আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এন্টি গল্প > ক্রান্তিকালের মা >

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
উত্তরে রাঢ় দক্ষিণে গাঙ্গেয় সমুদ্র, পশ্চিমে মগধরাজ্য পূর্বে আরাকানি। রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে সেনরা শাসন করিতেছিল। মা গঙ্গা তাহার শাখা-প্রশাখা লইয়া গাঙ্গেয় সমুদ্রে পতিত হইবার কালে ভাটি অঞ্চল পলি-বিধৌত করিয়া বঙ্গালদিগের শশ্যাদি বৃদ্ধিতে প্রভুত সহায়তা করিতে ছিল। মহারাজা কৈবর্ত সেনের রাজত্বে চারিদিকে কেবলই সুবাতাস বহিতে ছিল। প্রজারা মাটি কর্ষণ করিয়া সকলের ক্ষুন্নিবৃত্তির উপায় করিতে ছিল।

তাহাদের কাহারো মধ্যে জগতসংসারের যতরূপ ব্যথা কষ্ট রহিয়াছে তাহার কিছুই স্পর্শ করিতেছিল না। রাজ দরবারের নিয়ম মাফিক সভায় সভ্যগণ রাজাকে এই মর্মে জ্ঞাত করাইতেছিলেন যে সমগ্র রাজ্য জুড়িয়াই অপার শান্তি বিরাজ করিতেছে। এইরূপ অতিশয় সুখ ব্যঞ্জক সন্দেশপ্রাপ্তিতে রাজা ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন তাহা হইলে আগামী শীত মৌসুমে পাখি শিকারের ব্যবস্থা হইলে কী রূপ হয়? যথার্থ, তথাস্থ বলিয়া সভাসদগণ উৎফুল্ল হইয়া গম গম শব্দযোগে রাজপ্রসাদ কাঁপাইয়া তুলিল। শীত আসিবার কালে রাজা জ্ঞাত হইলেন ত্রিপাঠিনগরের উপকন্ঠে পাখি শিকারের যে স্থান নির্বাচন করা হইয়াছিল তাহাতে কতিপয় স্বজাতি জবন এবং মগধদিগের প্ররোচনায় বিদ্রোহ করিতেছে। সৈন্যসামন্ত পেয়াদারা ভূমি দখল লইতে পারে নাই।

উনাশিজন স্বজাতি, মগধ এবং জবনকে হত্যা করিবার পরও শীর্ণদেহ শুদ্র আর চন্ডালদিগের শরীরে কোথা হইতে এইরূপ দ্রোহ বাসা বাঁধিল তাহাই রাজাকে ভাবাইয়া তুলিল। রাজা ভাবিলেন। সভাসদ আর আমর্ত্যরা ভাবিলেন। সিদ্ধান্ত হইল সেন বংশের মর্যাদা রক্ষার্থে প্রজাকুলে শান্তি রক্ষার্থে আর সভাসদ আমর্ত্যবর্গের নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত করিতে বিদ্রোহ দমন করিতে হইবে। এগারশত সৈন্য লইয়া সেনাপতি অকুস্থলে গমন করিলেন।

আঠার দিন পর রাজাকে এইরূপ সন্দেশ উপস্থাপন করা হইল। "আড়াইশত চাষা, চন্ডাল-শুদ্রকে কয়েদ করা হইয়াছে। একশত উনিশখানা কুঁড়ে এবং চারচালা ভূপাতিত করা হইয়াছে। নিহতদের মধ্যে প্রায় দেড় কুড়ি শিশু ও নারী রহিয়াছে। তাহাদের ভিতরও বিদ্রোহ সংক্রমিত হইয়াছিল কী- না তাহা ঠাওর করা যায় নাই।

" রাজা কহিলেন ঠাওরে কাজ নাই, কহিতে থাকো। অতঃপর মাথা নিচু করিয়া সংবাদে উপস্থাক কহিলেন ' কিন্তু মহারাজ রাহুল নাম্নিয় বিদ্রোহের প্রধান হোতা পালাইতে সক্ষম হইয়াছে। ' রাজা বামহস্ত উত্তোলন করিয়া বিরক্তি প্রকাশ করিলেন। বিরক্তি! পরদিন হইতে রাজ্যময় একটিই আলোচ্য বিষয় রাজার বিরক্তি! শত সহস্র সভাসদ, সুশীলজন, ব্রাহ্মণ-কায়েত, পুরুত. মুনি-ঋষীগণ ব্যাকুল হইলেন। রাজা বিরক্ত হইয়াছেন? এ যে ভাবনার ও অতীত? পরের সারাটা বছর জুড়িয়া রাজার পেয়াদারা রাহুলকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল।

রাজার এই মহাবিরোক্তিতে একাত্মতা প্রকাশ করিবার জন্য পুন্ড্রদের রাজা, উক্তর খন্ডের রাজা এমনকি কামাখ্যা প্রদেশের রাজারাও সাহায্যের হস্ত বাড়াইয়া দিলেন। বছরাধিকাল পরে। রাজার হুকুমে বিদ্রোহী রাহুলের মাতা সরুজুবালা দেবীকে আটক করিয়া রাজ দরবারে হাজির করা হইল। ”তোমার পুত্রকে কোথায় রাখিয়াছ? রাজা জানিতে চাহেন। ”জানিনা, জানিলেও বলিতাম না।

” ”মহারাজ ঔদ্ধত্য দেখিলেন? তুমি কি জান না তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা হইবেএবং রাজআদেশ অমান্য করিবার অপরাধে কতল করা হইবে?” ”জানি। কতলে কী বা আসে যায়। আমার পুত্র অন্যায় করে নাই। করিতে পারে না। তাহাকে আমি মনুষ্যজগতের সর্বাপেক্ষা ভাল শিক্ষা দিয়াছি” ”কী সেই শিক্ষা শুনি? রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ?” ”ঠিক তাই।

তাহাকে আমি মানুষের সেবা করিতে শিখাইয়াছি। আপনারা দু’চারিদানা খাদ্য ছড়াইয়া জনকল্যাণ করিতে চাহেন। আমার পুত্র প্রজা দিগকে শিখাইতেছে যে, রাজ্যের সকল কিছুই তাহাদের, রাজার নহে, রাজা আবারো বিরক্ত হইলেন। এইবার সিংহাসন কাঁপাইয়া হুংকার ছাঁড়িলেন, ”আমার সম্মুখ হইতে এই কুলটাকে লইয়া যাও, আর পুর্ণীমা কাটিয়া অমবশ্যা আসিবার আগেই তাহারপুত্রের কাটা মুন্ডু দেখিতে চাই। সেই বন্দোবস্ত কর।

” ইরাবতীর জল গড়াইয়া সমুদ্রে পড়িল। পাখিরা আবার উত্তরে উড়িয়া গেল। শশ্য ক্ষেতের চারা বড় হইয়া পাকিল। ফসল উঠিয়া রাজার গোলা ভরিল। প্রজাকুলের শীর্ণ মুখগুলি অধিকমাত্রায় শীর্ণ হইল।

রাজানুকুল্লের রাজেন্যবর্গরা ভাবিত হইলেন্, রাজাকে প্রীত করিবার যথাসাধ্য কসরত করিলেন। রাজা নিয়মিত সৈন্যদের উপর আস্থা রাখিতে না পারিয়া বিশেষ বাহিনী গঠন করিলেন। তাহারা বিষমাখা তীর, তরবারী, ল্যাজা লইয়া স্বর্গমর্ত্য চষিয়া বেড়াইতে লাগিল। বর্ষা আসিয়া চলিয়া যাইবার প্রাক্কালে এক অপরাহ্নে সকলে দেখিল শ্বেত শুভ্র বস্ত্রে এক বৃদ্ধা কিংশুক তলে একটি মনুষ্য দেহ কোলে লইয়া স্থির বসিয়া রহিয়াছেন। শুধুই মনুষ্য দেহ।

মুন্ডু নাই। অশরীরী আতংকে কেহ ধারে যাইতে চাহিল না। গভীর রাতে শেয়াল হায়নারা আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। বুঝিবা মুন্ডুহীন শব তাহাদের ক্ষুধাকে ভুলাইয়া থাকিবে। কেহ আক্রামণ করিল না।

প্রত্যুষে যখন রক্তবর্ণের থালার মত সূর্য্য উঠিল, তখন সকলে দেখিল বামুনের সন্তান চিতাগ্নির বদলে মাটিচাপা হইয়াছে। বৃদ্ধা সরুজুবালা নিজেই মাটিচাপা দিয়া মুঠো মুঠো মাটি কিংশুক তলে ছড়াইতেছে। ইহার কোনো কারণ কেহই খুঁজিয়া পাইল না। ১৪শ’ বছর পর। বর্ষাকালের এক সন্ধ্যা।

এক বৃদ্ধা কাটা শিমুলগাছতলে বসে আছেন। গাছটা ক’দিন আগেই কাটা হয়েছে। এরই মধ্যে কাটা গুড়িতে নতুন পাতা-কুড়ি বেরুতে শুরু করেছে। সরুজুবালা দেবী যে কিংশুকতলে (শিমুল) বসেছিলেন। এটা কি সেই? শিমুলের ফুল রক্ত লাল।

রাহুলের রক্ত লাল। এই বৃদ্ধার সন্তানের রক্ত লাল। শিমুলের ফল পেকে তুলো হয়ে আকাশে ওড়ে, সাথে একটি করে বীজ বয়ে চলে। সহস্র মাইল দূরে যেয়ে গাছ হয়। এটা কি সেই গাছ? বীজ কি উড়ছেই।

বৃদ্ধার নাম কি নভেরা?
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।