আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র

বউটুবান

দশ বছরের মেয়ে অপরাজিতা। সুযোগ পেলেই সে তার দাদা-দাদুর সাথে ভাব জমিয়ে চুটিয়ে গল্প শোনে। যে বয়সে বুড়োদের কোন কাজ করার থাকে না সে বয়সে তারা শিশুদের সাথে খাতির জমিয়ে গল্প করে সময় কাটাতে চায়। এই সুযোগটা অপরাজিতা দাদা-দাদুর সাথে ভাগ করে নিয়েছে। মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে বেজায় কদর তার।

অপরাজিতার দাদা-দাদু বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে পছন্দ করেন বেশি। অপরাজিতারও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে ভীষণ পছন্দ। কারণ এগুলো তো কোন রূপকথার গল্প নয়; একদম সত্য ঘটনা। এতে আনন্দ-বেদনা আর বীরত্বের বহু কাহিনী আছে। গল্প শুনতে শুনতে তার মনের মধ্যে যুদ্ধসময়ের নানা ঘটনা জীবন্ত হয়ে উঠে।

মুক্তিযুদ্ধটা স্বচে দেখতে পারেনি বলে অপরাজিতার খুব আপে হয়। সে মনে মনে ভাবে, এখন যদি যুদ্ধ হতো, আমি নিশ্চয়ই বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করতে যেতাম! গুলি করে শক্রুদের বুক ঝাঁঝরা করে দিতাম। গুলিখেয়ে শক্রুরা যখন মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খেতো তখন খুব আনন্দ হতো আমার। মনে মনে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সে বহুবার যুদ্ধ করে বহু সৈন্য মেরেছে, বহুবার স্বাধীন করেছে দেশটা। তার মনে একটা দুঃখ বারবার জেগে ওঠে, সেটা হলো সে এখনও কোন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেনি।

সে তার বাবার কাছে আফছুছ করে প্রায়ই তার এই দুঃখের কথা বলে। তার বাবা তার মনের কথাগুলো বেশ বুঝতে পারেন। একদিন তার বাবা তাকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ দেখোনি তো কী হয়েছে? মুক্তিযোদ্ধা তো দেখতে পারো, যাঁরা তখন বীরের মতো যুদ্ধ করে এ দেশটা স্বাধীন করেছেন। অপরাজিতা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলে, আমি মুক্তিযোদ্ধা দেখবো বাবা। পরেরদিন অপরাজিতার বাবা তাকে তার স্কুলের গেটে নিয়ে গেলেন।

তার বাবা সেখানে যবুথবু দাঁড়িয়ে থাকা এক ভিক্ষুককে দেখিয়ে বললেন, ইনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অপরাজিতা থ হয়ে গেল। সে বলে, কী বলো তুমি! ইনি তো ভিুক। আমি তো এই লোকটাকে প্রায়ই ভিক্ষা দেই। তবে লোকটা কখনও হাতে করে ভিক্ষা নেয় না; ঝোলার মুখটা বাড়িয়ে দেয়।

ভিক্ষুক আবার মুক্তিযোদ্ধা হয় কীভাবে? বাবা বললেন, ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে কি না জানি না, তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুক হয়ে গেছেন। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমাদের দেশে এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আছেন, যারা ভিক্ষা করেন, খেয়ে না খেয়ে রোগে-শোকে কষ্ট করে কোনোমতে বেঁচে আছেন। আবার অনেকেই নানা কষ্ট করে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়ে মারা গেছেন। আমরা তাঁদের জন্যে তেমন কিছুই করতে পারিনি।

আমরা অনেক বড় অকৃতজ্ঞ। লজ্জায় অপরাজিতার মাথা হেট হয়ে গেল। সে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ভিক্ষুকটার দিকে তাকিয়ে রইল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কেমন ছিলেন ও কীভাবে শক্রুর দৃষ্টি এড়িয়ে কাঁধে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, শক্রুদের হত্যা করেছিলেন এসব ঘটনা অপরাজিতার মনে ভেসে উঠতে লাগল। এখন ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধার দুরবস্থা দেখে তার মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আছ্।

অপরাজিতার মনে হতে লাগল, ‘আমাদের স্কুলে প্রতিবছরই স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস উপলে নানা অনুষ্ঠান হয়। তখন স্কুল মাঠটি লোকে কানায় কানায় ভরে যায়। সেখানে আমিও অংশ নিই। অনুষ্ঠানে আমরা মুক্তিযোদ্ধা সেজে যুদ্ধ করি। ঢোল-কাড়া বেজে ওঠে।

মেলা আনন্দ, হৈচৈ ও হাততালি হয়। আমরা কি জানি আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধার ভূমিকায় সামনাসামনি যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করে বিজয় উল্লাস করি তখন স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে থেকে আসল মুক্তিযোদ্ধাটি বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষা করছেন? অপরাজিতার কেন জানি ভালো লেগে গেল মুক্তিযোদ্ধাটিকে। তার কল্পনায় তখন এই মুক্তিযোদ্ধাটি বন্দুকের গুলিতে পটাপট মেরে ফেলছে পাকসৈন্যদের। সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধার সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভয়ে পালিয়ে যাচেছ। এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাটি বন্দুক নিয়ে দৌড়াচেছন পলায়নপর শক্রুদের পেছনে।

তিনি কোনো বাধাকে পরোয়া করছেন না। তিনি সব বাধাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছেন। এভাবে জীবন বাজি রেখে বহু জায়গায় বহুবার যুদ্ধ করেছেন তিনি। পরাজিত হননি। তাঁর প্রতিজ্ঞা, ডু অর ডাই।

অতঃপর শক্রুদের পরাস্ত করে ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়; আমাদের স্বাধীনতা। ইশ্ কত কষ্ট, কত মৃত্যু আর ত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা! অসীম সাহসী সেই বীরমুক্তিযোদ্ধা এখন আমার সামনে। অপরাজিতা তার বাবাকে আবদার করে বলল, বাবা আমি এখন এই মুক্তিযোদ্ধাকে পা ছুঁয়ে সেলাম করব। তার বাবা তাকে একটা হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বললেন, মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ভিক্ষুকের পা ছুঁয়ে সেলাম করবে তুমি? লোকজন দেখলে কী বলবে, শুনি? এ কথা বলেই তার বাবা আর বিলম্ব না করে অপরাজিতাকে টেনে নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলেন। অপরাজিতা চিৎকার করে বলছে, তুমি না বললে, ইনি মুক্তিযোদ্ধা! তাহলে আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে এলে কেন? বাবা বললেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা তা ঠিক আছে।

কিন্তু যিনি ভিক্ষা করেন তার আর কোনো পরিচয় থাকে না, সব মুছে যায়। ভিাবৃত্তি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পেশা। এ পেশার মানুষকে কেউ মানুষ বলেই তো স্বীকার করে না; সেলাম করবে কোন সাহসে! অপরাজিতার মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। তার মনের ভেতরে বারবার মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের ও দুরবস্থার নানা ছবি আলো ছায়ার মত খেলা করতে লাগল। পরের দিন স্কুলে গেল অপরাজিতা।

স্কুল গেটে প্রতিদিনের মত শত শত ছাত্র ছাত্রী আর অভিভাবকদের ভিড়। ভিড় ঠেলে গেটের কাছে যেতেই সে ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধাকে ভিক্ষার ঝোলাটা মেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সোজা ভিক্ষুকের পায়ের ওপর আছাড়খেয়ে পড়ে সেলাম করতে লাগল। ভিক্ষুক বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে কৃতজ্ঞতার হাত বুলিয়ে দিল। এ অপূর্ব দৃশ্য দেখে মুহূর্তে ভিড় জমে গেল।

সবাই হতবাক! মেয়েটি এমন করল কেন? কী হয়েছে তার? ভিুকের পায়ে পড়ে সেলাম! মাথা ঠিক আছে তো মেয়েটির! তার চারপাশে কৌতূহলী লোকের ভিড়। সবাই অবাক হয়ে তাকে দেখছে। ছাত্র ছাত্রী ও অভিভাবকদের অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত অপরাজিতা কার প্রশ্নের কী জবাব দিবে এর কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সে চোখ বন্ধ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কে একজন ফোন করে তার বাবাকে বলছে, ‘হ্যালো, আপনি কি অপরাজিতার আব্বু বলছেন? আপনার মেয়ে স্কুল গেটে অ্যাবনরমাল আচরণ করছে, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। ‘ একটু পরেই উদ্বিগ্ন পিতা-মাতা ভিড় ঠেলে এসে তাকে বুকে টেনে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে অজস্র প্রশ্ন করছেন, কী হয়েছে মা? মাথাটা খারাপ লাগছে? শরীর ঝিমঝিম করছে? মাথা পাকদিয়ে পড়ে গিয়েছিলে? এমন করছিলে কেন? কেউ ধাক্কা মেরেছে, বকেছে? বল।

অপরাজিতার কান্না থামছে না। তার পিতা-মাতা মেয়ের বেশুমার কান্নার কোনো কারণও জানতে পারল না। তারা নানা আশঙ্কা করে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। অপরাজিতাকে জোর করে বেডে শুইয়ে দেয়া হলো। ডাক্তার এসে সব শুনে বললেন, সামথিং রং, ডোন্ট ওরি।

আমি দেখছি। পরের দিন অপরাজিতার মেঝমামা হাসপাতালে গিয়ে তাকে আদর করতে করতে বললেন, কোনো চিন্তা করো না মামা, শালার ভিক্ষুককে এমন প্যাঁদানি প্যাঁদাইছি, সে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। একেবারে এলাকাছাড়া করে দিয়ে এসেছি। ফকির মিছকিনদের যন্ত্রণায় রাস্তা-ঘাটে আমরাও চলতে-ফিরতে পারি না, এখন শিশুদের ওপরও আছর করেছে হারামজাদারা। অপরাজিতা বলল, এগুলি কী বলছো মামা! ফকিরবেটা তোমার কী তি করেছে? আরে, কী তি করেছে মানে? যেই ভিুকের জন্য তুমি অসুস্থ হয়ে সোজা হাসপাতালের বেডে লম্বা হয়ে শুয়ে আছ, সেই ননসেন্সের কথা বলছি।

আর ভয় নেই। এ বেটা ইহজনমেও আর এদিকে পা বাড়াবে না। বেটা বাপবাপ করে পালিয়েছে- এসব বলে মামা জোসে কাঁপতে লাগল। মামার বীরত্বের কাহিনী শুনে অপরাজিতা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল, ছিঃ কী আবোল তাবোল বকছ মামা! ভিক্ষুকটা কী করল তোমাকে? তুমি একজন অসুস্থ দুর্বল বৃদ্ধ মানুষের সাথে অন্যায় আচরণ করে এসেছ। উফ্, এখন আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচেছ করছে।

অপরাজিতার বাবা আদর করে বললেন, এমন নিসপিস করছ কেন, মা। খারাপ লাগছে তোমার? অপরাজিতা বিরক্ত হয়ে বলল, খুবই খারাপ লাগছে বাবা। আমি এখন কাঁদব। মন খুলে কাঁদব, একা একা কাঁদব, চিৎকার করে কাঁদব। কাঁদলে আমার ভালো লাগবে।

তোমরা এখন রুম থেকে বেরিয়ে যাও, প্লিজ। মামা কপাল কুচকে বললেন, আমরা যাব কেন? কাঁদতে হলে তুমি বাথরুমে বসে নিরিবিলি কেঁদে এসো গে, যাও। অপরাজিতা বলল, আমি বাথরুমে বসে কাঁদতে যাব কেন? সেখানে বসে কাঁদলে সবাই মনে করবে আমার পায়খানা কষা, তাই বাথরুমে বসে চেচাঁচ্ছি। আমি আমার বেডে বসে কাঁদব, শুয়ে কাঁদব, ওয়াল ধরে কাঁদব, বাতাসের কাছে কাঁদব। আমার কান্নার সময় তোমরা কেউ ডিষ্টার্ব করতে পারবে না।

মামা তুমি আর কখনও আমার সামনে আসবে না, কখনও না। আমার সামনে থেকে চলে যাও। বাবা তার হাত ধরে বিষ্ময়ে বলছেন, তুমি এখানে বসে কাঁদবে? সত্যি সত্যি কাঁদতে পারবে, মা! হ্যা বাবা এখানে বসেই কাঁদব এবং সত্যি সত্যি কাঁদব, এবার যাও তো, আমার কান্না পড়ে গেল। তার মা এতণ রাগে ফুসছিলেন। তিনি ঠোঁট উল্টিয়ে সমস্ত শরীর ঝাকিয়ে আঙ্গুল খাড়া করে বললেন, কাঁদবে যখন একা একা কেন, আমাদের নিয়ে যোগাল বেন্ধে কাঁেন্দা, দেখি কান্নার মাঝে কত মধু আছে, ফাজিল মাইয়া কোথাকার! ফকির-মিছকিনগোর পায়ে গিয়ে পড়ে! আবার বলে, আমি কাঁদব! ঢং।

তিনি অপরাজিতার দিকে চোখ গোল করে তাকিয়ে রাগে কটমট করতে লাগলেন। পরে তার বাবা, মামা ও মা কানে কানে কি জানি বলাবলি করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অপরাজিতা কান্না শুরুর আয়োজন করতেই তারা আবার ডাক্তারসহ ছুটে এল এবং তাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। তার বাবা বলল, মা, তুমি চুপ করে শুয়ে পড়। তোমার সমস্যাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বোধ হয়, ডাক্তারসাব একটু দেখবেন।

অপরাজিতা রাগে ডাক্তারকে বলল, আমি এখন কাঁদব। আপনি আসতে পারেন ডাক্তার আঙ্কেল। তুমি কাঁদবে কেন মা? ডাক্তার আদর করে বললেন। বারে! আমি কাঁদব কেন সেটাও বুঝি বলতে হবে আপনাকে? দেখুন, এখন কাঁদলে আমার ভালো লাগবে, আরাম লাগবে। আমার কোনো রোগ নেই।

আমি একদম সুস্থ আছি। ডাক্তার বললেন, কষ্ট না হলে কেউ বুঝি কাঁদে? কান্না সহজে আসে না মানুষের। তোমার বিরাট বড় কষ্ট হচেছ। না কাঁদলে তোমার ভাল্লাগছে না। এটা কিন্তু একটা প্রবলেম, বুঝতে পেরেছ মা? অপরাজিতা এতগুলো বড় মানুষের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে হাত-পা ছুড়ে শুরু করে দিল চিৎকার করে কান্না।

তারা যতই বারণ করছে, শান্ত হতে বলছে ততই চড়াগলায় কান্না শুরু করে দিল সে। অপরাজিতা ফুল ভল্যুমে যখন চিৎকার চেঁচামেচি করে কান্নার হাট বসিয়ে দিল তখন আশেপাশের রুম থেকে লোকজন ছুটে এসে এমন ভাবে ভিড় করে আছে যে, মনে হচেছ এখানে একটি মেয়েকে জবাই করা হচেছ। এদের জোরজবরদস্তিতে অপরাজিতার কান্না রাগে পরিণত হলো। তখন অশুভশক্তির কাছে অপরাজিতা অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে। ডাক্তারের ইশারায় তারা অপরাজিতাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিল।

ইনজেকশন পুশ করতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। অপরাজিতা চোখ মেলে দেখে সে বাসায় খাটে শুয়ে আছে। চারদিকে ওষুধ আর পথ্যের ছড়াছড়ি। আতœীয়-স্বজনেরা চিন্তিত মুখে মাথা ঝুকিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর কেউ মাথা হাতিয়ে তার চুল গুছাতে ঘুছাতে আফছুছ করে বলছেন, আহা রে! কী ভালো মেয়েটা, কী হয়ে গেল। খোদায় কখন যে কারে কী করে বলা যায় না।

কেউ বা ছিরাত ছিরাত করে আঁচলে নাক মুছছে। পাশের বাড়িওয়ালি অশিতিপর এক বুড়ি পান চিবুতে চিবুতে এলেন। তিনি চোখ গোল করে বিজ্ঞের মত অপরাজিতার আপাদমস্তক পরখ করে লম্বাশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ছেরির লক্ষ্মণ ত ভালা ঠেকছে না গো। অবহেলা করোন যাইবে না। মনে অয় ছেরিরে ভূতে ধরেছে, না হয় তার বেরেন আউট অইয়া গেছে গা।

দেহো না তার চোখ-মুখ কেমুন ফুইল্লা গেছে ! দেরি কইরো না। ছেরিডারে লইয়া সোজা পাবনা চইলা যাও। হেনে বালা চিকিস্যা অয়। ‘ অপরাজিতা রাগে আঙ্গুল খাড়া করে সবাইকে দেখিয়ে বলল, তোমাদের সবার ব্রেন খারাপ হয়ে গেছে, তোমরা বুড়ির সাথে পাবনা গিয়ে তোমাদের ব্রেন ঠিক করে এনে দেখবা আমার ব্রেন সত্যিই ঠিক আছে। বুজছ? এ কথা বলে সে চোখ বন্ধ করে গোত্তামেরে শুয়ে পড়ল।

বুড়ি ঠোঁট দুটি চোখা করে এমন ভাবে মাথাটা ঝাকা দিল যে, ছেরির ব্রেন সত্যিই গোল্লায গেছে। বাসায় তাকে চোখে চোখে রাখা হচেছ। অপরাজিতা তার মা বাবার কাছে কিরা-কসম কেটে বহুবার বহু করে বলেছে, আমার কিছুই হয়নি, আমি একদম সুস্থ। আামার পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমাকে স্কুলে যেতে দাও।

কিছুদিন পরে অপরাজিতা স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিল। স্কুলগেটে গিয়েই তার বুকটা ধক্ করে উঠল। সেই ভিক্ষুকটি নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে এক বয়স্ক মহিলা ভিক্ষা করছে এখন। কষ্টে তার মনটা বিষিয়ে ওঠে।

তার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। অপরাজিতা একদিন সুযোগ পেয়ে মহিলা ভিক্ষুকটিকে বলে, আপনি কি দয়া করে বলবেন, এখানে দাঁড়িয়ে যে লোকটি ভিক্ষা করতেন তিনি এখন কোথায়? মহিলাটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অভিমানের সুরে বলল, ’কোথায় আবার, এক জোয়ান পোলায় তারে মাইরা-ধইরা অপমান কইরা এহান থেইকা খেদাইয়া দিছে। হেরপরে লোকটা যে বিছানায় পড়ল আর খাড়াইতে পারল না। গত পরশু হেয় মইরা গেছেগা। ’ ‘বড় বালা মানুষ আছিল গো, অভাবের তাড়নায় তার বউ-পোলা-মাইয়ারা হেরে ছাইড়া কই জানি চইলা গেছে।

দেশের জন্যি যুদ্ধ করিছে বেটায়, গুল্লি খাইয়া তার এক পাও অচল অইয়া গেছে। এহন হের কোনো দাম নাই। হেয় খাইছে বিক্কা কইরা। আমি হেরে কইছিলাম, তুমি না মুক্তিযোদ্ধা। সরহার ট্যাহা দেয়, যাওনা ক্যান? হেয় কয় কি, আমি যখন সব হারাইয়া পথের ভিক্ষুক অইয়া গেছি এহন আর কাউকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিমু না।

‘ একটানে কথাগুলো বলে মহিলাটি আঁচলে চোখ মুছতে লাগল। কষ্টে অপরাজিতার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। অনুতাপ আর অনুশোচনার ভারে সে নুয়ে পড়েছে। তার সারাটা শরীর মায়ায় ভরে গেছে। অপরাজিতা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করল, ওনাকে কবর দিয়েছে কোথায়? মহিলাটি বলল, ফহিরগো আবার কব্বর।

হেরে সেতুডাঙ্গার ঢালে কোনোমতে কব্বর দিয়া সাইনবোট লাগাইয়া দিছে। অপরাজিতা বলল, আপনি দয়া করে আমাকে নিয়ে যাবেন সেখানে? রিক্সায় যাবো আপনাকে নিয়ে। মহিলাটি বলল, যামুনে, তয় আইজ না, কাইল। পরের দিন অপরাজিতা মহিলাকে নিয়ে গেল কবরের পাশে। সেতুডাঙ্গার ঢালুতে একটি মাত্র কবর।

চারকোণে চারটা খেজুরের ডালা কোপানো। কবরের শিথানে কাঠিতে ঝুলানো আছে এ্যাবরো-থ্যাবরো টিনপ্লেট। প্লেটে আনাড়ী হাতের লেখা। এতে আছে- ”মৃতের শেষ ইচছায় লেখা হলো- কেউ আমাকে না চিনলেও সেদিন স্কুলগেটে একটি ছোট্ট মেয়ে আমাকে চিনেছিল। যেদিন সে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আমার পা ছুঁয়ে সেলাম করেছিল সেদিনই আমি আমার স্বীকৃতি পেয়ে গেছি।

কেউ না জানুক, অন্ততঃ সেই মেয়েটি আমাকে জেনেছে। আমি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আমার সমস্ত কৃতিত্ব ও অহংকার সেই ছোট্ট মেয়েটিকে উৎসর্গ করলাম!“ লেখাটি পড়ে অপরাজিতার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কবরে। সে দু‘হাত তুলে মোনাজাত করছে- ‘হে প্রভূ, একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা তাঁর সমস্ত কৃতিত্ব ও অহংকার আমাকে উৎসর্গ করে গেলেন, আমাকে তার পূর্ণ মর্যাদা রা করার শক্তি দাও। আমরা তাঁর কোনো মর্যাদা দিতে পারিনি। তুমি তাঁর উপযুক্ত মর্যাদা দিও।

এতদিন তিনি যা গোপনে লালন করেছিলেন, আমি যেন তার চেতনা সবলে প্রকাশ করতে পারি। মহিলা ভিক্ষুকটি আমিন! আমিন!! বলে চিঁ চিঁ করে কেঁদে উঠল। অপরাজিতা চোখ মুছে কবরটা সামনে রেখে স্থির হয়ে শক্তপায়ে দাঁড়াল এবং সে সামরিক কায়দায় সেল্যুট করল। অতঃপর অপরাজিতা বীরমুক্তিযোদ্ধার সমস্ত কৃতিত্ব আর চেতনা নিয়ে সগর্বে বাসায় চলে গেল। সামনে তার অনেক কাজ!



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.