আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মরণকালের ভয়াবহ সংকটে মুদ্রাবাজার ১৯০ শতাংশ সুদে আন্তঃব্যাংক লেনদেন



তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের স্মরণকালের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে মুদ্রাবাজারে। নগদ টাকার তীব্র অভাবে দিশেহারা ব্যাংকগুলো। অভাব মেটাতে উচ্চ সুদ হারে টাকা ধার নিচ্ছে। প্রতিদিনই রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে আন্তঃব্যাংক লেনদেন সুদ হারে (কলমানি রেট)। গাতকাল সর্বোচ্চ ১৯০ শতাংশ সুদে আন্তঃব্যাংক লেনদেন হয়েছে।

এটা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বুধবার গড় সুদ হার ছিল ১শ ৭৫ শতাংশ। আর মঙ্গলবার এ হার ছিল ৬২ শতাংশ। এতে ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়ছে ব্যাংকগুলো। তবে নীতি নির্ধরকদের পক্ষ থেকে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

মুদ্রাবাজারের এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, উচ্চ সুদ হারে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যয় বেড়ে যাবে ব্যাংকগুলোরা। এর মাসুল গুণতে হবে সাধারণ গ্রাহকদের। কারণ বাড়তি ব্যয় পুষিয়ে নিতে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেবে ব্যাংকগুলো। এতে বেড়ে যাবে উৎপাদন ব্যয়।

লাগামছাড়া হয়ে যাবে মূল্যস্ফীতি। শিল্পের বাড়তি উৎপাদন ব্যয়ের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ। কমে যাবে রপ্তানি আয়। বন্ধ হবে শিল্প কারখানা। বাড়বে বেকারত্ব।

এ ব্যাপারে কতৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খান এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, কলমানি মার্কেটে এত উচ্চ সুদহার হওয়া অস্বাভাবিক। এতে মুদ্রা বাজারের শৃংখলা ভেঙ্গে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই অস্বাভাবিকতার নেপথ্য কারণ খুজে বের করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মো. আল্লাহ্ মালিক কাজেমী ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে।

এজন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বাজার থেকে টাকা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। টাকা উঠিয়ে নিতে দুই ধাপে সিআরআর ও এসএলআর ১ শতাংশ করে বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে কলমানি সুদ হার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু ১৯০ শতাংশ পর্যন্ত হওয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো পূর্বেই তাদের নগদ অর্থ বাজারে বিনিয়োগ করে ফেলেছে। বিভিন্ন খাতের টাকা গিয়ে জমা হয়েছে পুঁজিবাজারে। ফলে একদিকে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে পুঁজিবাজার। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তাই বাজার থেকে নগদ অর্থ উঠিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উদ্যোগের ফলে হয়তো কিছুদিন আন্তব্যাংক মুদ্রা বাজার অস্থির থাকবে। তবে তারল্য প্রবাহ কমবে। একসময় বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কমিয়ে দেবে। ফলে পুঁজিবাজারেও অর্থের প্রবাহ কমবে।

এতে পুঁজিবাজারেও কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। নিয়ন্ত্রণে আসবে মূল্যস্ফীতি। সিআরআর ও এসএলআর বাড়ানোর বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ভারত ১ বছরের মধ্যে ৬ বার সিআরআর ও এসএলআর বাড়িয়েছে। চীন বাড়িয়েছে ৫ বার। সেখানে আমরা মাত্র দুই বাড় বাড়িয়েছি।

তাও প্রতিবারে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ করে। সাধারণত ঈদের আগে ব্যাংকগুলোতে টাকার চাহিদা বেড়ে যায়। এসময় গ্রাহকেদের টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে বেশি টাকা উত্তোলন করে। গ্রাহকেদের বেশি টাকার চাহিদা মেটাতে চাপে পড়ে ব্যাংকগুলো। এসময় কিছু ব্যাংকের নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়।

সংকট মোকাবেলায় এসব ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ঋণ নেয় যাকে কলমানি মার্কেট বলা হয়। চাহিদা বাড়ায় এ মার্কেটে সুদ হার বেড়ে যায়। গত ঈদের পূর্বে এ মার্কেটের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ২৮ শতাংশ। তবে এখন ঈদ নেই। তবুও কলমানি সুদ হার অস্বাভাবিক বেশি।

এর কারণ হিসেবে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিযোগকে দায়ী করছেন অনেকে। বাংলাদেশ ব্যংক প্রতিদিন ৬ থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার রেপো ও বিশেষ তারল্য সহযোগিতার আওতায় সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ধার দিচ্ছে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সুদ দিতে হয় সাড়ে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে ৩ হাজার ২৭৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এটা আগের চেয়ে ১ হাজার কোটি টাকা বেশি।

রেপোর চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৪৫৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার। এটা বাজারের চাহিদার সমান ছিল। গতকাল কলমানি মার্কেটে মোট লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক দিয়েছে ১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

বাকি ৩৯২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধার দিয়েছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার এ ভয়াবহ সংকটের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, সিআরআর হার বাড়ানোর কারণে সাময়িকভাবে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছি। এর অংশ হিসেবে সিআরআর ও এসএলআরের মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলোকে চাহিদামতো টাকা ধার দিলে উদ্দেশ্য ব্যহত হবে।

সরকারের চাহিদা পূরণের জন্য ডিলার ব্যাংকগুলোর চাহিদামতো তারল্য সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। তবে রেপো সহায়তা দেয়া হচ্ছে চাহিদার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। তবে আজ (রোববার) রেপো সরবরাহ বাড়িয়েছি। রেপো চাহিদার ২৫ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত ১ হাজার কোটি টাকা বেশি সরবরাহ করা হয়েছে। এদিকে ব্যাংকাররা কলমানি সুদ হার বেড়ে যাবার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করেছেন।

তাদের মতে, এমনিতেই আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট চলছে। এ কারণে প্রায় প্রতিদিনই রেপো এবং বিশেষ তারল্য সহযোগিতার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) হার বাড়নোর ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট আরো বেড়ে গেছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক আগের মতো রেপো দিচ্ছে না। তাদের প্রতিদিনের চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ দেয়া হচ্ছে।

এই সংকট মেটাতে কলমানি মার্কেটের দারস্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে বেড়ে যাচ্ছে সুদের হার। পুনঃনির্ধারিত সিআরআর ও এসএলআর হার গত বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ওইদিন থেকে ব্যাংকগুলোকে দৈনিক ভিত্তিতে সাড়ে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৬ শতাংশ সিআরআর এবং সাড়ে ১৮ শতাংশের পরিবর্তে ১৯ শতাংশ এসএলআর জমা রাখতে হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত ২ হাজার কোটি টাকা চলে এসেছে।

###

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.