আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আপেক্ষিক তত্ত্বের কিছু অজানা কথা -১

h

শুরু কথাঃ অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে লিখব, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি কিন্তু তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল একজন বিখ্যাত (সেলিব্রেটি) মানুষকে নিয়ে লিখতে গেলে, যখন বিতর্কের আভাষ থাকে তখন যথেষ্ট পরিমানে সতর্কতা ও পুঙ্খানু পুঙ্খরূপে রেফারেন্স ও ব্যাখ্যা প্রদান করা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবুও লেখাটি শুরু করেছি, কারন সত্যকে যতই ঢেকে রাখা, অথবা তিক্তই হোকনা কেন, জানার অধিকার ও প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের সবারই আছে। আপেক্ষিকতার দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম পর্বে আমি বিশেষ আপেক্ষিকতা ও দ্বিতীয় পর্বে সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে আলোচনা করব। ফরাসী গণিতবিদ ও দার্শনিক হেনরী পয়েনক্যার (১৮৫৪-১৯১২) সে সময় কাজ করছিলেন আন্তঃসময় রেখা (Geodesic Straight Line ) নিয়ে, যা কিনা পরে তার চিন্তা ভাবনাকে মহাকাশে অবস্থিত কোন বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন গতির কারনে পার্থিব সময়ের সাপেক্ষে সে বস্তুটির স্থান-কালের অবস্থানের কেমন পরিবর্তন হবে সেদিকে ধাবিত করে।

সময়টি ছিল ১৮৯৫ সাল। ইতিমধ্যে ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেন্টজ (১৮৫৩-১৯২৮) বিখ্যাত মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে (যাতে বলা হয়েছিলো ‘ইথার’ বলে কিছু নেই) গতিশীল কণিকার জন্য কিছু গবেষণা পত্র বের করেন যা কিনা লরেন্টজ সমীকরণ নামে পরিচিত। মোদ্দা কথাটি কি ছিলো তাতে? সহজ ভাষায় বলতে গেলে লরেন্টজ দেখিয়েছিলেন আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলমান কোন ঘড়ি স্থিতিশীল একটি ঘড়ির সাপেক্ষে তা ধীরে ধীরে চলবে আর সেই বেগে চলমান কোন বস্তুকে স্থিতিশীল পর্যাবেক্ষকের কাছ থেকে আসল দৈর্ঘ্য থেকে একটু ছোট ও ভারী মনে হবে। পয়েনক্যারের কাছে লরেন্টজের এই আবিষ্কার অত্যাশ্চর্য্য বলে মনে হয়েছিলো আর তিনি এ নিয়ে তার গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেন যে, দুটি গতিশীল ঘড়ি থেকে যদি একই সাথে আলোক সংকেত প্রদর্শন করা হয় তবে তারা উভয়েই আলোর গতি একই পরিমাপ করবে। কেমন যেন মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তাই না? সোজা বাংলায় বলা যায়, পয়েনক্যার বলেছিলেন, আলো সর্বদাই একটা ধ্রুব রাশি, যা কিনা এর উৎসের গতির ওপর নির্ভর করে না।

অর্থাৎ আপেক্ষিক বেগের ধারনাটি আলোর ব্যাপারে খাটেনা। কি মনে হচ্ছে? এ যেন বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বেরই প্রাথমিক ধারণা তাই না? ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত “Measure du temps-Revue de métaphysique et de morale (The Measurement of Time)” গ্রন্থে তিনি তৎসংলগ্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন আর এর নাম দেন তিনি “আপেক্ষিকতার মূলতত্ত্ব”, যাই কিনা পরে বিশেষ আপেক্ষিকতা নামে পরিচিতি লাভ করে। আরও আছে, ১৯০২ সালে প্রকাশিত তার লেখা “Science and Hypothesis” গ্রন্থে তিনি বলেন, পরম স্থান বা পরম সময় বলে কিছু নেই। স্থান-কাল-পাত্র সবই আপেক্ষিক। চিন্তা করে দেখুন, হাইস্কুলে আমরা প্রায় সবাই জিনিসটা পড়ে এসেছি, কিন্তু সবাই আইনস্টাইনের নাম শুনে আসলেও পয়েনক্যারের নাম হয়ত অনেকই আজ প্রথম শুনলাম, অথচ তিনিই কিনা এর প্রবক্তা, ইতিহাসের লুকোচুরিটা এখানেই! স্থান-কালের পরিবর্তনঃ লরেন্টজ সমীকরণ (উইকি থেকে নেয়া) এবার একটু গোড়ার দিকে ফিরে যাই।

১৯০০ সালের প্রাথমিক দিকে পয়েনক্যার কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এই বিকিরণ গবেষণা করে সর্বপ্রথম কোয়ান্টাম তত্ত্বের সুচনা ঘটান। কিন্তু হেনরী পয়েনক্যার এই কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণকে আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি এই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণকে এক ধরনের কল্পিত তরঙ্গের প্রবাহ হিসেবে ধরে নেন যার প্রতি একক আয়তনের ভরের পরিমান শক্তির ঘনত্ব আর আলোর গতিবেগের বর্গের অনুপাত, অর্থাৎ যে কোন বিকিরণের ক্ষেত্রে তরঙ্গের সমতুল্য ভর m=E/c^2। সে সময় এই মতবাদ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয় কেননা নিউটনিয় বলবিদ্যায় ভর অকৃত্তিম রাশি হিসেবে গণ্য।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা শক্তির সমতুল্য ভর। মাদাম কুরির সাথে পয়েনক্যার লক্ষ্য করেন, রেডিয়াম থেকে নির্গত তেজস্কৃয় রশ্মি উক্ত পদার্থের ভর ক্ষয়ের সমানুপাতিক। এতে তার পূর্বতর ধারনা আরও পোক্ত হয়। অর্থাৎ, পয়েনক্যারই সর্বপ্রথম E=mc^2 সমীকরনের মূল ধারনা দেন। আলোর খেলাটি (উইকি থেকে নেয়া) ওপরের কথাগুলো থেকে প্রশ্নটা আসা খুবই স্বাভাবিক, আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের সবকিছুর মূল ধারণা যদি লরেন্টজ আর পয়েনক্যার দেন তাহলে এখানে আইনস্টাইনের কৃতিত্বটা কোথায়? বলছি এখন- বিশেষ আপেক্ষিকতার লরেন্টজের সমীকরনের রূপান্তর করে লরেন্টজ-ফিটজেরাল্ড সমীকরণ পাওয়া যায়।

লরেন্টজের সমীকরনে কিছু ভূল ছিল। ১৯০৫ সালে পয়েনক্যার সেই ভূল গুলো চিহ্নিত করে তার রূপান্তরিত সমীকরণ গুলোতে “টাইম ডাইলেশন” ফ্যাক্টর যোগ করেন। এরই মাঝে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা নিয়ে তার প্রথম গবেষণা পত্রে লরেন্টজের সমীকরণ পূণঃপ্রতিষ্ঠা করেন যা কিনা পয়েনক্যার আগেই সুসম্পন্ন করে রেখেছিলেন কিন্তু বিশদ ব্যাক্ষ্যায় যাননি এই খেয়ালী দার্শনিক। আগেই বলে রাখি, পয়েনক্যার যতটা না ছিলেন বৈজ্ঞানিক তার থেকে বেশী ছিলেন দার্শনিক ঋষি প্রকৃতির। ঠিক যেন আমাদের জগদিশ চন্দ্র বসুর মতন (পরবর্তিতে আরেকজন মহান বিজ্ঞানীর নাম বলব, তিনিও এ ধরনের মানুষ ছিলেন যে কিনা খ্যাতির লোভে কাজ করেননি আর তার নাম সাধারন আপেক্ষিকতাবাদে অঙ্কিত আছে স্বর্ণাক্ষরে)।

আইনস্টাইন পয়েনক্যারের আগেই ব্যাক্ষ্যা সহ লরেন্টজের সমীকরণ গুলো পুণঃপ্রতিষ্ঠা করেন। হ্যাঁ পয়েনক্যারের ভূলটি কোথায় ছিলো? তিনি আইনস্টাইনের কাজকে স্বীকৃতি দেননি, কিন্তু আইনস্টাইন কিন্তু পয়েনক্যারের কাজের স্বীকৃতি ঠিকই দিয়েছিলেন। তার ভাষায়, “ম্যাক্সওয়েলের তাড়িতচৌম্বকীয় সমীকরণগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে লরেন্টজ তার রূপান্তর সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন আর পয়েনক্যার সমীকরণ গুলোর গভীর তাৎপর্য উল্লেখ করেন...” এবার আসি ভর-শক্তি সমীকরণ সম্পর্কে, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ‘ইলেক্ট্রোডিনামিক্স’ জার্নালে তার বিশেষ আপেক্ষিকতা নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত করেন আর সেখানে তিনি আলোর বেগ ও ভর-শক্তি সমীকরণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি-ই সর্বপ্রথম ভর-শক্তি সমীকরণকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আলোকে সার্বজনীন ব্যাখ্যা দেন। সত্যি বলতে কি, পয়েনক্যারের অবদান অনস্বীকার্য হলেও সে মূহুর্তে আইনস্টাইন ও পয়েনক্যার দুজনেই বিশেষ আপেক্ষিকতার শেষ ধাপটি নিয়ে কাজ করছিলেন আর আইনস্টাইন সর্বদাই ভয়ে থাকতেন, এই না পয়েনক্যার তার আগেই আপেক্ষিকতা সম্পর্কে সমীকরণগুলো জার্নালে প্রকাশ করে দেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পয়েনক্যারের আগে তার কাজগুলো জার্নালে প্রকাশ করেন। বস্তুত এটা এখনও বিতর্কিত, আইনস্টাইনের জার্নালের কাজ তার নিজের করা নয়, বরঞ্চ সেগুলো লরেন্টজের সমীকরণ আর পয়েনক্যারের কাজের একীভূত রূপ। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আইনস্টাইনের কৃতিত্বটা কোথায়? কেনইবা তাকে আপেক্ষিকতার জনক বলা হয়? সত্যি বলতে কি তার এই কাজ প্রশ্নসাপেক্ষ বলেই কিন্তু এই সুবিশাল কাজের ওপর তাদের কাউকেই নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়নি। আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার ওপর প্রকাশিত ৩য় গবেষণা পত্র “Electrodynamics of Moving Bodies”-এ সার্বজনীন বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের অবতারনা ঘটান। তিনি বিশেষ আপেক্ষিকতার স্থান-কাল-ভর-শক্তির সাথে তাড়িতচৌম্বকতার সঙ্গতিপূর্ণতা বা কনসিসটেন্সি তুলে ধরেন এবং তার ৪র্থ গবেষণা পত্র “Does Inertia of a Body Depends upon its Energy Content?”" শিরোনামে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাথে সঙ্গতি রেখে ভর-শক্তি সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন অর্থাৎ E=mc^2 সমীকরণটিকে তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন যা পদার্থবিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার বলা যায়।

(চলবে...) দ্বিতীয় পর্ব References: 1. Henri Poincare and the Theory of Relativity: W. Scott (2005) 2. "Minkowski, mathematicians, and the mathematical theory of relativity ", in H. Goenner, J. Renn, J. Ritter, and T. Sauer 3. Relativity of Space , Henry Poincare (1897) 4. "The Mystery of the Einstein-Poincaré Connection ",Darrigol, O. (2004) 5. "A Note on Relativity Before Einstein ", British Journal for the Philosophy of Science.,Macrossan, M. N. (1986) 6. "Lost in Einstein's Shadow " ([dead link]), American Scientist 94 (2): 112,Rothman, Tony 7. Lorentz-Poincaré relativity and a scalar theory of gravitation

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.