আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্তাচলের রবির আলো (২)

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
শান্তিনিকেতনে বসন্ত এসে গেল। অশোক, পলাশ, বনপুলোকেরা চারিদিক রঙ্গিন করে সাজিয়ে দিয়েছে। আশ্রমে বসন্ত উৎসবের আয়োজনে মেতে উঠেছে ছেলে-মেয়েরা। গুরুদেবের অসুস্থতায় সকলের মন খারাপ। তবুও উৎসব যাতে যথাযত হয়, তার দেখভাল করছেন শৈলজারঞ্জন বন্দোপাধ্যায় ও শান্তিদেব ঘোষ।

এবার “নটির পূজ়ো”র অভিনয় হবে। এই বসন্তে সবই আছে, পুস্প, সুগন্ধ, ঋতুর আনন্দ-আবেদন, প্রেম-ব্যাকুলতা, কেবল রবীন্দ্রনাথ থেকেও নেই। পর পর ক’টি উৎসবে তিনি অনুপস্থিত। আশ্রমিকদের বুক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। “নটির পূজ়ো” তাঁর সামনে একদিন নিবেদন করা হল।

রোগ-শয্যায় বন্দি গুরুদেব আনন্দ উপভোগ করলেন। কিন্তু শরীর ফুরিয়ে আসছে। গানের সব সুর তাঁকে আর ধরা দিচ্ছে না। কবিগুরু বুঝতে পারছেন, প্রকৃতিতে বসন্তের আবির্ভাব হয়েছে, কিন্তু তাঁর ইন্দ্রিয়েরা আর বসন্তের যোগ্য নেই। এইবার তিনি বাতিলের দলে পড়েছেন।

বসন্তৎসবের দিন রচিত কবিতায় উঠে এলো সেই সত্য- " রুদ্ধ কক্ষে দূরে আছি আমি, এ বৎসর বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রন”। চৈত্র শুরু হল। একদা এই চৈত্রে কারো চোখে সুন্দর সর্বনাশ ঘনাতে দেখেছিলেন যে কবি, তাঁর কাছে আজ সর্বনাশ শব্দটি থেকে রোমান্টিকতা ঝরে গিয়েছে। ভগ্ন-স্বাস্থ্য কবি প্রবল গরমে আরও কাহিল হয়ে পড়েছেন। প্রতি সন্ধ্যায় জ্বর আসছে।

ভিতরে আরও কি কি সমস্যা হচ্ছে, কবি তো কাউকে বুঝতে দেন না। যারা সেবার দ্বায়িত্বে আছেন তারা জ্বর বুঝতে পারছেন। কবিগুরু অপারেশনের ভয়ে ছোট্ট শিশুর মত সদা তটস্ত। সে ভয়েই কষ্ট গোপন করে এমন ভাব করছেন, যেন ওষুধেই তিনি ভালো হয়ে যাচ্ছেন। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী-সহ নিকটজনেরা সবই বুঝতে পারছেন।

কিন্তু তাঁকে জোর করবে কে? শরীর প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই কবি ক্ষুন্ন হন। প্রায়শই অভিমান প্রকাশ করেন। কখনও বা অধৈর্যও হয়ে যান। সেসব থেকেই বুঝতে পারা যায়, উত্তরোত্তর তিনি ফুরিয়ে যাচ্ছেন। টের পাওয়া যায়, চুড়ান্ত বাস্তব এক সর্বনাশের গন্ধ।

যে কোন কবিতারই প্রিয় বিষয় ‘মৃত্যু”। কবিগুরুও নানা কবিতায় নানা রকম মৃত্যু-স্বপ্ন লিখেছিলেন। “পুরবী’র “সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত” কবিতায় তাঁর মৃত্যুর প্রিয় লগ্নগুলি সে-ই কবে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই মৃত্যু সময়গুলি কেমন? শান্ত শিউলী-ঝরা শুক্ল-রাত, দখিনা বাতাস-মেশা পাখী-ডাকা বসন্তের সকাল, শ্রাবনের অঝোর সঘন সন্ধ্যা বা প্রবল ঝড়ের রাত, হেমন্তের পড়ন্ত বেলা। নির্জন মৃত্যু, প্রকৃতির কোলে মৃত্যু- এই তাঁর কবি-বাসনা।

এসব কারনেই সম্ভবত শান্তিনিকেতন ছেড়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যেতে তাঁর এতো আপত্তি। অপারেশনেও মত নেই এ কারনেই। কিন্তু তিনি তো এখন দেশবাসীর, বিশ্ববাসীর সম্পদ। মৃত্যুর জন্য তাঁর যে নিভৃতি প্রার্থনা, তা কে শুনবে? বিষন্নতা লুকিয়ে রাখলেও বিষাদ কবিকে কুরে কুরে খায়। কবিরাজী ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার উপর কবির অগাধ ভরসা।

ঈশ্বরের দেওয়া শরীরে কোন কাটা-ছেঁড়া হবে, এ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। খাওয়ায় প্রবল অরুচি ও নিত্যকার জ্বর আসা দেখে উদ্বিগ্ন পুত্র রথীন্দ্রনাথ চাইছেন অপারেশনের যেন দেরী না হয়। শরীর আরও দুর্বল হলে অপারেশনের ধকল সামলাবেন কি করে? মানসিক অস্থিরতার মাঝে রথীন্দ্রনাথ প্রশান্তচন্দ ও রানী মহলানবিশকে চিঠিতে লিখলেন,-- “ শত বাধা-বিঘ্নের মাঝেও জন্মোৎসব যাতে অনুষ্ঠিত হয় সে চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে এটাই স্মৃতি-বার্ষিকী-উৎসব হবে- মৃত্যু তারিখে করতে চাইনা। বলাবাহুল্য তোমরা উপস্থিত থাকতে পারলে বিশেষ রকম খুশী হবো”।

চিঠির ভাষাতেই বোঝা যায়, শেষের সে-দিন যে আগত, রথীন্দ্রনাথ তা টের পেয়েছেন। ঘনিষ্টজনেরা সবাই বুঝতে পারলেও মানতে পারছেন না। ভাবছেন, কোন না কোনও ভাবে গুরুদেব আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। সে বছর পয়লা বৈশাখে কবির জন্মোৎসব পালিত হয়। বিদায়বেলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবিকে খুব কষ্ট দিয়েছে।

তাঁর বিশ্বাষের উপর আঘাত পড়েছে। সমস্ত আলোড়ন তিনি ধরে রাখলেন নববর্ষে তাঁর জন্মোৎসবের ভাষনে। কবির উপস্থিতিতে তার লেখা প্রবন্ধ পাঠ করলেন ক্ষিতিমোহন সেন। কালজয়ী এই রচনাটির নাম, “সভ্যতার সঙ্কট”। ক্ষিতিমোহন বাবুর কন্ঠে ফুঁটে উঠলো কবির বক্তব্য- “ জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাষ করেছিলুম ইয়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে।

আর আজ আমার বিদায় বেলায় সে বিশ্বাষ একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেলো। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি- পিছনের ঘাটে কি দেখে এলুম, কি রেখে এলুম। ইতিহাসের কি অকিঞ্চিতকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ন ভগ্নস্তুপ। কিন্তু মানুষের উপর বিশাষ হারানো পাপ, সে বিশ্বাষ শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহা-প্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পুর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে”।

চলবে... সুত্রঃ বাইশে শ্রাবন/ বিভাষ রায়চৌধুরী। ১ম পর্ব
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।