আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এন্টি গল্প > আচানক পান্থজন অপান্থ বারবেলায় >

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
শেষ শরতের স্নিগ্ধ চাঁদ সটান উঠে এলো বারান্দা সোজা। নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে ঘুরতে একফাঁকে চোখ বুলিয়ে নিল। ফাঁকা বারান্দা। তারপর একটু নড়েচড়ে আবার নিজের অক্ষে ঘুরপাক খেতে খেতে আরো ওপরে ওঠার দৈনন্দিন রুটিনে মনোনিবেশ করল। ধীর স্থীর দাঁড়ানো দরজাটা নিজের মনেই অভ্যেসবসে একবার খুলে যেতে চেয়েও বস্তুগত নিয়মে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল।

ওপরের সিটকানিটার একবার মন বলল- নড়েচড়ে ঠুস করে নিচের দিকে নেমে হাট হয়ে দরজাকে খুলতে দেয়! কিন্তু সেও শেষমেষ নিশ্চল। রোজকার নিয়ম মত চটি জোড়া মুখ ব্যাদান করে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় নিজের ফিতে দুটোকে হালকা দুলিনি দিয়ে আবার সোজা হতে চাইল। ফিতেরা দুলেও উঠল না, নড়েও উঠল না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর চটি জোড়ার মনে হলো কি সব্বোনাশ! এখনো যে বাথরুমে যাওয়া হলো না! ছড় ছড় করে জলের ধারাও তো বয়ে গেল না! আড়চোখে চটির ঘাপটিমেরে পড়ে থাকা দেখে বেডসাইড টেবিলটার বেশ মজা লাগল। সে জানে, তাকে নড়াচড়া করতে হবেনা।

কিন্তু সেও অনেকক্ষণ নিরবে নিশ্চল থেকে একসময় হাঁপিয়ে উঠল। কই তার বুকের উপর একে একে মারিব্যাগ, চাবির গোছা, ফাউন্টেন পেন, একটা ময়লা রুমাল তো এসে বসল না! মাঝে মাঝে কিছু নতুন নতুন জিনিসও তার বুকের ওপর রাতভর থাকে। মনে মনে ভাবল, কি জানি বাপু, দিন বদলেছে। আজকাল আর কেউ সব কিছু নিয়ম মেনে টেনে করে না! চাঁদাটা ততক্ষণে বারান্দা পেরিয়ে আরো ওপরে উঠে প্রায় ওই ঘরের ছাদের ওপর চলে গেছে। আবছা আলো তখনো বারান্দাময় ছড়ানো।

শেষ বারের মত আর একবার উঁকি দিয়ে আবার মুখ ব্যাদান করে সেও সরে গেল। এবাড়ি-ওবাড়ির সব বাতি সেই সন্ধ্যে থেকে জ্বলে জ্বলে প্রায় টুক শব্দ করে নেভার সময় হয়ে এলো। কিন্তু এ ঘরের বাতিগুলো জ্বলল না। সদর দরজার কাছেই যে স্যুইচটা, সে খানিকক্ষণ নিজে নিজেই চেষ্টা করল দুম করে নিচের দিকে নেমে যেয়ে তারের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলিয়ে ন্যাংটা বাল্বটা জ্বালিয়ে দেবে, কিন্তু হায়! আজ হাড়ে হাড়ে বুঝল, ওর সে ক্ষমতা নেই। ছিলও না কোন কালে।

শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে ন্যাংটো বাল্বটার দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বসে রইল। এ দশা দেখে বাল্বটা হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে না পেরে ভ্যবলাকান্ত হয়ে ঝুলতে থাকল। ও না হয় ওভাবেই ঝুলতে থাকল, কিন্তু বাথরুমের বাল্বটার কি হলো? ওর একবার ইচ্ছে হল নিজেই হাত বাড়িয়ে দেয়ালের স্যুইচে টোকা দিয়ে জ্বলে ওঠে। নিচের কলটাকে ফিস ফিস করে বলে উঠল, কিরে মুখে যে কথাবার্তা নেই, ব্যাপার কি? বিপুল বেগে ছড় ছড় করা শব্দ কই? কলের মাথার কাছে যে মোটা চাবিটা সে না ঘুরলেও কলের মুখ থেকে খুব অল্প হলেও ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ে। সেটা যে মেঝেতে পড়ে সেও দেখল সেই সকালের দিকে যেটুকু পড়েছিল তারপর আর নেই! আরো অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পর বারান্দার ইজি চেয়ারটা অনড় আধাশোয়া অবস্থায় কার যেন ভারের অপেক্ষা করতে করতে একসময় নিজেই খানিকটা উঁচু হয়ে আবার আগের যায়গায় সটান।

সেই আধোশোয়া। খুব রাগ হলো তার। আর কেউ কিছু না বুঝলেও সে বেশ বুঝতে পারছে কিছু একটা ঘটেছে! শীত না এলেও শিরশিরে কনকনে বাতাস মাঝে মাঝেই বয়ে যাচ্ছে। সেই এক দমকা বাতাস বারান্দা দিয়ে সরে যাবার সময় কি এক আকুতিতে ইজি চেয়ারের ঢেউ খেলানো কাপড়টা বাতাসকে একটু থমকে দাঁড়াতে অনুরোধ করে বসল। বাতাস নিজেকে বরাবরই এজমালি সম্পত্তি ভাবে বলে কারো কোন অনুরোধ বা আদেশ মানতে বাধ্য নয়।

তবুও তার মনে হলো কি এমন যায় আসে? শুনি না কি বলতে চায় ইজি? বোঝা গেল তাকে একটু উঁচু-নিচু করে দিতে বলেছে! হায়রে অবুঝ ইজি! রোজকার অভ্যেস, তাই কি? ইজির পাশে ছোট্ট টুলটার ওপর একটা এ্যাশট্রে শুয়ে ছিল। প্রায় ভরে উঠলেও তার বুক খালি করেনি আজ কেউ। দম বন্ধ হয়ে সেভাবেই পড়ে আছে। কিন্তু ইজিকে নিশ্চুপ দেখে সেও ধরে নিল আধপোড়া সিগারেটের ছাই এই এলো বলে; ভাবলেও কেন যেন মনে হচ্ছে যদি না আসে? বারান্দায় একটা বাঁশের চটার সঙ্গে পেঁচিয়ে গ্রিল ভেদ করে নিচের দিকে ঝুঁকে থাকা মাধবী লতা গাছটা আপন মনেই দুলে চলেছে। ও জানে কেউ একজন যত দেরিই হোক একাবারটি হলেও ওর লতায়, ডগায় হাতের স্পর্শ দেয়, শুকনো এবং পুরোনো পাতা খসিয়ে দেয়, তারপর একেবারে শেষের দিকের থোকায় যে রংবেরঙের একগুচ্ছ ফুল থাকে তাতে একটা টোকা দিয়ে তারপর আবার ইজি চেয়ারে গিয়ে বসে।

রাত বাড়তে বাড়তে প্রায় শেষ হতে চললেও কেউ তা করল না। অভিমানে নিজেই গা-ঝাড়া দিয়ে একটা পুরোনো পাতা খসিয়ে দিল। একটা প্রায় মরতে বসা ক্যাকটাসের তেমন একটা রাগ টাগ নেই, কারণ ও জানে ওর গায়ে রোজ রোজ কেউ হাত বুলোয় না। জল লাগে সপ্তায় একবার মোটে। অবহেলায় বড় হওয়া নিয়তি মেনে সে তেমনিভাবেই বসে রইল একটা রংচটা টবে।

নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও বালিশদুটোকে দলাই মলাই করে তার উপর একটা চারকোণা কাপড়ের ঘর বানিয়ে কেউ তার বুকের উপর মাথা রাখল না। একবার ওর মনে হল বুকের ওপর মাথা রাখলে যেমন মাঝখানটিতে একটু নিচু হয়ে যায়, সেভাবে নিজেই একবার নিচু হবে কি-না। কিন্তু শত চেষ্টায় পারল না সে। বিছানার চাদরটা কোথাও কোথাও এলোমেলো হয়ে সটান শুয়ে ছিল। দক্ষিণের জানালাটা একটু খোলা ছিল বলে সেখান দিয়ে একটু একটু হাওয়া এসে ফ্যানটাকে দোলাচ্ছিল।

চাদর ভাবল ফ্যানটা যদি আর একটু জোরে নড়ে উঠত তাহলে সে সমান হয়ে থাকতে পারত। না, ফ্যানের ওই নড়াচড়া পর্যন্তই। সে পুরোপুরি ঘোরার কৌশল যানেনা। গ্যাসের চূলোটাও অলস বসে রইল। ম্যাচটাও নিজে নিজে তার খাপ খুলে কাঠি বের করে জ্বলে উঠতে পারল না।

চূলোর পাশে কয়েকটা বাটিতে আধখাওয়া ঝোল-তরকারি তেমনি অবহেলায় অস্পৃশ্য। একদল তেলাপোকা আজ মনের আনন্দে বীর বিক্রমে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াতে লাগল। রান্নাঘরের কোণায় একটা পিঁপড়ে উঁকি ঝঁকি দিতেই তেলাপোকারা অভয় দিয়ে বলে- বেরিয়ে আয়, কোন ভয় নেই। এদিক ওদিক দেখে পিঁপড়ে ঠিকই সাহস করে বেরুল। অন্ধকারে ঠিকই খুঁজে খুঁজে তরকারির বাটি, ভাতের গামলায় হামলে পড়ল।

গামলাটার একবার মনে হলো নিজেই সরে গিয়ে বাঁচে। পারল না। তারপর অনন্তকাল অপেক্ষায় থাকতে লাগল, যেন পিঁপড়ে বা তেলাপোকারা তার কোলের ভেতর বসে যত রকম হার্মাদিই করুক না কেন, তাতে তার কিছু আসে যায় না। রাত আরো গভীর। টিক টিক করে দেওয়াল ঘড়িটা কেবল ঘুরে চলেছে।

এক একটা ঘণ্টা পেরুচ্ছে আর নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য ঘড়িটা ঢং ঢং করে বেজে উঠছে। এঘরে একমাত্র সে-ই সচল। বাইরে কারা কারা যেন ঝিম ঝিশ শব্দে একটানা ডেকে চলেছে। আরো দূরে কেউ একজন পাহারাদার রোজকার নিয়মে ল্যাম্পপোস্টে লাঠির বাড়ি মেরে হেঁকে উঠল, হেই..... কে জাগে..... এঘরের সবার অনেক কষ্টেও হাসি পেল। কে জাগে? বলে কিনা কে জাগে? ওরা এতগুলোতে যে সারাটা রাত ধরে ঠাঁয় জেগে আছে, জেগে জেগে একবার সরব হয়ে আবার যার যার যায়গায় গিয়ে সেই রাতের মত নিশ্চুপ হয়ে যাবার জন্য জেগে আছে সে খবর কি রাখে ওই পাহারাদার? ছোঃ পুব আকাশ যখন হালকা আবীরের রঙে রঙিন হয়ে উঠছে, জানালার সামান্য খোলা অংশ দিয়ে যখন শেষ শরতের মৃদু হিমেল হাওয়া ঢুকতে শুরু করেছে, দেওয়াল ঘড়িটা যখন ক্লান্তিহীন ঢং ঢং করে চলেছে, তখন সবার মনে হলো কি হয়েছে? কিছু একটা যে হয়েছে তাতে তো কারোই কোন সন্দেহ নাই।

তাহলে এখন কি করা যায়? সবার মনে হলো সবাই একসাথে বসে চিন্তা করতে পারলে ভাল হত, কিন্তু কিভাবে হবে তা কেউ ঠাওর করতে পারল না। বারান্দায় বেড়াতে আসা পোকারা, রান্না ঘরের তেলাপোকা, পিঁপড়ে আর খুব কসরৎ করে ঘরে ঢোকা নেংটি ইঁদুর, লাইটের নিচে অকে দিন ধরে এই ঘরের স্থায়ী বাসিন্দার মত বড় হয়ে ওঠা টিকটিকি, ফুলের টবে সেই কত বছর আগে আসা কেঁচো আপ্রাণ চেষ্টা করল দরজা, জানালা, চটি, এ্যাশট্রে, ইজি চেয়ার, বাল্ব, পানির কল, পেস্ট-ব্রাশ, চিরুণী, আয়না, প্যারাসিটামল, মাধবী লতা, বালিশ, চাদর, ফ্যান, জানালার পর্দা-সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, ভীষণ খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু ওরা কেউ তো ওদের কথা শুনতে পাবে না! রাত যখন শেষ, পুব দিকটা এখন আর আবীরে রাঙানো নয়, প্রায় সাদা হয়ে এসেছে। বারান্দার পাশ ঘেঁসে একদল পাখি ছটফট করে উড়ে গেল। একটা চড়ুই প্রায় তিন চার দিন পর এঘরের বারান্দায় এসে ওদের সবার মুখ ব্যাদান দেখে মন খারাপ করে চলে গেল।

ঠিক এই সময় টিকটিকি টিক টিক করে সবাইকে জানিয়ে দিল- হ্যা গো বাছারা, তোমরাইক নিজেরা একসাথে বসে একটু ভাবতে পারছ না? কেউ সাড়া শব্দ করল না। শুধু ঘড়িটা আরো একবার ঢং করে জানান দিল, আরো একটি ঘন্টা পেরিয়ে গেল। ঘড়ির ঢং শুনে ওরা সবাই একসাথে ঘড়িটার দিকে তাকায়। তারপর ঝট করে বাইরের দরজারটার দিকে। নাহ্ ! কেউ নেই! সারা রাত কত কথা কত আকুলি বিকুলি করে চিন্তাভাবনা করে, ভয় সঙ্কায় সিঁটকে উঠে, অজানা আশঙ্কায় দুরু দুরু বুকে মঙ্গল কামনা করে ক্লান্ত সবাই সেই ভাবতে না চাওয়া সত্যটার মুখোমুখি হলো, এ ঘরের প্রৌঢ় মানুষটি কাল রাতে ঘরে ফেরেনি।

এ শহরের অনেক মানুষই কোন কোন রাতে ঘরে ফেরে না। এরা না ফেরায় অনেক মানুষেরই তেমন কিছু যায় আসে না। ২৩ নভেম্বর, ২০১০
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।