আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোধূলির শেষে



লাঞ্চ আওয়ারে অফিসের বাইরে গিয়েছিল অমিত। ফিরে এসে ওর রূমে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে টেবিলের ওপর নীল খামটি। খামের ওপরে ওর ঠিকানাটি চোখে পড়তেই অমিতের হৃদয় নিজের অজান্তে দুলে ওঠে। মনে মনে ভাবে এতদিন পর আবার তাকে চিঠি লিখেছে নীলা। কিন্তু কেন? সেদিনের পর থেকে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে, নীলা আর কোন রকমে যোগাযোগ করেনি।

তাহলে? নীলা ভাল আছে তো? অনেকগুলো প্রশ্ন মনে নিয়ে, নীল খামটি খোলে অমিত তারপর পড়তে শুরু করে। অমিত, অনেকদিন পর আবার তোমাকে লিখতে বসেছি। জানিনা আমার লেখা পেয়ে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হবে, ভাল লাগবে নাকি, রাগ হবে, নাকি কষ্ট পাবে। তারপরও খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, তুমি কেমন আছ অমিত? আমার কথা কি তোমার মনে পড়ে? মনে পড়ে প্রথম দেখার সেই মাহেন্দ্র ক্ষণটির কথা কিংবা চোখের জলে যেদিন বিদায় নিয়েছিলাম তোমার সামনে থেকে সেদিনের কথা। তারপর থেকে প্রতিটি মুহুর্ত যুদ্ধ করেছি নিজের সঙ্গে, ভূলে যেতে চেয়েছি তোমাকে।

কিন্তু পেরেছি কি? মানুষের মন যে পৃথিবীতে সব থেকে জটিল। নিজের মনকেই বোঝা সব থেকে কঠিন কাজ। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি। যা আমার নয়, কখনো ছিল না, তার জন্য, কেন এত কষ্ট পাওয়া, কেন এত চোখের জল ফেলা। তবুও ---- ব্যর্থ হয়েছে আমার নিরন্তরের প্রয়াস।

তোমার কি মনে পড়ে অমিত প্রথম দেখার সেই মুহুর্তটির কথা। এক কবিতা পাঠের আসরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। আমি লাল পাড় আর আঁচলের সাদা তাঁতের শাড়ী পরেছিলাম। সঙ্গে লাল বাউজ আর কপালে লাল টিপ। তুমি দর্শকদের সামনের সারিতে বসেছিলে কবিতা পাঠের আসর শেষে তুমি সামনে এসে দাড়িয়েছিলে, বলেছিলে, আপনার কবিতা ভারী ভালো লেগেছে।

কণ্ঠস্বর আর পড়ার ভঙ্গীটিও ভারী চমৎকার। তারপর হেসে বলেছিলেন, তার চেয়েও ভাল লেগেছে আপনার সূচী-স্নিগ্ধ এই শুভ্র সাজ। সত্যি চমৎকার ---। আমি লজ্জা পেয়ে তোমাকে রক্তিম মুখে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলাম। এরপরে দেখা হয়েছিল বই মেলায়।

এক বইয়ের স্টলে। কেন যেন তুমি আমাকে দেখে খুব উচ্ছসিত হয়েছিলে। বলেছিলে, আরে, আপনি --- জানেন, আপনাকে আমি প্রতিটি কবিতা আসরেই খুঁজেছি। তোমার চোখে চোখ রেখে শুধিয়েছিলাম, কেন? তুমি হেসে ফেলেছিলে। সেদিন বই মেলায় দু’জনে হেঁটে, হেঁটে অনেক কথা বলেছিলাম।

বিদায় নেবার সময় তোমার ফোন নাম্বার আর অফিসের ঠিকানা চেয়ে নিয়েছিলাম আমি। তারপর থেকে আমিই মাঝে, মাঝে ফোন করতাম। তুমি উচ্ছসিত হয়ে উঠতে। কিন্তু কোন দিনই নিজে ফোন করতেনা। যখন মনটা তোমার জন্য খুব ব্যাকুল হয়ে উঠতো তখন তোমার অফিসে গিয়ে দেখা করতাম।

তোমার চোখে, মুখে আমি আলোর দীপ্তি ফুটে উঠতে দেখতাম। ভাবতাম, আমাকেও তোমার হয়তো ভাললাগে। কিন্তু কোন দিনও তুমি সে ভাললাগার কথা বলতে না। অবশেষে আমি তোমাকে চিঠি লিখে আমার ভাললাগার কথা তোমাকে জানিয়েছিলাম। তুমি চিঠি পেয়েই আমাকে ফোন করেছিলে, বলেছিলে, নীলা তোমার চিঠিটা পেলাম।

এত সুন্দর একটি চিঠি, মনে হয় বাঁধিয়ে রাখি। কিন্তু --- কিন্তু কি? প্রশ্ন করেছিলাম। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। তুমি কি দেখা করতে পারবে? আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বলেছিলাম নিশ্চই পারবো। কখন, কোথায় বলো।

এক ক্যাফেটেরিয়ায় বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আমি। শীতের শেষ। বসন্তের আগমনে সারা প্রকৃতি তখন সেজেছে নতুন সাজে। আমিও সেজেছিলাম বাসন্তি সাজে। লাল পাড় আর লাল আঁচলের বাসন্তি রংয়ের জামদানি শাড়ী পরেছিলাম।

কপালে লাল টিপ। কিছুক্ষণ পরে তুমি এলে। মুখোমুখি বসে কফির অর্ডার দিলে। তোমাকে খুব আনমনা লাগছিল। নিঃশব্দে কফি শেষ করে বললে, চল।

হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। পাকা পথ ধরে দু’জনে নিরবে হাঁটছিলাম। নিরবতা ভেঙ্গে আমি ডাকলাম, অমিত --- কিছু বলছোনা যে? কই আমাকে তো একবার তাকিয়ে দেখলে না। বললেও না, আমাকে কেমন লাগছে? মান কণ্ঠে বললে, যে দেখায় কষ্ট বাড়ে, তা না দেখাই ভালো। কেন একথা বলছো? দেখ নীলা, আমি এতদিন বলিনি।

ভেবেছিলাম তোমার এটা ক্ষনিকের ভাললাগা, তুমি একদিন সব ভূলে যাবে। যার কারণে আমি তোমাকে উপেক্ষা না করলেও গ্রহণ করার আগ্রহও দেখাইনি। কিন্তু দিনে দিনে তুমি যেভাবে -- নীলা, আমার জীবনে একজনের অবস্থান খুবই সুদৃঢ়, যার জন্য তোমাকে ভাললাগলেও ভালবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নীলা, তুমি আমায় ক্ষমা করো। ততক্ষণে চিবুক বেয়ে আমার জলের ধারা নেমেছে।

তোমার ওপর আমার রাগ অভিমান অভিযোগ কিছুই ছিল না কারণ তুমি আমাকে কখনো ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ করনি। মানুষের মন কখন, কোথায় আর কেন যে, কারো কাছে বাধা পড়ে কেউ বলতে পারে না। একজন মানুষ যখন আর একজন মানুষের মনের কাছে আসে তখন নিঃশব্দেই আসে। ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে, জরীর পোশাকে সেজে, ড্রাম বাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে সেই আসা ঘোষিত হয় না। শিউলী ফুল ঝরে পড়ার মত নিঃশব্দে ঝরে পড়ে মনের মধ্যে।

আর সেই ঝরে পড়া আটকায় কার সাধ্যি। তাই তো তুমি না চাইলেও আমি পারিনি তোমার দিক থেকে নিজেকে ফেরাতে। চোখে জল নিয়ে সেদিন বিদায় নিয়েছিলাম আমি। তারপর থেকে তোমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করিনি। কিন্তু তাই বলে কি ভূলতে পেরেছি।

নাকি তুমি আমার অনেক দূরের হয়ে গেছ। অমিত, দুরত্ব অবস্থানের হয়তো হয় কিন্তু হৃদয়ে যার বাস তাকে তো দূরে সরিয়ে রাখা যায়না। সে যে আত্মার সঙ্গে মিশে থাকে। আর সেই পাওয়াই তো আসল পাওয়া। তুমি বলেছিলে, ভাল থাকা আর ভাললাগার পথ দুটো সম্পূর্ন আলাদা।

এই দুটো পথের মাঝে একটিকে সব সময় বেছে নিতে হয়। আমিও তাই নিয়েছি। আমি ভাল থাকার পথটি বেছে নিয়ে তোমাকে সুখি দেখতে চেয়েছি। ভাল থেক অমিত। সারাজীবন -----।

নীলা পড়া শেষ করে। নীল খামে লেখা চিঠিটা স্তব্ধ হয়ে ধরে থাকে অমিত। সত্যি, দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলেই কি রাখা যায়। এটাও যে এক ধরণের কাছে আসা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।