আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক্তদান নিয়ে কিছু কথা ( ২ নভেম্বর একসময় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস হিসেবে পালিত হতো)

ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...

".......মুমূর্ষুদের প্রয়োজনে মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তা উল্লেখ করার মতো। পহেলা বৈশাখে রমনায় সন্ধানী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ইউনিটের স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান ছিল। বোমায় আহতদের জন্য রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় ঘোষণার পর সেখানে ভিড় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সবাই যেন প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন, কে কার আগে রক্ত দেবেন। যারা আগে কখনো রক্ত দেননি, তারাও রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন।

.......টিভিতে রক্তের প্রয়োজনের ঘোষণা দেয়ার পর পর মানুষ ভীড় জমায় সন্ধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ইউনিটে। ...... রক্তদানে আগ্রহীর সংখ্যা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত বারান্দা এবং কলেজ ক্যান্টিনেও বাড়তি টেবিল পেতে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। আর্তমানবতার সেবায় মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে আসা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। " (‘ফিরে দেখা’, দৈনিক জনকন্ঠ, ২০ এপ্রিল, ২০০১) বাস্তবতা হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততার এই দৃষ্টান্তগুলো দেখা যায় শুধু বিশেষ বিশেষ দিন বা ঘটনার প্রেক্ষিতে। ফলাফল- সারা বছর রক্তের যে প্রয়োজনীয়তা, তা পূরণ হয় না কখনোই।

শুধু রক্তের অভাবে মারা যায় অসংখ্য মানুষ। আবার বিশেষ ঘটনায় নির্দিষ্ট স্থানে রক্ত সরবরাহ এত বেশী হয়ে যায় যে, অনেক সময় উদ্বৃত্ত রক্ত নষ্টও হয়ে যায়। ২০০১ এর ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষে ঢাকায় রমনার বটমূলে বোমার ঐ ঘটনার কথাই বলি। ঐ সময়ে আহতদের প্রয়োজনের তুলনায় এত বেশী মানুষ রক্ত দিয়েছিলেন যে সন্ধানীর এক ফ্রিজে তার জায়গা হচ্ছিল না। আহতদের প্রয়োজন মিটিয়ে পরবর্তীতে ঢাকা মেডিক্যালের অন্যান্য রোগীদের সরবরাহ করার পর, এমনকি অনেক ব্যাগ মিটফোর্ড হাসপাতালের রোগীদেও জন্য দেয়ার পরও কিছু ব্যাগ নষ্ট হয়েছিল।

হ্যাঁ- রক্ত নষ্ট হয়েছিল। কারণ, রক্ত বেশীদিন সংরক্ষণ করা যায়না। তখন সন্ধানীতে যে ফ্রিজটা ব্যবহার করা হতো, তাতে বড়জোর সাত-আটদিন রক্ত সংরক্ষণ করা যেত (পরে অবশ্য রক্ত সংরক্ষণের উপযোগী উন্নত প্রযুক্তির একটি ফ্রিজ ডোনেশন পাওয়ায় প্রায় তিন সপ্তাহ রক্ত সংরক্ষণ করা যায় এখন)। আবার ঢাকায় রক্ত সংগ্রহ করে সেটি চুয়াডাঙ্গা বা কক্সবাজারে কোন রোগীর প্রয়োজনে লাগানোও বিরাট ঝক্কির ব্যাপার। নির্দিষ্ট তাপমাত্রার বাইরে কয়েক ঘন্টা রাখা হলেও রক্ত রোগীর শরীরে পরিসঞ্চালনের অনুপযোগী হয়ে যায়।

তাই, শুধু একটি ঘটনায় বিশেষ এলাকায় বা বিশেষ সময়ে শুধু নয়, সব সময়ে সব অঞ্চলে প্রয়োজনীয় রক্তের সরবরাহ যাতে নিশ্চিত করা যায়, সে ব্যাপারটি খেয়াল রাখা দরকার। বলা হয়, প্রতিবছর দেশে রক্তের প্রয়োজন তিন লাখ ব্যাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিককালে দেশে রক্তের চাহিদা কত এ নিয়ে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা যায় এমন কোন গবেষণা হয়নি। ১৯৮৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল এ গবেষণা চালায়) দেখা যায়, প্রতিবছর রক্তের প্রয়োজন প্রায় আড়াই লাখ ব্যাগ। ২০ বছর পর এখন আনুমানিক হিসাব ধরে এটিকে তিন লাখ বলা হয়।

প্রতিদিনই শত শত রোগীর অপারেশন হচ্ছে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে। প্রয়োজন পড়ছে শত শত ব্যাগ রক্তের। দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণ, প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, রক্তের ক্যান্সার, রক্তশূন্যতা, হিমোফিলিয়া, থ্যালাসেমিয়া, ডেঙ্গুসহ রক্তের স্বল্পতাজনিত অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় রোগীর দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে। থ্যালাসেমিয়ার রোগীরা তো বেঁচেই থাকে কিছুদিন পর পর শরীরে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে। চিকিৎসকরা সব সময়ই বলেন, নিরাপদ বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য।

কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে রক্ত? রক্ত কারখানায় তৈরী হয় না, এবং রক্তের কোন বিকল্পও এখনও তৈরী হয়নি। একজন মানুষের দেহের একই গ্র“পের রক্তই সঞ্চালন করা হয় আরেকজনের দেহে। সাধারণত আত্মীয়স্বজনের মাঝ থেকেই রোগীর জন্য রক্তদানকে উৎসাহিত করা হয়। আত্মীয়-স্বজনের মাঝে না পাওয়া গেলে কোন সুস্থ, নিরোগ মানুষের দেহের একই গ্রুপের রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়। বিশুদ্ধ রক্ত পাওয়ার আশায় আমাদের দেশে মানুষজন সন্ধানী, রেডক্রিসেন্ট, বাঁধন. কোয়ান্টাম প্রভৃতি সংগঠনের দ্বারস্থ হয়।

এইসব সংগঠন কিন্তু রক্ত তৈরী করে না। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের দান করা রক্ত লোকজনের কাছে সরবরাহ করার মাধ্যম হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। যত বেশী মানুষ রক্ত দেবেন, এসব সংগঠন তত বেশী বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ করতে পারবে। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যে কোন সুস্থ, নীরোগ মানুষ (পুরুষের ক্ষেত্রে ওজন কমপক্ষে ৪৮ কেজি, মেয়েদের ৪৫ কেজি) প্রতি চার মাস পর পর ১ ব্যাগ রক্ত (৩৫০-৪৫০ মিলিলিটার) দিতে পারেন, এতে শারীরিক ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই। তবে যেদিন রক্ত দেবেন সেদিন ভারী কোন কাজ না করা এবং স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী পানি খাওয়া উচিত।

একজন মানুষের শরীরে থাকে ৫.৫ থেকে ৬ লিটার রক্ত। রক্তের অন্যতম উপাদান লোহিত কণিকা (রেড ব্লাড সেল) ১২০ দিন পর পর প্রতিস্থাপিত হয়। অর্থাৎ এক একটি লোহিত কণিকা ১২০ দিন বাঁচে। আপনি রক্ত দিন বা না দিন ১২০ দিন পর সেটি মরে যায় এবং নতুন লোহিত কণিকা জন্ম নেয়। রক্তের অন্যান্য কণিকার আয়ুষ্কাল আরো কম।

রক্তদান সম্পর্কে অহেতুক ভীতি, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফলে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার আমাদের দেশে এখনও অনেক কম। গত বছর সন্ধানী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ইউনিটের এক জরীপে (স্বল্প পরিসরে হওয়ায় যদিও সেটি গবেষণাকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়) দেখা যায়, রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে কি কি রোগ ছড়ায় ৬২% মানুষই তা জানেন না, ৫৩% জানেনই না তাদের রক্তের গ্রুপ কি, অবশ্য ৬৬% মনে করেন, রক্তদান সম্পর্কে তারা যতটুকু জানেন, তা যথেষ্ট নয়। এখনও স্বেচ্ছায় রক্তদান প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম হলেও এটা ঠিক যে আগের চেয়ে আমাদের দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার বেড়েছে। দশ বছর আগেও পেশাদার রক্তদাতারাই ছিল আশি ভাগ রক্তের যোগানদাতা। বিভিন্ন সংগঠনের সচেতনতামূলক কর্মকান্ড, সরকারী উদ্যোগ, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৯৭টি সেন্টার চালু করা, রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে নির্দিষ্ট পরীক্ষা করার ব্যাপারে কড়াকড়ি ইত্যাদির ফলে পেশাদার রক্তদাতাদের দাপট কমেছে।

নিজের আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজনে রক্ত দেয়ার মানসিকতা বেড়েছে আগের চেয়ে। তবে এখনও তা বাৎসরিক রক্তচাহিদা পূরণের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। তাই অনেককেই পেশাদার রক্তদাতাদের রক্তই ব্যবহার করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। পেশাদার রক্তদাতা কারা? যারা টাকার বিনিময়ে রক্ত দেয়। আমাদের দেশে পেশাদার রক্তদাতাদের বেশীরভাগই মাদকাসক্ত বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত।

মূলত মাদকাসক্তরাই নেশার টাকা যোগাড়ের জন্য রক্ত বিক্রি করে। এরা ভোগে রক্তবাহিত নানান রোগে। এদের রক্ত গ্রহণ করায় রোগী সাময়িকভাবে সুস্থ হলেও দীর্ঘমেয়াদে রক্তবাহিত জটিল কোন রোগ যেমন-এইডস, হেপাটাইটিস-বি ও সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতে পারেন। এক জরিপে দেখা গেছে, পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে শতকরা ২৯% হেপাটাইটিস-বি ও ২২% সিফিলিসে ভোগে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক জরীপে দেখা গেছে, যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া রোগীকে রক্ত দেয়ায়, পরবর্তীতে ৬০.১% রোগী হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।

আরেকটি ব্যাপার, পেশাদার রক্তদাতাদের বেশীরভাগই পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং চার মাসের বিরতির ব্যাপারটি না মেনেই রক্ত বিক্রি করে বলে রক্তের অন্যতম উপাদান হিমোগ্লোবিন এদের দেহে কম থাকে। ফলে, এক ব্যাগ রক্তে যতটুকু হিমোগ্লোবিন রোগীর পাওয়ার কথা, তা সে পায় না। আর পেশাদারদের রক্ত বিক্রির মাধ্যম হিসেবে অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংকগুলোও যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই রোগীদের সরবরাহ করছে এসব রক্ত। দেশের জনসংখ্যা প্রায় চৌদ্দ কোটি। অর্ধেক বাদ দিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক ধরি সাত কোটির মতোই।

অসুস্থ, অক্ষম বা রক্তদানের শারীরিক যোগ্যতা নেই বলে আমরা এরও যদি অর্ধেক বাদ দেই - সাড়ে তিন কোটি। সাড়ে তিন কোটি মানুষের মাত্র ১% - ও যদি বছরে মাত্র একবার রক্ত দান করেন, বাৎসরিক রক্তদান হয় সাড়ে তিন লাখ ব্যাগ। সংখ্যাতত্ত্বে খুবই সহজ এই ব্যাপারটিই এদেশে ঘটে না বলে রক্তের জন্য এখনও প্রতিনিয়ত মরছে মানুষ। বি:দ্র: ১৯৯৫ সাল থেকে ২ রা নভেম্বর স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। বছর কয়েক ধরে নাকি এ দিবসটি আর জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে না।

সংগঠনগুলো নিজেদের মতো করে তা পালন করছে। কেন এখন আর জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে না, সেটি অবশ্য আমার এখনও জানা হয়ে ওঠেনি। .................................................................................... রক্তের প্রয়োজনে যেখানে যোগাযোগ করতে পারেন: সন্ধানীঃ (সকল সরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ ও কয়েকটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে এর শাখা রয়েছে ) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ইউনিট: ৯৬৬৮৬৯০ সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ইউনিট: ৭৩১৯১২৩ ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ইউনিট: ৯০১১৮৮৭ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ইউনিট: ০৩১-৬১৬৬২৫ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ইউনিট: ০৯১-৫৪৮২৯ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ইউনিট: ০৭২১-৭৭৩০৮০ রেডক্রিসেন্ট : (মোহম্মদপুর, ঢাকা)- ৮১২১৪৯৭, ৯১১৬৫৬৩ কোয়ান্টাম: (কাকরাইল, ঢাকা) - ৯৩৫১৯৬৯, ৮৩২২৯৮৭ বাঁধন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এর কেন্দ্রীয় অফিস। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর শাখা রয়েছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.