আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রামীণের ক্ষুদ্রঋণে সুদখোর মহাজনী ব্যবসা রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে

ধর্ম যার যার , বাংলাদেশ সবার

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম গ্রামীণের ক্ষুদ্রঋণে সুদখোর মহাজনী ব্যবসা রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে রাজশাহীর বেড়পাড়া সীমান্ত থেকে ফিরে: গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাক, ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএমএস), আরআরএফ’সহ কয়েকটি এনজিও’র ক্ষুদ্রঋণের টাকায় রাজশাহীর ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে সুদখোর মহাজনী ব্যবসা। এনজিওভুক্ত সদস্যরা ঋণ তুলে হাজার হাজার টাকা সুদের ব্যবসায় খাটাচ্ছেন। তাদের সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে আদায় করা সুদের পরিমাণও আকাশছোঁয়া। ১০ হাজার টাকায় প্রতি সপ্তাহের সুদ ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা, মাসে সুদ হিসেবে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেন তারা। ফলে চোরাকারবারীতে বিনিয়োগের চেয়েও সুদের ব্যবসা ‘নিরাপদ লাভের’ আকর্ষনীয় ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এত চড়া সুদের ব্যবসা করেও ‘সুদখোর নারী মহাজনেরা’ ভাল নেই, সুখে নেই। কারণ হিসেবে স্থানীয়রা জানান, মাত্রাতিরিক্ত লাভের ব্যবসায় মাঝে মধ্যে মূল পুঁজিটাই গায়েব হয়ে যায়। এ অবস্থায় নিজেই পাল্টা সুদে টাকা নিয়ে কিস্তি শোধে বাধ্য হন। এমন নজিরও কম নয় রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে। রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর গ্রামীণ ব্যাংক কার্যালয় ঘেষা পাড়াতেই জরিনা বেগম (২৮), আদিনা আক্তার (২৬), রুমা বেগম (২২), আছিয়া খাতুন (৩২) ও সুফিয়া বেগমের (৩০) বসবাস।

তারা সবাই বিভিন্ন অংকের ঋণ তুলে তা প্রতিবেশী ব্যবসায়ি মোক্তার আলীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ টাকা দেওয়া হয় তাকে। কথা ছিল তিনি লাভ বাবদ প্রতি সপ্তাহে তাদের কিস্তি শোধ করবেন। মোক্তার আলী দু’মাস জরিনা, আদিনা, রুমাদের কিস্তির টাকা পরিশোধও করেছেন। কিন্তু গত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই ব্যবসায়ি মোক্তার আলী বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় সুফিয়া বেগমরা সীমাহীন বিপাকে পড়েছেন।

সুফিয়া বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ঋণের টাকা লাভে খাইট্যে আসলডাই হাইরে‌্য গেলছে। আমি তো আর মোক্তার আলীর মতোন গ্রাম থাইক্যা পাইল্যা যাতে পাচ্ছি না, ব্যাংক আলারাও ছাড়িচ্ছে না। বাধ্য হইয়্যাই আরেকজনের থাইক্যা লাভে ৫ হাজার টাকা ধার লিয়ে কিস্তি চালাছি। ’ চড়া সুদে ঋণ শোধ করতে সুফিয়া এখন ঠেঙ্গামারা ও আশা সমিতিতে ঋণের জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন। প্রায় অভিন্ন অবস্থা রুমা বেগমের।

তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ি মোক্তারকে দিয়ে বড়ই বিপদে আছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি শোধের জন্য রুমা বেগম ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (স্থানীয়দের ভাষায় ঠেঙ্গামারা সমিতি) থেকে আবার ঋণ তুলেছেন ১০ হাজার টাকা। এখন দুটি কিস্তি বাবদ রুমাকে প্রতি সপ্তাহে জোগাড় করতে হয় সাড়ে ৯শ’ টাকা। এসব নিয়ে স্বামীর সঙ্গে রুমার প্রায়ই চলছে ঝগড়া-বিবাদ, সংসারে শুরু হয়েছে চরম অশান্তি। তবে এনজিও থেকে ঋণের টাকা সুদের ব্যবসায় খাটিয়ে ভাল থাকার বিকল্প চিত্রও দেখা গেছে একই উপজেলার খাটাপাড়া গ্রামে।

সেখানে ফেলু মিয়ার স্ত্রী টুলু বেগম (৫২) সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা তুলে লাভে লাগিয়েছেন আল্লাম মিয়া নামে প্রতিবেশী এক ব্যবসায়িকে। আল্লাম দাবি করেন, তিনি আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্সের মাধ্যমে বৈধভাবে ভারতীয় মালামাল আমদানি করে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। আল্লাম মিয়া টুলু’র মতো আরও ৭/৮ জনের কাছ থেকে সুদে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে এলাকাতেই গড়ে তুলেছেন গবাদিপশুর খামার। গত দুই মাস ধরে আল্লাম সবার কিস্তির টাকাও যথারীতি শোধ করছেন বলে টুলু বেগম বাংলানিউজকে জানিয়েছেন। লাখ টাকা ঋণ তুলে আল্লামকে দেওয়ায় তার লাভ কি জানতে চাইলে টুলু বেগম বলেন, ‘আল্লামে তো আমার নামে গ্রামীণ ব্যাংকে ৬ হাজার টাকা জমা দিছে।

প্রত্যেক মাসে ১২০ টাকা সঞ্চয় আর একশ’ টাকা করে ডিপিএস’ও চালাইছে যে। এগুলান হিসেব করলে বছরে ৮/৯ হাজার টাকা আমার লাভ থাকবে। ’ এ ব্যাপারে হরিপুর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মোঃ আব্দুল জলিলের কাছে খোঁজ নিয়ে টুলু বেগমের এক লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে ব্যাংকের রেকর্ডপত্রে আছে-‘ টুলু বেগম এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গবাদিপশুর চমৎকার একটি খামার গড়েছেন, তিনি এখন পুরোপুরি স্বনির্ভর নারী। ’ তাকে সফল খামারি ও ভাগ্য পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত বলেও তুলে ধরা হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের কাগজপত্রে।

কিন্তু বাস্তবে আল্লামের খামারে টুলু বেগম কেবল টাকা ধার দানকারী ছাড়া আর কিছুই নন। স্বনির্ভরতা অর্জন দূরের কথা, এখনও সাপ্তাহিক কিস্তির টাকার জন্য দিনমান অপেক্ষায় থাকতে হয় তাকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঋণ দেওয়া-নেওয়া ও সুদাসলে তা আদায়ের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি নির্দয় হন সুদখোর মহাজন সদস্যরা। বেড়পাড়ার বাসিন্দা সুরমান আলী বাংলানিউজকে জানান, তার ছোট ভাই সিদ্দিক আলীকে বিদেশে পাঠানোর সময় গ্রামীণ সদস্যা রুপাতন বেওয়ার (৪৫) শরনাপন্ন হন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা তুলে দিলেও ছয় মাসে ৩০ হাজার টাকা সুদ দাবি করে বসেন।

মুরুব্বিদের নিয়ে বিচার-শালিস, মিট-মিমাংসার মাধ্যমে ২৮ হাজার টাকা সুদ দিয়ে তবেই নিস্তার মেলে। শুধু সুফিয়া আর টুলু বেগম নন, কিস্তিতে টাকা তুলে সুদে খাটানোর ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন দুই গ্রামের দেড় শতাধিক নারী। লাভে টাকা খাটানোদের মধ্যে বেড়পাড়ার মমতাজ বেগম (৪৬) স্বামী আমজাদ আলী, শিলা আক্তার (২৬) স্বামী মাসুম আলী, কটু মিয়ার স্ত্রী ফেন্সি বেগম (৪৮) ও মেয়ে সীমা আক্তার (২৪), খোকা মিয়ার স্ত্রী সফেদা বেগম (৩৮), পূর্বপাড়ার আব্দুস সোবাহানের স্ত্রী রহিমা বেগম (৪০) ও সাইদুলের স্ত্রী শামসুন্নাহারের (৩০) নাম উল্লেখযোগ্য। গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় শাখা ব্যবস্থাপক মোঃ আব্দুল জলিল জানান, ওই এলাকায় গ্রামীণ সদস্যদের মাঝে দুই কোটি ৬৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া আছে। এসব ঋণ ১০০ ভাগ আদায় হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।

তবে এলাকাবাসীর ধারনা, এই ঋণের একটি বড় অংশ মহাজনী সুদে ব্যবহার হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংক, আরআরএফ, আশা, টিএমএমএস ও ব্র্যাক থেকে ঋণ তুলে কিস্তির চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বেড়পাড়ার বাসিন্দা শ্যামলী বেগম (২৪)। তার স্বামীর নাম বাবুল মিয়া। শ্যামলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘কিস্তি লিয়ে আমরা সব লিস্তি (বিপর্যস্ত) হইয়ে গেলছি। কারো কাছে দু-পঞ্চাশ টাকাও ধার কর্জ পাওয়ার উপায় নেই।

ধার চাইলে সবাই বুলে সুদে লেও- যত লাগে দিছি। ’ বাংলাদেশ সময় : ১১০৯ ঘন্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১০

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.