আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার রক্তদান সম্পর্কিত প্যাঁচালসমূহ

একজন ফুরিয়ে যাওয়া ব্লগার
পোস্টের মুখবন্ধ (কিংবা মুখব্যাদান) হিসেবে ম্যালা ভনিতা করা যেতো, কিন্তু সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে মূল প্যাঁচালই আরম্ভ করা শ্রেয়তর মনে হলো। অতএব... ১. তখন মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ঘটনাচক্রে সেদিন ছিলো আমার জন্মদিন। দুপুরবেলা ক্লাস করে বেরিয়েই দেখি সন্ধানী থেকে একটা গ্রুপ এসেছে, স্বেচ্ছায় রক্ত দানকারীদের থেকে রক্ত নিয়ে যাচ্ছে। আমি এর আগে কখনও রক্ত দিইনি, সেদিন মনে হলো, আহা আজ এত ভালো একটা দিন, কেন আজই এমন ভালো একটা কাজ করি না (কেন জানি বাড্ডের দিন মন একটু উড়ুউড়ু থাকে, এমন সাদামাটা একটা দিনকেও ভালো দিন বলে মনে হয়)! যেই ভাবা সেই কাজ।

সঙ্গে ছিলো দুই বান্ধবী, তাদেরকে মতামত জিজ্ঞেস করা মাত্রই তারা আঁতকে উঠে জানালো যে তাদের প্রাণে অনেক ভয়, এত মোটা সূঁচ গায়ে ফোটানো হবে ভাবলেই নাকি তাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। তা যেহেতু কবিগুরু বলে গেছেন "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে..." ইত্যাদি ইত্যাদি, কাজেই ওদের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে আমি একাই রক্ত দেয়ার টেবিলে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু ভয় ভয় যে করছিলো না তা নয় তবে যদ্দুর মনে পড়ে, খুব একটা ব্যথা লাগেনি তখন। পুরো সময়টা আমি খুশি মনে হাতের পাতায় ধরিয়ে দেয়া বস্তুটা পাম্প করছিলাম আর আমার সেই দুই বান্ধবী বড় বড় চোখ করে হ্যাবলার মত আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো, ভাবখানা এমন যেন আমার না জানি কি বিপদ হয়ে যাচ্ছে। মিনিট দশেক পর তারা দু'জন "না বাপু, তোর আসলেই সাহস আছে" বলতে বলতে হোস্টেলের দিকে পা বাড়ালো, আর আমি সন্ধানীর দেয়া বিস্কিট খেয়ে তাইরে নাইরে না করতে করতে বাসার দিকে রওনা দিলাম।

গন্ডগোলটা বাধলো তার কয়েক ঘন্টা পর। মায়ের কাছে বায়না করেছিলাম লুচি বানিয়ে দেয়ার জন্য (আমি আবার এইসব লুচি-পরোটা জাতীয় খাবারের জন্য চরম লুল)। মা বললেন, নো প্রবলেমো, তুমি যদি ময়দার খামির বানিয়ে দিতে পারো তাহলে লুচি বানাতে আমার কোনও সমস্যা নেই। আমার মায়ের হাতে একটু সমস্যা আছে, যেসব কাজ খুব হাতের জোর দিয়ে করতে হয় (যেমন আটা/ময়দা মথে খামির বানানো কিংবা ভেজা কাপড় নিংড়ানো) সেগুলো প্রপারলি করতে পারেন না। তো লুচি খাওয়ার জন্য সামান্য এটুকু করতে পারবো না এটা কোনও কথা হলো? মহা আনন্দে আমি বসে গেলাম খামির বানাতে।

এইখানে বলে রাখা ভালো যে, আল্লাহর ওয়াস্তে আমি একজন ডানহাতি ব্যক্তি, কাজেই ময়দা মাখাচ্ছিলাম ডান হাতে, আর বিপদের কথা হলো ঐদিন আমি রক্তও দিয়ে আসছিলাম ঐ ডান হাত থেকেই। ফলশ্রুতিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো রক্ত নেয়ার জন্য কনুইয়ের কাছে যেখানে সূঁচ ফোটানো হয়েছিলো সেখানটায় ফুলে ঢোল হয়ে গেলো, রক্ত বেরোতে শুরু করলো, এবং অবধারিতভাবে ব্যথা করতে লাগলো। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজেরই পুরা মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। খানিক পরে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে ময়দা মাখা বাদ দিয়ে 'আম্মাআআআআআআআআ' বলে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কোনও উপায়ই থাকলো না। ************************************* ২. অনেক বছর পরের কথা, চাকরি করি তখন।

অফিসে আসার কিছুক্ষণ পরেই একজন কলিগ (ধরা যাক ভদ্রলোকের নাম অমল) এসে বললেন ওনার এক বন্ধুর মা খুবই অসুস্থ, ক্যান্সার পেশেন্ট, তাঁকে রক্ত দিতে হবে। রক্তদান সংক্রান্ত ব্যাপারে 'না' বলার বিশেষ কোনও কারণ নেই, কাজেই রাজি হয়ে গেলাম। অমলদা জানালেন হসপিটালটা কাছেই, লাঞ্চ আওয়ারে ওনার সেই বন্ধু এসে আমাকে এবং ওনাকে নিয়ে যাবে, তখন রক্ত দিলেই হবে। খুব চড়া রোদ ছিলো সেদিন। যতদূর মনে পড়ে সেটা ছিলো চৈত্র মাসের কাছাকাছি একটা সময় , একটু একটু করে গরম পড়ে যাচ্ছে তখন।

সেই ভর দুপুরে গিয়ে যাহোক এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে আসলাম। অমলদার বন্ধু বারবার করে ধন্যবাদ দিলেন তার জন্য। অফিসে এসে দেখি ততক্ষণে লাঞ্চ আওয়ার পার হয়ে গেছে। হসপিটালে রক্ত দেয়ার পর সম্ভবতঃ ফ্রুট জুস খেতে দিয়েছিলো। ফিরে এসে ভাবলাম নিজের আনা খাবার যা আছে এইবেলা খেয়ে নেয়া উচিত, পরে হয়তো কাজের চাপে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, ততক্ষণ আর কিছু খাওয়াই হবে না।

লাঞ্চ বক্স খুলে দেখি মা জননী পরোটা আর সবজি দিয়ে রেখেছেন (আবারও সেই লুচি পরোটা!)। ভেরি গুড, আমি তো এসব পেলেই খুশি। কিন্তু কি বিচিত্র ব্যাপার, খেতে গিয়ে দেখি এক টুকরাও গলা দিয়ে নামে না! খাওয়া থামিয়ে কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম যে আসলে সমস্যাটা হচ্ছে কোথায়? অ্যাম আই ফিলিং ইল? নাকি রক্ত দিয়ে এসে দুর্বল লাগছে? কিন্তু রক্ত তো আমি বহুবার দিয়েছি গত কয়েক বছরে, এমন তো হয় না কখনো! কেসটা কি? খানিক পরে বুঝলাম যে আসলে সমস্যাটা হচ্ছে খাবারে। পরোটাটা বোধহয় একটু পুরনো ছিলো, প্রায় চামড়ার মত (কিংবা রাবারের মত) শক্ত হয়ে গেছিলো সেটা। কি পরিমাণ শারিরীক শক্তি ব্যয় করে যে সেই পরোটা চিবোতে হচ্ছিলো, কি আর বলবো।

খাওয়া শেষ হওয়ার পরে দেখি আমার আর ঢোঁক গেলার মত অবস্থাও নেই। ঐ অফিসে যে রুমটায় আমরা বসতাম সেটা ছিলো পশ্চিমমুখী। ঠিক দুপুরের পর থেকেই এমন কড়া রোদ আসতো যে মনে হতো ঘরে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বোধহয়। রুমে একটা এসি ছিলো কিন্তু সেটা মাঝেমাঝে নিজের খেয়াল খুশিমত ডাউন হয়ে যেতো (যেদিনকার কথা বলছি সেদিনও যে এমন হয়েছিলো তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না!)। তো সেইদিন ঐ ১ ব্যাগ রক্ত দিয়ে এসে ঐরকম অমানুষিক পরিশ্রম করে পরোটা খেয়ে অমন প্রচন্ড গরম হজম করে একটা সময় শরীর এত খারাপ করতে লাগলো যে সোজা হয়ে বসে থাকার মত অবস্থাও আর ছিলো না।

একেকবার মনে হচ্ছিলো- বাবা রে, ফেইন্ট না হয়ে যাই! অমলদা বেচারা তো রীতিমত ভয় পেয়ে গেলো, বোধহয় ভাবছিলো যে উনার কারণেই আমার আজকে এই অবস্থা কিনা। বহু কষ্টে সেদিন অফিসের একটা রুমে কিছুক্ষণ ঠান্ডা বাতাসে চুপচাপ লম্বা হয়ে শয্যাশায়ী ('সোফা'শায়ী অ্যাকচুয়ালি) হয়ে থেকে বিশ্রাম নেয়ার পর বাসায় ফেরার মত সাহস দেখাতে পেরেছিলাম, নইলে সেদিন পথের মাঝেই পড়ে থেকে নির্ঘাত গাড়ি চাপা পড়ে মরতে হতো। *************************************** ৩. উপরোক্ত দু'টো ঘটনার মাঝামাঝি সময়ের কথা। গ্রাম থেকে দূর সম্পর্কেরএক চাচা এসেছেন, বেচারা খুবই দরিদ্র মানুষ এবং শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। ওনার সমস্যাটা ছিলো এরকম যে, উনি কিছু খেতে পারতেন না কারণ খাবার গলাধঃকরণ করতে গেলেই গলার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অসহ্য যন্ত্রণা হতো।

সাধারণ যেকোনও খাবার খেতে গেলেই এমন হতো, আর ঝাল খাবার হলে তো কথাই নেই, একেবারে চোখ দিয়ে পানি পড়ার মত অবস্থা। খুবই কষ্টে পড়ে বেচারা একদিন এলেন আমাদের বাসায়। নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে। অদ্ভুত ব্যাপার, সব দেখে-টেখে ডাক্তার বললো, আপনার কিন্তু এটা গলার সমস্যা নয়, এটা হলো রক্তের অভাব। আপনি খুব সিরিয়াসলি রক্তের অভাবে ভুগছেন, কাজেই জরুরী ভিত্তিতে অন্ততঃ দুই ব্যাগ রক্ত নেবেন।

পরীক্ষা করে দেখা গেলো উনি বি পজিটিভ অর্থাৎ গরুর রক্তের অধিকারী। যেহেতু আমাদের ফ্যামিলিতেও সবাই তাই, কাজেই বাবা বলে দিলেন কোনওভাবেই বাইরে থেকে রক্ত কেনার দরকার নেই, আমরা দুই বোন দুই যেন দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে দিই, তাহলেই হবে। এখন কথা হলো, রক্ত দেয়া যত সহজ প্রসেস, রক্ত নেয়া কিন্তু তত সহজ নয়, এক ব্যাগ রক্ত-- দিতে সময় লাগে বড়জোর ১০ মিনিট কিন্তু নিতে সময় লেগে যায় প্রায় ৩ ঘন্টারও বেশি। সবেমাত্র তখন আমার রক্ত দেয়া হয়েছে, ছোট বোন দিতে যাবে-- চাচা বললেন, থাক মা তোমরা আর কষ্ট কোরো না, এই ১ ব্যাগ নিতেই আমার দীর্ঘ সময় লেগে যাবে, আগে এটুকুই নিই, তাতেও যদি কাজ না হয় তখন আরেকজনের থেকে নেয়া যাবে, আপাততঃ একজনেরই থাক। চাচার কথামত একজনই রক্ত দিলাম, আরেকজন আর দিলাম না।

বাসায় ফিরে একটা ডিমসেদ্ধ করতে দিলাম, যেহেতু রক্ত দিয়ে এসেছি কাজেই একটা কিছু খাওয়া উচিত। ও মা, তাকিয়ে দেখি আমার পেয়ারের বোনও একটা ডিম পোচ করতে দিয়েছে। বললাম- সেকি, তুই আবার ডিম নিয়ে পড়লি ক্যান, তুই তো রক্ত দিসনি! সে ব্যাপক ভাব নিয়ে উত্তর দিলো, তাতে কি হয়েছে? যে রক্ত দিয়েছে আমিও তো তার সঙ্গেই গেছিলাম, রক্ত দিতেও চেয়েছিলাম, দেয়া হলো না বলে কি ভালোমন্দ খেতেও পারবো না?
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.