আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সবুজের বুকে লাল, সেতো উড়বেই চিরকাল।

কিছু মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছু মানুষ স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠে। জীবন আপনার কাছে সেভাবেই ধরা দিবে আপনি যেরকম থাকবেন।

খুব ছোটবেলায় বিজয় দিবস আসলে আমার মন মেজাজ সামান্য খারাপ হয়ে যেত। জাতির সব থেকে গৌরবময় একটা দিনে আমার মন খারাপের কারন ছিল দুটো।

একটা হল দৌড় প্রতিযোগিতা। বেইলিরোড কলনীর মাঠে বিজয়দিবস উপলক্ষ্যে যে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হত তাতে আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতাম এবং ৮ জনের মধ্যে হয়ত পিছন দিক দিয়ে ফার্স্ট অথবা সেকেন্ড হতাম। এটার একটা কারন অবশ্য এরকম ছিল যে আমার গ্রোথ ভাল ছিল। যেহেতু উচ্চতা দিয়ে গ্রুপ নির্ধারন করা হয় যে কে কাদের সাথে দৌড়াবে তাই একটু বড়দের সাথে পাল্লা দিতে হত সবসময়। আরেকটা সহজ ব্যাখ্যা হল আমি দৌড়ে খুব পারদর্শী নই।

ক্রিকেট এবং ফুটবল ভাল খেললেও দৌড়ানো ভিন্ন জিনিস। অন্যরকম স্কিল লাগে। বিজয় দিবসে সন্ধ্যা থেকে অনুষ্ঠান হত। সেখানে বাচ্চাদের জন্য ছড়া, কবিতা আবৃতির ব্যবস্থা থাকত। খুব সাহস করে একবার ছড়া আবৃতিতে নাম লেখালাম।

স্টেজের সামনের দর্শকদের আগমনের হেতু ছিল মুলত ব্যান্ডের গান শোনা। তারপরেও যারা আগে চলে এসেছে তাদের ছড়া/ কবিতা শুনতে হত। আমার আগের ছেলেটা স্টেজে উঠে ৪ লাইন পড়ার পর কবিতা ভুলে গেল। কান্না শুরু করে দিল। দর্শক সারিতে শুরুতেই তার বাবা বসে আছে।

তার বাবা গিয়ে বলল, তোমার পকেটে কবিতাটা লিখে দেওয়া আছে সেটা দেখে আবৃত্তি কর। ঐ ছেলের অবস্থা দেখে ততক্ষনে শীতকালেও আমি ঘামতে শুরু করলাম। কারন আমার পকেটে আমার কবিতা লেখা নাই এবং আমি সব ভুলে গেছি। কবিতার নাম কবির নাম সব কিছু “ফরগটেন” হয়ে গেছে। এরপর যখন আমার নাম ডাকা হল আমাকে পাওয়া গেলনা।

কারন ততক্ষনে আমি পালিয়ে গেছি। ১৬ ডিসেম্বর আসলেই তাই এলাকায় আমি মোটামুটি মাথা নিচু করে থাকতাম। কারন ছবি আঁকার প্রতিযোগিতাতেও আমার কিছু হতনা। তবে একটা ব্যাপারে আমার উৎসাহের কোন সীমা ছিলনা। সেটা হল বাংলাদেশের একটা পতাকা কিনা।

কাগজের পতাকা কাঠির উপরে। দাম ২ টাকা। ১৬ ডিসেম্বর আসলেই সব জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা দেখে মনটা কেমন জানি পুলকিত হয়ে উঠত। তখনও ১৬ ডিসেম্বরের তাৎপর্য বোঝা হয়ে উঠেনি। ন্যায়ের কাছে যে অন্যায় পরাজিত হতে বাধ্য সেই মর্মবোধ তখনও হয়ে উঠেনি।

সত্যিকথা বলতে কি ১৬ ডিসেম্বর বা বিজয় দিবসের প্রকৃত অর্থ আমি বুঝতে পারি ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল। একটা দেশের সবগুলা মানুষ কখন একসাথে আনন্দে মেতে উঠতে পারে সেটা আমার প্রথম দেখা। বাংলাদেশ যখন আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ান হয়, জাতি তখন আনন্দে উত্তাল। নতুন প্রজন্ম কখনই পুরা দেশকে এভাবে বরন করতে দেখেনি। সবাই পতাকা নিয়ে আনন্দ করছে।

তখন আমি প্রথম বুঝলাম ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর কি হতে পারে। বুঝতে পারলাম এই যে সবুজের বুকে লাল এই একখানা কাপড়কে আমরা কত ভালবাসতে পারি। এই সবুজের বুকে লাল এর জন্য আমরা কতটা ত্যাগী হতে পারি। কত অবলীলায় ৩০ লক্ষ লোক এর জন্য প্রাণ দিতে পারে। বিজয় দিবস আসলেই আমি সব সময় চেস্টা করি একটা নতুন পতাকা কিনে সেটা আমার বারান্দায় টানিয়ে দিতে।

আর নিত্য উপহার থকে সবুজের বুকে লালের একটা গেঞ্জী কিনতে। গতবার চেস্টা করলাম এই কাজটা আরও অনেককে দিয়ে করাতে। আর কিছু না হোক ১৬ ডিসেম্বর ফেসবুকের প্রোফাইল পিকটা সবুজ দিয়ে রাঙ্গাতে। হাজার হাজার লোক এটাতে সাড়া দিল। কয়েকজন ভুল বুঝল।

বলল লোক দেখানো দেশপ্রেম না দেখাতে। আমার কথা হল, দেশপ্রেমই একমাত্র প্রেম যেটা লোক দেখানোর জন্য হলেও দেখানো দরকার। আমি বিশ্বাস করতে পছন্দ করি সবুজের বুকে লাল এই প্রকৃতি আমরা প্রতিটা বাংলাদেশি নিজেদের বুকে ধারন করি। আর মাঝে মাঝে নিজের হৃদয়টা দেখানোও জরুরি। যখন একজন এই কাজটা করে তখনই ব্যাপারটা অসাধারন হয়।

যখন সবাই মিলে এই কাজটা করে তখন সেটা হয় অতি-অসাধারন। দেশকে ভালবাসার অংশই হচ্ছে নিজের পতাকাকে ভালবাসা আর যে কোন অবস্থায় এর অমর্যাদা থেকে বিরত থাকা। দেশকে ভালবাসার অধিকার সবার। ১৬ ডিসেম্বর নিজের পতাকাকে শোভিত করা মানে এক দিনের ভালবাসা না। এটা মানে হচ্ছে আমার হৃদয়ে আমি কি ধারন করি সেটা একদিনের জন্য দেখানো।

মাঝে মাঝে যেহেতু হৃদয়টা দেখানোও জরুরি। আমি বিশ্বাস করতে ভালবাসি বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেট জিতবে। এমন একদিন আসবে বাংলাদেশের কেউ অভুক্ত থাকবেনা। যতদিন সামনে যাবে তত দিন আমরা একটা একটা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাব। কিন্তু আমাদের সব থেকে বড় অর্জন হল ১৬ ডিসেম্বর।

এই একটা দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সফল হবই। এই একটা দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয় জাতি হিসেবে আমাদের কেন এক হতে হবে। কেন সবার সম্মিলিত চেস্টাতে আমরা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাব। এই একটা দিন নতুন প্রজন্মের বাচ্চারা সবুজের বুকে লাল পতাকা দেখবে আর সে সম্পর্কে জানতে চাবে। গতবার আমার কিছু ভাগ্নে ভাগ্নিদের সবুজের বুকে লাল গেঞ্জী নিত্য উপহার থেকে কিনে দিলাম।

তাদের খুশি আর দেখে কে। কেন তারা ১৬ ডিসেম্বর এইটা পড়ল জানতে চাইল। তাদেরকে বললাম ১৬ ডিসেম্বরের কথা। আমাদের অর্জনের কথা আমাদের ত্যাগ মহিমার কথা। আর কোন ভাল উপলক্ষ্য কি পাওয়া যেত তাদের এটা বোঝানোর জন্য।

ব্যাপারটা এখানে থেমে থাকেনি। আমার ভাগ্নে, ভাগ্নী যারা আমেরিকা থাকে তারা জানাল তাদেরো সবুজের বুকে লাল লাগবে। ব্যাস নিজে গিয়ে কিনে আনলাম। আমেরিকা যে যাবে তাকে দিয়ে পাঠালাম সবার জন্য। সুদূর আমেরিকায় থেকেও একটুকরা বাংলাদেশকে তারা বুকে ধারন করল।

বলা বাহুল্য অনেক ভাগ্নে ভাগ্নি আছে আমেরিকান বর্ন। কিন্তু দেখতে ভালই লাগল বাংলাদেশের পতাকার প্রতি তাদের আগ্রহ দেখে। জগন্নাথ হলের শামসুন্নাহার সাইডের দিকে কে জানি রাস্তাতে সবুজ-লাল পতাকাটা এঁকে রেখেছিল। অনেকদিন যাবত সেটা ছিল। মাঝে মাঝেই হাটার সময় আমি পাশ দিয়ে যেতাম।

রাস্তা দিয়ে রিকশা যাবে মানুষ হেটে যাবে রাস্তা যে পতাকা আঁকার জায়গা না সেটা সম্ভবত সে বুঝতে পারেনি। আর সবুজের বুকে লালের স্থান মাটিতে না। এর স্থান হল আকাশে। আমরা সবসময় একে আকাশে উড়িয়ে রাখব। দেশের মাটিতে সে আকাশে উড়বে।

এশিয়ান গেমসে সোনা জিতার মত কৃতিত্বের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতেও তাকে আমরা আকাশে উড়াব। কারন, সবুজের বুকে লাল, সেতো উড়বেই চিরকাল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।