আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিলেকোঠার সেপাই।

!!
সুলেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খুব বেশী সাহিত্যকর্ম আমাদের জন্য রেখে যান নি। ২টি উপন্যাস,২৮টি গল্প আর একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। একজন সুলেখকের খুব বেশী কি লেখতে হয়? এই গুটিকয়েক লেখাই তার মেধার পরিচয় বহন করে। এই লেখাগুলোই উনাকে বাংলাসাহিত্যের খাতায় চিরস্থায়ী আসন এনে দিয়েছে। তিনি তৈরী করেছেন লেখার নিজস্ব একটি স্টাইল।

সত্যি বলতে কি তার লেখা সাহিত্যপ্রেমীদের নিকট সবসময়ই উপভোগ্য। আখতারুজ্জামান এর লেখার বৈশিষ্ট হল উনার লেখা অনেক বর্ননাময়। তবে অতিরিক্ত বর্ননা কখনই তাকে ভাসিয়ে নেয় নি। তার এই আনুপুঙ্খিক বিবরন কখনই বিরক্তিকর হয়ে উঠে নি, একঘেয়ে হয়ে উঠে নি কারন তিনি জানতেন কখন তাকে থামতে হবে। উনার লেখার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল স্বপ্নচারিতা যা ঐন্দ্রজালিক এবং কিছুটা অতিপ্রাকৃত ছোয়াই বিকশিত।

আখতারুজ্জামান তার বিপ্লব সুট,টাই পড়া রুমে বসে তত্ত্ব কপচানোদের দিয়ে করান নি। তার বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছে বস্তির শ্রমিক বা গ্রামের চাষারা। উনার বেশীরভাগ গল্প এবং দুটি উপন্যাসই আমার পড়া হয়েছে। এবং আমার ব্যাক্তিগত লাইব্রেরীতে উনার বই এর উপস্থিতি আমার জন্য গর্বের বিষয়। তবে কোন সন্দেহ ছাড়াই আমি বলতে পারি "চিলেকোঠার সেপাই" তার সবচেয়ে সেরা সৃষ্টি।

বইটি অবশ্যই আমার প্রিয় একটি বই। "চিলেকোঠার সেপাই" ষাট এর অগ্নিগর্ভ সময়ের গল্প। উনসত্তুরের গণঅভ্যুথ্থান এর গল্প। ঢাকা তখন মিটিং,মিছিল এর শহর। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের শহর।

সেই ঢাকার এক ঘিন্জি গলির মধ্যে বাস ওসমান ওরফে রন্জুর। সে এক অফিসের জুনিয়র কর্মকর্তা। তার বন্ধু বাম রাজনীতির কর্মী আনোয়ার আর ডানপন্থি আলতাফ। তাদের সাথে সে আইয়ুব বিরোধী মিছিলে যায়,মিটিং এ যায় আলোচনায় বসে কিন্তু সবকিছুতে থেকেও যেন সে কোনকিছুতেই নেই। সে বন্দী থাকে তার চিলেকোঠার রুমে।

বাসার পাকা দেয়াল যেন তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সবকিছু থেকেই। এই বাসা আবার আইয়ুবপ্রেমী মহাজন রহমতউল্লাহর। যার আশ্রয়ে বড় হয় খিজির ওরফে হাড্ডি খিজির। তার মা এবং স্ত্রী দুজনেই মহাজনের উপভোগ্য। খিজির এই বই এর অন্যতম চরিত্র এবং একদিক থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

আমি যত বই পড়েছি তার মাঝে "চিলেকোঠার সেপাই" ছাড়া আর কোথাও পুরানো ঢাকার বস্তিবাসী শ্রমিককে কোনো বই এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে বা এত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আসতে দেখিনি। তো এই খিজির আবার বিপ্লবী। তার বিপ্লব সূচিত হয় মহাজনের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকে। পরে অবশ্য তা শ্রেণীসংগ্রামে আবন্ধ থাকেনি। বিস্তৃত হয়েছে অনেক বড় প্লাটফর্মে।

সে রিক্সাচালকদের উৎসাহ দেয় আন্দোলনে নেমে পড়ার জন্য। নিজে সারাদিন ব্যাস্ত থাকে মিটিং মিছিল নিয়ে। এদিকে ওসমান প্রেমে পড়ে তারই সহনামী এক কিশোর এর বড়বোনের উপর। যারা কিনা তারই সাথে রহমতউল্লাহর বাসার ভাড়াটে। উসমান প্রেমে পড়ে রানুর উপর কিন্তু সে চুম্বনে রক্তার্ত করে রানুর ভাই রন্জুকে।

না সে বিকৃত যৌনপ্রেমী নয় সে আত্মপ্রেমে পরাজিত সৈনিক। চারপাশের উত্তাল সময়ের চাওয়া এবং নিজস্ব চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিলাতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে বসে ওসমান। দেখা দেয় মস্তিষ্ক বিকৃতির। এদিকে আন্দোলন বেগবান হয়। কার্ফ্যু জারি হয়।

সেই কার্ফ্যু ভেঙ্গে রাস্থায় নামে মানুষ। স্লোগান উঠে, “জেলের তালা ভাঙ্গব শেখ মুজিব কে আনব। ”শহর বন্দর কাপে সেই স্লোগানে। রাতের আধারে কার্ফ্যু ভেঙ্গে রাস্থায় নেমে পড়ে খিজির। সেই খিজির যে কিনা তার বাপের নামও জানে না।

সে ওসমানকেও প্ররোচনা দেয় মিছিলে আসতে। মিছিলে সেনাদের গুলিতে নিহত হয় খিজির। কিন্তু এ মৃত্যু আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলে। তবে কি আন্দোলন শুধু শহরেই সীমাবন্ধ? না। গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে পাকি বিরোধী আন্দোলন।

বামপ্রন্থি আনোয়োর চলে যায় গ্রামে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু তার আগেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। যমুনার দুর্গম চরে। আইয়ুবের গ্রামীন চেলা খয়বার গাজী কৃষকদের সম্পত্তি দখল করতে থাকে একের পর এক। তাদের হালচাষের গরু চুরি করে রাখে চরে।

আবার সেই গরু ফেরত আনতে গেলে চোর সাজিয়ে মেরা ফেলা হয় নীরিহ চাষীদের। ধীরে ধীরে ফোসে উঠে চাষীরা। ওদের সংঘবদ্ধ করে তরুন বাম কর্মী আলীবক্স ও চাষা চেংটু। খয়বার গাজীর ডানহাত হোসেন ফকিরকে মেরে ফেলে তারা। গণআদালতে বিচার হয় খয়বারের।

কিন্তু চালাকি করে সে পালিয়ে যায়। না আন্দোলন থামেনি এতে। আরও জোরদার হয় স্লোগান “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা,মেঘনা,যমুনা। ” “জেলের তালা ভাঙ্গব, শেখ মুজিবকে আনব। ” এদিকে ওসমানের অসুস্থতার খবর পেয়ে আনোয়ার ঢাকায় ফিরে আসে।

খিজিরের মৃত্যুর পর উসমান পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। নিজের খাচা থেকে বাইরে আসার জন্য তার চেষ্টা পরিণত হয় ক্রোধে। মৃত খিজির প্রতিনিয়ত ওসমান কে প্ররোচনা দেয় এই বিচ্ছিন্নতার দেয়াল ভেঙ্গে চিলেকোঠা থেকে বের হয়ে আসার জন্য। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না খিজির কি তাহলে ওসমানের কাউন্টার পার্সোনালিটি? উসমান ভাঙ্গতে চায় ঘরের তালা। উপেক্ষা করতে চায় মিলিটারির রক্তচক্ষু।

পাকিদের কার্ফ্যু। তাকে আটকায় আনোয়ার,আলতাফ রা। খিজিরের ঘর থেকে বের হয়ে আসার আহবান ঠিকই চলতে থাকে। একদিন ঠিকই সে বের হয়ে পড়ে তালা ভেঙ্গে। সবার অজান্তে নেমে পড়ে রাস্থায়।

কার্ফ্যুকে করে অগ্রাহ্য সে। তার সামনে এখন মুক্ত পথ। যেদিক ইচ্ছা সেদিকই যেতে পারে সে। পুর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিণ সব দিকই তার জন্য উন্মুক্ত। সব দিক থেকেই তার কানে ভেসে আসে, “জয় বাংলা।

” উনসত্তুরের গণঅভ্যুথ্থান তথা ষাট এর অগ্নিগর্ভ সময় নিয়ে লেখা এই বই এর তুলনা শুধু চিলেকোঠার সেপাই ই হতে পারে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এই বই মাওলা ব্রাদার্স অথবা দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লি: থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। নেট এ ফ্রি কপি আমি খুজে পাই নি। তবে বইমেলা সাইটটি থেকে টাকা দিয়ে সংগ্রহ করতে পারবেন।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।