আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জিয়া ও তাঁর সহযোগীরা তাহেরকে হত্যা করেছেন

Hope is immortal

‘যে ব্যক্তি তাঁকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন, জিয়া কেন সেই তাহেরের ফাঁসি অনুমোদন করলেন? মুজিব হত্যা ও মোশতাকের অপসারণের পর যেসব কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তাঁরা নতুন মিত্র হিসেবে জিয়াকে পান। দেশের তখনকার সামরিক-বেসামরিক কাঠামোতে একটি শ্রেণী ও শক্তি হিসেবে টিকে থাকার জন্য তাঁদের একে অন্যের প্রয়োজন ছিল। যখন তাহেরের শাস্তির বিষয়টি আসে, তখন পাকিস্তান-প্রত্যাগত সামরিক কর্মকর্তারা তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পক্ষে মত দেন। জিয়া ৪৬ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে তাহেরের বিষয়টি আলোচনার জন্য ডাকেন। তাঁরা সবাই ছিলেন তাহেরকে চরম দণ্ড দেওয়ার পক্ষে।

’ গতকাল মঙ্গলবার কর্নেল তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিটের চূড়ান্ত শুনানিতে মওদুদ আহমদের লেখা ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ বই থেকে এই উদ্ধৃতি দেন তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ‘...জিয়াউর রহমান এই বিষয়টি লেখককে নিজেই বলেছেন বলে বইয়ের ফুটনোটে বলা হয়। ’ এর পর আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আজ দিবালোকের মতো সত্য হয়ে উঠেছে, বিচারের নামে প্রহসন করে জিয়াউর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা কর্নেল তাহেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন। আইনের কী গুরুতর লঙ্ঘন জেনারেল জিয়াউর রহমান করেছিলেন! তাঁর সৃষ্ট তথাকথিত গোপন সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালে নয়, ঢাকা সেনানিবাসের সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা যাঁদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁদের বৈঠকে তাহেরের মৃত্যুদণ্ড স্থির হয়েছিল। নির্ধারিত হয়েছিল অন্যান্য সহ-অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড।

’ বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চে এ শুনানি হয়। চারজনের বিচার ও দণ্ড নিয়ে রুল: আদালত গতকাল অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউদ্দিন, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, করপোরাল শামসুল হক ও আবদুল মজিদের গোপন বিচার নিয়েও রুল জারি করেছেন। রুলে ওই সময়ে বিচারের জন্য বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন, তাঁদের বিচার ও দণ্ড কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। গত সোমবার মেজর জিয়াউদ্দিনসহ তিনজন রিট করেন। গতকাল রিট দায়ের করেন আবদুল মজিদ।

শুনানির পর আদালত রুল জারি করেন। আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী শাহ্দীন মালিক শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আলতাফ হোসেন। এই নিয়ে ১৯৭৬ সালে তাহেরের সঙ্গে গোপন বিচারের মুখোমুখি হওয়া সামরিক আদালতে বিচারের ঘটনায় পৃথক চারটি রিটে রুল জারি হলো। গত ২৫ জানুয়ারি জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সহসভাপতি রবিউল আলম সামরিক আদালতের বিচার অবৈধ ঘোষণা এবং হারানো সামাজিক সম্মান ফিরে পাওয়ার দাবিতে রিট আবেদন করেন।

আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আবেদনকারীদের বিচার ও দণ্ড কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন একই আদালত। একই সঙ্গে ওই বিশেষ আদালত গঠন, বিচারক নিয়োগ, বিচার কেন অবৈধ ও সংবিধানবহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। তাহেরের শুনানি: বিকেল পৌনে চারটায় ঘটনাক্রম বর্ণনা করে আনোয়ার হোসেন শুনানিতে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দিই। ওই বছরের নভেম্বরে আমার দুই ভাই কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম ও আবু ইউসুফ বীর বিক্রমকে গ্রেপ্তার করার পর আমার শিক্ষকজীবনেও ছেদ পড়ে। আমাদের গোটা পরিবার জেনারেল জিয়াউর রহমানের রুদ্ররোষে পড়ে।

আমাকে আত্মগোপনে যেতে হয়। ১৯৭৬ সালের ১৫ মার্চ আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় ও ঢাকা সেনানিবাসের ডিএফআইর (বর্তমান ডিজিএফআই) সেইফ হোল নামে পরিচিত গোপন নির্যাতন কেন্দ্রে তিন মাস আটক রাখা হয়। ১৫ জুন আমাকে সেখান থেকে পুলিশ হেফাজতে কোর্টহাজতে এবং ওই রাতেই কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ডিএফআই সেলে আমার বন্দীজীবনের প্রথম এই তিন মাস কোনো হিসাবের খাতায় নেই। কোর্ট হাজতে পাঠানোর দিন থেকে আমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

’ আদালতে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তাদের নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা ছাড়া আর অন্য কিছু ছিল না, সে সম্পর্কে বলব। ওই নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া যে বিচারের নামে প্রহসন করে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় তাহেরকে হত্যা করেছিলেন, সে সম্পর্কে জানাব। ’ বিচার সম্পর্কে আনোয়ার হোসেন বলেন, ৩৩ জন গোপন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এর মধ্যে দুজন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির সংগঠক ছিলেন। যে বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালটি জিয়াউর রহমান গঠন করেছিলেন, তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে; যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকায় অবস্থান করেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন।

ট্রাইব্যুনালের অপর চার সদস্য কেউই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। লক্ষণীয়, গোপন এই সামরিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অর্থাৎ পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে রাখা হয় প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে। ... সরকার পক্ষের প্রসিকিউটর ছিলেন এ টি এম আফজাল। তাহেরের ফাঁসির পর তাঁকে হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করেন জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীকালে তিনি দেশের প্রধান বিচারপতিও হন। ...ট্রাইব্যুনালকে প্রদত্ত ক্ষমতার পরিধিও ছিল ব্যাপক।

সাধারণ আইন, সশস্ত্র বাহিনী এবং সামরিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ এমন সব সামরিক-বেসামরিক অপরাধের বিরুদ্ধে বিচারের ক্ষমতা পায় ট্রাইব্যুনাল। সামরিক অধ্যাদেশ ১৪ জুন জারি হলেও একই দিনে ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন। এর আগে ১২ জুন ওপর মহলের নির্দেশে ডিআইজি প্রিজনের অফিস কক্ষটি খালি করে গোপন আদালত কক্ষ হিসেবে তৈরি করা হচ্ছিল। এসব থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, অধ্যাদেশ জারির আগেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং তথাকথিত এই বিচার ছিল পূর্বপরিকল্পিত, সাজানো। কারাগারের অভ্যন্তরে অস্ত্রধারী প্রহরী থাকতে পারে না।

কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল তার ব্যতিক্রম। ...জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দালালদের যোগসাজশে দেশের প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধাদের সমূলে বিনাশ করার চক্রান্তের ফসল হচ্ছে কর্নেল তাহের ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে গোপন সামরিক আইন টাইব্যুনাল। শেষ পর্যায়ে ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহেরের উচ্চারিত বক্তব্য তুলে ধরে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সব কালো আইন ভাঙতে হবে বার্তা পেলাম, চৈতীর শেষে ঝড়ো বৈশাখে তাই জন্ম নিলাম। পাপী আর পাপ থেকে দূরে থাকব, তাই হাতে অস্ত্র নিলাম। ইতিহাস বলবেই শোষকের মৃত্যুকবজ আমিই ছিলাম।

পৃথিবী, অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম। ’ সত্য উদ্ঘাটিত হবে কালো আইনের বেড়াজাল ভেঙে। সুবিচার পাবেন এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে সম্পূরক বক্তব্য শেষ করেন তিনি। প্রসঙ্গত, তাহেরের সঙ্গে আনোয়ার হোসেনকেও সহঅভিযুক্ত হিসেবে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.