আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাস্তি



‘ও আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল,’বলতে বলতে জানালার বাইরে চোখ রাখল রায়হান। অন্ধকারে মৃদুমন্দ বাতাসে দুলতে থাকা নারকেলের পাতাগুলোর দিকে শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ওর নাম ছিল শহীদ সোবহান। ওর বাবা ছিলেন সোবহান চৌধুরী,আরামবাগের এমপি। আমরা সবাই এ তাকে মস্ত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই জানতাম। ’ কথা থামিয়ে অরিনের দিকে তাকালো রায়হান।

বোধহয় বোঝার চেষ্টা করল সে মন দিয়ে শুনছে কিনা। তাকানো মাত্র অধৈর্য গলায় বলে উঠল অরিন,’তারপর?’ ‘তারপর?’মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল রায়হান,’তারপর তোমরা বন্ধুদের সাথে যা যা কর আমরাও তাই করতাম। ক্লাসে দুষ্টুমি,মাঠে খেলাধুলা,এর-ওর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া,ছুটির দিনে পিকনিকে যাওয়া, আরও কত কি!’ ‘তবে আমি আর শহীদ কিন্তু ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিলাম না। আমি ওদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস সেভেনে। কিন্তু মাত্র কটা দিনের মধ্যেই আমার মনে হল,ওর মত বন্ধু আমার জীবনে কোনদিন হয়নি।

ও এত বন্ধুবৎসল...আর ভীষণ ডানপিটেও ছিল। ঐ যে পানির ট্যাংকটা দেখছ না?আমাদের বাড়ির সামনেও ওরকম একটা পানির ট্যাংক ছিল। বিকেলবেলা ওতে পা ঝুলিয়ে বসে আমরা আড্ডা দিতাম। ’ ‘অত উঁচু ট্যাংকে বসে?’অবাক গলায় বলল অরিন,’তোমার ভয় করত না বাবা? ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমার একটু ভয় করত, কিন্তু শহীদের সামনে বলতে লজ্জা পেতাম,’হাসল রায়হান,’যদি ও আমাকে ভীতু ভাবে!’ ‘এই শহীদের জন্মদিনে একদিন ওর বাসায় দাওয়াত পেলাম,’আবার প্রসঙ্গে ফিরে এল রায়হান,‘বিরাট আয়োজন,প্রচুর মানুষ। তাদের মধ্যে মন্ত্রী-এমপিরাও আছেন।

সেদিনই প্রথম শহীদের বাবা সোবহান চৌধুরীকে দেখলাম। মুক্তিযোদ্ধা!শুনলেই কেমন একটা অনুভূতি হয় বুকের ভেতর। যুদ্ধের সময় আমার বয়স দুই বছর,কিছুই বুঝিনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শ্রদ্ধা আর ভালবাসার তো কোন ঘাটতি নেই। সোবহান চৌধুরীকে দেখে মনে হয়েছিল আদর্শ একজন মুক্তিযোদ্ধা।

সেদিন খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর উনি আমাদের,মানে সব ছোটদের শুনিয়েছিলেন একাত্তরের গল্প। সেদিন শহীদকে দেখেছিলাম গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে। বাবাকে ভীষণ ভালবাসত ও। ওর মা মারা গিয়েছিলেন সেই একাত্তরেই। ’ ‘বাড়ি ফিরে আমি সবাইকে বলেছিলাম শহীদের বাবার যুদ্ধের গল্প।

গল্পগুলো এক ধরণের শিহরণ জাগাত আমাদের মধ্যে। বন্ধুদের আড্ডায়ও ঘুরে ফিরে ওর বাবার সাহসীকতার কথা উঠত। আর তখনই উজ্জ্বল হয়ে উঠত শহীদের মুখ। বাবাই ছিল ওর সব। ’ দম নেয়ার জন্য একটু থামল রায়হান।

মাথা নিচু করে নিজের নখগুলো দেখতে দেখতে একটূ হাসল,‘তখন ছোট ছিলাম। শহীদের জন্মদিনের উৎসব দেখে তখন আমারও ইচ্ছে হয়েছিল জন্মদিন পালনের। আমাদের বাসায় জন্মদিনের কোন উৎসব হতনা। কিন্তু সেবার আমার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়েই একটা ছোটখাট উৎসবের আয়োজন করলেন বাবা-মা। শহীদদের মত অত ভালো অবস্থা না থাক্লেও আমরা বেশ স্বচ্ছল ছিলাম।

জন্মদিনে দাওয়াত পেল আমার সব বন্ধুরা। ’ ‘জন্মদিনের আগেরদিন বরিশাল থেকে নানী এসে হাজির। আমার খুশি আর দেখে কে!সারাদিন নানীর সাথে বসে রাজ্যের গল্প। গল্প হল স্কুলের,বন্ধুদের,আর হ্যাঁ, গল্প হল শহীদের বাবা সোবহান চৌধুরীরও। আমাদের এলাকার গর্ব যিনি।

’ ‘সোবহান চৌধুরীর নাম শোনা মাত্র নানী জিজ্ঞেস করলেন,‘শহীদদের দেশের বাড়ী কোথায় রে?’ ‘তা তো জানিনা নানী,কাল শহীদ এলে ওকেই বরং জিজ্ঞেস কোরো’,বলে আমি সোবহান চৌধুরীর মুখে শোনা তার যুদ্ধের গল্পগুলো একে একে শোনালাম নানীকে। শুনতে শুনতে নানী যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। আমি ভাবলাম,বোধহয় নানার কথা মনে পড়েছে। আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একাত্তরে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে খুন করে তাকে।

’ রায়হান এ পর্যন্ত বলতেই দরজায় উঁকি দিল ফাহমিদা,‘ক’টা বাজে দেখেছ?এগারোটা। আজ রাতে ঘুমাবেনা তোমরা?’ ‘প্লিজ মা আরেকটু,’অনুনয় করল অরিন,‘আর পাঁচটা মিনিট মা। ’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিক দশ মিনিট দিলাম। এরপর কিন্তু শুতে আসতে হবে।

’ হাসি ফুটলো অরিনের মুখে,’থ্যাংকিউ মা। ’ রায়হান এতক্ষণ কথা বলেনি,এবার ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে হাসল। ফাহমিদা হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যেতেই আবার গল্পটা শুরু করল সে,’সেবারের জন্মদিনটা আমার দারুণ কেটেছিল। সব বন্ধুরা নানীর সাথে বসে গল্প করলাম,মজা করলাম,কেক কাটলাম,আরও কত কি!’ ‘রাতে সবাই চলে যেতেই নানীর কাছে এসে বসলাম আমি। আমি লক্ষ্য করছিলাম নানী আমাদের সাথে আনন্দে যোগ দিলেও মুখখানা বরাবরই ম্লান।

এবার জিজ্ঞেস করলাম,‘তোমার কি হল নানী বলত?’ কেমন একটা অসহায় হাসি হাসলেন নানী,‘যা ভেবেছিলাম। শহীদ বলল,ওদের দেশের বাড়ি বরিশালেই,এবং আমাদেরই গ্রামে। আর তখনই বুঝে গেলাম,সোবহান চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা নয়। সে সেই রাজাকার,যে তোর নানাকে খুন করেছে। ’ ‘বজ্রাহত হয়ে বসে রইলাম আমি।

নানীর কথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। কিন্তু শহীদের বাবা রাজাকার...খুনী!শুধু তাই না,লোকটা মুক্তিযোদ্ধা সেজে সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছে!রাগে আমার শরীর জ্বালা করতে লাগল। ইচ্ছে হল ঐ মুহূর্তে গিয়ে সবাইকে ডেকে সোবহান চৌধুরীর কথা জানাই। ’ ‘কিছুক্ষণ চিন্তা করে ভাবলাম,প্রথমেই শহীদকে বলা উচিত। ওর বাবাকে ও যতখানি ভালবাসে,রাজাকার জানলে কি আর ততখানি বাসবে?ও নিশ্চয় আমাকে সাহায্য করবে সোবহান চৌধুরীর মুখোশ খুলে দিতে।

’ ‘সেই রাতেই ছুটলাম শহীদদের বাসায়। ও তখন ঘুমানোর আয়োজন করছিল। আমাকে দেখে দ্রুত ওর ঘরে নিয়ে বসালো,ও ভেবেছিল কোন দুঃসংবাদ। ’ ‘অবশ্য কথাগুলো ওর জন্য দুঃসংবাদই ছিল। উত্তেজনার প্রথম ধাক্কায় আমি এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলে গেলাম।

শহীদের দিকে ভাল করে তাকাইনি পর্যন্ত। বলা শেষ হলে আমি দেখলাম ও কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর চেহারায় যেন এক ফোঁটা রক্ত নেই। ও আর একটা কথাও বলতে পারছিলনা। ’ ‘আমার মনে তখন সোবহান চৌধুরীকে ধরবার তাড়া।

ওর এই চেহারা দেখে মনে হল ও বুঝি আমার কথা বিশ্বাস করছেনা। আমি ওর অবস্থা বোঝার চেষ্টা না করে আরও জোর দিয়ে বললাম,তোর বাবা এতদিন সবাইকে ধোঁকা দিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন যখন আমরা সব জানি,আমরা এই অন্যায় চলতে দিতে পারি না। ’ খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল শহীদ। স্তিমিত স্বরে বলল,‘সব হবে।

তবে আজ না। আজ তুই বাড়ি যা,আমাকে একটু ভাবতে দে। ’ ‘শহীদ বাড়ি যেতে বলায় আমার খানিকটা রাগই হল। মনে হল,ও আমার কথা বিশ্বাস করছেনা। আবার এও মনে হল,যদি আজ রাতেই শহীদ তার বাবাকে নিয়ে পালিয়ে যায়?কিন্তু আমার তো আর কিছু করার ছিলনা।

বাড়ি ফিরে এসে আমি সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম,ঘুমাতে পারলামনা। ’ গল্প থামিয়ে এবার অরিনের দিকে তাকালো রায়হান,‘এবার শুয়ে পড় মা,অনেক রাত হল। বাকিটা কাল বলব। ’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও আর কিছু না বলে ঘুমাতে গেল অরিন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আজ অনেক এলোমেলো স্বপ্ন দেখল সে।

অনেকগুলো রাজাকার,তাদের ধরে ধরে ফাঁসি দিচ্ছে,আরও কত কি!কিন্তু অবাক কান্ড,রাজাকারগুলো ফাঁসি হয়েও মরল না,আবার জেগে উঠতে লাগল। এক পর্যায়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। কেমন অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছিল সে!উঠে বসে ঘড়ি দেখল,রাত পৌনে দুটা। পানি খাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এল অরিন।

বেরোতেই চোখে পড়ল বাবার পড়ার ঘরে আলো জ্বলছে। গুটিগুটি এগিয়ে গেল সেদিকে। অনেকসময় বাবা বই পড়তে পড়তে আলো জ্বালিয়ে রেখেই টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু না,আজ বাবা ঘুমায়নি। হলদে হয়ে যাওয়া একটা কাগজ নিয়ে একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

তার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল কাগজটার উপর। বাবা কাঁদছে!অবাক হয়ে ডাক দিল সে,‘বাবা!’ চমকে তাকালো রায়হান,সাথে সাথেই সামলে নিয়ে বলল,‘ঘুমাওনি?’ ‘ঘুম ভেঙ্গে গেছে বাবা’,ঘরে ঢু্কল অরিন,‘তুমি কি পড়ছ?’ হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল রায়হান। তারপর কাগজটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিল নীরবে। দ্বিধাভরে কাগজটা নিল অরিন। কার যেন এটা চিঠি।

পড়া শুরু করল সে, রায়হান, কাল রাতে তুই যখন বাবার কথা বলছিলি,আসলেই প্রথমে আমি একবিন্দু বিশ্বাস করিনি। বাবা আমার কাছে সবকিছু। তিনি কি আমাকে মিথ্যা বলতে পারেন?এজন্যেই খানিকটা সময় চেয়েছিলাম তোর কাছে। তুই যাবার পর ভেবে দেখলাম,তুই যা বলেছিস তাই সত্যি। কারণ আমার জ্ঞান হবার পর থেকে কোনদিনও বাবা আমাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাননি।

হয়ত সত্য প্রকাশ হবার ভয়েই। তারপর মনে পড়ল ছোটবেলায় একদিন এক লোককে দেখেছিলাম আমাদের বাড়ির সামনে এসে রাজাকার,রাজাকার বলে চেঁচাতে। পাগল ভেবে তাকে পুলিশে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ বুঝি,সেই ছিল একমাত্র সত্যবাদী। বাকিরা সব বাবার ক্ষমতার ভয়ে মিথ্যাকে স্বীকার করে চলেছে।

কিন্তু বাবাকে ভালবাসলেও আমি ত চুপ করে থাকতে পারবনা। বাবা আমার বিশ্বাস ভেঙ্গেছে,বাবা খুনী। তাকে আমি এমন শাস্তি দিচ্ছি,একজন বাবার জন্য তারচেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই হতে পারেনা। বাবা যতদিন বেঁচে থাকবে,তার মিথ্যার জন্য অনুতাপ করবে। রাজাকার জানার পর তার দেশ যদি তাকে শাস্তি দেয় দেবে,কিন্তু আমি,যে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতাম,তাকে সবচেয়ে বড় শাস্তিটা দিয়ে যাচ্ছি।

আমি চিরকাল গর্ব করে এসেছি আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কিন্তু রাজাকারের সন্তান হওয়ার অপমান আমি সহ্য করতে পারবনা। তুই নিজেকে কোন দোষ দিসনা রায়হান। তুই আমাকে সত্যটা জানিয়ে বরং উপকার করেছিস। আমি আশা করব তুই সারাজিবন সত্যের সঙ্গেই থাকবি।

ভাল থাকিস, শহীদ পড়া শেষ করে জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল অরিন। মাথা নিচু করে বসেছিল রায়হান। ধীরে ধীরে বলল,‘পরদিন সকালে পানির ট্যাংকের নিচে পাওয়া যায় শহীদের লাশ। ওর পকেটে ছিল এই চিঠিটা। ’


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.