আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুন্দরগঞ্জে বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থার নিরব বিপ্লব নিজের কাজ নিজে করে অনেকে স্বাবলম্বী

একটি ব্যাতিক্রমধর্মী লিটল ম্যাগাজিন

ভোর বেলা একটু পরেই সূর্য উদিত হবে। পরিবারের সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাজের তারা নেই। পাশের বাড়ির ঢেঁকির শব্দ তাদের আয়েশে বিঘ্ন ঘটায়। এ সময় গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের সকালের রান্না-বান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা।

কিন্তু শান্তনার সে দিকে ভ্র“ক্ষেপ নেই। গাছের পাশে বসেছেন চারায় ভর্তি মাষ কলাই নিয়ে। ফেনিয়ে চলেছেন একের পর এক। এখনও অনেক কাজ বাকি। তাকে সূর্য ওঠার আগেই মাষ কলাই ফেনিয়ে বড়ি তৈরী করে ঢেউটিনে সাজাতে হবে।

সূর্য উঠলেই তা শুকাতে দিতে হবে। ঝটপট হাত চালায় শান্তনা। এক এক করে সকলেই এসে শান্তনার কাজে সহযোগীতা করতে থাকে। মাষ কলাই দিয়ে তৈরি বড়ির অর্থই শান্তনার পরিবারের জীবন ধারনের প্রধান অবলম্বন। শুধু শান্তনা নয়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ফলগাছা গ্রামের শেনপাড়ায় ৩ শতাধিক পরিবার মাষ কলাইয়ের বড়ি তৈরি করে জীবন ধারন করছেন।

বংশ পরস্পরায় আবহমান কাল থেকে ঐতিহ্যবাহী মাষ কলাইয়ের বড়ি তৈরি করে আসছেন শেন পরিবার গুলো। উৎকৃষ্ট বড়ি তৈরির সময় পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস হলেও অভাবের তারনায় কার্তিক মাস থেকেই বড়ি তৈরী শুরু হয়েছে। ডালের বড়ি তৈরির প্রধান উপাদান খোসা ছাড়ানো মাস কলাই। অতীতে চাল কুমড়া ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে এ পরিবার গুলো তা আর ব্যবহার করে না। তথাপি শুধু মাস কলাইয়ের বড়ি তৈরির প্রক্রিয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।

ফলগাছা গ্রামের শেন স¤প্রদায়ের মহিলারা পূর্ব পূরুষের বড়ি তৈরির পদ্ধতি রপ্ত করলেও বর্তমানে মহিলা পুরুষ উভয়েই বড়ি তৈরি করে। পরিবারের ছেলে মেয়েরাও সহযোগীতা করে। খোসা ছাড়ানো মাষ কলাই কমপক্ষে ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভেজানো কলাই ঢেঁকিতে পেষ্ট তৈরি করতে হয়। আবার সেই পেষ্ট বড় পাত্র বা মাটির চারায় ফেনিয়ে ফেনিয়ে ঢেউটিনের উপর লাইন করে ছোট ছোট বড়ি সাজাতে হয়।

বড়ি গুলো দেড় থেকে ২দিন রোদে শুকানোর পর ঢেউটিন থেকে তুলে সংরক্ষন করা হয়। ভাল করে না শুকালে বা রোদ কম থাকলে বড়ির স্বাদ নষ্ট হবার আশংকা থাকে। সামান্য কারনে বড়ির রং সাদা না হলেও ক্রেতা ক্রয় করতে চায় না। প্রতি কেজি খোসা ছাড়ানো মাষ কলাইয়ের মূল্য ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। গত বছর ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ছিল।

এ বছর মাষ কলাইয়ের দাম আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ কেজি খোসা ছাড়ানো মাস কলাই থেকে ৪ কেজি বড়ি তৈরি করা হয়। বর্তমানে গ্রাম-গঞ্জকে ছাড়িয়ে শহরের বাজারেও বড়ি কিনতে পাওয়া যায়। প্রতি কেজি বড়ি ১০০থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচেছ। বড়ির মধ্যেও ভেজাল রয়েছে।

বেশী লাভের আশায় অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন মানের কলাই ও ময়দা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাজারের বড়ির প্রচুর চাহিদা থাকলেও শেন পরিবার গুলোর সমস্যা ছিল পুঁজির। কলাই কিনতে অগ্রিম টাকা লাগে। এতদিন মহাজনদের কাছে টাকা ঋন করতেন। সুদের হার বড় চড়া।

এক’শ টাকার জন্য মাসে ১০ টাকা হারে অর্থাৎ বৎসরে ১২০ টাকা সুদ দিতে হয়েছে। তারপরও ছিল মহাজনদের তিরস্কার। ক্ষুধা, পুষ্টিহীনতা, অসচেতনতা, কুসংস্কার, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ গোটা গ্রামকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। দারিদ্রতার কষাঘাতে ছিল নিষ্পেষিত। বড়ি তৈরির মৌসুম পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত যা আয় হত তা দিয়ে বছরের অন্যান্য মাস অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করতে হত।

তাই তিন বেলা পেট পুরে আহার করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। সেখানে দৈনন্দিন ক্যালরীর কথা চিন্তাই করা যেত না। কাজ নেই ঘরে ঘরে ছিল বেকারত্ব। স্বাস্থ্য সচেতনতা, টীকা, পরিকল্পিত পরিবার, পুষ্টি, গর্ভবতি নারীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করন এখানকার অধিকাংশ মানুষের পক্ষে অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, তালাক সর্বোপরি গ্রামের লোক ছিল অসচেতন।

শিক্ষার হার ছিল হতাশাজনক। পরিবেশ ছিল উদ্বেগজনক। নারী শিক্ষা ছিল একেবারে অবহেলিত। অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। ঠিক সেই মহূর্তেই ফলগাছা গ্রামে তৈরী হলো উজ্জীবক নারী-পুরুষের সমন্বয়ে ‘বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থা’।

তখন থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উঠান বৈঠক ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে যুব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে সবাই সম্মিলিত ভাবে অংশ গ্রহন করেন। বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থার ৬ষ্ঠ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ফলদ বৃক্ষ রোপন পক্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ বরাদ হোসেন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। তিনি সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।

এসময় তিনি মুগ্ধ হন। সংস্থার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে জনসাধারনের ব্যাপক উন্নয়ন হবে বলে তিনি সকলকে একাতœচিত্রে কাজ করে যাবার আহ্বান জানান। বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে নিয়মিত উঠান বৈঠক হয়। যেখানে আলোচনা করা হয় তাদের জীবন-জীবিকার নানা সমস্যা, সংস্থার কর্ম-পরিকল্পনা, গ্রামের স্বাস্থ্য সমস্যা, সন্তানদের পড়ালেখা, খোলা স্থানে মলমূত্র ত্যাগের কুফলসহ অনেক কিছুই। তাদের মধ্যে এখন এটুকু উপলব্ধি হয়েছে, অভাব-অনটনের মধ্যেও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা যায়।

স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এটা জরুরী। বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাবলু জানান, বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে আলোকিত সমাজ গঠনের লক্ষে কাজ করছি। আমরা দারিদ্র মুক্ত দেশ গড়তে চাই। এ গ্রামের অধিকাংশ লোকই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে । যারা দিনমজুরী করেন তাদের হাতে বছরের বেশীর ভাগ সময় কাজ থাকে না।

এ প্রসঙ্গে সংস্থার নির্বাহী সদস্য শেনপাড়ার বাসিন্দা অমল চন্দ্র সরকার বলেন সংস্থার উদ্যোগে বিভিন্ন সময় আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষন কর্মশালায় অংশগ্রহন করে গ্রামের মানুষ বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। তারা বাড়ির উঠানে খোলা স্থানে শাক-সব্জি চাষ করছে, হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশু পালন করছে। জরাজীর্ণ পল্লী অঞ্চলকে বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থা আলোকিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তারা কতটা সফল এ প্রসঙ্গে সংস্থার ভাইস-চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান,বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে আমাদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমরা সব বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে সম্মূখ পানে এগিয়ে যাচ্ছি।

বিপ্লব পল্লী উন্নয়ন সংস্থার সদস্যরা নিজেরাই দল গঠন করে সঞ্চয়ের মাধ্যমে নিজেদে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।