষণা ও সমীায় প্রাথমিক স্তরে একটি মাত্র ভাষায় শিাাদানের নির্দেশনা রয়েছে। ‘প্লানিং ইন দ্য প্রাইমারি স্কুল কারিকুলাম’ গ্রন্থে মাতৃভাষায় শিাাদান যুক্তিযুক্ত বলা হয়েছে। ইংল্যান্ডের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞানের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. ডি এ উইলকিনস, ভাষা সম্পর্কিত বহু গবেষণা গ্রন্থের লেখক ড. ফ্রাংক গ্রিটনার, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক জি বি ক্যারোল, জার্মানীর ইংরেজি ভাষার শিক পিটার ডয়ী, ভারতের ভাষা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক পট্রনায়ক প্রমুখ প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন দ্বিতীয় কোনো ভাষা শিার পে যুক্তি দেন নি। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তÍত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্টাফ ডরনিক, ভাষাবিদ জে পপারসন প্রমুখ বলেছেনÑ প্রাথমিক স্তরে দু’টি ভাষায় শিা শিশুকে নি¤œমানের শিার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, শিশুর স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, উপলব্ধির মতা কমিয়ে দেয়, শব্দ ভাণ্ডারের ওপর দখল বাড়ায় না, শিশুর বিকাশের পথ বাধাগ্রস্ত হয়।

প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা শেখালে শিশুর অন্যান্য বিষয়ে শিাার মতা ও দতা হ্রাস পায়। শরীর-বিজ্ঞানীরাও তাঁদের গবেষণালব্ধ অভিমত দিয়ে বলেছেন যে, প্রাথমিক স্তরে শিাার বাহন একমাত্র মাতৃভাষা হওয়া উচিত। তাঁরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, শিাার ওপর ¯œায়ুতন্ত্রের সম্পূর্ণ আধিপত্য থাকে। ¯œায়ুজগৎ ছাড়া ভাষা শিা অসম্ভব। ¯œায়ুতন্ত্রের এলাকাগুলো খুব প্রণালীবদ্ধ, একের সঙ্গে অন্য পরস্পর জড়িত।

মানব শিশুর শিায় যদি এ প্রণালী নষ্ট হয়, তবে তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শিশু ভাষা শেখে পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে। শিশুর পরিবেশে থাকে স্বাভাবিকভাবে তার মাতৃভাষা। মা ও পরিবারের অন্যান্যরা শিশুদের আদর করে, কথা বলে, ঘুম পাড়ায়, এটা-ওটা চিনিয়ে দেয় মাতৃভাষায়। মানব শিশুর কান দিয়ে শোনার এলাকা ও কথা বলার এলাকা খুবই কাছাকাছি।

মাতৃভাষায় পরিচিত ধ্বনিরাশি সংজ্ঞাবহতন্ত্র দিয়ে শ্রবণনিয়ন্ত্রণ এলাকা হয়ে কথা বলার এলাকায় অনায়াসে মুদ্রিত হয়। শিশু শুনে, বোঝে ও বলে ভাব প্রকাশের দতা অর্জন করে। এভাবে ¯œায়ুতন্ত্রের সাথে মাতৃভাষাগত পরিবেশের সম্পর্ক রয়েছে। ভিন্ন ভাষা চাপিয়ে দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর শিা শুধু বাধাপ্রাপÍ হয় না, শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশও বিলম্বিত হতে পারে। আমরা আমাদের প্রিয় শিশুদের শিার নামে শিাপ্রতিষ্ঠানে দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষার মূল ছায়া থেকে ভিন্ন ভাষার চোরা¯্রােতে ভাসিয়ে দিতে চাই না, যা নৈতিক দিক থেকে শিামূলক মনোভঙ্গির পরিপূরক নয়।

সীমিত সংখ্যক উচ্চাভিলাষী পরিবার বা লোকদের স্বার্থে সমগ্র দেশের পুরো শিাাব্যবস্থার ওপর অপ্রয়োজনীয় ও যুক্তিহীন চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এদের উচ্চাকাক্সা মেটানোর জন্য প্রাথমিক শিাস্তরের সকল শিশুদের ওপর ইংরেজি বা আরবি চাপিয়ে দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। মাধ্যমিক স্তরের আগ পর্যন্ত মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন ভাষা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভিন্ন ভাষা অন্যস্তরে বা অন্যভাবে শেখা যেতে পারে। মাতৃভাষার শিা সাবলীল হলে অন্য ভাষা ভালো করে আয়ত্বে আনা সম্ভব।

অন্য ভাষা শিখবার আগে মাতৃভাষায় প্রয়োজনীয় দতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করার বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিা অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও মাতৃভাষায় আরো উন্নত করতে হবে। নিররতা দূরীকরণ ও প্রাথমিক পর্যায়ে শিাার আলো থেকে বঞ্চিত ল-কোটি শিশুকে শিাার আওতায় নিয়ে আসার জন্য মাতৃভাষার বিপরীতে অন্য ভাষা অবলম্বন কোনোক্রমেই যুক্তিযুক্ত নয়। এতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হবে। কিছু লোক আছেন, যারা ভাবেন যে, ইংরেজি ভাষার দতার অভাবেই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।

কিন্তু প্রায় দুইশত বৎসর ইংরেজি শেখা-বলা-লেখার শতচেষ্টা করেও আমরা এখনো অন্যান্য দেশের তুলনায় শুধু শিার েেত্র নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নয়নের পিছনের সারিতেই রয়েছি। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অনেক ব্যবস্থাই উন্নয়ন প্রয়োজন। ইংরেজি শিাার মান নিচু হয়ে গেছে বলে অনেকে কাতরান! কিন্তু তারা কি জানেন না যে, শুধু ইংরেজি কেন, মাতৃভাষার মান কি শিা েেত্র বেড়েছে? অথবা শিাার সামগ্রিক মান কি আমরা এখনো উন্নত পর্যায়ে কাক্সিতভাবে নিয়ে আসতে পেরেছি? শিাসংক্রান্ত বহু সমস্যা এখনো অনেকেেত্র আমরা দূর করতে পারি নি। ইংরেজি ভাষায় অজ্ঞ থেকেও চীন ও জাপান আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ শিল্প-বাণিজ্যে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। সর্বাধুনিক কম্পিউটার, জৈবপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে চীনা ও জাপানীরা বিদেশি ভাষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থেকেছে।

সেখানে প্রয়োজনে অনুবাদব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। জাপানি ও চীনা ভাষার ধারণশক্তি বাংলা ভাষার চেয়ে বেশি নয়। বাংলা ভাষার শক্তি অনেক উন্নত ভাষার চেয়েও বেশি। কিন্তু তা আমরা ভুলে যাই! আরও ভুলে যাই যেÑ বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের বাঙালিত্ব, জাতীয় স্বত্ত্বা, মুক্তিযুদ্ধের দর্শনগত অবস্থান ও ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার। উন্নত দেশ চীন, জাপানের উদাহরণ শুধু না দিয়ে আরো উদাহরণ যোগ করি; যেসব দেশ আমাদের মতই অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ ছিল।

থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, হংকং, ইন্দোনেশিয়াÑ কয়েক বছরে বেশ উন্নত হয়েছেÑ আমাদের দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। এসব দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমেই নিররতা দূর করা হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাসহ অন্যান্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু তারা ইংরেজি বা ভিনদেশি ভাষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উন্নতি করে নি। তবে আমরা কেন ভাষা বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে উন্নয়নের অন্যান্য শর্ত পূরণ না করে বাংলাভাষাকে দূরে ঠেলে রেখে - ইংরেজি জানা কিছু লোকের ইচ্ছেপূরণের দাবিতে - ভিনদেশি চশমা পরে ভাববো - ইংরেজি ছাড়া আমাদের ভবিষ্যত ধুলোমাখা ও বিবর্ণ! ইংরেজি ভাষায় খানিকটা ব্যুৎপত্তি লাভ করা মানেই শিতি হওয়া নয়। আর সকল শিতি মানুষকে ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে - এ ধরনের উন্নাসিক মানসিকতা সমর্থন করা যায় না।

শিার সকল স্তরে ইংরেজি চাপিয়ে দিয়ে ছাত্রদের শিার মূলভিত্তিতে সম্পর্কিত না করে শুধুই বিব্রত করার কোনো যুক্তি নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেছেন : ‘ আমি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষার পথ দিয়েই শিখেছিলাম ভূগোল, ইতিহাস, গণিত, কিছু পরিমাণ প্রাকৃত বিজ্ঞান, আর সেই ব্যাকরণ যার অনুশাসনে বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার আভিজাত্যের অনুকরণে সাধুভাষার কৌলিন্য ঘোষণা করত। এই শিার আদর্শ ও পরিমাণ বিদ্যা হিসেবে তখনকার ম্যাট্রিকের চেয়ে কম দরের ছিল না। আমার বারো বৎসর বয়স পর্যন্ত ইংরেজি-বর্জিত এই শিাাই চলেছিল। তার পরে ইংরেজি-বিদ্যালয়ে প্রবেশের অনতিকাল পরেই আমি ইস্কুল-মাস্টারের শাসন হতে উর্দ্ধশ্বাসে পলাতক।

এর ফলে শিশুকালেই বাংলা ভাষার ভাণ্ডারে আমার প্রবেশ ছিল অবারিত। সে ভাণ্ডারে উপকরণ যত সামান্যই থাক, শিশুমনের পোষণের ও তোষণের পে যথেষ্ট ছিল। ’ আমাদের শিশুদের শিতি করার ল্েয শিাার প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষা-বাংলার মাধ্যমেই শিার সুযোগ অবারিত করা প্রয়োজন। মাতৃভাষা-বাংলার মাধ্যমেই মানবিক-নৈতিক-বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বাধামুক্ত পথ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করতে হবে, সেই উজ্জ্বলতায় শিশুরা হয়ে উঠবে একেকজন আলোকিত মানুষ। আর এই আলোকিত মানুষেরা কখনো মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করবে না, অবজ্ঞা করবে না দেশ ও দেশের ভবিষ্যতকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.