আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঃ সহজ পাঠ

বাংলা আমার দেশ

এই লেখাটির অনুপ্রাণনা হচ্ছে ১ নভেম্বরের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা একটি প্রতিবেদন, যার শিরোনম ছিল ‘সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টাÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার দরজা খোলা আছে। ’ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, যদি আইনের আওতায় কেউ যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি বিচারব্যবস্থায় নিয়ে আসতে চান তাঁকে তিনি স্বাগত জানাবেন। প্রতিবেদনটিতে আরও পড়ালাম, এ প্রসঙ্গে প্রধান উ৫পদেষ্টা প্রশ্ন রাখেন, কে বা কারা যুদ্ধাপরাধী সেটা কীভাবে নির্ণয় করা হবে। এটা করতে গেলে বিচারব্যবস্থা বা আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের কেন বিচার করা ও দণ্ড দেওয়া জরুরি তার পরোক্ষ সমর্থন পাওয়া যায় সম্পাদকদের সঙ্গে ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার একটি মন্তব্যে।

তিনি যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে াংশ নেওয়া সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত মনে করেন। এটা যথার্থ ন্যায়নুগ ও আইনানুগ মন্তব্য। ইংল্যান্ডে ১৯৪৯ সালে ‘মৃত্যুদণ্ডবিষয়ক রাজকীয় কমিশন’ গঠিত হয়েচিল। লর্ড ডেনিং কিমশনের সামনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সমর্থনে সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন, ‘যে কোনো রকম দণ্ড দেওয়ার পক্ষে মৌল যুক্তি এটাই নয় যে দণ্ড অপরাধ নিরোধ করে, বরং এটাই যে, দণ্ড সমাজ কর্তৃক অপরাধের বিরুদ্ধে জোরালো ঘৃণা জ্ঞাপন করে।

’ যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতের কাঠগড়ায় বিচারে উপস্থিত করার জন্য বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১, ১২১ক, ১২২ ও ১২৩ক ধারা চারটিই যথেষ্ট। সেগুলো এরকম : ‘১২১। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করে কিংবা অনুরূপ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় সহায়তা করে, সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে ও তাকে আরও জরিমানা দণ্ড দেওয়া যাবে। ’ ‘১২১ক। ১২১ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধসমূহ সংঘটনের ষড়যন্ত্র : যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের ভিতরে বা বাহিরে থেকে ১২১ ধারা মতে দণ্ডনীয় অপরাধসমূহের মদ্যে যে কোনো একটি অপরাধ সংঘঠনের জন্য কিংবা বাংলাদেশের এলাকা অথবা তার কোনো অংশে সার্বভৌমত্ব থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার জন্য কিংবা অপরাধজনক বল প্রয়োগ দ্বারা অথবা অপরাধজনক বলপ্রয়োগের হুমকি দ্বারা সরকারকে সন্ত্রস্ত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাহলে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কিংবা দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে ও আরও জরিমানা দণ্ড দেওয়া যাবে।

’ ‘১২২। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য কিংবা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হওয়ার জন্য যদি কোনো ব্যক্তি লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র অথবা গোলাবারুদ সংগ্রহ করে কিংবা অন্য কোনোভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর পর্যন্ত মেযাদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদাণ্ডে দণ্ডিত হবে ও আরও তাকে জরিমানা দণ্ড দেওয়া যাবে। ’ ‘১২৩ক। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচরণ ও উহার সার্বভৌমত্ব বিলোপের দাবি : (১) যদি কেউ বাংলাদেশের ভিতরে বা বাহিরে থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমার ভিতরের সকল এলাকায় অথবা তার কোনো অংশে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে এই উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে কিংবা জনসাধারণের সমগ্র বা কোনো অংশকে প্রবাবিত করার জন্যে কিংবা তার সে কাজ দ্বারা কোনো ব্যক্তি কিংবা জনসাধারণের সমগ্র বা কোনো াংশ প্রভাবিত হবে জেনে, উচ্চারিত বা লিখিত কথা দ্বারা কিংবা চিহ্নি বা দৃশ্যমান প্রতীক দ্বারা, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার নিন্দা করে কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের এলাকার সঙ্গে সম্মিলনের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমার অন্তর্ভুক্ত সকল এলাকার বা কোনো এলাকাবিশেষের দিক থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব করার বা বিলোপের সমর্থন বা সেই মর্মে প্রচারণা করে, তাহলে তাকে দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে ও তাকে জরিমানার দণ্ডও দেওয়া যাবে। (২) অন্য কোনো আইনে যা কিছু সে সময় থাকুক না কেন, তা স্বত্ত্বেও, এই ধারা মতে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে, তার তদন্ত বা বিচারকালে যে আদালতে তাকে সোপর্দ করা হবে, সে আদালত আইনসম্মতভাবেই যে পর্যন্ত না বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় সে পর্যন্ত ওই ব্যক্তির গতিবিধি, অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে তার মেলামেশা বা সাহচর্য বা যোগাযোগ এবং সংবাদ সরবরাহ ও মতামত প্রচারণাসংক্রান্ত ওই ব্যক্তির কার্যকলাপ সম্পর্কে যে কোনো আদেশ, যা প্রয়োজন বলে বিবেচিত হয়, দিতে পারবে।

(৩) ২নং উপধারায় উল্লেখিত আদালতের সম্পর্কীয় আপিল আদালত কিংবা রিভিশন আদালত ২নং উপধারা বলে কোনো আদেশ দিতে পারবে। ’ মুজিবনগরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কর্তৃক ‘বাংলাদেশ যাহা হইবে সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র’, প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ঘোষণাপত্রে বলা হয় ‘অত্র স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া বিবেচিত হইবে। ’ উদ্ধৃত ধারাগুলো যে দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত সে দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৬ অক্টোবর ইংরেজ শাসিত ভারতে কার্যকর হয়। ধারাগুলোর যে যে জায়গায় বাংলাদেশ লেখা আছে, মূল পাঠে সেখানে ইন্ডিয়া (ভারত) লেখা ছিল, এরপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য ‘পাকিস্তান’ লেখা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৮ নম্বর আইন দ্বারা তদস্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত হয় এই শর্তে যে এই প্রতিস্থাপন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বলবৎ হয়েছে এবং ওই একই শর্তে ওই ৮ নম্বর আইন দ্বারা ১২৩ক ধারার ‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণার অনুসারে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়।

উল্লেখ্য, বিশেষ ক্ষমতা আইন (১৯৭৪ সালের ১৪নং আইন)-এর ২৬(২) ধারা অনুযায়ী গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডবিধির উপরিউক্ত ১২১, ১২১ক, ১২২ ও ১২৩ক ধারাগুলোয় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার হবে। প্রিয় পাঠক, ‘কে বা কারা যুদ্ধাপরাধী সেটা কীভাবে নির্ণয় করা যাবে’Ñ প্রধান উপদেষ্টার এই প্রশ্নটির মীমাংসা করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন কোন ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধের কাজে লিপ্ত ছিল তার তথ্য পাওয়া যাবে তৎকালীন প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথিগুলোয়। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর সে সময়ে কারা হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করছে, কীভাবে সাহায্য করছে, তার রিপোর্ট প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিত ইসলামাবাদে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাত এবং সেগুলোর কপি এখনকার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যাবে। একটি আইনি প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দলিলগুলো যাঁরা তৈরি করেছিলেন কিংবা এগুলোয় যাঁদের স্বাক্ষর আছে তাঁদের না পাওয়া গেলে তাঁদের সাক্ষ্য ছাড়া দলিলগুলো কীভাবে বিচারকালে প্রমাণিত হবে।

প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে, সাক্ষ্য আইনের ৯০ ধারায় এগুলো বিচারকালে উপস্থিত করা মাত্র আপনা-আপনি একজিবিট বা প্রদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হবে। সাক্ষ্য আইনের ৯০ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো দলিল ৩০ বছরের পুরোনো হলে আদালত এই অনুমতি নেবে যে দলিলটির স্বাক্ষরকারীর স্বাক্ষর সঠিক এবং দলিলটি সঠিকভাবে তৈরি করা হয়েছিল। তৎকালে প্রচারিত লিফলেট ইত্যাদি ও সংবাদপত্রগুলোয় ছাপা বিবৃতি প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা যাবে। এগুলো সাক্ষ্য আইনের ১৭ ধারা, যেখানে স্বীকারোক্তির সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তার আওতায় সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। প্রিয় পাঠক, দেখা যাচ্ছে : এক যুদ্ধাপরাধীদের নির্ণয় করতে যে দলিলসংক্রান্ত প্রমাণগুলো, যেগুলো অত্যন্ত নির্ভরযোগ্যও বটে, সেগুলো সরকারের হেফাজতে আছে।

দুই. যেকোনো গুরুতর অপরাধের বিচারে আদালতের সামনে রাষ্ট্রকেই বিচারপ্রার্থী হতে হয়, যেমনÑ নরহত্যা কিংবা ধর্ষণ কিংবা ডাকাতি ইত্যাদি। এ দুটো কারণের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধ একটি গুরুতর অপরাধ হওয়ায় অপরাধীদের নির্ণয় করে রাষ্ট্রকেই তাদের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হতে হবে এবং জনগণের সহায়তা চাইতে হবে রাষ্ট্রকেই। প্রিয় পাঠক আপনি-আমি সবাই অবশ্যই চাইব এমন একটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সত্য সেথায় দারুণ সত্য, মিথ্যে ভীষণ মিথ্যে’। বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী এই লেখাটির অনুপ্রাণনা হচ্ছে ১ নভেম্বরের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা একটি প্রতিবেদন, যার শিরোনম ছিল ‘সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টাÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার দরজা খোলা আছে। ’ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, যদি আইনের আওতায় কেউ যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি বিচারব্যবস্থায় নিয়ে আসতে চান তাঁকে তিনি স্বাগত জানাবেন।

প্রতিবেদনটিতে আরও পড়ালাম, এ প্রসঙ্গে প্রধান উ৫পদেষ্টা প্রশ্ন রাখেন, কে বা কারা যুদ্ধাপরাধী সেটা কীভাবে নির্ণয় করা হবে। এটা করতে গেলে বিচারব্যবস্থা বা আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের কেন বিচার করা ও দণ্ড দেওয়া জরুরি তার পরোক্ষ সমর্থন পাওয়া যায় সম্পাদকদের সঙ্গে ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার একটি মন্তব্যে। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে াংশ নেওয়া সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত মনে করেন। এটা যথার্থ ন্যায়নুগ ও আইনানুগ মন্তব্য।

ইংল্যান্ডে ১৯৪৯ সালে ‘মৃত্যুদণ্ডবিষয়ক রাজকীয় কমিশন’ গঠিত হয়েচিল। লর্ড ডেনিং কিমশনের সামনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সমর্থনে সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন, ‘যে কোনো রকম দণ্ড দেওয়ার পক্ষে মৌল যুক্তি এটাই নয় যে দণ্ড অপরাধ নিরোধ করে, বরং এটাই যে, দণ্ড সমাজ কর্তৃক অপরাধের বিরুদ্ধে জোরালো ঘৃণা জ্ঞাপন করে। ’ যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতের কাঠগড়ায় বিচারে উপস্থিত করার জন্য বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১, ১২১ক, ১২২ ও ১২৩ক ধারা চারটিই যথেষ্ট। সেগুলো এরকম : ‘১২১।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করে কিংবা অনুরূপ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় সহায়তা করে, সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে ও তাকে আরও জরিমানা দণ্ড দেওয়া যাবে। ’ ‘১২১ক। ১২১ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধসমূহ সংঘটনের ষড়যন্ত্র : যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের ভিতরে বা বাহিরে থেকে ১২১ ধারা মতে দণ্ডনীয় অপরাধসমূহের মদ্যে যে কোনো একটি অপরাধ সংঘঠনের জন্য কিংবা বাংলাদেশের এলাকা অথবা তার কোনো অংশে সার্বভৌমত্ব থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার জন্য কিংবা অপরাধজনক বল প্রয়োগ দ্বারা অথবা অপরাধজনক বলপ্রয়োগের হুমকি দ্বারা সরকারকে সন্ত্রস্ত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাহলে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কিংবা দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে ও আরও জরিমানা দণ্ড দেওয়া যাবে। ’ ‘১২২। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য কিংবা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হওয়ার জন্য যদি কোনো ব্যক্তি লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র অথবা গোলাবারুদ সংগ্রহ করে কিংবা অন্য কোনোভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর পর্যন্ত মেযাদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদাণ্ডে দণ্ডিত হবে ও আরও তাকে জরিমানা দণ্ড দেওয়া যাবে।

’ ‘১২৩ক। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচরণ ও উহার সার্বভৌমত্ব বিলোপের দাবি : (১) যদি কেউ বাংলাদেশের ভিতরে বা বাহিরে থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমার ভিতরের সকল এলাকায় অথবা তার কোনো অংশে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে এই উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে কিংবা জনসাধারণের সমগ্র বা কোনো অংশকে প্রবাবিত করার জন্যে কিংবা তার সে কাজ দ্বারা কোনো ব্যক্তি কিংবা জনসাধারণের সমগ্র বা কোনো াংশ প্রভাবিত হবে জেনে, উচ্চারিত বা লিখিত কথা দ্বারা কিংবা চিহ্নি বা দৃশ্যমান প্রতীক দ্বারা, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার নিন্দা করে কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের এলাকার সঙ্গে সম্মিলনের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমার অন্তর্ভুক্ত সকল এলাকার বা কোনো এলাকাবিশেষের দিক থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব করার বা বিলোপের সমর্থন বা সেই মর্মে প্রচারণা করে, তাহলে তাকে দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে ও তাকে জরিমানার দণ্ডও দেওয়া যাবে। (২) অন্য কোনো আইনে যা কিছু সে সময় থাকুক না কেন, তা স্বত্ত্বেও, এই ধারা মতে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে, তার তদন্ত বা বিচারকালে যে আদালতে তাকে সোপর্দ করা হবে, সে আদালত আইনসম্মতভাবেই যে পর্যন্ত না বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় সে পর্যন্ত ওই ব্যক্তির গতিবিধি, অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে তার মেলামেশা বা সাহচর্য বা যোগাযোগ এবং সংবাদ সরবরাহ ও মতামত প্রচারণাসংক্রান্ত ওই ব্যক্তির কার্যকলাপ সম্পর্কে যে কোনো আদেশ, যা প্রয়োজন বলে বিবেচিত হয়, দিতে পারবে। (৩) ২নং উপধারায় উল্লেখিত আদালতের সম্পর্কীয় আপিল আদালত কিংবা রিভিশন আদালত ২নং উপধারা বলে কোনো আদেশ দিতে পারবে। ’ মুজিবনগরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কর্তৃক ‘বাংলাদেশ যাহা হইবে সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র’, প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ঘোষণাপত্রে বলা হয় ‘অত্র স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া বিবেচিত হইবে।

’ উদ্ধৃত ধারাগুলো যে দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত সে দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৬ অক্টোবর ইংরেজ শাসিত ভারতে কার্যকর হয়। ধারাগুলোর যে যে জায়গায় বাংলাদেশ লেখা আছে, মূল পাঠে সেখানে ইন্ডিয়া (ভারত) লেখা ছিল, এরপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য ‘পাকিস্তান’ লেখা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৮ নম্বর আইন দ্বারা তদস্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত হয় এই শর্তে যে এই প্রতিস্থাপন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বলবৎ হয়েছে এবং ওই একই শর্তে ওই ৮ নম্বর আইন দ্বারা ১২৩ক ধারার ‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণার অনুসারে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়। উল্লেখ্য, বিশেষ ক্ষমতা আইন (১৯৭৪ সালের ১৪নং আইন)-এর ২৬(২) ধারা অনুযায়ী গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডবিধির উপরিউক্ত ১২১, ১২১ক, ১২২ ও ১২৩ক ধারাগুলোয় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার হবে। প্রিয় পাঠক, ‘কে বা কারা যুদ্ধাপরাধী সেটা কীভাবে নির্ণয় করা যাবে’Ñ প্রধান উপদেষ্টার এই প্রশ্নটির মীমাংসা করতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন কোন ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধের কাজে লিপ্ত ছিল তার তথ্য পাওয়া যাবে তৎকালীন প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথিগুলোয়। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর সে সময়ে কারা হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করছে, কীভাবে সাহায্য করছে, তার রিপোর্ট প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিত ইসলামাবাদে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাত এবং সেগুলোর কপি এখনকার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যাবে। একটি আইনি প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দলিলগুলো যাঁরা তৈরি করেছিলেন কিংবা এগুলোয় যাঁদের স্বাক্ষর আছে তাঁদের না পাওয়া গেলে তাঁদের সাক্ষ্য ছাড়া দলিলগুলো কীভাবে বিচারকালে প্রমাণিত হবে। প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে, সাক্ষ্য আইনের ৯০ ধারায় এগুলো বিচারকালে উপস্থিত করা মাত্র আপনা-আপনি একজিবিট বা প্রদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হবে। সাক্ষ্য আইনের ৯০ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো দলিল ৩০ বছরের পুরোনো হলে আদালত এই অনুমতি নেবে যে দলিলটির স্বাক্ষরকারীর স্বাক্ষর সঠিক এবং দলিলটি সঠিকভাবে তৈরি করা হয়েছিল।

তৎকালে প্রচারিত লিফলেট ইত্যাদি ও সংবাদপত্রগুলোয় ছাপা বিবৃতি প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা যাবে। এগুলো সাক্ষ্য আইনের ১৭ ধারা, যেখানে স্বীকারোক্তির সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তার আওতায় সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। প্রিয় পাঠক, দেখা যাচ্ছে : এক যুদ্ধাপরাধীদের নির্ণয় করতে যে দলিলসংক্রান্ত প্রমাণগুলো, যেগুলো অত্যন্ত নির্ভরযোগ্যও বটে, সেগুলো সরকারের হেফাজতে আছে। দুই. যেকোনো গুরুতর অপরাধের বিচারে আদালতের সামনে রাষ্ট্রকেই বিচারপ্রার্থী হতে হয়, যেমনÑ নরহত্যা কিংবা ধর্ষণ কিংবা ডাকাতি ইত্যাদি। এ দুটো কারণের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধ একটি গুরুতর অপরাধ হওয়ায় অপরাধীদের নির্ণয় করে রাষ্ট্রকেই তাদের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হতে হবে এবং জনগণের সহায়তা চাইতে হবে রাষ্ট্রকেই।

প্রিয় পাঠক আপনি-আমি সবাই অবশ্যই চাইব এমন একটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সত্য সেথায় দারুণ সত্য, মিথ্যে ভীষণ মিথ্যে’। বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.