আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাহেরের ‘বিনয়ে’ ভীত ভোটাররা!

আমার সোনার দেশ, বাংলাদেশ

আমি ভালো হয়ে গেছি। গত দুই বছরে কোনো অন্যায় করিনি। শোধরানোর চেষ্টা করছি। আমাকে ভোট না দিলে হয়তো আগের অবস্থা ফিরে আসবে। সেটা যাতে না হয়, সে জন্য আপনারা ভোট দেন।

’ লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার একজন ভোটার দাবি করেছেন, তাঁর কাছে এভাবেই ভোট চেয়েছেন মেয়র পদপ্রার্থী আবু তাহের। তবে তাহের প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি কারও কাছে ভোট চাইছেন না, দোয়া চাইছেন। ২০০০ সালের ঘটনা। লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলামের লাশটাও দেখতে পারেনি তাঁর স্বজনেরা। তখনকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধারণা ছিল, হত্যার পর তাঁর লাশ টুকরো টুকরো করে মেঘনার স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ওই মামলায় সন্ত্রাসের ‘গডফাদার’ বলে পরিচিত লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু তাহেরের ছেলে এ এইচ এম বিপ্লব ফাঁসির দণ্ড নিয়ে ফেরারি। তাহেরও দীর্ঘদিন কারাভোগ করে এখন বাইরে। ‘হারানো রাজত্ব’ ফিরে পেতে আবারও মরিয়া তিনি। এর অংশ হিসেবে এবার পৌরসভার মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। পৌরবাসীকে বিস্মিত করে আওয়ামী লীগও তাঁকে সমর্থন দিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা, এর মাধ্যমে তাহেরকে আবার স্বরূপে ফেরার সুযোগ করে দেওয়া হলো। এখনই তাহেরের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। গত কয়েক দিন সরেজমিন ঘুরে লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার মানুষের মধ্যে শঙ্কা, ভয় ও আতঙ্ক দেখা গেছে। খোদ আওয়ামী লীগেরই সহসভাপতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তাহের লক্ষ্মীপুরকে আবারও ‘সন্ত্রাসের জনপদে’ পরিণত করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। শুধু নুরুল ইসলাম নন, যুবলীগের কর্মী কামাল, ছাত্রদলের নেতা ফিরোজ, শিবিরের মহসীন, কামাল ও জায়েদের পরিবার আজও সন্তান হারিয়ে নীরবে চোখ মুছছে।

ছাত্রদলের নেতা মনসুর আহমেদ, আনোয়ার হোসেন জুলফু, নূর আলম বেঁচে আছেন। তবে কারও দুই হাত কবজি পর্যন্ত কাটা, কারও পা নেই। এঁরা সবাই তাহের ও তাঁর ছেলেদের সন্ত্রাসী বাহিনীর শিকার। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হলো। সবার একই শর্ত, কিছুতেই তাঁদের নাম প্রকাশ করা যাবে না।

তাঁদের বক্তব্য, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে ফেনীর জয়নাল হাজারী, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, লক্ষ্মীপুরের তাহেরসহ কয়েকজন গডফাদারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সারা দেশে নিন্দিত হয়েছিল। এদের সৃষ্ট দুর্নামের কারণে জাতীয় নির্বাচনেও হারতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। কিন্তু এবার অন্য গডফাদারদের দূরে রাখলেও তাহেরকে আবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়েছে। এতে এলাকায় নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) নজরুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কথায় আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁধুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।

আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি পরিস্থিতি ঠিক রাখতে। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ আতঙ্কে থাকলে পুলিশকে অবহিত করা উচিত। পুলিশকে জানালে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন—এই আশঙ্কায় অনেকেই থানা-পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে এসপি বলেন, ‘অভিযোগকারীকে নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের নৈতিক দায়িত্ব। ’ নির্বাচনকে ঘিরে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছেলে বিপ্লবের তৎপরতা বিষয়ে এসপি বলেন, ‘লোকে বলে, একটু আগে সে লক্ষ্মীপুরে ছিল।

এখন চলে গেছে। তবে তাঁকে পাওয়ামাত্রই ধরে ফেলা হবে। ’ এসব বিষয় নিয়ে মেয়র পদপ্রার্থী আবু তাহেরের মুখোমুখি হয়েছিল প্রথম আলো। অতীত নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন জানতে চাইলে তাহের বলেন, ‘হত্যা- সন্ত্রাসের বিষয় সব মিডিয়ার বানানো। আপনাদের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, আমি নাকি নুরুল ইসলামকে টুকরা টুকরা করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি।

তাহলে আমি আদালত থেকে খালাস পেলাম কীভাবে?’ কিন্তু ওই হত্যা মামলায় আপনার ছেলে বিপ্লবের তো ফাঁসি হয়েছে। তিনি এখন ফেরারি। জবাবে তাহের বলেন, ‘শুধু আমার ছেলের নয়, আরও অনেকের ছেলেরই সাজা হয়েছে। ’ ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কী বললেন! ছেলের সঙ্গে কোন বাবার যোগাযোগ থাকে না?’ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, বিপ্লব অনেককে ফোন করে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। আপনি কী এমন কিছু শুনেছেন? তাহের বলেন, ‘কাকে হুমকি দিয়েছে? এমন একজনকে আমার কাছে নিয়ে আসেন তো।

বরং আমার কর্মীদের প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা হুমকি দিচ্ছে। ’ ভোটের মাঠের অবস্থা কী, জানতে চাইলে তাহের বলেন, ‘একজন চকিদারও বলতে পারবে না আমি ভোট চাইছি। আমি শুধু দোয়া চাই। ’ লক্ষ্মীপুরের চকবাজারে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু একসঙ্গে কয়েকজন থাকলে কেউ কথা বলতে চান না।

একা একপাশে ডেকে নিয়ে কথা বলতে চাইলে শুরুতেই নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিলেন কয়েকজন। যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরাও বলার সময় এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেন কেউ দেখছে কি না। একজন দোকানদার বললেন, ‘তাহেরের ছেলে বিপ্লব কাউকে সালাম দিলে মনে করা হতো, তাঁর একটা অঙ্গ যাবে কিংবা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এখন তাঁর বাবার দোয়া চাওয়ার অর্থ কি তা বোঝা যাচ্ছে না। ’ জেলা গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য জানান, ‘শুনেছি, তাহেরের ছেলে ফোনে লোকজনকে বিনয়ের সঙ্গে তাঁর বাবাকে ভোট দেওয়ার জন্য বলছেন।

কিন্তু অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর বিনয় মাখানো কথাতেই অনেকের কাপড় নষ্ট হওয়ার অবস্থা হয়। ’ এই প্রতিবেদক যখন আবু তাহেরের সঙ্গে তাঁর বাসায় কথা বলেন, তখন রাত প্রায় সোয়া ১১টা। তাঁর পাশে বসা ছিলেন বাহার ভেন্ডার নামে বিএনপির একজন কর্মী। এই বাহারকেই বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন তাহেরের ছেলে। হাত-পা ভাঙলেও বেঁচে যান তিনি।

বাহার এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, তিনি এখনো বিএনপির লোক। তবে তাহের ২২ মাসে পৌরসভার যে উন্নয়ন করেছেন, তা ৩৬ বছরেও কেউ করেনি। তাই তিনি নির্বাচনে তাহেরের পক্ষে। স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন নেতা বললেন, তাহের বা তাঁর ছেলের হাতে নির্যাতিত অনেকেই ভয়ে এখন তাঁর পক্ষে নির্বাচন করছেন। তবে বাহারের এক আত্মীয় জানান, লক্ষ্মীপুর কারাগারে থাকার সময় বাহারের সঙ্গে তাহেরের সখ্য হয়।

তাহেরের বসায় ওই আলাপের সময় ঘরভর্তি লোক ছিল। স্থানীয় সাংবাদিক, বণিক সমিতির নেতা, জুয়েলারি সমিতির নেতাসহ অনেকের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। বললেন, সবাই তাঁর পক্ষে ভোট চাইছেন। তাহের দাবি করেন, ‘পৌর এলাকার সবজি ব্যবসায়ী সমিতি থেকে শুরু করে কসাই সমিতির নেতারাও তাঁর সঙ্গে আছেন। ’ জেলা জামায়াতের আমির রুহুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, তাহেরের বাহিনীর হাতে তাঁদের তিন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।

এর মধ্যে জায়েদ পৌর এলাকার আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। তাঁদের মাদ্রাসাও পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। তবে তাহের দাবি করেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। জায়েদ হত্যা মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মীপুর ছাত্রদলের সাবেক নেতা মনসুর বলেন, ‘বিপ্লবের নেতৃত্বে আমার দুই হাতের আঙুল কেটে দেওয়া হয়েছিল।

শুনেছি বিপ্লব নাকি লুকিয়ে এলাকায় আসে। ’ মুখ খুলছে না কেউ: লক্ষ্মীপুরে গত কয়েক দিনে ওই সময়ে হত্যার শিকার একাধিক পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে তাঁরা যা বলেছেন, তার মর্মার্থ হলো, তাঁদের সন্তানকে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন নিজেদের তো বাঁচতে হবে। কথা বলে নিজেদের ওপর বিপদ ডেকে আনতে চান না তাঁরা।

তাহের হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে বর্তমানে একটি মামলা বিচারাধীন আছে। তিনটি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন। একটি মামলা ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে প্রত্যাহার-পূর্বক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এবার তাঁরা প্রার্থী: ১৯৯৮ সালের ঘটনা। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচনের হাওয়া সবে বইতে শুরু করেছিল।

সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ন ম ফজলুল করিম ও সদ্য সাবেক মেয়র হাসানুজ্জামান চৌধুরী। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিততে হবে—এটা মেনে নিতে পারেননি তখনকার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। এলাকাছাড়া করলেন দুই সম্ভাব্য প্রার্থীকেই। জানা গেছে, সেবার ফজলুল করিম নিজে না এসে বাবাকে দিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আবু তাহেরের ছেলে বিপ্লবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী।

এই দৃশ্য দেখে তখনকার বিরোধী দল বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী হাসানুজ্জামান মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ারই সাহস দেখাননি। সেবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র হন তাহের। কিন্তু ২২ মাস মেয়রের দায়িত্ব পালনের পরই আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে গ্রেপ্তার হন তাহের। ছাড়া পান ২০০৮ সালে।

এবার নির্বাচনে তাহেরের সঙ্গে প্রার্থী হয়েছেন সেই ফজলুল করিম ও হাসানুজ্জামান। এবার মনোনয়ন ছিনিয়ে নেয়নি তাহেরের অনুসারীরা। তবে ভোটের আগে ও পরে কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত দুই প্রার্থীই। প্রতিদ্বন্দ্বীদের বক্তব্য: শুধু সাধারণ ভোটার নয়, তাহের প্রার্থী হওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র পদপ্রার্থীরাও ভয়ে আছেন। আ ন ম ফজলুল করিম বলেন, ‘আমি জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

শুনেছি, তাহেরের ছেলে বিপ্লব লক্ষ্মীপুরে আছে। তবে মরে গেলেও প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াব না। ’ ফজলুল করিম জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। গত শনিবার তাঁকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বহিষ্কার করেছে। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী হাসানুজ্জামান চৌধুরী অভিযোগ করেন, তাঁর কর্মীদের ফোন করে ধমকাচ্ছেন তাহেরের ছেলে বিপ্লব।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছেন বলে তিনি জানান। ‘আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) জেলা আহ্বায়ক জাকির হোসেন বললেন, ‘তাহের প্রার্থী হওয়ায় ভোটাররা আতঙ্কে আছেন। কারণ কয়লা ধুইলে ত ময়লা যায় না। অতীতের কথা কে ভোলে?’ তাহের অবশ্য দাবি করেন, পৌর মেয়র হলে তিনি আর সক্রিয় রাজনীতি করবেন না। পৌরবাসীর সেবা করেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.