আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তারুণ্যের তরল আধুনিকতা, তারুণ্যের পাতলা সম্পর্ক

একসময় আমরা সবাই হারিয়ে যাব অন্য জগতে...রয়ে যাবে আমাদের কর্মফল...

আজকের তারুণ্যকে বলা যায় উল্টানো নারকেলের মতো। ওপরটা সাদা ও নরম, ভেতরটা বাদামি ও কঠিন। ওপরটা হলিউডি-বলিউডি, ভেতরটা স্বদেশি। ওপরটা মোবাইল ভেতরটা স্থির। বাইরে পপ কালচার ভেতরে পরিবার।

আজকের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত তারুণ্যের মন বুঝতে এই দুইয়ের সংঘাতকে বুঝতে হবে। এই বৈপরীত্যের মধ্যে দেখতে পাই দুই ধরনের আধুনিকতা। সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বৌম্যান এর ভাষায় বললে লিকুইড ও সলিড আধুনিকতা তথা তরল আধুনিকতা বনাম ভারী আধুনিকতার টানাটানি। সব যুগেই পরিবর্তনের গতি তারুণ্যের ওপরই ভর করে। তার মন হতে চায় বাঁধনহারা হতে।

তরল আধুনিকতা তাকে সেই ডাকই দিচ্ছে। টেলিভিশনে ডিজুস ব্র্যান্ডের ‘দুনিয়ার সুখ’ নামের একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা যায়, এক বিষণ্ন তরুণ আর এক বিষণ্ন তরুণী ঘর পালিয়ে, দেয়াল টপকে ছুটে যাচ্ছে কোনো এক আলো-আঁধারির উৎসবে। সেখানে নাচ আছে, উত্তালতা আছে, আছে ফুর্তি। কলেজে উঠে তুমি কী চাও? এক তরুণের উত্তর: মাস্তি। একটি এফএম রেডিও চ্যানেলের নামও রাখা হয়েছে রেডিও ফুর্তি।

এমনকি ডিজুসের লোগোর মধ্যেও সেই উত্তাল-ফুর্তি আর দেহজ বিকারের ভঙ্গিমাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে: অনেকগুলো স্তম্ভ একটা কেন্দ্র থেকে ১০ দিকে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। অনেকটা চরম আনন্দে বা ব্যথায় হাত-পা ছুড়ে দেওয়ার মতো। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীদের ফেভারিট সালসা নাচের মধ্যেও সেই দেহজ ভঙ্গিমা আর যৌনাবেগই প্রকাশিত হয়। দুনিয়ার সুখের ওই বিজ্ঞাপনটি হলো আজকের তারুণ্যের তরল আধুনিতার ইশতেহার। এই তারল্য, এই বাঁধনহারা দুনিয়ার সুখ, এই ফুর্তি আর কামজ প্রেম তরল আধুনিকতার লক্ষণ।

তাহলে কঠিন আধুনিকতা কী ছিল, যা থেকে তরুণেরা পালাতে চায়? তরল আধুনিকতার প্রতীক যদি হয় বলিউডি ফিল্ম বান্টি আউর বাবলির রানী মুখার্জি আর অভিষেক বচ্চন, কঠিন আধুনিকতার প্রতীক হলো হারানো সুরের উত্তম-সুচিত্রা জুটি। সিনেমায় যেমন বাস্তবেও উত্তমের জীবন দায়হীন ফুরফুরা নয়, পরিবারের-সমাজের-জীবনের অনেক দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। নায়িকা সুচিত্রারও উপায় নেই সব বাধা উপেক্ষা করে নায়কের কাছে যাওয়া। প্রেম তাঁদের জীবনে একবারই আসে, কিন্তু আজীবন সেই স্মৃতির দুঃখমাখা সুরভি বহন করে চলতে হয়। তাঁরা কেউ কাউকে শেষ পর্যন্ত পায় না, তবু তাঁরা বিশ্বাস করে, ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার।

’ এই প্রেম কঠিন, কোনো মানসিক ডিটারজেন্টেই এই দাগ ওঠে না। বাস্তবেও উত্তমকে অকালে প্রয়াণ করতে দেখি, আর সুচিত্রা সেনকে দেখি লোকচক্ষুর আড়ালে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যেতে। এই প্রেম আজ অচল। সচল হলো বান্টি আউর বাবলির যতক্ষণ ভালো লাগে ততক্ষণ আছি টাইপের প্রেম। জনম জনম তব তরে কাঁদিব আজ কেউ আর বলে না।

ক্যারিয়ার হলো তার ধ্যান-জ্ঞান। গরমের ছুটিতে তারা গ্রামের বাড়ি যায় না, একটা কোর্স করে কিংবা পার্টটাইম জব করে সিভি ভারী করে। আত্মীয়তা থেকে বন্ধুত্ব তাকে বেশি টানে। প্রেম তার স্ট্যাটাসের অনুষঙ্গ মাত্র। বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড থাকলে আড্ডায় বা পার্টিতে কদর বাড়ে, বন্ধুদের চোখটাটানি দেখার সুখ হয় এবং বলা বাহুল্য, দুজনেরই সালসা নাচ শেখা থাকলে ভালো।

নইলে শুনতে হবে ‘পাপ্পু কান্ট ডান্স সালা’। কঠিন আধুনিকতার যুগের শেষ গান ছিল, কেয়ামত সে কেয়ামত তক ছবির ‘পাপা ক্যাহতে হয়, বড়া নাম করে গা’। আর আজকের পাপ্পু নাম নয় বড় কাম করতে চায়, প্রতিষ্ঠা পেতে চায়, চায় সৌভাগ্যের ব্রেক। আজকের বান্টি আর বাবলিরা চায় সম্পর্ক হালকা হোক, চাপ তৈরি না করুক। বিশ্বাস, আস্থা, দায়, মূল্যবোধ তাদের কাছে বাড়তি ঝামেলা।

উত্তম-সুচিত্রার জাদুকরি প্রেমের মোহের চেয়ে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড টাইপের সম্পর্কই তাকে স্বস্তি দেয়। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললে, ‘সুবিধা অনেক কিন্তু ওজনে হালকা; ব্যবহার করেই দেখুন!’ বিনোদন ম্যাগাজিনের প্রেমঘটিত উপদেষ্টা অথবা মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলররাও এখন এই পরামর্শই দেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ভালবাসা, প্রেম নয় এরা চায় না। এরা চায় প্রেম, ভালোবাসা নয়। বাস্তব প্রয়োজনের সঙ্গে রোমান্টিক চাওয়ার সংগতি স্থাপনের সমস্যারই প্রতিফলন ঘটে এই মনোভাবে।

তরল আধুনিকতার আরেকটি প্রতীক হলো মোবাইল। মোবাইল প্রজন্ম ও তরল আধুনিকতা প্রায় সমার্থক। তার অস্থির জগতে একমাত্র স্থির বিষয় হলো মোবাইল। মোবাইল মানে ক্যারিয়ার ও বন্ধুত্বের গতিশীল নেটওয়ার্ক। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক তারুণ্যেরও নেটওয়ার্ক।

সম্পর্কের চেয়েও দামি এই নেটওয়ার্ক। তরল তারুণ্য সম্পর্ককে ভয় পায়, সে চায় হালকা নেটওয়ার্কের মধ্যে পালকের মতো ভাসতে। তরল আধুনিকতা ও ভারী আধুনিকতার পার্থক্য ল্যান্ডফোন আর মোবাইল ফোন দিয়েও বোঝানো সম্ভব। ল্যান্ডফোনকে থাকতে হয় দেয়ালের পাশে টেবিলের ওপর স্থির হয়ে। তার জন্য তারের লাইন লাগে, লাগে প্লাগ ও সকেটের সঙ্গে স্থায়ী যোগাযোগ।

কিন্তু মোবাইল-ইন্টারনেটের নেটওয়ার্কে থাকার জন্য কোনো প্লাগ, কোনো লাইন, কোনো ঘর-টেবিলের প্রয়োজন নেই। ঘর-বাহির এখানে একাকার। নেটওয়ার্কে ঢোকা ও বেরিয়ে আসা কেবল একটা ক্লিকের ব্যাপার। যুক্ত থাকার জন্য কোনো দায়, আস্থা, বিশ্বাস, ভার কিছুই নিতে হবে না। ইচ্ছেমতো বন্ধু হওয়া বা বাতিল করায়ও কোনো মানা নেই।

ভার্চুয়াল বন্ধুত্বকে তাই বলা যায় পাতলা সম্পর্ক। সেজন্যই বুঝি তা এত জনপ্রিয়। অন্যদিকে কারও সঙ্গে সম্পর্ক করা মানে অন্য রোমান্টিক সম্ভাবনার দরজা বন্ধ করে দেওয়া। তরল আধুনিকতার যৌনতা ও প্রেম কমিটমেন্ট ও ভালোবাসা ছাড়াও সম্ভব। অনেকটা পণ্যের মতো, চাইবামাত্র তৃপ্তি পাবেন, কিছুক্ষণ পর ভুলে যাবেন এবং আবার চাইবেন।

কবি শহীদ কাদরী বহু আগেই বলেছেন, ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কিন্তু শান্তি পাবে না পাবে না পাবে না। ’ আর রবিঠাকুরের গান তো আছেই, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না’। আজকের তারুণ্য বলবে, সুখের চেয়ে আনন্দই উত্তম। এই আনন্দ-মাস্তি-ফুর্তির হালকা নেটওয়ার্ক গভীর সম্পর্কের ভার বইতে পারে না। ফেসবুকে তারই বেশুমার নজির।

মিলান কুন্ডেরার বিখ্যাত উপন্যাস আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং বা সত্তার অসহ্য নির্ভার এরও বিষয় ছিল এই টানাপোড়েন। নায়ক অনেকটা মাসুদ রানার মতো, কাছে টানে কিন্তু জড়াতে চায় না কাউকেই। কারও দায়িত্ব নেওয়া, প্রেমের বন্ধনে জড়ানো তার ভারী লাগে, হাঁসফাঁস লাগে। কিন্তু উপন্যাসের শেষে তাকেই দেখা যায়, তানিয়া নামের মফস্বলের মেয়েটির সঙ্গে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে, যেখানে তারা সন্তান জন্ম দেবে, খামার গড়ে তুলবে, দুজনের জন্য শুধু দুজনই থাকবে, এমন আস্থা তাদের। নায়ক থমাসের তখন মনে হয়, নিদায় নির্ভার ভেসে বেড়ানোটাই বরং অসহনীয়।

তরল বা কঠিন, পাতলা বা গভীর যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত জীবন একটাই। সেই জীবনকে রাংতার মতো একদিকে চকচকে আর অন্যদিক ফাঁকা রয়ে গেলে হতাশার বোধে জর্জরিত হওয়া বিচিত্র নয়। তারুণ্য নিজেকে এতটা হালকা ও তরল করতে পারে না যে, সামাজিক-রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব ছাপিয়ে তারা বেলুনের মতো ওপরে উঠে যাবে। বেলুন একসময় ফাটে বা চুপসায়। আবার যে সমাজ-রাজনীতি তাদের স্বতঃস্ফূর্ততাকে আটকায়, সেটাও ভেঙে পড়তে পারে।

তা যে পারে, তা প্রমাণ করেছে তিউনিসিয়ার যুব প্রজন্ম। তাদেরও ছিল মোবাইল নেটওয়ার্ক, ফেসবুক-নেশা আর তরল আধুনিকতার পাতলা সম্পর্ক। বৈষম্য, বেকারত্ব ও স্বৈরশাসনের ঘেরাটোপের বাইরে সেটাই ছিল তাদের সচলায়তন। কিন্তু দুঃশাসন একসময় তাদের বেপরোয়া করে তোলে। মুহাম্মদ বুয়াজিজ নামের এক তরুণ গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মাহুতি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দেয়।

এই আগুন দাবানল হয়, তার তাপ ভার্চুয়াল দুনিয়ার পাতলা নেটওয়ার্কেও লাগে। যে বাস্তব দুনিয়ার দুঃখ তাদের ভার্চুয়াল দুনিয়ার দিকে ঠেলেছিল, সেই দুনিয়ার চাপেই তারা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। লাখো তরুণ-তরুণী পথে নেমে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলে। ২৪ বছরের স্বৈরশাসনের খলনায়ক বেন আলী দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তাদের এই ঘুরে দাঁড়ানোতেই ইতিহাস জেগে উঠল, ঘটল বহু কাঙ্ঘিত পরিবর্তন।

এই পরিবর্তন সলিড ও কঠিন। যে তরল আধুনিকতা ও পাতলা সম্পর্কের নেটওয়ার্ক তাদের ভাসাচ্ছিল, এবার তারাই সেই নেটওয়ার্ককে ভাসিয়ে দেয় সেই কঠিন পরিবর্তনের সংগ্রামে। তরল আধুনিকতা তাদের উল্টানো নারকেল বানাতে চাইলেও, জীবনের ডাকে তারা সোজা হয়, কঠিনের বিরুদ্ধে দেখায় কাঠিন্য আর কোমলকে বাঁচিয়ে রাখে বুকের ভেতর। ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক। সংগ্রহে nixon1333


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।