আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৈঠক, গল্প

বৈঠক -আব্দুল লতিফ, কও তোমার অহন কি বিচার করমু, তুমি যে কাম করছো তাতে ত তোমারে সমাজঅ রাখা যায়না! -খানকির পোলারা, আমরা বউরে আমি আনছি তগো এত পুটকিত বিষ ক্যা? ঘরের ভিতর জরিনা বিবির কান্নার ধারাবাহিক বিলাপ আর আব্দুল লতিফের অর্ন্তকোনে চলতে থাকা ক্ষোভ আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয় গোল হয়ে বসা পঞ্চায়েতের প্রতি এবং উৎসুক জনতার কৌতুহলও আরো একধাপ উপরে উঠে। গোটা পরিবেশ জরিনা বিবির বিধি বিধানের একাগ্রতায় একাত্ত। -বাইসাব... আপনেরা এট্টু থামেন। এর বিহিত আজিসাব করবো। আজিসাব... এর একটা বিহিত দ্যান।

'হ, বাচ্চু বাই ঠিক কইছে। আজি সাবঅই পারব এর একটা সুক্কু বিচার করতে। ' বৈশাখ মাস। তুফান-মেঘ-গাছ পাকা আম। গাছ তলাত কেডায়রে?! ঐ সবুজ, গদাডা লৈয়ায়; হোগার পোলারে আম নেওয়াইয়া দেই।

ও মাগো ও ও... মাজাডা ভাইঙ্গা ফালাইছে গো ও ও... ! স্মৃতি হাতরে আউলাদ ‘হ, হালার একটা কডিন বিচার করতে অইবো!’ -অই তুই চুপ কর, ছোড মুহে বড় কতা মানায় না; দ্যাখ আজি সাব কি করে, চুপ কইরা হোন। নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে অথবা ভিতরে ভিতরে অপরাধবোধ অথবা মাজা ভাঙ্গার জো মনে করে বৈঠক ছাড়ার সিদ্ধান্তে আউলাদ যখন প্রস্তুত আর বাচ্চু কাদিয়ানের বিশেষ ভুমিকায় সভাসদ তাকে স্বীকৃতি না দিলেও আয়োজিত উপস্থিতির পরীক্ষায় সে যখন উত্তীর্ণ এবং স্বীকৃতি স্বরুপ ‘হ বাচ্চু ভাই, ছেরাডায় বেদ্দপঅই’ ‘আরে কইস্না; পোলাডা বাপের মতই হাম্বা অইছে, বাদ দে অর কতা(!), কারোবা সভ্যপ্রধান একজনের অনুপস্থিতিতে চেয়ারে বসতে দেয়ার আপত্তিটুকুও থাকেনা; যা কিনা বাচ্চুর বিচিত্র রকম অঙ্গ ভঙ্গিতেও স্পষ্ট তখন হান্নাব মহাজনের বিরক্তিটা আব্দুল লতিফকে ছাপিয়ে বাচ্চুর উপরই থিতু হয়। -চুদির ভাই, আমার লগে জোড়া দিয়া বইতে চায়! কিন্তু বাচ্চু কাদিয়ান কি হান্নাব মহাজনের জন্য কম করে! রাতদিন সারা গ্রাম ঘুরে সুদের টাকা তোলা, গুদারা ঘাটের চাইলের আড়ৎ এর চাইল ডেলিভারি দেয়া, মাঝে মধ্যে সময় পেলে হান্নাব মহাজনের বাড়ীর সদাইপাতিটা পর্যন্ত করে দেয়। এত কিছু করার পরও কি হান্নাব মহাজনের পাশের খালি চেয়ারটায় বসার যোগ্য হয়নি! আর বাচ্চু কাদিয়ান না থাকলে হান্নাব মহাজনের অবস্থাটাই বা কি হতো? কতো বিশ্বস্ত লোক! বিনিময়ে সে কী-ই বা পায়। তো পাশে রাখা খালি চেয়ারটায় বসলে হান্নাব মহাজনের কি এমন ক্ষতিটা হবে।

সব কিছুর চুল-চেরা হিসাব-নিকাশ করেই কিছুটা রাগে কিছুটা পশ্রয়ের সুরে ডাক দ্যায় হান্নাব মহাজন। -ব বাচ্চু, ব, বইয়া ল। -হোগার পোলা মাতবরী চোদাইতে আইছত! হান্নাবের বালের পিছে ঘুইরা ঘুইরা আর কতো পুটকি মারা খাবি। তর বাপেও না হান্নাবের বাপের তাল্লিত পইরা সব কিছু খোয়াইয়া গ্যাছে। শেষে না রাস্তা ঘাট অ হাইগ্যা মুইত্যা মরল! তুইও হেই তাল্লিত পড়ছত, খা পুটকি মারা ছোয়াব দিব আল্লায়! বাচ্চুর প্রতি দ্বিমেরীয় ভাবনায় আব্দুল লতিফের অংশগ্রহণ পঞ্চায়েতের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া ক্ষোভটাকে জিইয়ে রাখতে সচেষ্ট যা তার চাপা স্বগতোক্তিতেই প্রকাশ।

-নেন হাজি সাব, শুরু করেন। শরতের শান্ত-নিরব বিকাল বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ঝিলিক মারে। তিরতিরে বাতাসে খাল পাড়ে আমির আলীর খোলা পায়খানার জলো গন্ধ। গন্ধে পিক-থুতুর অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হলেও সবার চোখে-মুখে কিন্তু একটা কৌতুহলী ভাবনাই হাসে। সেই ভাবনাটা মাঝে-মধ্যে ঘাড় ফেরায় কলা পাতায় ছাওয়া রান্নাঘরে জোছনা’র মা’র দিকে।

সেটা কি রান্না করা কলমি না হেলেঞ্চা শাকের কচি-সবুজ গন্ধে নাকি কোলে বসা জোছনা’র মা’র দুই বছরের সোহানের মুখে ঠেসে ধরা ঝুলে পরা স্তনের দিকে- সবার সমন্ধে চুল চেরা বিশ্লেষণ করা না গেলেও বিশেষ করে বাচ্চু কাদিয়ানের পেছনে দাঁড়ানো কেতর আলী, আহম্মদ আলী, রমজান মিয়া, টোক্কা মিয়ার মুখায়বে বোধ করি তা স্পষ্ট। উত্তর দিকে কান্ড বেয়ে ছোট লতা-গুল্মে দাঁড়ানো গাব গাছটার নিচে ছইদার মা’র গর্ভিনী গাভীটার যোনীপথ দিয়ে চুইয়ে-চুইয়ে প্রানরস ঝরছে- এখনি বিয়োয় বিয়োয় ভাব- ছইদার মা’র ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছাই, খড়-বিচুলি জোগার করার প্রাণান্ত চেষ্টা, কিছুই অদৃষ্টিগোচর থাকেনা গোলজার হাজীর। সাথে বিচারের একটা রুপরেখাও মনে মনে দাঁড় করায়। নিজের সাথে চলতে থাকা বিচারের স্বগতোক্তিটা প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে যাঁতাকলে গম পেষার মতো দু পাটির দাঁতে ফেলে পান পিষে। -আজি সাব, আলা শুরু করেন না! মাগরিবের সময় ত হইয়া যায়! নামাযের সময় সমন্ধে সন্দিহান মালেক মুন্সি যখন আল্লার কালামে তটস্থ এবং মুসুল্লিদের নামাযে আহ্বানের দায়িত্বে অথবা একটা ঘটনার রহস্য উদঘাটনে নিজের অনুপস্থিতি নাকি পূর্ব হিংসার জোরে অনেকটা বিরক্তিরই প্রকাশ ঘটে যা তার নামায সম্পর্কীয় ভাবনায় গোলজার হাজিকেও বিপাকে ফেলে।

-সাঁ কাঁম সাল্লি? খুব সচেতন ভাবে মালেক মুন্সির সময়-জ্ঞানকে বিদ্রুপ করে আরবী ভাষায় নামাযের সময় জানতে চাইলে গ্রাম্যসভ্যদের মাঝে প্রধান চেয়ারটা পাওয়ার বন্দোবস্তো অন্তত আজকের এই মজলিসে আর কেউ আটকাতে পারেনা গুলজার হাজীর। তার একবাক্য বলা আল্লার কালাম আর সুমিহিত আতর গোলাপের সুবাসে পুরো সভাসদ ঝিঁঝিঁ ডাকা রাত্রিকালীন নিরবতায় সম্মোহিত হয়। তা মালেক মুন্সি কি মনে করে- মাডি কামলার পোলা আজি অইছে(!), নাকি হাদিস-কোরআন সমন্ধে ক-অক্ষর গোমাংস গুলজার হাজীর মুখে আল্লার কালাম, না পরকালের সুখের উন্মত্ততায় নামাজের প্রতি অনুরুক্ত হয়ে- অনেকটা ক্ষোভে, অনেকটা বিরক্তিতে বিচারের নির্দেশ দেয় তা ভাবলেশহীন ভাবে পাশ কাটিয়ে নিজের উচ্চকিত প্রশংসায় উৎফুল্ল হয়ে উঠে গুলজার হাজী। -গুলজারে বলে আমার বিচার করব রে এএএ... আল্লারে এএএ... ! দেশে কি বিচার নাই গো ওওও... ! অয় আমার বার-বাড়ির কুটুম, অয় আমার কি বিচার করব! সারাডা জীবন আমার ঠ্যাংয়ের পিছে লাইগা রইছে। জরিনা বেগমের ধীর লয়ের কান্নাটা হঠাৎ থেমে থেমে ধাক্কা মারে।

আর সেই ধাক্কায় হিংস্রতা মাথা তোলে। অতিতের স্মৃতিগুলো কালসাপের মত পেঁচিয়ে ধরে গোলজার হাজীকে। -খানকি মাগী বহুত জালাইছত, আইজকা এইডার একটা শেষ খেইল দেহামু। নিষ্ঠুর-চাপা কালসাপের ছোবলটা তাকেই কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। অপ্রকাশিত গালির ছোবলটা গুলজার হাজীর লাল-গোল কোটরগত চোখে থেকে বিষ বানে নিক্ষিপ্ত হয়।

বাচ্চু কাদিয়ান লাফিয়ে উঠে। -ঐ বেডি, তুমার ত সাহস কম না! উডান ভর্তি মাইনষের সামনে আজি সাবরে অপমান করো। বিল সাতঁরিয়ে সন্ধ্যার হাঁসগুলো তখন পাড়ে উঠে গদ গদ করে উঠল। সন্ধ্যা তখন আম গাছ, শ্যাওড়া গাছ, ডুমুর গাছের ফাঁক-ফোকরে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছোঁয়াছুঁয়ি করছে। দুই-একটা কুকুর বৈঠকের আশে পাশে সভ্য মানুষদের উপহাস করার জন্য ঘুরছে নাকি কার্তিক মাসে এটাই কুকুরের স্বভাব তা বোঝা যায়না।

আর অবিরত চলতে থাকা বৈঠকে জরিনা বিবি ও গুলজার হাজীর চারিত্রিক প্রমোশন-ডিমোশন দিন রাত্রির সন্ধিক্ষণ অন্ধকারকে গাঢ় করে। আর গাঢ় অন্ধকারের হাত ধরে মগরিবের আযানের ছিপছিপে আওয়াজ বৈঠকের টান টান উত্তেজনা ভেঙ্গে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশে একটা অজানা গন্তব্যের ভয় চোখ থেকে চোখে চকচক করে উঠে। -হুনেন মুসুল্লি ভাইয়েরা হুনেন, এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করলে বাউত্তুর বছর দোজগের আগুনে জ্বলতে অইব, আর ঐ আগুনের তাপ দুনিয়ার আগুনের চে স..ত্তু..র গুন বেশী। দোজখে জ্বলার অঙ্কটা ভুল কি সঠিক হিসাব করার সুযোগ না দিয়ে একটানা বলে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ভীত সন্তস্ত্র লোকদের একটা অপ্রতিরোধ্য উৎকন্ঠায় ফেলে ক্ষান্ত হয় মালেক মুন্সি।

খাচায় বন্দি হিংস্র নেকড়ের মতো সবকিছু কটমট দৃষ্টিতে দেখতে থাকে গুলজার হাজী। জরিনার উপর আক্রোশটা মালেক মুন্সি হয়ে আযানে গড়ায়। -হালার আযানেরও বুঝি সময় অইলনা! আর এদিকে মালেক মুন্সি হাদিস চুদাইতাছে। মনে মনে নানা খিস্তি খেউরিতে জরিনার উপর আক্রোশটা জিইয়ে রাখার জন্য তরিঘড়ি করে, মসজিদ পানে ছোটে। আছরের অযুতে মগরিবের জামাতে গিয়ে দাঁড়ায়।

ইমাম সাহেবের কন্ঠস্থ সূরা বলার ফাঁকে জরিনা বিবিকে ফাঁসানোর নানা ফন্দি-ফিকির তেলাওয়াতের সুরে মনে মনে ভাঁজে। -খানকি মাগীর কত তেজ অইছে আইজকা দেখমু, খালি নামাজটা শেষ অউক। রুকু-সেজদার মধ্যবর্তী সময়ে অর্ন্তকোনে জেগে থাকা অভিরুচি অনুযায়ী ত্রিশোর্ধ্ব জরিনা বিবির টলটলে বাঁধানো শরীরের অলি-গলি চোখের কোনে নেচে বেড়ায়। দীর্ঘ দিনের অবৈধ ক্ষুধার্ত কামনাটা খলখলিয়ে উঠে। আদিম হিংস্রতায় কাতরায় গুলজার হাজী।

জরিনা বিবির অদৃশ্য অবয়বে নিমজ্জিত মনোযোগ নামাজে আরোপিত করলেও বিশেষ লাভ হয়না, পরক্ষনে নগ্ন বেশে হাজির হয়। অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুন্নতি কায়দা অসম্পূর্ণ রেখেই পবিত্র-শান্তির ঘর মসজিদ থেকে ছুটতে হয় তাকে। তখনও অন্ধকার তার নগ্ন-কালো শরীর নিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। শুধুমাত্র গাছ-গাছালী, বাড়ি-ঘরের চিপেচাপা থেকে হালকা কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। বৈঠক তলায় খুঁটিতে বাঁধা হ্যাজাক লাইটটা এই সুযোগে অন্ধকারকে তার শাখা-প্রশাখা মেলে বিচরণের পথটা প্রশস্ত করে দিয়ে রাগে-দুঃখে শোঁ শোঁ করে জ্বলে।

উপরে আম পাতার ফাঁকে নিকশ-কালো-অন্ধকার পাকা-কালো-জামের মতো ঝুলতে থাকে, আবার কখনও কখনও ঝলসিত আলো-বাতাসের দুলুনিতে অদৃশ্য হয়। মগরেবের রেশ শেষ হতে না হতেই গ্রামের এইট্টি পারসেন্ট ঘরমুখী। হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমে জীর্ণ লোকগুলি সন্ধ্যার নামাজের আহ্বানে ‘মরলে যে কি অইব ’ মনে করেও ইহজাগতিকতার ক্লান্তিতে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ঘরে ফেরে। মগরেব থেকে এশার মাঝখানের সময়টায় কালো-তামাটে-ধূসর বর্নের হাড্ডিসার লোকগুলো ধূমায়িত কুপির আলোয় পিড়ি পেতে খেতে বসে। গায়ে-ব্লাউজ-নেই বউ-ঝিরা স্বামীর পাতে ভাত বেড়ে দেয়, তালের খোল দিয়ে বাতাস দেয়, মাঝে মধ্যে দুই একটা কথা- সান ক্যামুন অইছে, নুন ঠিক মত অইছেনি, আর দুগা ভাত লন- এইসব কথাবার্তা-মুখরসে পুরো গ্রাম মুখরিত হয়ে উঠে।

এশার পর মনুষ্য কোলাহল স্তব্ধ হতে হতে ঘন্টা খানেকের মধ্যে পুরো গ্রাম শশ্মানে পরিণত হয় আর সেই সাথে ঝিঁ ঝিঁ পোকার বিরামহীন গুঞ্জনে মনুষ্য পৃথিবী বিদায় নেয়- অন্তত ফযর পর্যন্ত। চিরাচরিত সন্ধ্যার দৃশ্যকল্পে নিজেকেও দেখতে পায় গুলজার হাজী, সাথে বউ বানু নয়; জরিনা বিবি, ব্লাউজে ঠাসা জরিনা বিবি। হাতে তালের খোলের পরিবর্তে ময়ুরপঙ্খী খচিত বেতের পাখা। পাখা আর পুরুষ্ট হাতের দুলুনিতে একটা মোহনীয় বাতাসে বিবস হতে থাকে গুলজার হাজী। কিন্তু আমতলার হ্যাজাক লাইটের কেরোসিন পোড়ার শব্দ আর ঘরের ভিতর চলতে থাকা আব্দুল লতিফ-জরিনা বেগমের বিচারে অনাস্থা কঠিন অবস্থান নিলে গুলজার হাজীর পুলকিত ভাবনায় তাড়িত স্বপ্নটা ইটের কোয়ার মতো নানা অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

অদম্য যন্ত্রনায় কাশি মারে। কালো কুচ কুচ গতর আব্দুল লতিফের প্রেমালাপের রশি এক ঝটকায় খেজুর বিছনায় এসে ভাঙ্গে। আড়চোখে গুলজার হাজীকে দেখে ‘এই চুতমারানীর পোলায় আমার পিছে লাগছে ক্যান, আমি অর কুন্ বালডা ছিরলাম’ রাগে দুঃখে বিছনার পাতা ঁেছড়ে। মগরেবের কোর্স সম্পূর্ন হতেই একে একে সবাই আসে- হান্নাব মহাজন আসে, মালেক মুন্সি আসে, বাচ্চু কাদিয়ান আরো অনেকেই... - ছোড বেলায় ই গুলামের গরের গুলামে এক নম্বরের জাউরা আছিল। একদিন হইছে কি আমি মরছিদতে আইতাছি; বুকঅ কুারান শরিফ, জাউরার ঘরে জাউরায় আমারে কয় কি ‘তরে একটা কথা কই; কারো কাছে কিন্তু কইবিনা, তর আতঅ কুরান শরিফ, কইলে কিন্তু... ।

আমি কইলাম কন। ‘রাইতে বাইশঝার তলাত আহিছ; টেকা দিমুনে’। লজ্জায় আর কুরান শরিফের ডরে আমি দুই রাইত ঘুমাইতে পারিনাই, দানা পানিডা পরযন্ত মুখে লইনাই। খালি কান্দি। আযরে ধরছে মনে কইরা বাবায় কবিরাজ আনছে, কবিরাজে কয়, হ, খারাপটায় ধরছে।

কিন্তু আমি ত জানি আমার কি অইছে! গ্রাম্য কয়েকটা চেংড়া পোলার আগমনে বৈঠকতলাটা হ্যাজেক লাইটের মতো জ্বল জ্বল করে যেন একটা অঘোষিত আড্ডা। হান্নাব মহাজন তার আশে পাশের জয়নাল কয়েল, আহম্মদ সরদার, নুরা মুন্সি, বাচ্চু কাদিয়ানের সাথে তার সদ্য তোলা ব্রয়লার ফার্মের লাভ-লোকসানের পরিকল্পনায় বিভোর। হান্নাব মহাজনের পিছনে দাঁড়ানো যুব স¤প্রদায় কেতর আলী, রমজান মিয়া, টোক্কা মিয়ার বয়সের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারী দেহ, প্রেম এসব নিয়ে তুখোড় আলোচনা। ওদিকে ছৈদার মা’র পেট অলা গাভীটার ডাকাডাকি কিছুটা থেমে এসেছে। ভোর বেলায় হয়ত বিয়োবে! ছৈদার মা’র চোখে ঘুম নেই, লাল শিখার কুপি জ্বালিয়ে গাভীটার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।

নতুন বাছুর, সাথে দুধ পাওয়ার আকাঙ্খা চলমান কষ্টকে মেনে নিয়ে কখনো গামছা দিয়ে মশা-মাছি তাড়ায়, কখনো খড়-বিচুলী কিংবা ফ্যান পানির পাত্রটা এগিয়ে দ্যায়। আম গাছের গোড়ায় চেয়ার পেতে বসা মালেক মুন্সি। হাতে তজবিহ্। আঙুলের কৌশলে তজবিহ্ দানা এক হাত থেকে আরেক হাতে, আঙুলের কৌশল আর এক ঘেয়েমী খেলায় আল্লা’র নিরানব্বই নাম জপ করছে নাকি গুলজার হাজীর বিচার কার্যে ভুল ধরার কসরত মনে মনে জপ করছে, তা বোঝা মুশকিল। সব কিছু সূক্ষভাবে নিরীক্ষণ করেও আলাদা এক ক্ষমতাবলে ঘরে চলতে থাকা জরিনা বিবির লাগামহীন গুঞ্জনে কান পাতে গুলজার হাজী।

সত্যে মোড়ানো এক একটা বাক্য লক মেশিনের সুঁচলো সুই এর আঘাতে গুলজার হাজী ককিয়ে উঠে, ‘খানকি মাগী কয় কি দেখছত! লাং লইয়া যহন পলাইয়া যায়গা তহনও আমারঅই দোষ। ’ প্রেমময় সঙ্গম করার কামনাটা দস্যুতায় প্রকাশ পায়। -হিল্লা! শরিয়ত মোতাবেক হিল্লা বিয়া দিতে অইব। আপনেরা কি কন? -আ..জি সা-ব, আমি কিছু ক-তা কমু। -অই বাচ্চু হগলতরে চুপ করতে ক; হোন মালেক মুন্সি কি কয়! -আজি সাব রাগ কইরেননা, শরিয়ত মোতাবেক হিল্লা বিয়ার নিয়মডা একটু কই- শরিয়তে হিল্লা বিয়া অইল; যদি কোনো স্বামী...(ঢোক গিলে) তার বউরে তালাক দ্যায় এবং তারপরে যদি... (আবার ঢোক গিলে) আবার আনতে চায় তাইলে হিল্লা বিয়া... বুঝছেন হিল্লা বিয়া দিয়া আনতে অয়।

জোড়াতালি দেয়া শরিয়ত বৃত্তান্ত গুলজার হাজীকে বিপাকে ফেলে। তীব্র চোখে মালেক মুন্সির দিকে তাকায়। ‘জলজ্যান্ত একটা নাটকের শেষ’ আঁচ করতে পেরে মনের কোণে জমা সুপ্ত কামনাটাকে নিস্তেজ করে গুটিসুটি। মালেক মুন্সির ভাঙ্গা-চোরা শরিয়ত বৃত্তান্ত, গোলজার হাজীর বিচার অপরাগতায় হান্নাব মহাজনই অঘোষিত ভাবে দায়িত্ব জ্ঞানের বৈঠাটা কাঁধে নেয়। -জরিনা, তুামার কিছু কওনের থাকলে কও।

‘গুনি ছাড়েনা মান, ধনী ছাড়েনা চাঁন’। কঠিন মুহূর্তে উপায়হীন মানুষের মান বজায় রেখে চলাটাই মোক্ষম। জরিনা বিবিও দরজার আড়ালে থেকে একনাগারে বলে -বাজান আমার মরনের অবস্থা, দুলাবাই আইছে আমারে নিতে, আর আমি বুলে কার লগে পলাইয়া গেছিগা! মরন ভাবনাও মাঝে মধ্যে নাটকীয়তার জন্ম দেয়। আর এরকম নাটকীয়তা যে জীবন বিষিয়ে তুলতে পারে তা কি মানুষ ভেবে চিন্তে রাখে! গুলজার হাজী ফাল দিয়ে উঠে -তোমার একলার কথাই হাছা, আর সবাই মিছা কথা কয়! কি ও আপনেরা কি কন, হেঃ! দুর্বলতা বা ভয় সব সময়ই আহম্মকিতা উপহার দেয় আর সেই দুর্বলতাকে দশজনের ঘাড়ে চাপানোই মানুষের সহজাত অভ্যাস। -আব্দুল লতিফ তুমি কিছু কও।

-আমি কি কমু(!) আমার বউরে আমি আনছি কারতে জিগাইয়া আনতাম! -লতিফ ভাই, এইডা তুমি কি কইলা; বিচার অ বইছ বিচারের মত কথা কও। -বিচার! বিচার কি আমি ডাকছি না আমার বউ ডাকছে!!! এই বিচার আমি মানিনা। আব্দুল লতিফের বিচার অনাস্থায় পুরো শাসন ব্যাবস্থাই কেঁপে উঠে। নেতৃস্থানীয় কয়েকজন কানে-গালে ফিস ফিস করে। একটা সুক্কু বিচার তো অন্তত করতে হবে, না হলে যে বিচার নামক ব¯ুÍটারই অপদস্থ হতে হয়।

-আপনেরা একটু চুপ কইরা বন। জুরি বোর্ডঅ বইতে অইব। বাচ্চু কাদিয়ানের হুকুমটাকে হুকুম মনে না করে সভ্য গ্রামবাসীরা অনেকটা নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য ভেবে জলজ্যান্ত একটা বিনোদনের শেষ দেখতে বসে থাকে। রাতও যেন তাদের সাথে গায়ে গা মিলিয়ে চুপচাপ। গায়ে মাথায় কালি মেখে গাছ-গাছরা, ঝোপ-ঝাড়ও।

হ্যাজাক লাইটের জ্বলজ্বলে আলোয় কালো জলে রুপালী স্রোতে ছলকায়। আর সভ্য গ্রামবাসীরাও অধীর আগ্রহে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে বিনোদনের শেষ অপেক্ষায়। এক সময় বৈঠক সদস্যদের পরীক্ষার অবসান হয়, জুরি বোর্ড ভাঙ্গে। জুরি বোর্ডের রায় সভ্যপ্রধানদের চোখে মুখে জ্বলমল করে। গুলজার হাজীর কোটর কালো চোখ দিয়ে রায় ছিটকে বেরোয়।

হান্নাব মহাজন অগোছালো ভাবে পাঠ করে - আব্দুল লতিফ কও, অহন তোমার কি বিচার করমু! এই পর্যন্ত তুমি যে কাম করলা তাতে ত তোমারে সমাজঅ রাখা যায়না। তুমি তুমার বউ লইয়া অন্য রাস্তা দেহো... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।