আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবৃত্তি পূজাই সকল ব্যাধির কারণ

জ্ঞানই সকল শক্তির মূল উত্স

আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা, তার সন্তুষ্টি কামনা করা এবং শুধু তাকে পাওয়ার আশা করাই হচ্ছে তওহিদের মূল তত্ত্বকথা। আর এটাই হচ্ছে কালিমায়ে শাহাদাত ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র অর্থ ও দাবি। শায়েখ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহহাব রহ. বলেন, ‘ইলাহ’ হচ্ছে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। যারা আল্লাহ সম্পর্কে জানে না, তাদের কাছে হয়তো ব্যাপারটি সাধারণ হতে পারে, কিন্তু যারা আল্লাহ সম্পর্কে জানে ও তার কুদরতের ধারণা রাখে, তাদের কাছে বিষয়টি মোটেও সাধারণ নয়। বরং অসাধারণ ও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

’ (দুরারে সানিয়্যাহ : ২ / ২১) পক্ষান্তরে যাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আল্লাহ নয়, তাদের অবশ্যই আল্লাহ ব্যতীত অন্য সত্তা বা বস্তু রয়েছে, এবং তারা (জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে) সে সত্তা বা বস্তুর দাসত্ব করছে। ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলেন, ‘তথ্য তালাশ করে দেখা গেছে যে, যে যত বেশী আল্লাহর এবাদত থেকে নিজকে গুটিয়ে নিয়েছে, সে তত বেশী শিরকে লিপ্ত হয়েছে। কারণ, আল্লাহর এবাদত, আনুগত্য ও তার শরণাপন্ন হওয়া থেকে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো এবাদত ও আনুগত্য করা এবং তার শরণাপন্ন হওয়া। ’ প্রত্যেকের জন্যই একটি আশ্রয় কেন্দ্র বা ভরসাস্থল রয়েছে, যার তরে সে উৎসর্গ হয় এবং যাকে সে অন্তরের ভক্তি-শ্রদ্ধা দিয়ে মহব্বত করে। অতএব যে ব্যক্তি নিজ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আল্লাহকে স্থির না করে তাকে প্রত্যাখ্যান করল, সে নিশ্চিত আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে লক্ষ্য স্থির করল এবং তার দাসে পরিণত হল।

হতে পারে তা বস্তু-ধন-সম্পদ-পদমর্যাদা-ভাষ্কর্য বা আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্তা। হ্যাঁ, মানুষের অন্তরে বিদ্যমান ও স্মায়ুতন্ত্রের অভ্যন্তরে বিরাজমান এমন কিছু প্রবৃত্তির আচার ও কামনা বাসনার বিবরণ-বিশ্লেষণ নিয়েই আমাদের এ আয়োজন। প্রবৃত্তির মোকাবিলায় সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রসঙ্গে কিছু কথা : প্রবৃত্তি বা বিষয়ে প্রধান প্রধান স্বভাবের আলোচনার পূর্বে, তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা ও মোকাবিলা করার পদ্ধতির ওপর সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা আবশ্যক জ্ঞান করছি। বর্তমান বিশ্ব মানুষের জৈবিক ও দৈহিক চাহিদার পূরণের ক্ষেত্রে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক শ্রেণী দৈহিক ও জৈবিক চাহিদাকে মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং একেই তারা পার্থিব জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছে।

ফলে তারা এ চাহিদা পূরণ করার জন্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হচ্ছে, নিমজ্জিত হচ্ছে পাপাচারে, ত্যাগ করেছে সালাত ও অন্যান্য এবাদত। এদের অধিকাংশ হচ্ছে পাশ্চাত্যের অধিবাসী বা তাদের অনুসারী। দ্বিতীয় শ্রেণী দৈহিক ও জৈবিক চাহিদাকে সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করে গ্রহণ করেছে বৈরাগ্যবাদ। ফলে এরা আল্লাহর হালাল করা অনেক বস্তুকেই হারাম করে নিয়েছে। এদের অধিকাংশ হচ্ছে প্রাচ্যের অধিবাসী বা তাদের অনুসারী।

এর বিপরীতে ইসলাম দৈহিক ও জৈবিক চাহিদার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা গ্রহণ করেছে। আর এটাই হচ্ছে মানুষের জৈবিক ও আত্মিক চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দীন, মানুষের স্বভাবের ধর্ম। ইসলাম মানুষের সার্বিক চাহিদার জিম্মাদার, তাই সে মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও প্রকৃতিগত চাহিদার বিরোধিতা করে না, বরং তার স্বীকৃতি দেয় এবং সংগত কারণে তা নিয়ন্ত্রণও করে। ইবনে কাইয়ূম রহ. ইসলামের এ মধ্যম পন্থার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মানুষ কখনো প্রবৃত্তি থেকে আলাদা হতে পারবে না, যতদিন সে আছে ততদিন তার প্রবৃত্তিও আছে, এর থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব, তাই ইসলাম তাকে প্রবৃত্তি থেকে আলাদা হতে বলেনি বরং তা নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

যেমন তাকে নারীর প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে বলেনি, বরং তাকে বিবাহের নিদের্শ দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তার চাহিদা পূরণ করার বিধান দিয়েছে। ইসলাম এক থেকে চারটি পর্যন্ত বিবাহের অনুমতি দিয়েছে। এভাবেই ইসলাম মানুষের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানব জাতিকে নৈতিক পদস্খলন, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করা। ’ (জাম্মুল হাওয়া : ৩৫ ইবনে জাওজি) যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ ও তার চাহিদা পূরণে মশগুল থাকে, সে কার্যত প্রবৃত্তির দাস ও গোলামে পরিণত হয় এবং প্রবৃত্তি তাকে গ্রাস করে নেয় সম্পূর্ণরূপে।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘পানাহার, পোশাক-আশাক, অবৈধ ভালবাসা ও গান-বাজনায় মগ্নতা মানুষকে উন্মাদ বানিয়ে দেয়। কারো অন্তরে যখন তার ভালবাসার বস্তুটির চিত্র ফুটে উঠে, তখন সে তাতেই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, এগুলো একাকার হয়ে যায় তার সত্তার সঙ্গে, যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় না তার পক্ষে। এমন হয় কখনো লোভের কারণে, যেমন সম্পদ, সম্মান ইত্যাদির জন্য। কখনো হয় ভয়ের করণে, যেমন দুশমন বা অন্য কারো আতঙ্কে আতঙ্কিত ব্যক্তির অন্তর। প্রবৃত্তির অনুসারীরা আরো অনেক কারণে পানিতে নিমজ্জিত ব্যক্তির ন্যায় প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে আপাত-মস্তক নিমজ্জিত হয়ে থাকে।

’ (মাজমুআতুল ফতওয়া : ১০ / ৫৯৪) ইমাম শাফি রহ. বলেছেন, ‘যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে, সে প্রকারন্তরে দুনিয়াদার লোকদের দাসে পরিণত হবে। ’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১০ / ৯৭) নফসের নিয়ন্ত্রণহীন অনুসরণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও সুস্থ্য বিবেক উভয়ের আলোকেই নিন্দিত ও পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا ﴿مريم ‘তাদের পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। ’ (মারইয়াম : ৫৯) তদ্রƒপ সুস্থ্য বিবেকের বিচারেও তা ঘৃণ্য ও নিন্দিত।

কারণ, বিবেকবান কাজ হচ্ছে কর্মের ভাল-মন্দ বিচার করা, অস্থায়ী স্বাদ ও আনন্দের বিপরীতে স্থায়ী দুঃখ ও কষ্ট খরিদ না করা। কাজেকাজেই একজন বিবেকবান কোনভাবেই পার্থিব সুখ-দুঃখের মোকাবিলায় আখেরাতের সুখ-দুঃখকে প্রধান্য দিতে পারে না। ইবনে জাওজি রহ. বলেন, ‘মনে রেখো, নফসের প্রকৃতি হচ্ছে দূর ভবিষ্যৎ বা ভাল-মন্দ বিচার না করে বর্তমান ভোগ ও আনন্দের প্রতি প্ররোচিত করা, তাকে প্রধান্য দেয়া এবং তার জন্যই উদ্বুদ্ধ করা। যদিও এর পশ্চাতে থাকে দুঃখ আর লাঞ্ছনা, নিরানন্দ আর যন্ত্রণা। পক্ষান্তরে বিবেকবানরা এমনসব ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-বিনোদন পরিত্যাগ করে, যার পশ্চাতে রয়েছে দুঃখ-বিড়ম্বনা, অপমান ও লাঞ্ছনা।

এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় নফস ও বিবেকের পার্থক্য, বুদ্ধিমান ও নির্বোধের মধ্যকার তফাৎ। দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার, তাই এর সবর্ত্র প্রবৃত্তির বিচরণ থাকাই স্বাভাবিক। তবে বিবেকবানের কর্তব্য হচ্ছে প্রতিটি বিষয় গ্রহণ ও বর্জনের জন্য বিবেকের শরাণপন্ন হওয়া এবং বিচারের ভার তার ওপর ন্যস্ত করা। কারণ বিবেক তার বিবেচনায় অস্থায়ী সুখের পরিবর্তে স্থায়ী সুখ গ্রহণ করার পরামর্শ দিবে, এবং যার মাধ্যমে আখেরাতের স্থায়ী সুখ, শান্তি নিশ্চিত হবে তাই গ্রহণ করার জন্য বারবার তাগিদ দিবে। ’ (জাম্মুল হাওয়া ৩৬, ইবনে জাওজি) ‘একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, নফসের প্ররোচনা, উত্তেজনা, চাকচিক্য-প্রীতি ও তার আসক্তিকে তখনই কঠোরভাবে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যখন নফসের প্রায়শ্চিত্ত তথা আফসোস, পরিতাপ, হতাশা ও যন্ত্রণা সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি রাখবে ও সে ব্যাপারে চিন্তা করবে।

ইবনুল কাইয়ূম রহ. বলেন, ‘প্রবৃত্তির প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করার চেয়ে প্রবৃত্তি দমন করাই সহজ। কারণ, প্রবৃত্তির প্রায়শ্চিত্ত খুবই নির্মম ও বেদনাদায়ক। হয়তো অফসোস, হয়তো হতাশা কিংবা অসম্মান। কখনো সম্পদ বঞ্চিত হওয়া, কখনো পদচ্যুতি কিংবা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। আবার অধস্তন ব্যক্তিদের তিরস্কার বা নিন্দার পাত্রে পরিণত হওয়াও কম কিসের!? যা কল্পনাতেও স্থান পায়নি কখনো।

অধিকন্তু অন্তরের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, বিষাদ-দুশ্চিন্তা আর ভয় ও শঙ্কা তো রয়েছেই। ন্যূনতম পক্ষে প্রবৃত্তির ফলে তুলনামূলক বিনোদন থেকে মাহরুম হওয়া, শত্র“র খুশির কারণ হওয়া, শুভাকাঙ্খীদের দুশ্চিন্তায় লিপ্ত হওয়া, অথবা কলঙ্গের চাপ মাথায় নিয়ে বেচে থাকায় মঙ্গল কোথায়!? কারণ, কর্মের দ্বারাই মানুষ সৎ-অসৎ ও ভাল-মন্দ হিসেবে বিবেচিত হয়, বরং কর্মই তার ফল নির্ধারণ করে দেয়, তাই প্রবৃত্তি তাড়িত কর্মের ফলাফল চিন্তা করে প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া না দেয়াই হচ্ছে বিবেকবান কাজ। ’ (আল ফাওয়ায়েদ : ১৩১) নারী প্রীতি : নারী প্রীতি : ব্যাপক অর্থে যৌনতা বা যৌনকামনা বুঝায়। শুধূ মুসলমানদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যায় যে, কি পরিমাণ যৌন উন্মত্ততার বিস্তার ঘটেছে, কি পরিমাণ প্রবৃত্তির উন্মাদনায় ডুবে আছে মুসলিম যুবকরা। তারা ডিশ আর ইন্টারনেট নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত, রাতের পর রাত পার করে দিচ্ছে শুধু অশ্লীল ও নগ্ন ছবি দেখে দেখে, আবার প্রবৃত্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে চলেছে দূর-দূরান্তে তথা বেহায়া ও অশ্লীলতাপূর্ণ স্পটে।

এদিকে মানুষ ও জ্বীন জাতির কুচক্রি একটি দল আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমেছে মুসলমান যুবকদের চরিত্র ও ইসলামি শিষ্টাচার ধ্বংস করার নিমিত্তে। তারা যে কোন মূল্যে মুসলমানদের মধ্যে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার বিস্তার ঘটাতে চায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَاللَّهُ يُرِيدُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَيُرِيدُ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الشَّهَوَاتِ أَنْ تَمِيلُوا مَيْلًا عَظِيمًا ﴿النساء:২৭﴾ ‘আর আল্লাহ চান তোমাদের তওবা কবুল করতে। আর যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা প্রবলভাবে (সত্য পথ থেকে) বিচ্যুত হও। ’ (নিসা : ২৭) একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, প্রবৃত্তির উন্মদনার কোন শেষ নেই।

যে ব্যক্তি দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত সে কোন দিন দুনিয়া দ্বারা পরিতৃপ্ত হবে না। হাদীসে এসেছে, যদি কোন মানুষের স্বর্ণের দু’টি উপত্যকা থাকে, সে তৃতীয় আরেকটি উপত্যকার অনুসন্ধানে প্রয়াসী হবে, মাটি ছাড়া অন্য কোন জিনিস তার উদর পূর্ণ করতে পারবে না। তদ্রুপ যে ব্যক্তি হালাল-হারাম বিচার না করে কাম লিপ্সায় মত্ত, সেও কোন দিন পরিতৃপ্ত হবে না, কখনো মিটবে না তার চাহিদা। শায়খ আলী আত-তানতাবি বলেন, ‘তুমি যদি কারুনের ন্যায় সম্পদের মালিক হও, বাদশাহ হিরাকলের মত বিশাল দেহের অধিকারী হও আর তোমার অধীনে থাকে প্রত্যেক রঙ্গ, জাত-পাত ও সৌন্দর্যের দশ হাজার রূপসী নারী, তবু তোমার অন্তর তাতে তৃপ্ত হবে না এবং সেসবকে তুমি নিজের জন্য যথেষ্টও মনে করবে না। আমি এ কথা খুব জোড় গলায় বলতে পারি, বরং স্বর্ণাক্ষরেও লিখে রাখতে পারি।

তবে হালাল একজন নারীই তোমার জন্য যতেষ্ট হবে, এ জন্য কোন দলিলের প্রয়োজন নেই, বরং তোমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চতুর্পাশ্বে-ই রয়েছে এর হাজারো নজির। ’ (ফতওয়া তান তাবি : ১৪৬) ইবনুল মুকফে রচিত আদাবুল কাবিরে রয়েছে, ‘স্মরণ রেখ, নারীপ্রেম ও নারীপ্রীতি দীন খতম করে, স্বাস্থ্য ও সম্পদ বিনষ্ট করে, জীবনের ওপর কলঙ্কের ছাপ নিয়ে আসে, ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ ও মর্যাদার পতন ঘটায়। কী অদ্ভুত! একজন সুস্থ্য বিবেকবান ব্যক্তি দূর থেকে চাদরে লেপটানো এক নারীকে দেখে, অতঃপর হৃদয়ে তার রূপ ও সৌন্দর্যের ছবি অঙ্কন করে, এক পর্যায়ে তার প্রেমে পড়ে যায়, অথচ তাকে সে দেখিনি, তার সম্পর্কে কিছু শোনেনি! কখনো তার সঙ্গে অবৈধ বাসনা পূরণ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়, তবুও তার স্বাদ মিটে না, বিরত থাকে না সে অন্য নারীদের থেকে! অথচ তারাও তো দৈহিক গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এ নারীর ন্যায়ই। বরং, অনাস্বাদিত প্রতিটি নারীর জন্য তার অন্তর থাকে অস্থির, উদ্গ্রীব। এমনকি যদি পৃথিবীর বুকে একটি নারীও অবশিষ্ট থাকে, তার ব্যাপারেও তার কৌতুহল শেষ হবে না।

সে আরো ভাবতে থাকে, এর ভেতর রয়েছে আলাদা স্বাদ, যা অন্য নারীদের মধ্যে ছিল না। এখানেই তার নির্বুদ্ধিতা, মূর্খতা ও বোকামি। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় সে কপাল পোড়া, হতভাগা। ’ এ পার্থিব জগতে পুরুষের জন্য সব চেয়ে ক্ষতিকর বস্তু ও পরীক্ষার জিনিস হচ্ছে নারী। রাসূল সা. বলেন, ‘আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীরাই হবে পরীক্ষার বস্তু।

’ (মুসলিম) আল্লাহ তাআলা বলেন, وَخُلِقَ الْإِنْسَانُ ضَعِيفًا ﴿২৮﴾ ‘আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দূর্বল করে। ’ (নিসা : ২৮) এর ব্যাখ্যায় ইমাম তাউস রহ. বলেন, ‘নারীর প্রতি দৃষ্টি পড়লে পুরুষরা দূর্বল তথা ধৈর্য হারা হয়ে যায়। ’ ইবনে আব্বাস রহ. বলেন, ‘আগের যুগে মানুষ নারীদের কারণে কুফরে লিপ্ত হয়েছে, পরবর্তী যুগেও নারীদের কারণে কুফরে লিপ্ত হবে। ’(জাম্মুল হাওয়া : ১৭৯) নিম্নে আমরা দু’টি ঘটনার উল্লেখ করছি, যার দ্বারা নারীর প্রেমে পড়ে পুরুষদের কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার একটি চিত্র ফুটে উঠবে। প্রথম ঘটনা : আবুল ফারাজ ইবনে জাউজি রহ. বলেন, আমি একটি ঘটনা শুনেছি, বাগদাদে একজন ব্যক্তি ছিল, যে মানুষের নিকট ‘সালেহ-মুয়াজ্জিন’ (নেককার-মুয়াজ্জিন) হিসেবে পরিচিত ছিল।

চল্লিশ বৎসর সে আজানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছে। চারিত্রগুনের কারণে জন-সমাজে সৎ, নীতিবান ও ভাল লোক হিসেবে খুব প্রসিদ্ধি ছিল তার। একদা সে আজান দেয়ার জন্য মসজিদের মিনারায় ওঠে, মসজিদের পাশেই ছিল এক খৃষ্টান ফ্যামিলি, সে বাড়ির এক মেয়ের ওপর তার দৃষ্টি পড়ে, আর এতেই সে তার প্রেমে মগ্ন হয়ে যায়। মিনারা থেকে নেমেই সে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দরজার কড়া নাড়া দিল। মেয়েটি বলল, কে ? সে বলল, আমি সালেহ-মুয়াজ্জিন।

দরজা খুলে দিল মেয়েটি। ঘরে প্রবেশ করে সে তাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটি বলল, তোমরা না সৎ! চরিত্রবান!! আমানতদার!!! তুমি একি করছ ?! সে বলল, যদি তুমি আমার কথায় সাড়া দাও, ভাল; অন্যথায় আমি তোমাকে হত্যা করব। মেয়েটি বলল, তুমি নিজ ধর্ম ত্যাগ না করলে আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারব না। তৎক্ষনাৎ সে বলল, আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করলাম, মুহাম্মদের আনীত সমস্ত বিধান থেকে মুক্ত হলাম।

অতঃপর সে মেয়েটির নিকটবর্তী হল। মেয়েটি বলল, তুমি ছলনা করছ, কার্যসিদ্ধির জন্য এ কথা বলছ, পরে তুমি নিজ ধর্মে ফিরে যাবে, যদি সত্য বলে থাক, শূকরের গোস্ত ভক্ষণ কর, সে তাতেও রাজি হল, শূকরের গোস্ত ভক্ষণ করল। মেয়েটি বলল, মদ পান কর, সে তাও করল। যখন তার ভেতর মদের ক্রিয়া শুরু হল, সে মেয়েটির কাছে এল, মেয়েটি একটি রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল। আরো বলল, তুমি ছাদে চড়, আমার আব্বার আসার অপেক্ষা কর, সে এসে বিয়ে পড়িয়ে দেবে।

সে ছাদে উঠে এবং সেখান থেকে পড়ে মারা যায়। মেয়েটি বের হয়ে একটি কাপড় দিয়ে তার মরদেহ ডেকে রাখে। মেয়েটির পিতা এসে এ ঘটনা অবহিত হলে, মৃত দেহটি রাস্তায় ফেলে রাখে। পরদিন ঘটনা জানাজানি হয়, অতঃপর লোকেরা তার দেহ ডাষ্টবিনে ফেলে দেয়। ’ (জাম্মুল হাওয়া : ৪০৯) দ্বিতীয় ঘটনা : হাফেজ ইবনে কাসির রহ. ইমাম জাউজির বরাত দিয়ে বলেন, আবদাহ বিন আব্দুর রহিম নামে এক মুজাহিদ ২৭৮ হিজরি সনে মারা যায়।

যার সম্পর্কে শ্র“তি রয়েছে যে, সে অধিকাংশ সময় ইউরোপের বিরুদ্ধে জেহাদে ব্যস্ত থাকত। একবারের ঘটনা, মুজাহিদগণ ইউরোপের একটি দেশ ঘেরাও করে রেখে ছিল, দূর্গের ভেতর অবস্থানকারী এক নারীর প্রতি তার দৃষ্টি পড়ল, আর এতেই সে তার প্রেমে পড়ে যায়। আরম্ভ হল চিঠির আদান-প্রদান, সে তাকে লিখল আমি তোমাকে কীভাবে পেতে পারি ? সে বলল, তুমি খৃষ্টান হও আর দেয়াল টপকে আমার কাছে চলে এসো, সে তাতে সাড়া দিল। বিষয়টি মুসলমানদের খুব ভাবিয়ে তুলল, বরং, আতঙ্কিত করল। সকলেই মর্মাহত হল, অনেক আফসোস করল, কঠিন মনে হল তাদের কাছে তার ঘটনাটি।

কয়েক বৎসর পর তার সাথে একদল মুজাহিদের সাক্ষাত। তারা দেখতে পেল, তখনও সে ঐ মহিলার সাথে সংসার করছে, তারা জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার ? কোথায় গেল তোমার কুরআন? আর তোমার আমল, রোজা, জেহাদ ও নামাজের খবর কি ? সে বলল, আমি পূর্ণ কুরআন ভুলে গেছি, শুধু একটি আয়াত আমার মনে আছে, رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ. ذَرْهُمْ يَأْكُلُوا وَيَتَمَتَّعُوا وَيُلْهِهِمُ الْأَمَلُ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ ﴿الحجر:২-৩﴾ ‘যারা কুফরি করেছে তারা একসময় কামনা করবে, যদি তারা মুসলমান হত! তাদেরকে ছেড়ে দাও, আহারে ও ভোগে তারা মত্ত থাকুক এবং আশা তাদেরকে গাফেল করে রাখুক, আর অচিরেই তারা জানতে পারবে। ' (সূরা হিজর : ২-৩) সে আরো জানাল, এখন তো আমার তাদের মধ্যে অনেক সন্তান ও সম্পদ হয়েছে। ’ (আল বেদায়া : ১১ / ৬৪) বিভিন্ন কারণে মানুষ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় জড়িয়ে পড়ে, নিমজ্জিত হয় তাতে আপাদ মস্তক। যার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে গান-বাদ্য।

মূলত গান-বাদ্য হচ্ছে যেনা ও অশ্লিলতার মন্ত্র। ইয়াজিদ ইবনে ওলিদ বলেন, ‘হে উমাইয়্যা সম্প্রদায়, গান-বাদ্য থেকে বিরত থাক। কারণ, গান-বাদ্য লজ্জা খতম করে দেয়, প্রবৃত্তির উত্তেজনা বৃদ্ধি করে ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট করে। এগুলো নেশার মত, নেশার মতই এর কাজ, যদি কখনো তোমাদের এগুলো করতে হয়, তবে নারীদের দূরে রাখ। কারণ, গান যিনার প্রতি প্রলুব্দ করে।

ইবনে কাইয়ূম রহ. বলেন, একটি প্রবাদ রয়েছে : মেয়েদের যখন ছেলেরা ফাঁদে ফেলতে না পারে, তখন তাদের গান শোনায়, যার ফলে তাদের অন্তরে এক ধরণের দুর্বলতার সৃষ্টি হয়। কারণ, মেয়েরা আওয়াজ শোনে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল হয়, আর সে আওয়াজ গানের হলে তাদের অন্তরে দু’ভাবে বিশেষ ক্রিয়ার সৃষ্টি করে : আওয়াজের দ্বারা, গানের অর্থের দ্বারা। এ জন্যই রাসূল সা. আনজাসা হাদিয়াকে বলেছেন, ‘হে আনজাসা, নারীদের সঙ্গে ধীরে চল নীতি গ্রহণ কর। ’ (বুখারী, মুসলিম) এর সঙ্গে যদি ঢোল-তবলা, বাদ্যযন্ত্র ও সুন্দরী নারীদের নাচ-গান ইত্যাদি জমা হয়, তবে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীরা যদি কোন আওয়াজের মাধ্যমে গর্ভ ধারণ করতে সক্ষম হত, তবে সে আওয়াজ গানেরই হত।

আল্লাহর শপথ, কত শালীন নারী শুধু গানের কারণে ব্যভিচারীনি হয়েছে! কত ভদ্র ছেলে এ গানের কারণে শিশু-কিশোরীদের দাসে পরিণত হয়েছে! কত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি গানের কারণে রুচিহীন ও অপধার্থে পরিণত হয়েছে! কত নিষ্পাপ আদম সন্তান গানের কারণে নানা মুসিবতের শিকার হয়েছে! যার কোন ইয়ত্তা নেই। সব চেয়ে ক্ষতিকর জিনিস হচ্ছে হারাম দৃষ্টি। বাজার, সিনেমা, টিভি, ইন্টারনেট, ডিশলাইন ও অশ্লীল ম্যাগাজিনে এ দৃষ্টির ফলেই অন্তরে অনেক ফেৎনার সূচনা হয়েছে, যা শেষ হয়েছে অফসোস, লাঞ্ছনা ও চরম অপমানের মাধ্যমে। ইমাম আহমদ রহ. বলেন, যেখানে দৃষ্টি পড়লে ফেৎনার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে দৃষ্টি না দেয়াই শ্রেয়, যেহেতু অনেক দৃষ্টিই ব্যক্তির অন্তরে ভূমিকম্পনের ঝড় তুলেছে। ’ (জাম্মুল হাওয়া : ১১৬) ইবনে জাওজি রহ. যথেচ্ছাচারী দৃষ্টি সম্পর্কে বলেন, ‘জেনে রেখ, চোখ অন্তরের বার্তাবাহক, সে বাইরে দেখা সকল জিনিসের সংবাদ দ্রুত অন্তরের কাছে পৌঁছে দেয়, তুলে ধরে তার ছবি, আর অন্তর তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়, পরকাল নিয়ে চিন্তা করার সময় তখন আর থাকে না।

এ জন্যই আল্লাহ তাআলা দৃষ্টি অবনত রাখার নিদের্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ ﴿النور:৩০﴾ ‘মুমিন পুরুষদের বল, তারা যেন তাদের নিজ দৃষ্টিকে সংযত রাখে। ’ (নূর : ৩০) وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنّ. َ﴿النور:৩১﴾ ‘আর মুমিন নারীদেরকে বল, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে। ’ (নূর : ৩১) এর পরেই আল্লাহ তাআলা দৃষ্টির সর্বশেষ নতিজা উল্লেখ করে বলেন, وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ. ﴿৩০﴾ ‘এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। ’ (নূর : ৩০) وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ. ﴿النور:৩১﴾ ‘এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।

’ (নূর : ৩১ ) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. কু-দৃষ্টি ও তার পশ্চাতের পরিণতির আলোচনায় বলেন, কু-দৃষ্টি কখনো কখনো মানুষকে শিরকে লিপ্ত করে ঈমানহীন করে দেয়। তিনি বলেন, ‘কু-দৃষ্টি ও নারীসঙ্গের ফলে যে সগিরা গুনা হয়, কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকার ফলে তা মাফ হয়ে যায়। তবে, বারবার কু-দৃষ্টি ও নারী সঙ্গে লিপ্ত থাকার ফলে সগিরা গুনাহগুলো কবিরা গুনাহে পরিণত হয়। বরং বারবার সংঘটিত সগিরা গুনাহ হটাৎ ঘটে যাওয়া কবিরা গুনাহ থেকেও ক্ষতিকর। কারণ, বারবার কু-দৃষ্টি ও নারী সঙ্গের ফলে অন্তরে পরস্পরের সম্পর্ক ও যৌন কামনার সৃষ্টি হয়, যা হটাৎ ঘটে যাওয়া যেনার চেয়েও মারাত্বক।

আর এ জন্যই ফোকাহায়ে কেরাম সৎ সাক্ষ্য দাতাদের সম্পর্কে বলেছেন। তারাই সৎ সাক্ষ্য দাতা যাদের থেকে কবিরা গুনাহ সংঘটিত হয় না এবং যারা বারবার সগিরা গুনাহ করে না। কবিরা গুনাহ কখনো কখনো কুফরির কারণ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে। ’ (বাকারা : ১৬৫) মানুষের প্রেম-ভালবাসা মূলত আল্লাহর প্রতি মহব্বত ও তার ওপর ঈমানের দুর্বলতার প্রমাণ।

এ ধরণের মহব্বত ও ভালবাসার কারণেই লূত আলাই হিস্সলামের কাফের গোষ্ঠীর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাজিল করেন। ’ (মাজমুউল ফতওয়া : খ: ১৫, পৃ:২৯২-২৯) ইবনুল কাইয়ূম রহ বলেন, ‘চোখ অন্তরের আয়না স্বরূপ, চোখ বন্ধ করলে অন্তরও তার প্রবৃত্তির ওপর পর্দা টেনে দেয়। আর চোখ উন্মুক্ত রাখলে অন্তরও তার প্রবৃত্তি উন্মুক্ত করে রাখে। ’ তিনি আরো বলেন, অন্তরের মধ্যে কু-দৃষ্টির প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার পর, ব্যক্তি যদি দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করে এবং সাথে সাথে তার মূল উপড়ে ফেলে, তবে এর প্রতিকার করা খুব সহজ। এর বিপরীতে যদি সে বারবার তাকাতে থাকে, তার ছবি অন্তরে বারবার স্মরণ করতে থাকে, তবে তার ভালবাসা অন্তরে প্রোথিত হয়ে যাবে।

কারণ, বারবার দৃষ্টি দেয়ার অর্থ হচ্ছে কু-প্রবৃত্তির গাছটি পানি দ্বারা সিঞ্চন করা। আর এভাবেই প্রবৃত্তির গাছটি ক্রমশ বড় হয়ে একদিন তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, ভুলিয়ে দিবে তাকে নিজ দায়িত্ব। অধিকন্তু সে এর কারণে বিভিন্ন পরীক্ষা ও কষ্টের সম্মুখিন হবে, নানা অপকর্মে লিপ্ত হবে। ’ (রওজাতুল মুহিব্বীন : পৃ : ৯২-৯৫) অশান্তি ও অস্থিতিশীল পরিবেশের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। এটাই হচ্ছে সে পথ, যার দ্বারা মানুষ খুব সহজেই নির্লজ্জ, বেহায়া ও ব্যভিাচারে লিপ্ত হয়।

জিন ও মানুষ প্রকৃতির শয়তানগুলো তাদের হাতিয়ার হিসেবে এ অবাধ মেলামেশাকেই সর্বত্র ও সবখানে ব্যাপক করে চলেছে। ইবনুল কাইয়ূম রহ. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষতি সম্পর্কে বলেন, ‘নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সকল মুসিবত ও সর্বনাশের মূল। সর্বগ্রাসী মহা বিপদের একটি অশনি সঙ্কেত। অধিকন্তু তা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে এবং অনেক হত্যা, অপমৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্ম দেয়। নবি মুসা আ.-এর সৈন্যদের মাঝে কিছু বেশ্যা নারীর অনুপ্রবেশ ঘটলে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলশ্র“তিতে আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর মহামাড়ি নাজিল করেন এবং একই দিনে সত্তুর হাজার লোকের মৃত্যু ঘটান।

এটা বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থের প্রসিদ্ধ ঘটনা। সুতরাং আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি যে, মৃত্যুহার বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হচ্ছে যেনার বিস্তার ও তার প্রসার, যা সাধারণত নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শন, নগ্ন ও অর্ধনগ্নাবস্থায় নারীদের চলাফেরার কারণে হয়ে থাকে। ’ (আত্তুরুকুল হিকমিয়্যাহ : ২৫৯) প্রেম-ভালবাসা মূলত ইমানের দুর্বলতার পরিচয়। কারণ, অন্তরে যখন ইমানের উপস্থিতি কম হয়, তখনই প্রবৃত্তি ও কু-কামনা বৃদ্ধি পায়, বরং তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ’ (আল-ফাওয়ায়েদ : লি-ইবনিল কাইয়ূম-পৃ : ৭৫) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে যাদের ইখলাসপূর্ণ সম্পর্ক নেই, বরং তারা কোন না কোন শিরকে মগ্ন, তারাই সাধারণত কামভাব ও কু-প্রবৃত্তিতে লিপ্ত হয়।

আল্লাহ তার বান্দা ইউসুফ আ. সম্পর্কে বলেন, ‘এভাবেই, যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয় সে আমার খালেস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। ’ (ইউসুফ : ২৪) লক্ষ্যণীয়, আজিজের স্ত্রী স্বধবা, তা সত্বেও সে কু-কর্মের প্রস্তাব দিয়েছে, পক্ষান্তরে ইউসুফ আ. অবিবাহিত, তা সত্বেও সে তার প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করেছে। এদিকে আজিজের স্ত্রীর ফুসলানো, অন্য নারীদের দ্বারা প্ররোচিত করা, প্রস্তাবে সাড়া না দিলে জেলখানায় নিক্ষেপের হুমকি তো রয়েছেই। এতো কিছুর পরও আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক ও ইখলাসের বদৌলতে আল্লাহ তাকে হেফাজত করেছেন।

এভাবেই ইবলিসের বিপরীতে আল্লাহ তাআলা নিজ ওয়াদা পূরণ করে থাকেন। ইবলিস বলেছিল, ‘সে বলল, আপনার ইজ্জতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপদগামী করে ছাড়ব, তাদের মধ্য থেকে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া। ’ (সাদ : ৮২-৮৩) তার বিপরীতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমার বান্দাদের ওপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই, তবে পথভ্রষ্টরা ছাড়া, যারা তোমাকে অনুসরণ করছে। ’ (হিজর : ৪২) বিপদগ্রস্ত ও পথভ্রষ্ট হওয়ার অর্থই হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। ’ (মাজমূউল ফতওয়া : খ:১৫: পৃ:৪২১) নারী প্রেম ও নারী আসক্তি ইহজাগতিক ও পরজাগতিক বহু বিপর্যয়ের কারণ : ইবনে জাওজী রহ. এসব বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘নারী প্রেম ও নারী আসক্তির প্রায়শ্চিত্য বিভিন্ন প্রকার।

কখনো ভোগ করতে হয় সঙ্গে সঙ্গে কখনো দেরিতে, কখনো প্রকাশ পায় কখনো তা পায় না। আবার এর কিছু শাস্তি রয়েছে যা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেও বুঝতে সক্ষম হয় না। তবে সব চেয়ে বড় শাস্তি হচ্ছে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও ইমান বিলুপ্ত হওয়া। নারী আসক্তি ও গুনাহের কারণে অন্তর মরে যায়, যার ফলে সে আল্লাহর সঙ্গে মুনাজাতের স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হয় না, পবিত্র কুরআন তার অন্তরে অবস্থান করে না। এস্তেগফারসহ অন্যান্য এবাদত তার কাছে অর্থহীন মনে হয়।

আরো অনেক ধর্মীয় অবক্ষয় রয়েছে, যা তাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নেয়, যা সে অনুধাবনও করতে পারে না। তার অন্তরের দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত হয় গুনাহের অন্ধকার, নষ্ট হয়ে যায় তার অন্তর দৃষ্টি, যার প্রভাব পড়ে তার শরীরেও। যেমন, চোখের দৃষ্টি চলে যায়, স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে ইত্যাদি। তাই অন্তরের মধ্যে গুনাহের আসক্তি উপলব্দি করার সাথে সাথে তওবা করা, হয়তো এর দ্বারা আসন্ন বিপদ দূরীভূত হয়ে যাবে। ’ (জাম্মুল হাওয়া : ২১৭) অবৈধ ভালবাসা সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন, ‘নারী কিংবা ছোট বাচ্চাদের আসক্তি ব্যক্তিকে এমন বিপর্যয়ে নিপতিত করতে পারে, যার থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা কারো নেই।

এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ, তার পূন্যের ভাণ্ডার একেবারে শূন্য হয়ে যায়। প্রথম পর্যায়ে কারো অন্তরে কোন চেহারার আসক্তি সৃষ্টি হলে, দ্বিতীয় পর্যায়ে সে তার ভালবাসায় মগ্ন হয়ে যায়। যার ফলশ্র“তিতে সে আস্তে আস্তে নানা অপকর্ম ও অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে, যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে সব চেয়ে বড় মসিবত হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়া। কারণ, বান্দা যখন আল্লাহর এবাদত ও তার প্রতি নিবিষ্ট চিত্ত থাকে, তখন তার কাছে আল্লাহর মহব্বতের চেয়ে মধুর ও সুখকর কোন জিনিস হতে পারে না।

’ (মাজমুউল ফতওয়া : খ ১০, পৃ : ১৮৭) তিনি আরো বলেছেন, গুনাহের প্রতি আসক্তি অন্তরের অন্যতম ব্যাধি, যা উন্মাদনার জন্ম দেয়। লুত আ.-এর জাতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার জীবনের কসম, নিশ্চয় তারা তাদের নেশায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ’ (হিজর : ৭২) বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘চোক্ষুদ্বয়ও যেনা করে, চক্ষুর যেনা হচ্ছে দৃষ্টি। ’ অনেকেই প্রবৃত্তির তাড়নায় পরনারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়, তাদের কথা শ্রবণ করে ও তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে চায়। আবার কেউ এর চেয়ে অগ্রগামী হয়ে র্স্পশ, চুম্মুন ও সংঘ লাভ করতে চায়।

এসব কিছুই নিষিদ্ধ ও হারাম। এসব লোকদের ওপর শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাদের নমনীয় হতে ও দয়া দেখাতে নিষেধ করেছেন। (মুসলমানদের সরকার না থাকলে বা তাদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা না থাকলে) সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা, তাদেরকে এ থেকে নিষেধ করা ও তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা। অতএব যেনার এসব প্রাথমিক কার্যাদি ও যেনার অন্যান্য সকল উপায়-উপকরণ ত্যাগ করা, তার থেকে দূরে থাকা সবার জন্য একান্ত জরুরি। ’ (মাজমুউল ফতওয়া : খ : ১৫ পৃ : ২৮৮, ২৮৯) ইবনুল কাইয়ূম রহ. যেনা-ব্যভিচারের ক্ষতি, বিপর্যয় ও সর্বনাশ সম্পর্কে তার লেখার অনেক জায়গায় আলোকপাত করেছেন।

তিনি একজায়গায় বলেন, ‘যেনা-ব্যভিচার সকল অপকর্ম ও অনিষ্টের মূল। ব্যক্তির দীনদারী, কৌলিণ্য, সুস্থ রুচিবোধ ও আত্মমর্যাদা সব নিঃশেষ করে দেয় এ অপকর্মটি। ব্যভিচারীর মধ্যে দীনদারী, ওয়াদা রক্ষা ও সততা থাকে-না বললেই চলে। আরো কিছু ক্ষতিকর দিক হচ্ছে : আল্লাহর নিদের্শ অমান্য করা ও তার সৃষ্ট প্রকৃতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। নিজ চেহারা কলুষিত করা এবং নিজকে চিন্তা ও পেরেশানীর ঘাটে উপস্থিত করা।

এর ফলে ব্যক্তির অন্তর কালো হয়, অন্তরদৃষ্টি লোপ পায়, সম্মানহানী ঘটে, আল্লাহ ও মানুষের সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়, ভাল উপাধির পরিবর্তে খারাপ উপাধিতে তাকে ডাকা হয়, তার অন্তর সংকীর্ণ ও কোনঠাসা হয়ে যায়, অনেকে সময় সে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। সে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে চায়, অথচ আল্লাহর নিকট হতে শান্তি একমাত্র তার আনুগত্যের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব, তার অবাধ্যতা কখনো কোনো কল্যান বয়ে আনতে পারে না। ’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৩৬০) তিনি আরো বলেন, ‘কর্ম অনুযায়ী ফলাফল দেয়া হয়। যে হারাম অশান্তির কারণ, সে হারামে লিপ্ত ব্যক্তি অশান্তি থেকে মুক্ত হতে চাইলেও মুক্ত হতে পারবে না, বরং তার আরো অশান্তি বৃদ্ধি পাবে। মৃত্যুর পরেও তার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা হবে কবরে ও আখেরাতে।

সহিহ বোখারিতে সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত হাদিসের কিছু অংশে বলা হয়েছে, রাসূল সা. বলেন, ‘... রাতে দেখলাম দু’জন ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং আমাকে ঘর থেকে বের করে তাদের সাথে নিয়ে চলল, হটাৎ চুলোর আকৃতির মত একটি ঘর দেখলাম, ওপরের অংশ সরু মাঝখানের অংশ খুব প্রসস্ত, তার নিচে আগুন জ্বলছে, ভেতরে উলঙ্গ নারী ও উলঙ্গ পুরুষ। যখন আগুন প্রজ্বলিত হয়, তারা আগুনের সঙ্গে ওপরে উঠে যায়। মনে হয়, এই যেন তারা বাইরে ছিটকে পড়ল। আগুন নিস্তেজ হলে আবার তারা নিচে চলে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম : এরা কারা? উত্তর দিল, এরা ব্যভিচারী।

’ একটু চিন্তা করে দেখুন, দুনিয়ার অবস্থা ও পরকালের শাস্তির সাথে কি মিল! দুনিয়াতে তারা তওবা সত্বেও ফিরে আসতে পারত না, গুনা ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করেও তা রক্ষা করতে পারত না, প্রবৃত্তির লালসা মুক্ত হতে চেয়েও মুক্ত হতে পারত না, পুনরায় তাতে নিমজ্জিত হয়ে যেত, তাদের শাস্তিও সেরূপ হচ্ছে, দোজখ থেকে বের হওয়ার পথে এসেও বের হতে পারছে না। বরং পুনরায় তাতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ’ (রওজাতুল মুহিব্বিন : পৃ : ৪৪২) আরেকটি জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞানী ব্যক্তিদের জেনে নেয়া জরুরি, প্রবৃত্তপূজারীগণ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, যেখানে কোনো স্বাদ তারা পায় না, তা সত্বেও তারা তা ছাড়তে পারে না। কারণ, এটা তাদের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ, যারা মাদকাসক্ত ও যেনায় অভ্।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।