আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দাগ-১৯ (এই দাগ হৃদয়রে, এই দাগ সমাজের )



নকশী বসুন্ধরা সিটিতে ঢুকেই ঘড়ির দিকে তাকাল। কারো জন্য অপেক্ষা করতে সে খুব বিরক্ত বোধ করে, গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা ছেলে তার চোখে পড়ল। ছেলেটা বেশ সুন্দর, হ্যান্ডস্যাম কিন্তু হেমা এবং উর্মীর মুখ থেকে সে শুভ্রর চেহারার যে বর্ণনা শুনেছে তাতে এই ছেলেটার কোন মিল নাই, তবু সে শুভ্রর মোবাইলে রিং দিল, শুভ্র আপনি কোথায়? এই তো কেবল অফিস থেকে বের হলাম। আচ্ছা আপনাকে আমি কিভাবে চিনব বলুন তো। আমি লম্বা, গায়ের রং ফর্সা, নেভি ব্লু শার্ট আর এস কালারের প্যান্ট পরে আছি।

আমি আপনাকে আমি কিভাবে চিনব? আমি এখন নীচে দাঁড়িয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। সবাই আমার দিকে যেন কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে। আমি এখানে থাকব না, আমি একটা ফার্স্ট ফুডের দোকানে বসে আপনাকে সেই দোকানের ঠিকানা বলব আপনি সেখানে চলে আসবেন। আর হ্যাঁ আমি মেরুন কালারের জর্জেট কাপড়ের থ্রি-পিস পরে আছি, আমার হাতে একটা জিনিস থাকবে যা দেখলেই আপনি আমাকে চিনবেন যে আমি কারো জন্য অপেক্ষা করছি। তাছাড়া দু’জনের হাতেই তো মোবাইল আছে।

আপনার আর কতক্ষণ সময় লাগবে? বলুন তো? এই দশ মিনিট। আচ্ছা ঠিক আছে। নকশী লিফ্ট দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেল। একবার সমস্ত ফ্লোরটা ঘুরে দেখল, তারপর একটা ফার্স্ট ফুডের দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়ল জোড়ায় জোড়ায় তরুণ-তরুণীরা গল্প করছে, কেউ বা খাচ্ছে। কেউ তার প্রিয় মানুষটির চোখে চোখ রেখে কথা বলছে আর কেউ বা লুকোচুরি করে কথা বলছে।

আসলে যে চোখে ¯^cœ থাকে সে চোখ বোধ হয় সহজে চেনা যায় আর যে চোখে ছলনায় থাকে সে চোখ চেনা যায় না, সে চোখ কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায় না। নকশী হাঁটতে হাঁটতে শেষ দিকের একটা দোকানে সামনের দিকে মুখ করে বসল। নকশী মনে মনে ভাবছিল, কিভাবে প্রথম কথা বলতে শুরু করবে, কি বলবে আর সেই বা কি কথার কি জবাব দিবে? অবশ্য নকশীর মধ্যে তেমন জড়তা নাই খুব সহজে কথা বলতে পারে কিন্তু আজকের পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন। শুভ্র দেখতে কেমন? সুন্দর তো? সে বলেছে তার গায়ের রং ফর্সা কিন্তু এট্রাক্টটিভ তো? অনেক ফর্সা মানুষ আবার ফ্যাকাশে হয়, কিছুটা রুগী রুগী টাইপের, শুভ্র সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে তো? একটা ছেলে আসছে, লম্বা, ফর্সা, এট্রাক্টিভ। এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে, মনে হয় কাউকে খুঁজছে।

নকশীর বুকটা ধক্ ধক্ করছে, এ যেন এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। মনে হলো যেন এই শুভ্র, তাকেই খুঁজছে। নকশী শুভ্রর মোবাইল রিং দিল। হ্যাঁ, ছেলেটার মোবাইলটা বেজে উঠল। নকশী ডাক দিল, হ্যালো শুভ্র।

শুভ্র এগিয়ে এলো। পরষ্পরের চোখে চোখ পড়ল। প্রথম দৃষ্টি বিনিময়েই নকশী যেন শুভ্রর মাঝে হারিয়ে গেল। সে অষ্ফুটস্বরে বলল, প্লিজ বসুন। শুভ্র বিনয়ের সঙ্গে বলল, সরি আপনাকে অনেকক্ষণ আমার জন্য ওয়েট করতে হলো।

আমি কিছু মনে করিনি। আসলে একটু কাজের চাপ বেশি ছিল তাই আসতে দেরি হলো, তাছাড়া আমি সাধারণত সময়ের ব্যাপারে হের-ফের করি না। শুভ্র এত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই, বলুন আপনি কেমন আছেন? ভাল, আপনি? হ্যাঁ ভাল। আসলে আমাদের পরিচয়টা অদ্ভুতভাবে হয়েছিল তাই না? কিছুটা নাটকের মতো। হ্যাঁ শুধু প্রথম পরিচয়টাই না, আজকেরটাও।

নকশী মুচকি হেসে বলল, টেকনোলজির সুবাদে আজকাল মোবাইলে প্রেম, বিয়ে সবকিছুই হচ্ছে। আমার পরিচিত এক মেয়ের মোবাইলে প্রথমে পরিচয় হয়েছিল, তারপর প্রেম, বিয়ে। এখন বেশ সুন্দর সংসার করছে। নকশীর হাসিটা খুব সুন্দর, হাসবার সময় গালে টোল পড়ে, অপর পাশে চিবুকে একটা কালো তিল আছে যা তার সৌন্দর্যকে সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শুভ্রর একবার বলতে ইচ্ছা করল, সে নকশীকে বলবে আপনার হাসিটা খুব সুন্দর।

নকশী জিজ্ঞেস করল, কি ভাবছেন? কিছু না। আপনি কিন্তু চালাকি করছেন, আসলে আপনি কিছু ভাবছেন, আপনি কয়েকমুহূর্ত এ জগতে ছিলেন না। হ্যাঁ বলুন। কি বলছিলাম বলুন তো? ঐ যে প্রযুক্তির সুবাদ। হ্যাঁ ছেলেটা বন্ধু চাই লিখে টাকায় তার মোবাইল নাম্বার লিখে দিয়েছিল, সেই নাম্বার দেখে মেয়েটা মোবাইল করেছে তারপর দেখা সাক্ষাত, প্রেম, শেষ পর্যন্ত বিয়ে।

একেই বলে প্রযুক্তির সুবাদ। নকশী বলল, কি খাবেন বলুন? আপনি নিউট্রিশন এন্ড চাইল্ড হেলথ নিয়ে লেখাপড়া করেছেন, কাজেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আপনার পছন্দই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নকশী মুচকি হেসে প্রাইজ লিস্টটা নিয়ে চলে যাচ্ছিল, শুভ্র বলল, আপনি যাচ্ছেন কেন? আপনি বসুন আমি যাচ্ছি। নকশী শুভ্রর কথা না শোনার ভান করে চলে গেল। কয়েকমিনিটের মধ্যে নকশী ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এলো।

শুভ্র জিজ্ঞেস করল, আপনি আনতে গেলেন কেন? কেন অসুবিধা কি? শুভ্র মনে মনে হাসল। নকশী বলল, আমি মেয়ে বলে। শুভ্র মনে মনে বলল, কি ব্যাপার আমার মনের কথা নকশী বুঝল কিভাবে? নকশী বলল, আপনি হয়ত মনে করছেন আমি আপনার মনের কথা বুঝতে পারলাম কিভাবে? এক্সাক্টলি। আমার এক কলীগ আছে ওর কাছ থেকে একটা গল্প শোনার পর থেকে এই বিষয়টা আমি অনুমান করছি। কি গল্প? আমার এক কলীগ অনেকদিন পর তার স্কুল জীবনের এক বান্ধবীকে খুঁজে পেল।

দু’জনে দেখা হলো, কয়েকদিন কথাবার্তাও হলো। মেয়েটা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করে, অনেক টাকা বেতন পায় আর আমার কলীগটা বেশি বেতন পায় না। যাহোক একদিন আমার কলীগকে তার বান্ধবী রিকোয়েস্ট করল, সোনারগাঁও বেড়াতে যাবে, অবশ্য তাদের রিলেশনটা ছিল খুব আন্তরিকতাপূর্ণ এবং বিশ্বস্থ। ব্যাস একদিন দু’জনে চলে গেল, সোনারগাঁও। তারপর।

সারাদিন দু’জনে সোনারগাঁও ঘুরে বেড়াল, সারাদিন যত খরচ হলো সব আমার কলীগই দিল। হ্যাঁ তাতে কি? শুভ্র জিজ্ঞেস করল। অবশ্যই অনেক কিছু। যেমন। সমস্ত বিল তার বন্ধুকে দিতে না দিয়ে সেই ভদ্র মহিলার কিছু খরচ শেয়ার করা উচিত ছিল।

তা ছিল বটে, তবে বিষয়টা বেশি মাইন্ড করার মতো নয়। অবশ্যই মাইন্ড করার মতো, আমার কলীগও চাকরি করে আর ভদ্র মহিলাও চাকরি করে। আসলে সোনারগাঁও বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছাটা ছিল তার বান্ধবীর। তাই সমস্ত খরচ আমার কলীগ-এর ওপর না চাপিয়ে তারও শেয়ার করা উচিত ছিল। কিন্তু সে মেয়ে হিসেবে সুবিধা নিয়েছে।

সে মনে করেছে তার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আমার কলীগ নিজেকে ধন্য মনে করেছে। আমার কলীগ বেচারা খুব সহজ-সরল। সে কষ্ট হলেও কিছু বলেনি শুধু মনের কষ্টটা আমাদের কাছে প্রকাশ করেছে। শুভ্র মৃদু হাসল। নকশী বলল, আমার মনে হয় বন্ধুত্ব হওয়া উচিত সমান সমান।

একজন সামনে এগিয়ে আসবে আর অন্যজন রিসপন্স করবে না তা হয় না। শুভ্র বলল, নকশী আপনার শেষ কথাটা কিন্তু আমাকে মিন করলেন। নকশী থমকে গেল। সরি আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে আপনাকে মিন করিনি।

ওকে, এখন বলুন আপনার কথা। দু’জনে অনেকক্ষণ গল্প করল। নকশী শৈশব থেকে তার জীবনের সমস্ত কথা বলল, তার কথা বলার মধ্যে যেন কোন জড়তা নাই, কোন রহস্য নাই। সে সবকিছু বলল অনায়াসে। শুভ্রও তার জীবনের সমস্ত কথা বলল, উর্মীর রহস্যজনক আচরনের কথা বলল।

নকশী ট্রে থেকে একটা প্লেট বাড়িয়ে দিল, নিন এটা খান আপনার খুব ভাল লাগবে। শুভ্র বলল, আচ্ছা নকশী একটা কথা সত্য করে বলুন তো। আমি মিথ্যা কথা বলি না। সরি, আচ্ছা বলুন। আপনি আমার মোবাইল নাম্বার পেলেন কিভাবে? এটা আপনাকে বলা যাবে না, তবে প্রথমে আমার উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে পরীক্ষা করা কিন্তু পরীক্ষা শেষ করার আগে আমি নিজেই ফেঁসে গেছি।

ফেঁসে গেছি মানে? ওতো মানে আপনার না বুঝলেও চলবে। আমি যতটুকু জানি আপনি বিয়ে করার জন্য কনে দেখছেন। হ্যাঁ। কনে পাওয়া গেছে? অনেকগুলো কনে পাওয়া গেছে তবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কেন? কাউকে পছন্দ হচ্ছে না।

দু’জনে হাসল। এখন পর্যন্ত না। শুভ্র মৃদু হাসল। নাস্তা শেষ হলো, শুভ্র চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে দু’কাপ কফি নিয়ে এলো। কফি খেতে খেতে নকশী বলল, শুভ্র আপনার সঙ্গে কথার পর থেকে আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল আজ দেখা হলো, কথা হলো ইচ্ছা করেই হোক আর মুখ ফস্কেই হোক একটা কথা আমি বলে ফেলেছি কারো সঙ্গে কোন রিলেশন ডেভলাপ করার দায়িত্ব আসলে উভয় পক্ষের সেদিক থেকে আমি মনে হয় অনেকদূর এগিয়েছি এবং আমার ইচ্ছার কথা আপনাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি এখন বাকী দায়িত্ব আপনার।

শুভ্র বলল, আমি বুঝতে পেরেছি নকশী, আপনি খুব ভাল মেয়ে, খুব ভাল। নাইস টু মিট ইউ, শুভ্র, বলে নকশী হ্যান্ড শ্যাক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। শুভ্র হ্যান্ড শ্যাক করার সময় নকশীর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, আপনার এস.এম.এস-এর এক সেকেন্ড এনজয় করেছেন তো? নকশী শুভ্রর চোখে চোখ রাখল, হ্যাঁ, আপনি? চলবে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।