আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বরাবর, সম্মানিত পরিবহন কর্তৃপক্ষ

ময়ুরক্ষী নদীটাকে মিস করছি!

- ভাইজান কোথায় যাবেন? - ঢাকা যাব। - তারাতারি আসেন, বাস ছাইড়া দিল। - বাসের নাম কি? - সুরভী, সুরভী লঞ্চের নাম হোনেন নাই? - আমি তো ভাই লঞ্চে যাবার জন্য তো বাসষ্ট্যান্ড আসিনি। - আরে না ভাই, লঞ্চ না বাসই, একই কোম্পানী বাস তো তাই। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

লোকটা আমাকে একটা কাউন্টারের সামনে এনে হাক ছেড়ে বলল- কামাইল্যা জলদি একটা টিকেট কাট। কাউন্টারের ডেকারেশন দেখে মনে হল ওটা একটা বিলাসবহুল বাড়ির ড্রইং রুম। তিনশ টাকা ভাড়া। আমি পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়ে তড়িঘরি করে বললাম- -ভাই, বাস ক’টায় ছাড়বে? - এইতো এখুনি ছাড়বে। আমিও কথা না বাড়িয়ে বাসের উদ্দেশ্যে ছুটলাম।

পরবর্তীতে সম্ভবত বাকি দু’শ টাকা নেওয়া হয় নি। সেটা মনে হয় আমারই ব্যার্থতা। গিয়ে যা দেখলুম তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। বাসের পেছনে দু’একজন ইতঃস্তত করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কিছু মাছি সিট দখল নিয়ে ঝগড়া বাধিয়েছে। কোথায় বাস ছাড়ল বলে, এত তাড়াহুড়া করলাম, সেখানে যাত্রীদেরই কোন খবর নেই।

আশেপাশে কন্টাক্টারকেও খুঁজে পেলাম না তাই জিজ্ঞাসাবাদটাও হল না। গাড়ির সিটগুলো থেকে এক ধরণের পরিচিত সু-ঘ্রাণ আসছে। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, ঢাকা-নরসিংদী লোকাল বাসের সিট থেকে যেরূপ ঘ্রাণ আসে ঠিক ঐরূপ। ভাবতেই গা বেড়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। নেমে পড়লুম।

পেট’টাকে সান্তনা দিতে হবে তাই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চা-ষ্টলগুলোর একটিতে গিয়ে বসলুম। সেখানে মিনিট বিশেক কাটালাম কিন্তু এখনো কন্টাক্টারের টিকির দেখাও পেলুম না। আগত্য আমার সি-১ নম্বর সিটে গিয়ে বসে পরলাম এবং সেখানেও যন্ত্রণা। পাশের ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা সুরতী মনে হলেও ওনার রুচিটা বেশ অ-সুরতী।

খোঁচা খোঁচা দাড়িও আছে মাশাল্লাহ্। কিন্তু যেইনা তার চায়না সেট থেকে ফুল ভলিয়মে “রূপবানে নাচে কোমর দুলাইয়া” গানটি প্লে হল, আমার সমস্ত ধারণাগুলো বানরমুখো ইদুরের গর্তে আশ্রয় নিল। একটু রিকোয়েষ্ট করে সাউন্ড কমানো গেল বটে কিন্তু তাতে কোন কাজ হল বলে মনে হল না। ওদিকে বাস ছাড়ারও কোন নাম নেই। সুরভী বাসের যে সুনামটা শুনে আসছিলাম তাতে মনে হয় মরিচা পড়েছে।

আরো মিনিট দশেক যাবার পর ড্রাইভার সাহেবের আয়েশী দেহখানা দেখা গেল। তিনি তখন ধূমপানে ব্যাপকভাবে ব্যস্ত ছিলেন। অতঃপর তিনি গাড়ি ষ্টার্ট নিলেন আর আমি পড়লাম, আলহামদুলিল্লাহ্। ওহ্ হো ওদিকে আই টপের দোকানীকে গাড়ি ছেড়ে যাবে বলে তাড়াতাড়ি টাকা পাঠাতে বলেছিলাম, কিন্তু আধঘন্টা পার হয়ে গেছে মাগার ব্যালেন্স এখনো সেই পনের পয়শায়। যাই হোক, দোকানী আমার ব্যাস্ততার সুযোগে ফাকা মাঠে গোল দিয়েছে ভেবে ভাবনাটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললুম।

এই মুহুর্তে আমি দুনিয়ার সবচে সূখী মানুষ। কানে হেডফোন দিয়ে, দেহখানা নরম গদিতে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আমার স্বপ্নগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। বাইরে সম্ভবত দুপুরের ঝলমলে রোদ আর মিহি হাওয়া বইছিল। পাটুরিয়া ফেরীঘাট পর্যন্ত ভাল ভালতেই কাটল। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল না।

তা না হলে আমাদের গাড়ি সবার আগে ফেরীতে উঠেও সবার পড়ে কেন যাবে? হ্যাঁ, গাড়ির সামনের চাকা ঘাটের ডিভাইডারের সাথে নব্বই ডিগ্রী কোণ বেকে গিয়ে লেগে আছে, তাই গাড়ি আর নড়তে পারছে না। ওদিকে গাড়ির বাটারী ডাউন তাই ষ্টার্ট নিচ্ছে না। কেউ বলছে, এই বাকানো অবস্থায় সামনে ধাক্কা দিলে চাকার ব্রেক কেটে যেতে পারে। কিন্তু পিছনে যে ধাক্কা দিব তারও উপায় নেই, গাড়ি সামনের দিকে অনেকটাই হেলানো। তবে ড্রাইভার বলল, যা হয় হবে আপনারা সামনের দিকে ধাক্কা দিন।

সবাই অনেক কষ্ট করে গাড়িটাকে সামনের দিকে ধাক্কা দিলাম। কাজ হল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। খানিক বাদে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্র ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে আরম্ভ করল। এবারের ভোগান্তি মনস্তাত্বিক।

শেষবারের মত সবাই ফোনে সবার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিচ্ছিল। কারণ, আমাদের গাড়ির হেডলাইটসহ সমস্ত বাতিই অস্তনিমিত। এমনকি হর্ণও বাজছিল না। তবে ড্রাইভার-এর কাছে সম্ভবত এটা একটা ছেলেখেলা ছিল। সে তার মত করেই গাড়ি চালাচ্ছিল।

কিন্তু আমাদের ড্রাইভার তো আর বোরাক যানের ড্রাইভার নয়, তাই যাত্রীদের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত ড্রাইভারকে বাস থামাতেই হল। যাত্রী এবং গাড়ির ষ্টাফদের মধ্যে বাগযুদ্ধ তেমন একটা কাজে আসল না। যাত্রীরা বলছে, এভাবে হর্ণ-লাইট ছাড়া গাড়ি ছাড়া হল কেন? ড্রাইভার এই প্রশ্নের কাছে পিঠে না গিয়ে বলছে, সে নাকি এভাবেই ঢাকা পৌঁছুতে সক্ষম আর তা না চাইলে এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে। আমরা অর্থাৎ যাত্রীরা আমাদের জীবনকে এভাবে ড্রাইভার সাহেবের কুক্ষিগত করে চিন্তিত মনে যার যার সিটে নীরবতা অবলম্বন করলাম। বাস আবারো চলতে লাগল।

তবে আমি বরাবরের মত এবারও তেমন একটা ভয় পেলাম না। এখন কথা হচ্ছে, গাড়ি ছাড়ার সময়ও এ অবস্থায় ছিল। ছিল না হর্ণ এবং লাইট। কিন্তু এমন একটা গাড়িকে কিভাবে কর্তৃপক্ষ রাস্তায় নামতে দিল, সেটাই সম্ভবত এক মহাপ্রশ্ন ! ! ! মানুষের জীবনের মূল্য সম্বন্ধে মনে হয় কর্তৃপক্ষ সম্যক অবগত নহে। তবে যাই হোক না কেন, আমরা কিন্তু এভাবেই বুকে একরাশ মৃত্যুভয় নিয়ে ঢাকা পৌঁছেছিলাম।

সবাই যার যার জমানো নিঃশ্বাস ছেড়ে দিতে লাগল, আমিও ইয়া বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মনে মনে বাস কোম্পানীর বিরূদ্ধে একটা মামলা ঠুকে দেবার চিন্তা করেছিলাম কিন্তু সম্ভবত সেখানে এর চেয়ে অধিক ভোগান্তি পেতে হয়, ভেবে এ বিষয়টা গিলে ফেললাম। এমন ভ্রমনের আশা আমি কখনো করেছিলাম বলে মনে পড়ছে না এবং নিশ্চয়ই কেউই এমনটি আশা করে না। তবে আশা না করলেও যে নিরাশার মধ্যে পড়তে হয়, আমি তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রইলাম। পরিবহণ ব্যবস্থায় নিয়োজিত ভাইদের প্রতি আমার আকুল আবেদন এই যে, তাহার যেন এমন নিরাশায় মধ্যে কাউকে না ফেলেন, তাহার বিহীত ব্যাবস্থায় তাহাদের যেন সু-মর্জি হয়।

নিবেদক, একজন ভীত যাত্রী।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।