আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযোদ্ধা

h
‘মুক্তিযোদ্ধা’- একটি পবিত্র শব্দ, যা হয়ত দেশ-কাল ব্যাতিরকে একএক জনের কাছে একেক রকম মনে হতে পারে। আগে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি উচ্চারিত হলে চোখের পর্দায় ভেসে উঠত মাথায় গামছা বাধা, স্টেন হাতে এক বীর যোদ্ধা, যার কাছে নির্ভয়ে সঁপে দেয়া যায় নিজেকে। এমন এক বীর যার ওপর নির্ভর করা যায়, যে অন্যায়কে দমন করে ছিনিয়ে আনে সততা ও ন্যায়ের সূর্য। যে শৌর্য বীর্যের অধিকারী চুড়ান্ত এক নক্ষত্র। কিন্তূ একটি ঘটনার পর থেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি শুনলে আর বীর যোদ্ধার চিত্র ভেসে ওঠেনা।

কেন? তাহলে খুলেই বলি- খুব বেশিদিন নয়, ৮ - ৯ বৎসর আগের ঘটনা, আব্বুর হাত ধরে বিজয়দিবসে সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াচ, ট্যাংক ও বিমান বহরের আয়োজন দেখতে গেলাম, জাতীয় স্কয়ারে। যারা এসব অনুষ্ঠানে ইতিমধ্যে গিয়েছেন তারা জানেন, ওখানে দুটি অংশ থাকেঃ একটি সর্বসাধারনের জন্য(তীব্র রোদ, ভিড়, ধুলা, ঘাম ও ঠেলাঠেলি) ও অপরটি হল সামিয়ানা টাঙ্গানো, সুন্দর-পরিপাটি করে সাজানো, গা-হিমেল করা মৃদু ঠান্ডা বাতাস, ফুল ও চেয়ার শোভিত নান্দনিক স্থান; যেখানে দেশের গণ্য-মান্য ও কিছু জঘন্য ব্যবসায়ী, সৎ ও অসৎ সরকারী কর্মকর্তা, নোংরা রাজনীতিবীদ এবং রাজাকার সহ আরো অনেকে আসন গ্রহন করবেন। কিন্তূ শর্ত একটাই, সবার গাড়ি থাকতে হবে। বড় বড় অফিসে যেমনটি লেখা থাকে ‘No Dog Allowed’-(কুত্তার প্রবেশ নিষেধ তেমনি) ও স্থানে ‘No Person Allowed Without Vehicle’. গাড়ী ও ধন-সম্পত্তি ছাড়া মানুষতো কুত্তার-ও সমতুল্য না(পাঠকগণ কিছু মনে করবেননা,খুব আক্ষেপ নিয়া কথাটা বলছি)। চারিদিকে কাটা তারের বেড়া, দেশের অশিক্ষিত বর্বর ও নোংরা জনসাধারনকে ঠেকানোর জন্য।

তারা এলিট প্যানেলের কাছে ভিড়লেতো অনুষ্ঠান-ই মাটি হয়ে যাবে। কঠোর চেহারার কিছু কর্তব্যনিষ্ঠ দাড়োয়ান(আমি সেনা সদস্যদের দাড়োয়ান বলি) স্থানুর মত উন্নত শিরে দণ্ডায়মান। কড়া আদেশ, গাড়ী ব্যতিত কারো প্রবেশ নিষেধ। সর্বসাধারনের আশ্রয়স্থল সেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গন। এলিট প্যানেলের গেটের কাছাকাছি শুনি হাল্কা হট্টগোল হচ্ছে, কৌতুহলের তাড়নায়-কাছে গেলাম।

দেখি পক্ককেশী, শশ্ত্রু শোভিত, শারীরিক প্রতিবন্ধী এক বৃদ্ধ সেই কর্তব্যনিষ্ঠ দাড়োয়ানের সাথে কথা কাটা-কাটি করছেন। উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। সময়ের প্রয়োজনে হাতের বই খাতা ফেলে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। যুদ্ধে তিনি এক পা হারিয়েছেন। আজ এই মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধিনতার ত্রিশ বছর পর এসেছিলেন বিজয়কেতনের এই অনুষ্ঠানে।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে সাধারন দর্শক সারিতে দাড়িয়ে থাকা স্বাভাবিক ভাবেই তার পক্ষে সম্ভব না। হয়ত সে কারনেই তিনি গেটের দাড়োয়ানকে অনুরোধ করেছিলেন ভেতরে যেতে দেয়ার জন্য, কিন্তূ সেই দাড়োয়ান তার প্রস্তাব শুধু প্রত্যাক্ষান করেছে তাই নয়, তিনি মুক্তিযোদ্ধা এটা শোনার পর বলল, ‘এইসব বইল্লা কোনো লাভ হইবনা। আমার উপর অডার আছে গাড়ী ছাড়া কাউরে ঢুকাইতে পারুমনা। অহন যান গিয়া চাচা, গাড়ী আইতাছে সরেন’। লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি বাকরূদ্ধ, নিঃপলক চোখে একবার দাড়োয়ানটির দিকে তাকালেন, এর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মুখে ক্লান্তি, চোখে বিস্ময় ও মনে বিষম হতাশা-যন্ত্রনা ও এক রাশ ক্ষোভ নিয়ে।

হয়ত ভাবছিলেন, আমরা কি উদ্দেশ্যে যুদ্ধে গিয়েছিলাম? কেন আমি পা হারিয়ে সমাজের এক অসহায় বঞ্চিত পঙ্গু লোক? মুক্তিযুদ্ধ আমায় কি দিল, অমানুষ কিছু সন্তান? যুদ্ধের সময় আমি কিছু ফাঁকা গুলি ছুড়ে ভন্ড মুক্তিযোদ্ধা সেজে, স্বাধিনের পর ত্রিশ বছর ধরে দেশকে লুটপাট ও ক্রমাগত ধর্ষণ করিনি, এটাই কি আমার অপরাধ? যুদ্ধের সময় কিছু নষ্ট রাজনীতিবীদ ও জ্ঞান পাপীদের মত, কলকাতার বিভিন্ন বারে গিয়ে সাইকাডেলিক রকের তালেতালে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে দেশের টাকা আত্মসাতের চিন্তায় মশগুল থাকিনি, এটাই কি আমার অপরাধ? আমরা তো দেশকে স্বাধিনতা দিয়েছি, বিনিময়ে দেশ শুধূ দিয়ে গেল এই অপমানের গ্লানি? তিনি হয়ত ওই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে তার দিব্য দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন দেশের ভবিষ্যত আর মনে মনে হেসেছিলেন, যারা দেশের সূর্য্য সন্তানদের এইভাবে প্রতিদান দেয়, সেই দেশের নাগরিকদের কি অবস্থা হতে পারে। তিনি হয়ত দেশকে নিজ সন্তানের মত ভালবাসেন, তাই অভিশাপ দিয়ে যাননি, কিন্তূ সাত আসমান ওপর যে সর্বশক্তিমান আছেন তাকে কি ফাঁকি দেয়া সম্ভব? মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, দেশের এত বিশৃংখলা অরাজকতার কারন আমার দেখা সেই মুক্তিযোদ্ধার দীর্ঘশ্বাস। এখন আর মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি উচ্চারিত হলে মাথায় গামছা বাধা, স্টেন হাতে এক বীর যোদ্ধাকে মনে হয়না; মনেহয় অসংখ্যবার পোড় খাওয়া, ক্লান্ত-শ্রান্ত ভগ্ন হূদয়ের, জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এক সংসপ্তককে। । ----------
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.