দেখে যা অনির্বান কি সুখে আছে প্রাণ...
ঃ কাজের সময় ওলি পড়ে নাইর নিতি আসে। মাইয়ার জন্য এত দরদ তো বিয়া দিছিলেন ক্যান।
ঃ না মানে ছোট মেয়েটা কাইল আইছে তো তাই ।
ঃ আরে রাহেন। এখন যাওন যাইবো না।
কাইল থিকা ধান কাটা লাগবো।
ঃ দুই দিন থাইকাই চইলা আইবোনে।
ঃ লইয়া যাইবেন তো একবারেই লইয়া যান।
বাছিরকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তার মা বানেছা থেমে যায়। বাছির তার শশুরকে দেখে বলে-
ঃ সালামালাইকুম।
ক্যামুন আছেন আব্বা?
ঃ ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো? তা কই গেছিলা।
ঃ নতুন একটা চিংড়ি ঘের করতাছি। সেই হানে গেছিলাম।
ইতোমধ্যে বাছিরের বউ শিউলী বাছিরের জন্য গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে আসে।
বাছির লুঙ্গি ও গামছা ঘারে বাড়ীর পাশের কীর্তনখোলা নদীতে গোসল করতে যায়। গোসল করে এসে বাছির খেতে বসে শশুরের সাথে।
ঃ আব্বা শিউলীকে নিতে আইছিলেন।
ঃ হ বাবা। কিন্তু তুমার আম্মায় কইতাছে- এখন কাজের সময়।
তাইলে থাক। বলে সে ভাত হাতাতে থাকে। শিউলীর শাশুরির কথা শুনে তার মনটা একেবারেই খারাপ হইয়া গেছে। আল্লাই জানে শিউলীর সাথে কতনা খারাপ ব্যবহার করে। আসলে তারই ভুল তার দোস্ত ইসব কইছিল এইখানে বিয়া না দিতে।
শিউলীর শাশুরি খুব মুখরা মহিলা। কিন্তু সে দিয়েছিল বাছিরের মতো ছেলের জন্য। তার ব্যাপারে এখানকার সবাই ভালো বলেছিল। আসলেও তাই, কিন্তু সমস্যা হলো শাশুরি।
ঃ আব্বা খান।
ভাত হতাইতাছেন ক্যান। শিউলী আব্বার পাতে মাছের তরকারি দেও। ধান কাটা শেষ হইলে আমি শিউলীরে লইয়া যামুনে। তাছাড়া আম্মার অনুমতি ছাড়া গেলে শিউলীরে আরো সব সময় সেই কথা হুনতে হইবো।
বাছির খাওয়া দাওয়া শেষে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে-
ঃ আব্বা আজ আপনি থাকেন।
আমি হাটে যামু। এমনি ম্যালা দেরি হইছে।
ঃ না বাবা আমি থাকতে পারবো না। আজই চলে যাবো। আমি না থাকলে কাল হাট বার সোবাহান সামলাইতে পারবো না।
সে এখনো ছেলে মানুষ। কবে যে তার উপর ভরসা করতে পারুম। হেই দিন কিছুটা বোঝা লাগব হইবো।
ঃ তাইলে আমি হাটে গেলাম।
ঃ ঠিক আছে বাবা।
বাছির হাটে যাবার পর পরই ইসমাইল শিউলীর শাশুরির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সাথে তার মেয়ে আগাতে থাকে।
ঃ মা তোরে বুঝি খুব বকাঝকা করে নারে?
ঃ না বাবা। তুমি এই সব ভাইবো না। আমি খুব ভালো আছি।
ঃ আমি বুঝিরে মা। গত ঈদেও তুই যাইতে পারসনাই। তোর কষ্ট আমি সবই বুঝি। আমি মনে হয় ভুল করছি। তোরে কেলাস এইটে থাকতেই এমন একটা বিয়া দিলাম।
ঃ না আব্বা ভুল করো নাই। সব মানুষ সমান না। তোমাদের জামাই খুব ভালো মানুুষ। কিন্তু সে মায়ের কথার অবাধ্য হতে পারেনা।
ঃ কিন্তু সবারইতো একটা সাধ আল্লাদ আছে।
ঃ আব্বা তুমি ভাইবো না তো। আমি এতে কষ্ট পাইনা।
ঃ আল্লায় তোকে সহ্য করার শক্তি দিক। তো গেলামরে মা।
ঃ শরীরের দিকে একটু নজর রাইখো।
কি অবস্থা হইতাছে শইলের।
ঃ আর কয় দিনরে মা। এখন তো ভাটির দিকে।
ঃ ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবা। কোন চিন্তা করবা না।
ঃ তুই ভাবিস না এই বুড়া ছেলের জন্য। এবার যাইরে মা। বেলা বেশি নাই। বলেই ইসমাইল রাস্তার দিকে পা বাড়ালো।
শিউলী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার বাপের চলে যাবার দিকে।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ডুবে যায় স্মৃতির সাগরে। একটা বারও তিন ছেলে মেয়ে ছাড়া খেতে বসতেন না। হাটের দিন জিলাপি আর কদমা আনতে কোন দিন ভুলতেন না। পারুল পছন্দ করতো কদমা। শিউলী আর সোবাহান জিলাপি।
তিন ভাইবোনের মধ্যে শিউলী সবার বড় তার পর সোবহান পরের জন পারুল।
বড় হওয়ায় শিউলীকে তার আব্বা যেন একটু বেশি ভালোবাসতেন। এখনও মনে পরে বড় হবার পরও মাথার চুল তার আব্বা আচরিয়ে দিতেন। কোথাও থেকে এসেই আগে বলতেন শিউলি কোথায়? কিন্তু ৫টি বছর হলো তার বিয়ে হয়েছে। তবু সেই স্মৃতি ভুলতে পারেনা।
ঃ ভাবী কি অত ভাবছো। হঠাৎ দেবর মামুনের কথা শুনে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকায়।
ঃ কই না তো। বলেই বাড়ি যাবার জন্য ঘুুরে দাড়ায়।
ঃ আমি কখন যে তোমার পিছনে দাড়াইছি তুমি টের পাও নাই।
কি ভাবতাছিলা। চোখেও মনে হয় পানি। আম্মা কিছু কইছে।
ঃ না। আব্বা এসেছিল।
তাই আগাইয়া দিলাম।
ঃ তোমারে বুঝি লইতে আইছিল। আম্মা যাইতে দেয় নাই। তাই বুঝি মন খারাপ।
ঃ অত পাকামো করতে হইবো না।
বাড়ি চলো বই থুুইয়া খাইয়া লও।
ঃ ভাবি তুমি না থাকলে বাড়ীডা একেবারে ফাঁকা হইয়া যায়। ছোট থিকা আমরে তুমি আদর, যত্ন কইরা বড় করছো।
ঃ যাও তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আসো আমি খাওয়ার দিতাছি।
বলেই শিউলি রান্না ঘুরে ঢুকে।
রাত ৮ টার দিকে বাছির হাট হতে বাড়ী আসে। তার পায়ের শব্দ শুনেই তার মা চিৎকার করে উঠে- একটা কথা কওন যায় না। খাওন দাওন বন্দ হইয়া যায়। অত দ্যামাগ ক্যা।
ঃ কি হইছে মা?
ঃ তোর বউরে জিগা।
দুপুরে খায় নাই ক্যা।
ঃ শিউলী খায় নাই।
ঃ বাপের বাড়ি না যাইতে না পাইরা খায় নাই। বাপের বাড়ী বাপের বাড়ী করলে কি আর সংসার ওইবো।
বাছির বাজারের ডালি মাথা হতে নামিয়ে রাখে বারান্দার উপর।
কলের পার গিয়ে হাত-মুখ ধুুয়ে আসে।
এদিকে শিউলী তার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে এসে সবার জন্য খাবার সাজায়। শাশুরিকে বলে-
ঃ আম্মা সবাই আসেন। ভাত বারছি।
বাছির তার মা ছোট ভাই সবাই খেতে বসে।
বাছেদ বলে-
ঃ খাও নাই ক্যা। এখন তুমিও আমাদের সাথে খাও।
ঃ পরে খামুনে।
ঃ দেখ তোর বউয়ের দেমাগ দেখ।
বাছির কি বলবে বুঝতে পারেনা।
শিউলি ভাবে অযথা এই নিয়ে আর বেশি কথা না হোক। সে একটা বাসনে ভাত নিয়ে খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার মাঝে মামুন বলে-
ঃ আম্মা ভাবীরে যাইতে দিলেই পারাতা। প্রায়ইতো বছর হইলো যায় না।
ঃ তোর পোরামানিকি করন লাগবো না।
এহন কামের সময় নাইর করলে সাড়া বছর পেডে বাত পরবো না।
কেউ আর কোন কথা বলে না। ভাবে এই মহিলা কথা কইলে আরো ক্যাচাল বাঁধাইবো। এক সময় কান্না কাটি কইরা বিলাপ করবো। তোর বাপে ছোট্ট থাকতে দুনিয়া ছাইরা চইলা গ্যাছে, আমারে তোদের সহ আকুল সাগরে ভাসাইয়া দিয়া।
তোগরে কতো কষ্ট কইরা আমি মানুষ করছি। আর আজ তোর মুখে মুখে তরকো করস। তাই সবাই চুপ থাকার চেষ্টা করে।
বাছির খাওয়া দাওয়া করে জামাটা গায়ে চাপিয়ে শিউলীকে বলে- আমি মোড়ের উপর থিকা একটু ঘুরে আসি। শিউলি কিছু বলে না।
অন্য দিন হলে বলতো যাওনের দরকার নাই। সারাদিন অনেক খাটা খাটনি করছেন। আর গেলে কিন্তু বেশি রাত কইরো না। বেশি রাইত হইলে আমি কিন্তু দরজা খুলুম না। বাছিরের অবশ্য খারাপ কোন নেশা নেই।
দিনে দুুই একটা সিগেরেট খায়। সন্ধায় আবুলের মোড়ে যেয়ে একটু খবর টবর দেখে এসে শুয়ে পড়ে। এমন দিন কাল পরছে যে এখন সব দোকানেই রঙ্গিন টিভি সিডি।
বাছির চলে যাবার পর শিউলী রান্না ঘর গুছিয়ে ঘরে গিয়ে চকির উপর বসে। মনে মনে ভাবে কত কষ্টইনা পাইতাছে পারুল।
আমি যাইতে না পারার কারনে। ছোট থাকতে ঝগড়া করলে একবেলা না কথা বলে কেউ থাকতে পারতো না। রাত বারতে থাকে। ঝিঝি পোকার ডাক আর মাঝে মাঝে তার দেবরের পড়ার শব্দ কানে এসে রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। মামুন এবার কাশ টেনে পড়ে।
ভালো ছাত্র। শিউলী যখন এ বাড়িতে আসে তখন সে অনেক ছেট। শিউলী ভাবতে থাকে তাদের দুই বোনের মধ্যে কোন কথাই গোপন থাকতো না। এক কথায় এক জনের কথা আরেক জনকে না বলে ঠিক থাকতে পারতো না। একবার শিউলীকে তার স্কুলের উপর কাশের এক ছাত্র তাকে প্রেম নিবেদন করে একটি চিঠি দিয়েছিল তার বান্ধবির মাধ্যমে।
এই কথাও সে বলেছিল পারুলকে। পারুল দুষ্টুমো করে বলেছিল- আব্বাকে বইলা দেব তুমি প্রেম করতাছো। না কইবি না, তাইলে আমার পড়া বন্ধ হইয়া যাইবো। আর আমিতো হেই ছেরার চিডি ধরিও নাই। কিন্তু পারুল বার বার তাকে ্যাপানোর জন্য বলতে থাকে- আমি কইয়া দিমু আব্বারে।
শিউলী রাগে পারুলে গালে এক চর মেরে বলে- যা কইয়া দেগা। হঠাৎ চর খেয়ে পারুল কান্না শুরু করে। কান্না শুনে তার আব্বা তার ঘর হতে বের হয়ে এসে বলে- কি হইছে? কিন্তু কেউ কিছু বলে না। পারুল কান্না থামিয়ে দেয়। কোন উত্তর না পেয়ে তাদের আব্বা যেতে যেতে বলে- তোদের যে কি হয় আমি বুঝতে পারিনা।
এহন কান্না আবার এহনই ভালা। এরকম হাজারো স্মৃতি আজ এসে তাকে গ্রাস করে। এভাবে ভাবতে ভাবতে এক সময় তার চোখে তন্দ্রা রানী ভর করে।
বাছির এসে দরজায় শব্দ করার পর সে ধরফর করে উঠে দরজা খুলে দেয়। কোন কথা না বলে আবার সে বিছানায় উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পরে।
অন্য দিন হলে বলতো- ছিগেরেট খাইতাছো না। আজ আমি মাটিতে পাটি পেতে শোব।
বাছির জামা খুলে কলের পার হতে হাত মুখ ধুয়ে আসে। এসে দেখে শিউলী শুয়েই আছে। বাছির চকির উপর বসে বলে- শিউলী তোমার লাইগা জিলাপি আনছি উঠো।
শিউলি কথা বলে না। যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই থাকে। বাছির তাকিয়ে দেখে গোল পাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো শিউলীর সর্বাঙ্গে পড়ে মোহনীয় করে তুলেছে। কয়েকটি চুলের গোছা মুখের উপর পড়ে আপূর্ব সৌন্দর্য্যে সৃষ্টি করেছ। তার সোনালী অঙ্গে চাঁদের রূপালী আলো পরে যেন প্রতিযোগীতা করে একে আপরকে বলছে- আমি বেশি সুন্দর।
এক সময় বাছির শিউলির গায়ে হাত দিয়ে ঠেলা দেয় বলে- উঠো তো এতো রাগ করলে হইবো।
ঃ বিরক্ত কইরেন না তো। ঘুমাইতে দ্যান।
ঃ জানি তুমি ঘুমাইতেছ না। তোমার মন খারাপ।
ঃ অত দরদ দেখাইতে হইবো না।
ঃ উঠো লèী সোনা বউ আমার। তোমারে আমি নিজে লইয়া যামুনে।
ঃ অত পিরিতের কথা কইতে হইবো না। ঘুমাইতে চাইলে ঘুমান।
প্যাচাল পাইরেন না।
ঃ তাইলে আমিও ঘুমামু না। এই যে আমি মোড়ার উপর বইলাম। বইয়া থাইকা সিগেরেট খাই। বউ যখন শালা পর তখন সিগেরেটই আমার আপন।
বাছির পকেট হতে সিগেরেট বের করে বাতির আগুন থাকতেও শব্দ করার জন্য ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরায়। দুই তিন টান দিতেই ধুয়ায় ঘর ভরে যায়।
এদিকে শিউলী রাগে ফুসতে থাকে। বাছির যে তাকে খ্যাপানোর জন্য এই কাজ করছে তা সে বুঝতে পারছে। বাছির কোন দিন বাড়িতে সিগেরেট খায় না।
বাছিরের কথায় তার আবার হাসিও পায়। বলে কিনা বউয়ের চেয়ে সিগেরেট আপন। সে ফিক করে হেসে দিতে গিয়েও দাঁত চেপে ছিল। কারণ এখন সে রাগ করে আছে হাসলে চলবে না। ধুয়ায় ঘর ভরে গেছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে। শিউলী এক ঝটকায় বিছানা থেকে নেমে বাছিরের হাত থেকে সিগেরেট নিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। বলে-
ঃ ইতরামির আর জাগা পান না না?
ঃ তা আমি কি করুম। বৌ যদি রাগে ঘুমের ভান করে বিছানায় পইরা থাকে তাইলে কি কারো ঘুম হয়। বলেই আরেকটা সিগেরেট বের করার জন্য পকেটে হাত ঢুকায়।
কিন্তু হাত বের করার আগেই শিউলী হাত চেপে ধরে বলে- আর একটা সিগেরেটও ধরাইতে পারবেন না।
ঃ তাইলে তুমি জিলাপি খাও। একটু হাসো।
ঃ আমার অতো হাসি নাই। বলেই শিউলী হেসে ফেলে।
দেখা দেখি বাছিরের মুখেও হাসি ফুটে। বাছির শিউলীর মুখে জিলাপি তুলে দেয়। শিউলী বলে-
ঃ আপনিও খান। বলেই তার মখে তুলে দেয়।
পরের অংশ- দানব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।