আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্রষ্টা ও মানব সৃষ্টির আদি কথাঃ ‘এলিট সেন্স’ মানবতার সবচে বড় শত্রু

দিন বদলের সময় এখন

স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীতে বসবাসের জন্য প্রেরণ করেন। পৃথিবীতে প্রেরণের প্রাক্কালে এমন একটি মহান শিক্ষা মানুষকে দিয়ে দেয়া হল, যা মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের তাবৎ সত্যকে মূর্ত্য ভাবে বুঝার জন্য আজীবন পাথেয় হয়ে আছে। অথচ মানুষ তার নিজের অস্তিত্বের প্রারম্ভিক এ জ্ঞান থেকে দূরে সরে এসে বার বার মহাভ্রমে নিপতিত হয়ে হয়ে যায়। মহাবিশ্বের বিস্ময়কর বিশাল সৃষ্টিরাজির মাঝে সৌরজগতের ক্ষুদ্র একটি গ্রহে সে অতি নগণ্য সময়ের জন্য অবস্হান করতে আসে। সাথে থাকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগ-শোক, ক্লান্তি-নিদ্রা, আলো-অন্ধকার, শীত-তাপ, মাধ্যাকর্ষণ, দূর্ঘটণা, বিরূপ প্রকৃতি, মৃত্যু- আরো কতো দূর্বলতা ও অমোঘ পরিণতি।

তবু কেন জানি মানুষ পৃথিবীতে নিজেকে সর্বদা চিরস্হায়ী ভাবতে চায়! পাশাপাশি সে নিজেকে অপরের চেয়ে শক্তিমান, বুদ্ধিমান, ক্ষমতাবান, মর্যাদাবান, ঐশ্বর্যবান ও বিত্তবান ভাবতে চায়। এসবের কিছুটা অর্জন বা যোগান তার জীবন কালে পেয়ে গেলে এবং তা পারিপার্শ্বিক অন্যদের চেয়ে অনেক বেশী মাত্রায় হয়ে পড়লে সে অবস্হায় তার শ্রেষ্ঠত্ববোধ বা ‘এলিট সেন্স' এতোটাই বেপরোয়া হয়ে যায় যে, অনেকে এরূপ অবস্হানে এসে নিজেকে অন্যদের ভাগ্য নিয়ন্তা বা ঈশ্বরের আসনে আসীন হবার দাবীদার বনে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ ঘটণাও দেখা যায়, ধরণীর বুকে এ আপেক্ষিক ক্ষণস্হায়ী অবস্হানে থেকে মানুষ নিজে স্বর্গ তৈরী করে ফেলা এবং ঈশ্বরের আসনে বসে যাবার দাবীদার হয়ে যাওয়া। তাদের অনুসারীর সংখ্যা ও আবার একেবারে কম নয়। তাদের এরূপ অস্বাভাবিক শ্রেষ্ঠত্ব বোধ বা ‘এলিট সেন্স’ অন্যান্য মানুষের উপর ভাগ্য নিয়ন্তার কর্তৃত্বের খড়গ চালিয়ে যুগে যুগে যেমন মানবতাকে নিষ্ঠুর উপহাস ও ধ্বংসের করুণ চিত্র এঁকে গেছে; অপরদিকে প্রকৃতি বিরোধী এ ভ্রান্ত উন্মাদনার জন্য তাদের বিভৎস অধঃপতন ও জঘণ্য পরিণতি তেমনি ভাবে ইতিহাসের চোঁখে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে গেছে যে, আসলে তারা ছিল বিভ্রান্ত ও বিকৃত মস্তিষ্কের দানব এবং তাদের মাঝে জন্ম নেয়া সে এলিট সেন্সটি-ই হলো মানবতার সবচে বড় শত্রু।

পৃথিবীতে প্রেরণের পূর্বেই স্রষ্টা প্রথম মানব আদম-কে সৃষ্টি করলেন মাটি দ্বারা। আদম সৃষ্টির আগেই স্রষ্টার হুকুম তামিলের জন্য তিঁনি তাঁর সবচে অনুগত ফেরেশতাগণকে সৃষ্টি করেন নূর বা আলো দ্বারা। জ্ঞানের দিক থেকে ফেরেশগণ বরাবর ইতিবাচক চেতণার অধিকারী। সৌরজগত সৃষ্টির পর স্রষ্টার মহা পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের বসবাসের উপযোগী করে পৃথিবীকে সাজাতে অনেকগুলো পর্যায়ে পরীক্ষা ণিরীক্ষা করা হয়। কারন, সৃষ্টির শুরুর দিকে ভূ-ভাগ অতি তেজষ্ক্রীয় ও সজীব প্রান সঞ্চালনের অনুপযোগী ছিল।

পর্যায়ক্রমে তা উদ্ভিদ ও সংবেদনশীল প্রাণীর বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ পর্যায়ে স্রষ্টা অপেক্ষাকৃত দূর্বল নূর হতে সৃষ্ট জ্বিন জাতিকে পৃথিবীতে বসবাসের জন্য পাঠান। জ্বিনরা নূর হতে সৃষ্ট বিধায় জড় প্রকৃতি ও মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব হতে অনেকটা মুক্ত এবং বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের প্রায় সর্বত্র তারা বিচরণক্ষম। আনুগত্যের মাপকাঠিতে জ্বিন জাতির নেতৃস্হানীয় হয়ে উঠা আজাযিল স্রষ্টার বিশেষ অনুকম্পা লাভ করেন এবং একসময় স্রষ্টা তাকে ফেরেস্তাদের সর্দার মনোণীত করেন। এখানে স্রষ্টা আর সৃষ্টির ক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার যে, মহাবিশ্বে স্রষ্টাই একমাত্র আদি অস্তিত্ব ও অবিনশ্বর সত্ত্বা; আর সৃষ্ট সকল বিষয় বা বস্তুই বিবর্তিত ও নশ্বর।

সৃষ্ট সব কিছুই ধ্বংসমূখী। স্রষ্টার সৃষ্টিমালায় দুটো ভাগ। সৃষ্ট প্রথম অস্তিত্ব হলো জড়সত্ত্বা তারপর জড়বস্তু থেকে বের করে আনা জীবসত্ত্বা। সৃষ্টিমালায় এ দুটো অস্তিত্বে বিদ্যমান দুপ্রকার শক্তি- জড়শক্তি ও জীবশক্তি। আলোক শক্তি, তাপ শক্তি, শব্দ শক্তি, আণবিক শক্তি, মহাকর্ষ বা মধ্যাকর্ষ শক্তি, রাসায়নিক শক্তি ইত্যাদি হলো জড় শক্তি।

জীবিত ও মৃতের মাঝে পার্থক্য নির্দেশক যে শক্তির অস্তিত্ব তাই হলো জীবন। জটিল জড় যৌগিক কাঠামোয় স্বয়ংক্রিয় জীবনের অস্তিত্ব আনয়ণ করে যে বিষয়টি- উহকে আমরা জীবশক্তি বলতে পারি। কিন্তু জীবশক্তির মাঝে যে স্বয়ংক্রিয়, সতেজ, সৌম্য ও স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়, উহার পেছনে ক্রিয়াশীল অদৃশ্য কিন্তু উপলব্ধির সূক্ষ্ম বিষয়টি হলো ইচ্ছাশক্তি। এ ইচ্ছাশক্তি আবার দুরকমঃ স্রষ্টার ইচ্ছা বা মহা ইচ্ছাশক্তি ও সৃষ্ট জীবের ইচ্ছাশক্তি। স্রষ্টা বা মহা শক্তির ইচ্ছা করা মাত্রই কোন কিছু সৃষ্টি হয়ে যাওয়া সম্ভব।

কিন্তু সৃষ্ট জীবের পক্ষে কোন কিছু নতুন সৃষ্টি করা কোন জ্ঞানেই সম্ভবপর নয়। শুধুমাত্র অস্তিত্বশীল কোন সৃষ্ট বস্তু বা বস্তু সমূহ দ্বারা একইরূপ বা ভিন্নরূপ অন্য বস্তু বা শক্তিতে রূপান্তর সম্ভব। স্রষ্টা পৃথিবীতে মানুষকে ইচ্ছাশক্তির সীমিত ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। জ্ঞান, বিশ্বাস আর প্রয়োজনের আবর্তে জীবনকে গতিময় করে দিয়েছেন। স্রষ্টার দেয়া এতটুকু সীমিত জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হয়েই মানুষ জগৎ সংসারে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন করে চলেছে।

স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য অনুধাবনে ব্রতী হয়ে ধারাবাহিক জ্ঞান চর্চ্চা মানুষকে অগ্রগতির সোপানে পৌঁছে দেয়। মানুষ তার দৃষ্টি সীমায় দাঁড়িয়ে জ্ঞান ও বিশ্বাসের উপর ভর করে সুদূর অতীত ও ভবিষ্যতকে সঠিকভাবে দেখার প্রয়াস পায়। নিজের প্রয়োজন গুলোকে মেটানোর ক্ষেত্রেও তার সক্রিয় ইচ্ছাশক্তিকে জ্ঞান ও বিশ্বাস প্রসূত বিচারশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ পণ্থার ব্যতিক্রম হলেই বিভ্রান্তির গহ্বরে পতিত হতে হয়। স্রষ্টার মহাজ্ঞান প্রসূত মহা ইচ্ছাশক্তিই কেবল সৃষ্ট জড় বস্তু বা জড়শক্তি গুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এতো সুন্দর, সুবিণ্যাসিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে মহাবিশ্বে অস্তিত্বশীল ও গতিশীল রাখতে পারে।

বস্তুর অণু পরমাণু থেকে শুরু করে সৌর জগৎ,গ্যালাক্সীর কোথাও কোন কণিকা অথবা গ্রহ নক্ষত্রের কারো গতি,প্রকৃতি,সময় বা বৈশিষ্ট্যের সামান্য বিচ্যূতি নেই। সামান্যতম হেরফের হলেই মহা প্রলয় অণিবার্য। প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টা শ্বাশত অর্থাৎ তিঁনি আদি অন্ত বা সময়ের হিসাবের ঊর্ধ্বে। সময় প্রযোজ্য হয় কেবল কোন কিছু সৃষ্টির শুরু থেকে। আর সকল কিছুরই সৃষ্টি স্রষ্টার দ্বারা।

কোনকিছু সৃষ্টির আগে তিনি পরিকল্পনা করেন। তারপর তা অস্তিত্বে আনেন অর্থাৎ সৃষ্টি করেন;বিবর্তন,রূপাণ্তর বা বর্ধিত করেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করেন। পৃথিবীতে আামাদের অর্জিত আপেক্ষিক জ্ঞানে এভাবে বলতে পারি,সৃষ্টির শুরুতে তিঁনি জড়শক্তিকে ইচ্ছাশক্তির বাঁধণে ভড়যুক্ত করে প্রথমে পরমাণুকে অস্তিত্বে আনেন। পরমাণুর কেন্দ্রে আদি ভরযুক্ত নিউট্রন ও প্রোটন কণিকাগুলো জড়াজরি করে থাকে এবং ইলেকট্রন কণিকাগুলো উহাদের চারদিকে ঘুরতে থাকে। এখান থেকেই শুরু হলো আদি ভর এবং গতি বা সময়ের অস্তিত্ব।

তারপর একাধিক পরমাণু মিলিয়ে তৈরী করেন অণু আর এ অণু পরমাণুর মহা জ্ঞানময় গাণিতিক বিণ্যাসে সৃষ্টি করেন জগতের বৈচিত্রময় তাবৎ বস্তুরাজি। সৃষ্টিতে আনা সকল জড়শক্তিই আসলে কম্পন বিশেষ। মহা ইচ্ছাশক্তিবলে তা প্রচ্চাপণ দ্বারা ঘণীভূত করে ভরযুক্ত করা হয়েছে বিধায় সৃষ্ট বস্তুর মাঝের অন্তর্ণিহিত জড়শক্তি বস্তুর অস্তিত্ব বিলীণ করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে মুক্তি পেতে চায়। এ পৃথিবী চিরস্হায়ী করে সৃষ্টি করা হয়নি বলে অর্থাৎ সৃষ্টির পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা দূর্বল করে সকল কিছুই সৃষ্ট বিধায় এখানে বস্তুকে ভেংগে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। তবে পৃথিবী ও মানবকূল তথা মানব কল্যাণে সৃষ্ট বস্তুরাজি স্রষ্টার মহা পরিকল্পণায় যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, উহার ব্যত্যয় বা অনাচার প্রশান্ত প্রকৃতিকে অশান্ত করবে এবং অনিয়ন্ত্রণযোগ্য জটিলতার উদ্ভব হয়ে মানুষ বা জীবকুলের জন্য ক্ষতিকর হবে।

অপরদিকে জীবশক্তিও এক প্রকার ভিন্নমাত্রিক কম্পন বা স্পন্দন বা চেতণা বলেই ধারণা করা যায়। একটি জীবিত মানুষ ও একটি সদ্য মৃত মানুষের দেহ পাশাপাশি রেখে দুয়ের পার্থক্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দুয়ের দৃশ্যমান অস্তিত্ব একই রকম। শুধু মৃতে উপস্হিত নেই জীবনের স্পন্দন। যে স্পন্দন বা স্টিমুলেশন উপস্হিত থাকলে দেহের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল থাকতো। তা কেবল মাত্র স্রষ্টার কাছ থেকেই প্রবিষ্ট হতে পারে।

জড় অণু, বস্তু বা বস্তুরাজির সাথে জড় অণু, বস্তু বা বস্তুরাজির যে পারস্পরিক আকর্ষণ শক্তি কাজ করে তা আণবিক শক্তি, চৌম্বক শক্তি, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, মহাকর্ষ শক্তি ইত্যাদি রূপে আমরা জানি। ঠিক তেমনি জীবের সাথে জীবের যে আকর্ষণ শক্তি তা ভালবাসা, অণুরাগ, স্নেহ, মায়া, মমতা ইত্যাদি ভিন্নমাত্রিক বোধ বা সেন্স সম্পর্কেও আমরা ভালোভাবেই জ্ঞাত। আবার জড় দেহ নির্ভর জীবনের কারনে অর্থাৎ জীবদেহে জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে জীবের মাঝে জড় বস্তুর ন্যায় বিকর্ষণ শক্তি বা ঘৃণা, বিরাগ, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা এসব বিপরীতধর্মী সেন্সও বিদ্যমান। পৃথিবীতে মানুষ যদিও আলো, তাপ, অক্সিজেন, পানি, খাদ্যসামগ্রী বা প্রাণ রাসায়ণিক জড় বস্তুর উপর বেঁচে থাকার জন্য সর্বোতভাবে নির্ভরশীল;তথাপি পরিমিতি বোধ বা এসবের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে আনার চর্চ্চা মানুষকে বোধির উৎকর্ষতর স্তরে পৌঁছে নিয়ে যেতে পারে। প্রকৃত জীবনবোধ এবং জীবনের উদ্দেশ্যকে যথাথযভাবে বুঝে বোধির উৎকর্ষতর স্তরে থেকে জীবনাচার করতে না জানলেই বিভ্রান্তি ও বিকৃতির অতলে ডুবে যেতে হয় মানুষকে।

কারণ তার দেহে স্রষ্টা নিজেই জ্ঞানসম্পন্ন ক্ষমতাধর মহামূল্যবান মস্তিষ্কটি (যা প্রায় চারশ সুপার কম্পিউটারের সমান কার্যক্ষম) তৈরী করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার বিবর্তণে এযাবৎ মানুষ উহার ঊনিশ লক্ষ ভাগের ঊনিশ শত ভাগ মাত্র দৃশ্যতঃ ব্যবহার করতে পেরেছে। সম্ভবত এ মহামূল্যবান সম্পদটির কারণেই মানুষের মাঝে একটি শ্রেষ্ঠত্ববোধ কাজ করে। কিন্তু সমস্যা বাঁধে তখনি- যখন একজন মানুষ শিক্ষায়, জ্ঞানে, ধর্মে, বর্ণে, গুণে, মর্যাদায়, সম্পদে, সৌন্দর্য্যে বা ক্ষমতায় অন্যদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বা শ্রেষ্ঠতম হিসেবে নিজেকে ভাবতে থাকে। তার মাঝে সক্রিয় থাকা এরূপ বোধ বা সেন্সই হলো ‘এলিট সেন্স’।

পৃথিবীতে কোন মানুষ বা একটি মানবগোষ্ঠীর যে কোন প্রকার উল্লেখযোগ্য উন্নততর বা সুবিধাজনক অবস্হান বা অর্জনের কারণে যদি সে বা তারা এলিট সেন্স তাড়িত হতে থাকে তা হলে সে সমাজ এলিট ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং নেমে আসে নানা বিপর্যয়। এরূপ এলিট ভাইরাস জাতি, দেশের গন্ডি পেড়িয়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে বিশ্বযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে ছাড়ে। পৃথিবীতে মানবতার যতো বড় বড় বিপর্যয়ের ঘটণা ঘটেছে, সবগুলোর পেছনে আসল কারণ ছিল এ এলিট ভাইরাস। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় পরে আসছি। অপরদিকে, নূর বা আলো এবং মাটি- উভয়ই জড়সত্ত্বা।

তবে মাটি (অনেকগুলো মৌল উপাদানের সমণ্বয়ে সৃষ্ট) যৌগবস্তু হেতু পঁচনশীল বা সহজে রূপান্তর যোগ্য এবং মৌলিক গুণ বিচারে নূর বা আলো অপেক্ষা নিম্ন মর্যাদার। কিন্তু স্রষ্টা এ জড় যৌগের দ্বারাই ফেরেশতাদের মাধ্যমে আদমের সুন্দর দেহ বল্ল্ররী তৈরীর কাজটি সম্পন্ন করেন। তারপর এ জড় অস্তিত্বের মাঝে তাঁর মহা পরিকল্পিত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবে নিজেই মস্তিষ্ক নামক হার্ডওয়্যারটিতে জীবন নামক ফার্মওয়্যারটি ইনস্টল করে দেন, যাতে প্রায় ঊনিশ লক্ষ সফ্টওয়্যার সংযুক্ত করা হয়েছে। সক্রিয় হয়ে গেল আদম নামক প্রথম পুরুষ মানবের জীবন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে শুরু করল বুদ্ধি সম্পন্ন অতিচেতণ মানব যন্ত্রটি।

তাকে রাখা হলো স্বর্গে। স্রষ্টা কিছু কিছু করে তাঁর আদেশ নিষেধ ইনপুট করলেন আদমের অন্তরে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, একটি মানব মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক গঠণ প্রক্রিয়ায় কর্মক্ষম প্রায় ঊনিশ লক্ষ সফ্টওয়্যারের সর্বমোট কর্মক্ষমতা, মানব সভ্যতায় এষাবৎ জড় বস্তু দ্বারা মানুষের তৈরী পৃথিবীর তাবৎ যন্ত্রকৌশলের সমষ্টি অপেক্ষাও প্রায় ঊনিশ হাজার গুণ বেশী হবে। যাহোক, স্বর্গে আদমের স্বকূলীয় একাকিত্বে স্রষ্টার অণুকম্পা হলো। তাঁর মহা পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তিঁনি আদমের হৃদয়ের নিকটবর্তী বাম পাঁজরের হাঁড় থেকে বিপরীত লিঙ্গের প্রথম নারী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন।

স্রষ্টা পুরুষ আদমের দেহকোষ থেকেই আকর্ষণীয় এবং অপেক্ষাকৃত কমণীয় ও রূপ লাবণ্যে সৌন্দর্য্য মন্ডিত করে হাওয়াকে রূপায়িত করেন। এক্ষেত্রে অস্তিত্বশীল একটি জীবন থেকেই অপর একটি আলাদা লিঙ্গসম্পন্ন জীবনের রূপায়ণ করা হয়েছে। হৃদয়ের টান বা আকর্ষণে মুগ্ধ এবং ভালবাসায় বিভোর থেকে স্বর্গে তাদের সময় গুলো সুখ শান্তিতেই কাটছিলো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন,স্বর্গে ইচ্ছা করা মাত্রই খাবার ও পানীয়ের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। আর এখানে তন্দ্রা,জড়া জীর্ণতা,রোগ শোক,মৃত্যু বা অবসাদ স্পর্শ করে না এবং মল মূত্র ত্যাগের প্রয়োজনও হয় না।

ঈর্ষাণ্বিত ইবলিশ তাদের স্বর্গীয় সুখ বেশীদিন স্হায়ী হতে দেয়নি। ইবলিশ তাদের অন্তরে মিথ্যা ভাষণ দ্বারা লোভের উদ্রেক ঘটায়। ইবলিশের মিথ্যাচারে প্ররোচিত হয়ে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা স্রষ্টার নিষেধকে অগ্রাহ্য করে নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলে। তাতে মল মুত্র ত্যাগ এবং জৈবিক বাসনা তাড়িত ক্রিয়ায় গর্ভধারণ ইত্যাদির উদ্ভব হবে হেতু তারা স্বর্গে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

অথচ ইবলিশ হাওয়াকে একা পেয়ে গোপণে কুমন্ত্রণা দেয় যে, স্রষ্টা ঐ বিশেষ গাছের নিকটে যেতে নিষেধ করার আসল কারণ হচ্ছে্‌ , সে গাছের ফল খেলে তারা স্বর্গে চিরস্হায়ী হয়ে যাবে। স্রষ্টা এটা চান না বলেই ঐ গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। কোমলমতি হাওয়া ইবলিসের দেয়া এ কুমন্ত্রণা নিজে বিশ্বাস করে ফেললো এবং নারীত্বের ছলাকলায় বহু কষ্টে আদমকেও বুঝাতে সমর্থ হলো। তারপর তারা দুজনেই নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেললো। স্রষ্টা রাগাণ্বিত হলেন এবং উভয়কে যোজণ দূরত্বের আলাদা দুটি স্হানে পৃথিবীতে নামিয়ে দিলেন।

তখন স্রষ্টা তাদের বল্লেন, তোমরা আর ইবলিশ একে অপরের শত্রু হয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করো। মোটামুটি এই ছিল মানব সৃষ্টি ও পৃথিবীতে মানুষের প্রথম যাত্রার আদি ঘটণা। এ ঘটণার পেছনে রয়ে গেছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটণা। আর তা হলো, স্রষ্টার সবচে প্রিয় ফেরেস্তা এবং ফেরেস্তাকূলের সর্দার আজাযিল এর অভিশপ্ত শয়তান বা ইবলিশ হয়ে যাওয়া এবং স্রষ্টার সান্নিধ্য হতে চিরতরে বিতারিত হওয়ার ঘটণাটি। স্রষ্টা যখন আদমকে জীবনদানের কাজ সমাপ্ত করলেন এবং আদম স্রষ্টাকে সিজদা করে মাথা ঊঁচু করলো, তখন উপস্হিত সকল ফেরেস্তাকে স্রষ্টা বললেন আদমকে সিজদা করতে।

কিন্তু আজাযিল বাদে একে একে সকল ফেরেশতাগণ আদমকে মাথা অবণত করে সিজদা করে স্রষ্টার হুকুম তামিল করলো। আজাযিল আদমকে সিজদা করা থেকে বিরত থাকলো। তখন আজাযিল কেন আদমকে সিজদা না করে তাঁর আদেশ অমান্য করলো উহার কারণ জানতে চাইলে আজাযিল বললো, হে মহান স্রষ্টা, তুমি আদমকে সৃষ্টি করলে মাটি থেকে আর আমাকে সৃষ্টি করেছ নূর দিয়ে। আমি নূরের তৈরী হয়ে কি ভাবে মাটির তৈরী আদমকে সিজদা করতে পারি? তারপর স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিরাজির অন্তর্গত সকল বস্তু সমূহ দেখিয়ে উহাদের নাম জিজ্ঞেস করলে ফেরেশতাগণ তা বলতে পারলো না। কিন্তু আদমকে জিজ্ঞেস করা মাত্র তিনি একে একে সকল বস্তুর নাম বলে দিলেন।

তখন ফেরেশতাগণকে উদ্দেশ্য করে স্রষ্টা বললেন, “আসলে আমি যা জানি তোমরা তা জাননা। “ স্রষ্টা আজাযিলের এ শ্রেষ্ঠত্বের দাবী বা এলিট সেন্স বা আভিজাত্য বোধকে স্বয়ং ক্রোধাণ্বিত হয়ে নাকচ করে দেন এবং অভিসম্পাৎ দ্বারা ফেরেশতার মর্যাদা ও দায়িত্ব হতে তাকে অব্যাহতি দিয়ে ইবলিশ বা শয়তানরূপে স্বর্গ থেকে বিতারিত করে দেন। মহান স্রষ্টার ক্ষমা ও রহমতের দুয়ার তার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তখন ধূর্ত ইবলিশ স্রষ্টার কাছে আকুতি জানায়, হে মহান পালনকর্তা, আমি জানি তুমি আমাকে আর ক্ষমা করবে না। তবু তোমার প্রতি আমার বিগত আনুগত্যের কথা বিবেচনা করে আমার সর্বশেষ একটি প্রার্থণা মঞ্জুর করো।

উহা হলো, আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত রেখো এবং আমাকে এমন শক্তি দাও যাতে আমি মানুষের প্রতিটি স্নায়ুকে প্রভাবিত করতে পারি। মহাণ স্রষ্টা ইবলিশের এ শেষ প্রার্থনাটি মঞ্জুর করেন। প্রকৃত পক্ষে এ সবকিছুই মানব সৃষ্টি ও সৃষ্টির এ শ্রেষ্ঠ জীবকে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক একটি নির্ধারিত পরিক্রমার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্রষ্টার মহা পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ মাত্র। তবে প্রতিটি ঘটণার মধ্য দিয়ে সৃষ্টির রহস্য ও স্রষ্টার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এসবের মাধ্যমে স্রষ্টা শুধু নিজেকেই প্রকাশ করেননি বরং সবচে প্রিয় সৃষ্টির পাথেয় হিসেবে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা ও সত্যজ্ঞান এবং পরীক্ষাক্ষেত্রে শত্রুকে চিনে নিয়ে পথ চলার মতো সতর্ক বিচার বুদ্ধির ঊন্মেষ ঘটিয়ে দিয়েছেন।

এখানে অনুধাবন যোগ্য ও শিক্ষা গ্রহণের উল্লেখযোগ্য বিষয় গুলো হলোঃ (১) মানুষের লোভ ও চিরস্হায়ী হবার আকাংখা ক্ষতিকর এবং উল্টো ফল নিয়ে আসে। এটা ইবলিশের প্ররোচণা। (২) ইবলিশ বা শয়তান মানুষের অন্তরে ক্ষতিকর লোভ ও উচ্চাকাংখার জন্ম দেয়। এ জন্যে সে প্রথমে বেঁছে নেয় কোমলমতি নারীকে। তারপর নারীর মাধ্যমে পুরুষকে প্রভাবিত করে।

(৩) মানুষকে স্রষ্টার কিছু গুণাবলী ও জ্ঞান পরিমিত,আপেক্ষিক ও সহনীয় মাত্রায় দেয়া হয়েছে। পৃথিবীতে আসার আগেই তার স্মৃতি ও জ্ঞান সৃষ্ট জগৎ ও বস্তুরাজি সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। জড়মাত্রিক ও আপেক্ষিক অবস্হানে সময়ের সাথে সাথে বর্তমানের ঘটণাবলী ও অনুভূতি সমূহ স্মৃতিতে নেয়া এবং কল্পিত দৃশ্যাবলী নূতনভাবে অঙ্কন ও উপলব্ধি করণ ব্যাতীত অধিকাংশ কাজের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হলো বুঝার বিষয়টি। যা নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল জ্ঞান ও বিশ্বাস এর উপর। স্রষ্টার সত্য জ্ঞান ও বিশ্বাস ছাড়া ঈন্দ্রিয় তাড়িত প্রয়োজন মানুষকে প্রতারিত করে।

( ৪) যে কোন কিছু দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে স্রষ্টার আদেশ নিষেধ অমান্য করা অভিশপ্ত বা বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার নামান্তর এবং পরিণতি স্বর্গচ্যূতি। (৫) শ্রেষ্ঠত্ববোধ বা এলিট সেন্স যোগ্যতমকেও ঘৃণিত ও অভিশপ্ত করে ছাড়ে। (৬) ইবলিশ কেয়ামত অবধি অমর এবং প্রচন্ড ক্ষমতাধর। মানুষের প্রতিটি অঙ্গ, লিঙ্গ বা স্নায়ুকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সে স্বয়ং স্রষ্টার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে। সুতরাং স্রষ্টার আশ্রয় ব্যাতীত ইবলিশের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারার ক্ষমতা মানুষের নেই।

(৭) এলিট সেন্সধারীগণ সরাসরি ইবলিশ দ্বারা প্রভাবিত। পৃথিবীতে এদের মিশন হলো ইবলিশের কাজ বা মানুষের শত্রু রূপে অনবরত কুমণ্ত্রণা দ্বারা মানবতার বিপর্যয় সাধন তথা মানুষকে অশান্তিতে নিপতিত করা, বিভ্রান্ত করা, দ্বন্ধ কলহে জড়িয়ে দেয়া, ক্ষতিগ্রস্ত করা, অধিকার বঞ্চিত করা, অন্যকে ভীত সন্ত্রস্ত করা, অপ্রয়োজনীয় কাজে উৎসাহিত করে অন্যের সময় নষ্ট করা, মন্দের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, সম্পদ ও ক্ষমতা কড়ায়ত্ব করে অপরের ক্ষতি সাধন- ইত্যাদির দিকে মানুষকে নিপতিত করা এবং সর্বোপরি মানুষকে স্বর্গসুখ অর্জনের অনুপযোগী করে দেয়া। এবার আসা যাক এলিট সেন্স প্রসঙ্গে। পৃথিবীর সব মানুষ একই রক্ত মাংসের হলেও অর্থ, বিত্ত, ধর্ম, বর্ণ, রূপ, ঐশ্বর্য, ক্ষমতা এসবের তারতম্যের কারণে একজন আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হয়ে যায়। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের এলিট সেন্স মানব সভ্যতাকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, কীভাবে উৎপীড়িত ণিপীড়িত করেছে উহার উদাহরন টেনে শেষ করা যাবেনা।

জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ সৃষ্টি হয়ে যুগে যুগে পৃথিবীতে মানবতার বিপর্যয় নেমে এসেছে এ এলিট সেন্সের কারনে। হিটলার মনে করতেন, জার্মাণ জাতির গায়ে নীল রক্ত বহে। তারা পৃথিবীর অপর সকল জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম জাতি। তাই পৃথিবীকে শাসন করবে জার্মাণীরা। এরূপ বোধ তাড়িত হয়েই তিনি গোটা পৃথিবী দখল করে নেয়ার যুদ্ধে নেমে পড়েন।

ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে পৃথিবীতে। লাখ লাখ মানুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। এলিট সেন্স ব্যক্তি পর্যায় থেকে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংক্রামিত হয়ে পড়লে তা ভয়াভহ পরিনতি ডেকে নিয়ে আসে। ধর্মীয় দিক থেকেও যদি একটি ধর্মের জাতি-গোষ্ঠী অপর কোন ধর্মীয় জাতি-গোষ্ঠী অপেক্ষা নিজেদের এলিট ভাবতে শুরু করে তাহলে সেখানেও এ বিপর্যয়কর পরিস্হিতি নেমে আসে। বিপত্তিটা হলো এখানেই যে, কেহ শ্রেষ্ঠ হলেই তা অন্যের উপর জোরজবস্তির কারণ হতে গেলে দেখা দেয় সংঘাত।

শ্রেষ্ঠ যদি আপন মহিমায় আপনার মাঝেই শ্রেষ্ঠরূপে টিকে থাকে এবং অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব চাপিয়ে দেয়ার জোরজবস্তি না করে তাহলে ঐ শ্রেষ্ঠত্বের সুবাসই কেবল প্রকৃত সুফল বয়ে আনতে সক্ষম। আজাযিলের মতো শ্রেষ্ঠত্ববোধ তাড়িত বা শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হিসেবে নিজেকে জ্ঞান করে অবাধ্য হয়ে ইবলিশে রূপান্তরিত হতে হয়। ধর্মীয় এ গোড়ার জ্ঞানটিই যেন অনেক ধার্মিকরা অনুভব করতে পারেননা। তাই পৃথিবীতে ক্রূসেড, জেহাদ ইত্যাদি অনেক বড় বড় ধর্মযুদ্ধ মানবতার বহু ক্ষতিসাধন করেছে। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে সন্ত্রা্‌স, জঙ্গীবাদ এসব মোড়কে তা অব্যাহত থেকে মানবতার চির শত্রুরূপে বিরাজ করছে।

কল্যানই অকল্যানের কারণে পরিনত হয়েছে। আমাদের এ বাংঙ্গালী জাতির কথাই ভাবা যাক। বৃটিশ এলিটরা দীর্ঘ্যদিন ধরে কতোভাবেই না এ জাতিটাকে শাসন শোষন করলো। আর তাদের সহায়তা করেছে একশ্রেনীর বাংঙ্গালীরাই যারা ইংরেজদের সাহচর্যে নিজেদের এলিট ভাবার প্রয়াস পেতো। আহাম্মক এ লোকগুলোর এলিট সেন্স তাদের এতোটাই বশীভূত করে রেখেছিল যে, নিজের ভাইয়ের রক্ত শোষণ করে ইংরেজদের ভান্ডারে তুলে দিতে তারা দ্বিধাবোধ করতো না।

শত শত বছর ধরে এদেশের গরীব মেহনতি মানুষের শ্রম ও সম্পদ লুন্ঠন করে ইংরেজরা নিজের দেশকে ধনবান করেছে। আর ঐ আহাম্মক এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকরা ইংরেজদের খাজনা আদায়ের ঔপনিবেশক জমিদারী প্রথার দায়িত্ব লাভেই নিজেদের এলিট ভাবতে শুরু করে এবং ঊচ্ছিষ্ট ভোগেই তারা সন্ত্তুষ্ট থাকে। ইংরেজদের দেয়া বিভিন্ন পদবী, পেশা বা বংশীয় খেতাব লুফে নিয়ে সেগুলোর মোড়কে তারা এলিট বংশবদ বনে যায় এবং সাধারণ মানুষের উপর নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবতে থাকে। মীর জাফর এ প্রকৃয়ার গোপণ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ প্রাপ্তির আশায় সিরাজদ্দৌলার পতনই শুধু ঘটায়নি, সে নিজেও ইতিহাসের ঘৃণ্য আস্তাকূড়েঁ নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ বিগ্রহ, হত্যা, নির্যাতন, শোষন নিষ্পেষনে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এখানে মানবতা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর মানবতা বিরোধী যতো ঘটনা প্রবাহ তা-ও এ এলিট ভাবনা প্রসূত। বৃটিশ ভাগের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনভার চলে যায় মূলতঃ পশ্চিম পাকিস্তানী এলিটদের কাছে। তাদের এলিট সেন্স এতোই তীব্র ছিলো যে, সম্পূর্ণ আলাদা কৃষ্টি-সংস্কৃতির ও আলাদা ভাষাবাসী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ জণগোষ্ঠী বাঙ্গালীদের উপর বাংলার পরিবর্তে তারা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। এর বিরোধিতা করতে গেলে বাঙ্গালীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। তখন রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ বা উচূঁ কোন পদেই বাঙ্গালীদের নিয়োগ দেয়া হতো না।

পূর্ব পাকিস্তানে তৈরী পণ্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে সিল মেরে বাজারজাত করা হতো। পাকিস্তানীদের দ্বারাও একেবারে বৃটিশের আদলে শাসন ও অর্থনৈতিক শোষনের শিকার হয়েছে বাঙ্গালী জাতি। বৃটিশদের কাছ থেকে সংক্রামিত এলিট ভাইরাসই এর পেছনের কারণ। এলিট সেন্স মানবতাকে পদদলিত করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে সর্বদা উচ্চাসীন করে রাখতে চায়। তারপর ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন এবং সত্তুরের সাধারণ নির্বাচণে যখন বঙ্গালী জাতির অগ্রনায়ক শেখ মুজিবর রহমান অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে উভয় পাকিস্তানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে যাবেন, তখন ভূট্টু ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের এলিট এলিট সেন্স তাতে বাঁধ সেঁধে বসে।

জনগণের ম্যান্ডেট এলিট সেন্সের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। একজন বাঙ্গালী নেতা উভয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে তাদের শাসন করবে- এটা পাকিস্তানী এলিটরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না। এতে করে যে জাতি হিসেবে তাদের এলিটনেস বা বড়ত্ব টিকে থাকে না! দায়িত্ব হস্তান্তরে শুরু হয় নানা টালবাহানা ও ষড়যন্ত্র। ৭১ এর ২৫-শে মার্চ রাতের আঁধারে তারা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞে। মহা বিপর্যয় নেমে আসে বাঙ্গালী জাতির উপর।

নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তারা হত্যা করেছে প্রায় ৩০ লাখ বাঙ্গালী, শ্লীলতাহানি করেছে প্রায় ৩ লাখ বাঙ্গালী নারীর। নরাধম এ পিঁচাশ হায়েনাদের কুৎসিত নরযজ্ঞে সহায়তা করেছে আবার এদেশীয় কিছু পিঁচাশ। এদের মাঝেও কাজ করেছে এক ধরনের এলিট সেন্স। তা হলো, তারা মনে করতো যে, ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের দিক থেকে তারা অন্যদের অন্য মুসলমানদের চেয়ে সঠিক ও সেরা। তাই অন্যের মত ও পথ ভুল ।

এজন্যে অন্যদের হত্যা করা বা মানবতার উপর যতো নিপীড়নই হোক বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে মুসলমান লেবাসধারী পাকিস্তানী শাসকদের অধীনে রাখার ধারণাকেই তারা সঠিক মনে করেছে। তারা সঠিক মনে করেছে প্রতিবেশী অপর মুসলমান ভাইকে হত্যা করার জন্য ঘাতক ভিনদেশীদের হাতে ধরিয়ে দেয়া বা স্বগোত্রীয় যুবতী নারীদের সম্ভ্রম লুটে নেয়ার জন্যে পিঁচাশ হায়েনাদের হাতে তুলে দেয়ার মতো জঘণ্য বর্বরতাকে। এলিট সেন্স মানুষকে এরূপ জঘণ্য বিভ্রান্তির মাঝে নিপতিত করে মানবতাকে বিপর্যস্ত করে থাকে। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বীরদর্পে এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন পতাকা ও স্বাধীন ভূখন্ড উপহার দিলেন বাঙ্গালী জাতিকে।

কিন্তু দেখা গেলো সে এলিট ভাইরাস মুক্ত হয়ে এ জাতি সূস্হ্য হয়ে আজো দাঁড়াতে পারেনি। এবার পাকিস্তানীদের রক্তে প্রবাহিত ইংরেজদের সংক্রামিত সে এলিট ভাইরাস চলে আসে বাঙ্গালীদের রক্তে। এলিটদের বিবেচনায় অসীম বীরত্বের অধিকারী বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন অবমূল্যায়িত ও নিগৃহিত। বাঙ্গালী জাতির জনককে স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। স্বার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশের সম্মানজনক সংবিধানে বার বার কাঁচি চালিয়ে রাষ্ট্রীয় মহা অপরাধগুলোকে বৈধতা দেয়ার ব্যবস্হা করা হলো।

বৃটিশদের রেখে যাওয়া ঔপনিবেশিক শোষন নিপীড়নে ব্যবহৃত সে আইনগুলোকে পাকিস্তানামলের মতো রেখে দেয়া হলো। সংবিধানের বিধানাবলীর ভুল বঙ্গানুবাদ ও ভুল ব্যাখ্যা করে সরকার পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত বিধিমালা তৈরীও নীতি নির্ধানের মাধ্যমে সামন্তযূগীয় পদ্ধতিতে জনশাসন অব্যাহত রাখা হলো। এভাবে স্বাধীনতা রিরোধীরা তাদের গাড়ীতে রাষ্ট্রীয় পতাকা উড়ালেন আর মুক্তিযোদ্ধারা হাতে ভিক্ষের ঝুলি তুলে নিলেন। এদেশের সিভিল ও মিলিটারী ব্যুরোক্রেটদের এলিট সেন্স সাংবিধানিক পদ্ধতিতে দেশটি চলুক-তা যেনো এখনো মেনে নিতে পারছে না। সে কারণেই বার বার হত্যা ক্যূর মতো ঘটনার পূণরাবৃত্তি হয়েছে।

স্হানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ্যদিন নির্বাচণের মুখ দেখেনি। জেলা পরিষদে অদ্যাবধি নির্বাচিত প্রতিনিধি আসতে পারেনি। উপজেলা পরিষদে যদিও নির্বাচন হয়েছে; কিন্তু আজো নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা ক্ষমতা বুঝে নিতে পারেননি। স্হানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকারের তথা নির্বাহী বিভাগের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রদান, কার্য বিতরণ, মর্যাদা বা স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্হাও অদ্যাবধি নেয়া হচ্ছে না। তদপরিবর্তে রাষ্ট্র পরিচালনার সাংবিধানিক মূলনীতি বহির্ভূতভাবে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের কর্মচারীদের দ্বারা তা পরিচালিত করা হচ্ছে।

স্হানীয় সরকারকে নির্বাহী বিভাগের অংশ হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে না এবং ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের সরকারী চাকরির মর্যাদা বা সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। এ সংবিধান বিরোধী কাজগুলো কারা করছেন, কাদের স্বার্থে করছেন। নিশ্চয় এসব জনস্বার্থে নয়। প্রকৃতপক্ষে এলিট ব্যূরোক্রেটগণ কিছু এলিট রাজনৈতিক ব্যক্তির প্রশ্রয়ে এখনো ঔপনিবেশিক বুর্জোয়া গোষ্ঠীস্বার্থের পদ্ধতিগুলো সংবিধাকে পাশ কাটিয়ে আজো টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। রাষ্ট্রের কার্য পরিচালনায় যতদিন এ এলিট সেন্স প্রভাব বিস্তার ধরে রাখতে সক্ষম হবে ততদিন মানবতার মুক্তি আসবে না এবং বিপর্যয় থামবে না।

কারণ এলিট সেন্সই মানবতার সবচে বড় শত্রু।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।