আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ একে একে মেয়েরা......

চুপ!

প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই ঊর্মি দেখে লিফট বন্ধ, ইলেকট্রিসিটি নেই। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচ তলায় উঠতে ইদানীং কষ্টই হয়। বয়স বাড়ছে বুঝতে পারে। ঘেমে নেয়ে বাসায় উঠে দেখে গরমে গনি মিয়া আর সাহেরা খাতুন অস্থির। ডিজিটাল বাংলাদেশে ইদানীং ইলেকট্রিসিটি এত ডিস্টার্ব করছে, আই পি এস টা কিনেই ফেলতে হবে সামনের ঈদে বোনাসটা পেয়ে।

দেখতে দেখতে অনেকটা বয়স পার করে ফেলল, পরের জাবারের (শস্যাধার) ধান হওয়ার ব্যাপারে বিবমিষাই থেকে গেল বলে বিয়েটা আর করা হলো না। গনি মিয়ার প্রথম সন্তানের যখন জন্ম হয়, বংশের প্রথম সন্তান মেয়ে এটা মানতে কষ্ট হলেও তার বাবা-মা বা গনি মিয়া মেয়ের চাঁদপানা মুখটা দেখে কষ্ট ভুলে গিয়েছিল, চাঁদনীর মতো ফকফকা মেয়েটার নামও রেখেছিল তাই জোছনা। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তানের সময় আশা ছিল- এবার নিশ্চয় ছেলেই হবে, বংশে বাত্তি দেওয়ার জন্যে। কিন্তু যখন শোনা গেল বাতির নীচের অন্ধকারের মতোই কালো এক মেয়ের জন্ম দিয়েছে সাহেরা খাতুন, সেই 'আলকাতরার ডিবা' কে আঁতুর ঘরেই দাফন করে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিল সোনা মিয়া, গনি মিয়ার ছোট ভাই। গনি মিয়া তখন বাড়ী নেই, শহরের স্কুলে পড়ান তিনি- আর তাই মেয়ে ফর্সা না হলেও নামটা রেখেছিলেন সুন্দর- হুসনা।

ছোটবেলায়ই মনে হয় মেয়েরা বুঝতে পেরেছিল বাবার সংসারে অনাকাংক্ষিত তারা- তাই হয় তো ছোট্ট মেয়ে জোছনা তার বাবাকেই অস্বীকার করতে চেয়েছিল- কল কল করে অনেক কথা বলত, সবাইকে নানান নামে ডেকে মুগ্ধ করত শুধু গনি মিয়াকে 'বাবা' ডাকত না। ওর মুখ থেকে 'বাবা' শব্দটি বের করার জন্যে ছোট্ট মেয়েটিকে সেজো চাচা জজ মিয়া উঠোনের মাঝের গহীন কূপটাতে মাথা নীচে দিয়ে পা উপরে ধরে রেখে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখাতেও পেছপা হয় নি। ততদিনে সোনা মিয়ার ঘরে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে- মেজো ছেলেই বংশের মান রাখল ভেবে খুশী সবাই, সকলের অতিরিক্ত আদরেই বড় হতে লাগল সে, শহর থেকে গনি মিয়া নিজের মেয়েদের জন্যে কিছু না আনলেও ভাতিজার জন্যে খেলনা বা খাবার আনতে ভুলে না, দরজার আড়াল থেকে মোমেনের আদর খাওয়া দেখে করুণ চোখে জোছনা আর হুসনা। আর সাহেরা খাতুন তার পাপের বোঝা বাড়াতে আবারো জন্ম দেন এক কন্যার- তার নাম নিয়ে ভাবার সময় বা মানসিকতা নেই কারুরই, আর তাই হয় তো হুসনার বোন বলেই নাম পায় 'আসমা'। সাহেরা খাতুনের মেয়েরা পড়াশুনা করার জন্যে কুপি বাতিটা নিয়ে বসলেই সারা বাড়ীতে আলোর দরকার হয়- মেয়েদের জন্যে কেরোসিন পোড়ানোর মানে খুঁজে পায় না কেউ।

সবারই এক কথা- মেয়েগুলারে জজ ব্যারিস্টার বানাইবার কী কাম! বড়টারে তো এমনেই পার করা যাইব, ওই কালাডা একটু পড়লেই অইব! গনি মিয়া তার 'বি এড' পরীক্ষার সময় নিজের আত্মজীবনীমূলক এক রচনায় লিখেছিলেন- ছেলের আশায় একে একে চারটি মেয়ে এসে আমার ঘর ভরে তুলল! আর তাই হয় তো চতুর্থ মেয়েটির জন্মের সময় অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল - আর না! সেই দ্বীর্ঘশ্বাস থেকে মেয়েটির নামও হয়ে গেল তাই আন্না। পঞ্চম মেয়েটি যখন জন্মের বার দিন পর আঁতুর ঘরেই মারা যায়,মেয়েদের ভারে ক্লান্ত গনি মিয়া সে মেয়েটির মুখও দেখেন নি; শুধু পরীর মতো দেখতে মেয়েটিকে হয় তো তার মা মনে মনে 'পরী' নামে ডেকেছিল! বংশের প্রথম সন্তানের ঘর এক পাল মেয়েতে ভর্তি দেখে, আর বড় ছেলের ঘরের নাতি না দেখার হাহাকার নিয়েই মারা যান রশীদ মিয়া- মাহদীর দাদা; হ্যা, অনেক বই ঘেটে গনি মিয়া বেশ কায়দার নামই রেখেছিলেন একমাত্র পুত্রের। মাথায় তোলেন নি উকুনে কামড়াবে, মাটিতে রাখেন নি পিঁপড়ায় কামড়াবে- কোলে কোলে অনেক আদরে বড় করেছেন তাকে, আকাশ থেকে কমলা-আপেল পেড়ে খাইয়েছেন ছেলেকে! বংশের বাত্তি বলে কথা! মেয়েরা তো দুদিন পরে চলে যাবে পরের ঘরে, পড়াশোনা করে চাকরি করলে গনি মিয়া বা সাহেরা খাতুনের কী লাভ! গনি মিয়ার সবচেয়ে ছোট মেয়ে ঊর্মির যখন জন্ম হয়, ওর বোনেরা তখন বড় হয়ে গেছে, - আর বংশ তার বাতি পেয়ে গেছে বলেই হয় তো ও দেখে নি মেয়ে সন্তানদের প্রতি অবহেলা, শুধু ভাইয়ের সমান আদর কেন পাচ্ছে না তাতেই তার অভিমান হত! ওর বোনদের কাছে যে কথাটা চরম কটাক্ষ ছিল- 'মেয়েদের লালন পালন করা মানে পরের জাবারে ধান রাখা' তা ওর কাছে ছিল নিতান্তই হাসির! যখন শুনত মেয়েরা চাকরি করলে বাবা-মায়ের তো লাভ নেই, বিয়ে হয়ে গেলে টাকা তো আর বাবা-মাকে দিবে না- ছোট বলেই হয় তো ও তীব্র প্রতিবাদ করত!যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চাইত- যে যার যার বাবা-মা কে দিবে, বিয়ে করলেই বা- ছেলে যেমন তার বাবা-মাকে দেখবে, মেয়েও তেমনি তার বাবা-মাকে দেখবে! যদিও দেখেছে তার বোনের বিয়ের পর স্বল্প আয়ের সংসার থেকে গনি মিয়ার সংসারে দেওয়ার মতো উদবৃত্ত তাদের কিছুই থাকত না! কিন্তু ওদের বংশের কর্ণধার ঊর্মির ভাইও আর গনি মিয়া বা সাহেরা খাতুনকে মনে রাখে নি, বহুজাতিক কোম্পানিতে তার ব্যস্তাতার চাকুরী আর বৌকে নিয়ে নানা পার্টির ফাঁকে সময় হয় নি তার। প্রচন্ড গরমে ইজি-চেয়ারে ঘেমো শরীরেই শুয়ে শুয়ে ঊর্মি ভাবে, মাসুদকে বিয়ে করলে কি ওর বৃদ্ধ বাবা-মা ওর সাথে থাকতে পারতেন? এলাউ করত কি মাসুদ? সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়েও ওর বেতন অল্প, মাসুদেরও তো তাই ছিল; মধ্যবিত্তের সংসারে মেয়ের বাবা-মা হিসেবে আত্মসম্মান নিয়ে কি থাকতে পারতেন তারা তার সাথে তার আর মাসুদের বাসায়, যেখানে মাসুদের বাবা-মা-ভাই-বোনও ছিল? এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না ও আর, একটা সাদা দেয়ালের সরু ঘর তার চোখের সামনে ভেসে আসে- বৃদ্ধ ঊর্মিমালা যেখানে বসে মৃত্যুর জন্যে প্রহর গুণছে! বিঃদ্রঃ এই লেখার চরিত্রগুলো ও কাহিনী সম্পূর্ণরুপে লেখকের কল্পনাপ্রসূত; এর সাথে বাস্তবের কোন সাদৃশ্য পাওয়া গেলে তা কাকতালীয় বলে বিবেচ্য হবে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।