আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাশিয়ার সেলুনে!

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

এমন শীতের দিনে গোসল করি সপ্তাহ কিংবা দশদিনে একবার। শীত কি আর যেমন তেমন! কখনো সখনো মাইনাস পচিশ-ত্রিশ টপকে যায়। রুম হিটারের উষ্ণতার মাঝেও জোব্বা-জাব্বা পরে বসে থাকলে আরাম। পোষাক খোলার সময় নেই,গোসল করব কখন?দেশ থেকে চুল কেটেছিলাম কদম ছাটে-ভেবেছিলাম কে জানে আল্লায় ওই দেশে নাপিত আছে কি নেই। তিন মাস কেটে গেছে মাথার চুল বেড়ে গেছে ইঞ্চি দেড়েক।

পশমের টুপি পড়লেই চুলের গোড়ায় চিড়বিড় করে-খুশকিতে সয়লাব! সময়ে অসময়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে চুলকাই। চুল এবার কাটতে হবে। আমার মত বাকি সবারই এক অবস্থা! এই ঠান্ডায় দুশ কদম দুরে কলেজে যেতেই হাত পায়ে খিল ধরে-না জানি নাপিতের ঘর কতদুরে! যদিওবা খুজে পেলাম কিন্তু মনে তখন রঙ ধরার বয়স। যেন তেন করে কি আর চুল কাটা যায়!রুশ ভাষার এখনো স্বর বর্ণ আয়ত্বে আসেনি। ওদেরকে বোঝাব কি করে;এইখানে দুই আনা এইখানে চার আনা আর এইখানে দেড় আনা চুল কাটতে হবে? মাঝে অবশ্য নিজেরা ছুড়ি কাচি নিয়ে চেস্টা করে ক্ষান্ত দিয়েছি।

অগত্যা তিন চারজন মিলে বেশ শলা পরামর্শ করে আমাদের আখরান(গার্ড) ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ট্যাক্সি ক্যাবে চললাম সেলুনের উদ্যেশ্য-এবার আর কারতুসকা কেনার মত ভুল করব না। ট্যাক্সি ক্যাব চালক শহরের মধ্যিখানে বেশ বড় সড় কাচ ঘেরা এক ঘরের সামনে নামিয়ে দিল। দুরু দুরু বক্ষে বিশাল কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলাম! ছোটবেলায় দেখেছি বট তলার নাপিত। সাধারনত হাটের দিনেই এদের দেখা যেত। বট গাছের সাথে পাটের দড়ি দিয়ে বহু পুরনো আধ ভাঙ্গা পারদ উঠে যাওয়া এটা আয়না ঝুলিয়ে চলত তার ক্ষৌর কর্ম।

সেই আয়নায় আলোর এমন দারুন প্রতিবম্ব হয় যে আপনি কি দেখছেন তা বুঝতে হলে বেশ খানিকটা সময়ের প্রয়োজন!চুল কাটার সময় নাপিত মহোদয় এমন জোড়ে ঘেটি ধরে এদিক ওদিক ঘোরান যে আয়না দেখার ফুসরৎ মেলে না। ভাঙ্গা একখান টুল জং ধরা দুয়েকটা কেচি দাত ভাঙ্গা সারা গায়ে ছাল ওঠা একখান চিরুনি আর কাটা চুল মিশ্রিত একটা পাউডারের ডিব্বা। সরঞ্জাম বলতে এই কয়টা। ওহ হো সাথে একটা পুরনো চামড়ার বেল্ট আর ক্ষুরও থাকত দাড়ি গোফ কামানোর জন্য। চুল কাটার আগে তেল চিটচিটে তিল পড়ে কালো হয়ে যাওয়া যেই কাপড়খানা তিনি খদ্দেরের গায়ে চড়াতেন সেটা যার গায়ে চড়িয়েছে সেই বলতে পারে কতটা বিরক্তি কর।

গায় এদিলেই কাটা চুলের খোচায় শুরু হত চুলকানি। আর আহা চুর কাটার সেকি ছিড়ি! এখনো অনেক গ্রামে নাপিতের ঘর নেই। চুল কাটতে যেতে হয় গঞ্জে বা মফস্বলে। মফস্বলে নাপিতের দোকান পাট আগে থেকেই ছিল। তবে তাদের চুল কাটার স্টাইল গুরুজনের পছন্দ নয়।

ওরা পোলাপানের কথা বড্ড বেশী শোনে। আহা বটতলার নাপিতরা কি দারুন চুলই না কাটে! এই গরমে চুল ভেদ করে চান্দি দেখা না দিলে কিসের চুল কাটা। ওই নাপিতেরা ছিল আমাদের ত্রাস। মুরুব্বিদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যেতাম দোকানের নাপিতের কাছে। চুল কাটতে সে কি মজা! হাতল আলা চেয়ার ক্যাচর ক্যাচর করে এদিক ওদিক ঘোরে ।

সামনে বেশ বড় সড় আয়না। নিজেকে সাহেব সাহেব লাগে। এরা ঘেটি ধরে চটকায় না। আলতো করে এদিক ওদিক ঘোরায়। ঢাকা শহরের নাপিতের জৌলুস দেখে আমাদের সেই মফস্বলের নাপিতের ঘর একদম শ্রীহিন মনে হত! এদের চেয়ার তখন অনেক বেশী আরাম দায়ক।

বিশাল বিশাল আয়নার সামনে ট্যাপ আর বেসিন। চুল কাটতে ব্যাবহার করে কয়েক ধরনের চিরুনী, ঝক ঝকে এপ্রোন দেখে চোখ জুড়ায়। ফিটকারির পরিবর্তে এরা ব্যাবহার করে এন্টি সেপ্টিক ক্রিম। সাবানের পরিবর্তে সেভিং ক্রিম! মনে হয় যেন জাতে উঠে গেলাম! ৮০এর দশকে ঢাকায় কয়টা এসি সেলুন ছিল হাতে গুনে বলা যেত। আমার তখনো সেই সব সেলুনে ঢোকার দুঃসাহস হয়নি।

আর এখন যিনি আমাদের সম্ভাষন জানালেন তাকে দেখেই ভিমড়ি খেলাম। কি দুর্দান্ত রুপসীরে বাবা! হলিউডের সিনেমাতেও এমন সুন্দরী চোখে পড় কদাচিৎ!মেয়েটাও আমাদের দেখে কিছুটা বিব্রত!বিদেশীদের চুল কাটতে গেলে ভাষাগত একটা ঝামেলা আছে- তারপরে এরাতো আবার ইংরেজীত লবডঙ্কা। লাভ আর কিস বাদ অন্য কোন শব্দ জানেনা! রুপসীর চেহারা আর ফিগার দেখ আমার হাতপা জমে গেছে- প্রায় অবচেতন অবস্থায় তার ইশারায় বসলাম গিয়ে একটা আরাম কেদারায়। গলায় একটা টস্যিু জড়িয়ে অতি মোলায়েম একখন্ড কাপড় পুরো দেহ জড়িয়ে সুমিষ্ট কন্ঠ আর হাতের ইশারায় শুধোল সে কোন কেতায় চুল কাটবে। আমি ঘোর লাগা নয়ন তার দকিে তাকিয় আদিম ভাষায় বললাম , মাথাটা তোমার কাছে অবনত করলাম তুমি যেমন খুশী ছেটে দাও।

চুল কাটাতো নয় যেন অতি সুক্ষ শিল্পকর্ম! পেলব দুটো আঙ্গুল দিয়ে চুলের গোড়ায় বিলি কেটে ধারালো কাচি দিয়ে অনুপম ঢঙ্গ যেন কোন ভাস্কর্য গড়ছে সে। এমন শৈল্পিক ভঙ্গীত চুল কাটা যায় আমার ভাবনার মধ্যে ছিল না কখনো! আমার সারা শরিরে আগুন জ্বলছে সেদকি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার। মাথাটা কখনো ডাইনে ঘুরিয়ে কখনো পিছনে সামনে কখনো বায়ে ঘুরিয়ে সে কেটে যাচ্ছ নিজ মনে। তার অতি কোমল শরিরের স্পর্শে আম রোমাঞ্চিত শিহরিত হচ্ছি। মাঝে একবার মাথাটা উল্টো করে চেপে ধরল তার অতি কোমল গুরুভার বুকের খাজে।

ভাল লাগার অতশিয্যে আমি যেন মরে যাই। কখনো নাকের ডগায় সুগন্ধী পর্বতচুড়া- অত ধীরে মিস্টি গন্ধ শুকে নিই- বেশী হলে আবার ভবলীলা সাঙ্গ না হয় এই ভয়ে। চুল কাটা শেষ! সামনের বেসিনে চুল ধুয়ে অতি যত্ন করে মুছে-ব্রাশ দিয়ে শিশুর মত ঘাড় আর জামার কাটা চুল ছাড়িয়ে দারুন এক সুমিস্ট হাসি দিয়ে সে বিদায় নিল। বিল দিতে গিয়ে ভিমড়ি খেলাম! কি বলে মাত্র চার কোপেক!!!এই পয়সা দিয়েতো আমাদের দেশে একটা ক্যান্ডিও কেনা যায় না! সস্তায় চুল কাটা আর সেই সুন্দরীর গল্প হোস্টেলে পৌছুতে দেরী হলনা। সবাই ছুটল চুল কাটতে।

কারো কপাল জুটল তার সান্যিধ্য কেউবা হল চরম ভাবে নিরাশ! লজ্জা নেই বলতে আমার চুল দুই সুতা বড় হলে আমিও ওদের কাতারে সামিল হতাম। লাইন ধরে বসে থেকে নিজের সুযোগ আসলেও পিছিয়ে যেতাম স ব্যাস্ত বলে। তাম্বুভ ছোট্ট শহর। ভাল মানের গাড়ি ছিল তখন হাতে গোনা কয়েকখান- তাও তেমন নামীদামি ব্রান্ড না। খুব অভিজাতরাও দেশী ‘ভলগা’ চালাত।

একদিন চুল কাটতে গিয়ে বসে আছি ওয়টিং রুমে- অলস সময় কাটাচ্ছি বিশাল কাচের জানালা দিয়ে বাইরের বরফ পড়া দেখে। আচমকা একটা ঢাউস মার্সিডিস এস থামল সেলুনের পোর্চে! এত দামী গাড়ি তখনো এই শহরে আমি দেখিনি! ভাবলাম অন্য শহরের কোন কেউকেটা এখানে বেড়াতে এসে চুল কাটাতে এসেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে দারুন সুদর্শন এক যুবক- তীর্থের কাকের মত। সামান্য কিছু পর আমার সেই সুন্দরী নাপিত রমণী ভয়ঙ্কর সাজে সজ্জিত হয়ে গট গট করে হেটে গিয়ে সেই গাড়রি সামনে যেতেই - গাড়ির গেট খুলে সুদর্শন দৌড়ে এসে ভীষন আবেগে চুমোয় চুমোয় ভরিয় দিল প্রিয়ার ওষ্ঠ অধর। দুমিনিট পরেই তারা হাওয়া ।

আমি আগের মতই সেই বিশাল জানালাটা দিয়ে তাকিয়ে আছি- এখনো বরফ পড়ছে তেমনি পেজা তুলোর মত মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভেসে ভেসে অতি ধীর মন্থর গতিতে। অতি শুভ্র বিশ্ব চরাচর-শুধু আমার হৃদয়রে অতি সুক্ষ কোনে একফোটা ভীষন লাল রক্তক্ষরণ!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.