আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্ব ইজতেমাঃ আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার



লেখক : মুফতি মুফিজুর রহমান ............................................................ ঢাকার শিল্পনগরী, টঙ্গীর কিংবদন্তি ও ইতিহাসখ্যাত “কহর দরিয়া” বর্তমান তুরাগ নদীর তীরে হজ্জের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ব বৃহৎ মুসলিম মহা সম্মেলন “বিশ্ব ইজতেমা” অনুষ্ঠিত হয় আমাদের এই দেশে। তাহা আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার । কথিত আছে যে, তাবলীগের মুরব্বীদের বৈঠকে স্থান নির্ধারনের জন্য নাকি লটারী হয়েছিল। লটারীতে বাংলাদেশেরই নাম উঠে। আর সেই থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় এই দ্বিতীয় বৃহৎ জমায়েত।

প্রতিবারই দেশী বিদেশী মেহমান ও সাধারণ মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয় ঐতিহাসিক তুরাগ নদীর তীর। প্রায় ১৬০ একরের বেশী জমির উপর চটের তৈরী সামিয়ানার নীচে ধনী, গরীব, আশরাফ, আতরাফ, আমির, ফকির, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আলেম, উলামা সহ সর্ব স্থরের মানুষের উপস্থিতি যেনো বর্তমান অশ্বান্ত বিশ্বের ঝঞ্জাবিক্ষুদ্ধ ও প্রতিহিংসার অনলে সৌর্হাদ্য, ভ্রাতৃত্ব, প্রেম-প্রীতি ও মায়া মমতার এক অতুলনীয় তীর্থস্থান। নজির বিহীন ভালো-বাসা ও নিজেকে মিটিয়ে দেয়ার মানুষিকতা অর্জনের কেন্দ্রস্থল। একটি শব্দ শুধু “খামুশ” বলার সাথে সাথে পুরো ঐতিহাসিক পিন্ডালের লাখো লাখো বনি আদম নিরব নিশচুপ হয়ে যায়। এ যেনো এক জীবন বদলে দেয়ার বিপ্লবী পথ।

নীরব বিপ্লব, মানুষ গড়ার বিপ্লব, জীবন গঠন করার বিপ্লব, দেশে-বিদেশে সর্বত্র চলছে এই বিপ্লব। কোথাও কোনো বাঁধা নেই। নেই কোনো প্রতিপক্ষ এই বিপ্লবের। সামান্য হাতে গুনা কয়েক চুনোপুটি বা চামচিকা ব্যতীত। এ যেনো এক মকবুল ও মাশহুর দ্বীনি আন্দোলন।

পৃথিবীর সর্বত্র একই আওয়াজ। “এ্যাই মুসলমানো তুম মুসলমান বনো”। প্রায় ছয় দশক আগে বিশ্ব তাবলীগী জামাতের স্বার্থক রূপকার, দাওয়াত ও ইরশাদের কিংবদন্তী হযরত মাওলানা ইলিয়াছ কান্দলভী (র) এর এই বুলন্দ আওয়াজ আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে । যদি ও নাম তার তবলীগ জামাত। কিন্তু এতো সকল নবীদের কাজ।

দাওয়াতের বানী নিয়ে উম্মাহর সংশোধনের আশায় নবীদের দাওয়াতের প্রতি ধবনিরই পুনচ্চারন । নবী নাই। তাই নবীর ওয়ারিসরাই এ কাজ আন্জাম দেবে। ওটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস তা-ই বলে।

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ৪৭তম বিশ্ব ইজতেমা বিশ্ব মুসমানের জন্য দু ভাগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামী ২১জানুয়ারী থেকে। ভারতের রাজস্থানের এক আলোকিত রুহানী পুরুষ, স্বার্থক নবীর স্বার্থক উত্তরসূরী মাওলানা ইলিয়াসের সুচিন্তিত ও প্রবর্তিত এই মেহনতের আলো জ্বলছে পৃথিবীর সর্বত্র। এতে জাতির ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ নিহিত। এ দ্বীনি আন্দোল চলছে, চলবেই। যতদিন মানুষ কল্যান ও মুক্তি চাবে।

যেভাবে শুরু : ১৯১০সালে ভারতের প্রাণ পুরুষ মাওলানা ইলিয়াছ কান্দলভী (র) রাসুল (সা) কর্ত্তৃক সপ্নাদিষ্ঠ হয়ে তাবলীগ জামাতের এ কাজ শুরু করেন। ভারতের ইতিহাসিক রাজস্থানের “মেওয়াতে” মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯৪৪) এই জামাতের কার্যক্রম তিনি নিজেই পরিচালনা করেন। মহান এই বুযুর্গের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য উত্তর সুরী ও একমাত্র ছেলে মাওলানা মুহাম্মদ ইউছুফ কান্দলভী (র) এ জামাত পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন ভারতের ছোট্ট ও প্রত্যন্ত এলাকাকে কেন্দ্র করে চালু হওয়া এ কাজ ধীরে ধীরে এশিয়ার সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এক সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জামাতের বিপুল সংখ্যক অনুসারীকে একত্রে জমায়েতের উদ্দেশ্যে একটি বার্ষিক সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা অনূভুত হতে থাকে।

১৯৪৬সালে প্রথম ইজতেমা বা ধর্মীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ তাবলীগ জামাতের মারকায ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। ১৯৪৮ সালে চট্রগ্রাম হাজী ক্যাম্পে। ১৯৫৮সালে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৫সালে টঙ্গির পাগারন নামক স্থানে। এক পর্যায়ে দেশী-বিদেশী ধর্ম প্রাণ মুসলমানদের অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থান সংকুলানের অভাবে ইতিহাসখ্যাত “কহর দরিয়া” বর্তমান তুরাগ নদীর তীরে ১৯৬৭সালে বিশ্ব ইজতেমার স্থান স্থানান্তর করা হয়।

সেই থেকে আজও প্রতি বছর এখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দ্বীনী জামাত বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬সালে তৎকালীন সরকার এই জায়গায় (১৬০একর জমি) স্থায়ী ভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্ধ দেয়। ইজতেমা মূল কর্মসূচীঃ তিনদিনের বিশ্ব ইজতেমার মূল কর্মসূচীতে থাকে আম বয়ান, খাছ বয়ান, তাশকিল, তা’লিম, ছয় উসুল বা নীতি। এর আলোকে মানুষের জীবন বদলে দেয়ার মেহনত, জামাত তৈরী, চিল্লার প্রস্তুতি ও যৌতুক বিহীন বিয়ে। ইজতেমা মাঠে মুসল্লিদের অবস্থানঃ বিশ্ব ইজতেমার মাঠে মূলত জামাত বা দলবদ্ধ তাবলীগ সাথীরাই যোগদান করেন।

এই মনস্কা আরো অনেক ধর্ম প্রাণ ও বার্ষিক এ মহৎ মাহফিলে অংশ গ্রহণ করেন। সারা দেশ থেকে আগত মানুষকে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকের সঙ্গে জামাতওয়ারী মিশিয়ে দেয়া হয়। এভাবে মোট ছয় শত থেকে সাত শতটি গ্রুপ রয়েছে। এছাড়া বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অংশ গ্রহণ কারীদের ও সুযোগ মত জামাত ভুত করে নেয়া হয়। ইজতেমায় জামাতবদ্ধ হয়ে আগত তাবলীগীদের জন্য থাকে প্যান্ডেলের নিচে নির্দিষ্ট খিত্তা (জোন) ও খুটি , প্রত্যেক জোন বা খিত্তাকে জেলা ওয়ারী নাম ও নম্বারিং করে দেয়া হয়।

আর যারা জামাতবদ্ধ ছাড়া আসেন তাদের অবস্থানের নির্দিষ্ঠ কোনো স্থান নেই। মাঠের খোলা স্থানে বা প্যান্ডেলের নীচে পরিচিত কারো সাথে তাদের অবস্থানের সুযোগ আছে। বিদেশী মেহমান ও তাবলীগীদের জন্য রয়েছে আলাদা আর্ন্তজাতিক নিবাস। ১৯৯৯ সালের আগে বাংলাদেশের ভি আই পি দের জন্য টিকেটের ভিত্তিতে লোকাল গেষ্ট নামে কয়েকটি প্যান্ডেল তৈরী করতে দেয়া গেলেও এরপর থেকে তা বাতিল করা হয়েছে। আমবয়ানঃ ইজতেমা মাঠে উপস্থিত সমবেত তাবলীগীদের উদ্দেশ্যে যে বয়ান দেয়া হয়।

তাকে আম বয়ান বলা হয়। আম বয়ান সাধারণত বিভিন্ন দেশ থেকে আগত তবলীগের প্রবীন ও শীর্ষস্থানীয় মুরব্বীরাই করে থাকেন। তবে তাৎক্ষনিক ভাবে বাংলা, আরবী, ইংরেজী, উর্দু, মালয়, তামিল, ফ্রাস, থাই, তুর্কি সহ আরো বেশ কয়েকটি ভাষায় বহু ভাষার পন্ডিত ব্যক্তি ও আলেমরা তার অনুবাদ করে দেন। খাছ বয়ানঃ- বিদেশী তাবলীগী ও বাংলাদেশের আলেম ওলামা ও মাদরাসা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে যে বয়ান করা হয় তা খাছ বয়ান হিসাবে পরিচিত। ইজতেমায় যে সব দেশের প্রতিনিধিরা যোগদেনঃ ইজতেমায় বিদেশী প্রতিনিধিদের আগমন প্রতি বছরই বেড়ে চলছে।

এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় এক শতটির মতো দেশের প্রতিনিধি বিশ্ব ইজতেমায় যোগদান করেছেন। সাধারণত যে সব দেশের প্রতিনিধি বিশ্ব ইজতেমায় যোগদান করেন- ভারত, পাকিস্থান, সৌদী আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য অষ্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ইরান, ইরাক, ইসরাঈল, ফিলিস্থিন, ইরিত্রিয়া, ইথিত্তপিয়া, মিশর, জিবুডি, বাহরাইন, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, আমিরাত, সাদ, সুদান, সোমালিয়া, সিরিয়া, ওমান জর্দান, মরক্কো মৌরিতানিয়া, সুইডেন, শ্রীলংকা, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, রাশিয়া, তুরস্ক, সেনেগাল, ত্রিনিদাদ, সুরিনাম, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া, তান্জারিয়া, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে. দক্ষিন আফ্রিকা, পানামা, পিলিপাইন, মিয়ারমার, মারি, মোজাম্বিক নেদারল্যান্ড, জাপান, ইতালি, কেনিয়া, কামার, ফ্রান্স, জার্মানি, ফিজি, মাদাগাস্কার, কমরোজ, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, চিন, ব্রুনাই, কানাডা, কম্বোডিয়া, ক্যামেরুন ইত্যাদি। মোদ্দাকথাঃ- জানা অজানা আরো অনেক দেশে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ চলতেছে। বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন বর্ণের লোকদের মাঝে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ অব্যাহত। নবীয়ে রহতম হযরত মুহাম্মদ (সা) উম্মতের এই মহৎ কাজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।

এটাই ইসলামের বিজয়। বিশ্ব ইজতেমার লোক সংখ্যাঃ লোক সংখ্যার সঠিক হিসাব একমাত্র আল্লাহ পাক ব্যতীত কে জানে? যেমন হজ্জ্বের মৌসুমের সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারেন না। তবে দেশের পত্রিকা-মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩৫/৪০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। কোনো কোনো বছর বেশ-কম হতে পারে। লন্ডন ভিত্তিক ইকোনমিষ্ট এর সংবাদদাতা এর চেয়ে অনেক বেশির বিবরণ ও দিয়েছেন।

মোট কথা ইজতেমা যেমন বিশাল তার লেখনির পরিধি ও বিশাল। এজন্য সব কথা এখানে তুলে ধরা সম্ভব হবে না। বিশ্ব ইজতেমা সর্ম্পকে কোনো সু-নির্দিষ্ট তথ্য দেয়া কঠিন। যৌতুক বিহিন বিবাহঃ ইজতেমার অন্যতম আকর্ষন যৌতুক বিহীন বিবাহ। ইজতেমার দ্বিতীয় দিন বর ও কনের সম্মতিতে তাদের উভয় অভিভাকদের উপস্থিতিতে প্রায় শতাধিক বিয়ে অনুষ্টিত হয়।

যৌতুকের মরন ছোবলে আক্রান্ত ও অতিষ্ট আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এ যেনো এক ব্যতিক্রম রহমত সরূপ। আগের যুগের মতো সাদাসিধে বিয়ে সাদী হয়। এতে বরকত হয়। সম্পদ ও বাড়ে। - নারীদের অংশগ্রহনঃ- কর্ত্তপক্ষ থেকে নারীদের কোনো অংশগ্রহণের কোনো ব্যবস্থা না থাকলে ও প্রতিবারই মহিলাদের বিরাট সমাগম হয়ে থাকে।

শত ব্যস্থতা সত্তেও দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী সহ দেশের উল্লেখযোগ্য মহিলারা জমায়েত হন। এছাড়া অন্যান্য ব্যবস্থাপনাঃ হারানো বিজ্ঞপ্তি কামরা, মিডিয়া ব্যবস্থাপনা, দাতব্য চিকিৎসালয়, ভ্রাম্যমান আদালত সহ ইজতেমাকে কেন্দ্র করে হাজার ও কর্ম ব্যবস্থা, মানুষের কর্ম ক্ষেত্র ও রুজির ব্যবস্থার দুয়ার খুলে। বিশেষ করে তুরাগ নদীর তীরে বসতি এলাকা ও বৃহত্তর টংঙ্গীর মানুষের জন্য ইজতেমার সময়ে অধিক রোজি রোজগারের সুযোগ হয়। দেশের বাহিরে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলের ও এর আকর্ষন ও আবেদন এবং এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। যদি ও কিছু সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে এই আলোর মিছিল ও হেদায়েতের পথ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে চায়।

আল্লাহ পাক তাদের সহীহ সমুজ দান করুন। লেখক : মুফতি মুফিজুর রহমান শিক্ষক : জামেয়া নূরীয়া ইসলামিয়া ভার্থখলা, সিলেট। সদস্য : জাললাবাদ লেখক ফোরাম, সিলেট।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.