আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেসবুক ব্ন্ধুদের দ্বিতীয় আড্ডা: হাকালুকির বুকে একদিন।



তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুক যেমন পরিচিত মহলকে কাছে রাখে ঠিক তেমনি অপরিচিতকে কাছে টানে। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে আমাদের প্রথম আড্ডাটি বসেছিল সিলেটের ঐতিহাসিক "আলী আমজদের ঘড়ি ঘর‌র নিচে। এখানেই আমাদের ফেসবুক বন্ধু ফেঞ্চুগঞ্জের বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার খালেদ ভাই ঘোষণা করেছিলেন আমাদের দ্বিতীয় আড্ডাটি হবে ফেঞ্চুগঞ্জের হাকালুকির হাওরে। প্রথম আড্ডার প্রায় একমাস পর গত ১৭/০৯/২০১০ খ্রি: তারিখে আমাদের এ কাঙ্খিত আড্ডার সময় ও স্থান জানিয়ে খালেদ ভাই ও লিমন ভাই তাদের ফেসবুকে স্টেটাসের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানান ফেসবুক ব্নধুদের।

সাড়া পড়ে সকলের। আমরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি নির্ধারিত তারিখের। ১৭/০৯/২০১০ খ্রি: তারিখে ফেসবুক খুলে অবাক। দেশ বিদেশ থেকে আমাদের পরিচিত অপরিচিত অনেক বন্ধুবান্ধব আমাদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আমাদের সাথে যোগ দেবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আবার কেউ কেউ দূর প্রবাসে থাকায় তাদের অনুভুতির কথা জানিয়ে আমাদেরকে শুভ কামনা করেছেন। অনেক বিদেশি নাগরিক হাকালুকি সম্বন্ধে জানতে চেয়ে মেইল করেছেন।

অনেকে সচিত্র প্রতিবেদন পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। প্রত্যেককে যতদুর সম্ভব ফিরতি মেইল বা স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তাদের উত্তর দিয়ে সকাল ১১.০০ টায় সিলেট থেকে রওনা দিলাম আমি, অবায়েল আতা, নিজাম ভাইও গুলজার ভাই। ফেঞ্চুগঞ্জ পৌছে আমরা সিলেট-৩ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর নির্মিত অত্যন্ত দর্শণীয় "দেলোয়ার আহমদ চৌধুরী জামে মসজিদে জুম‌য়ার নামাজ আদায় করলাম। তারপর ফটো্গ্রাফার খালেদ ভাইর পার্সোনাল অফিসে গিয়ে দেখি সেখানে অধীর আগ্রহে খালেদ ভাই ও লিমন ভাই অপেক্ষা করছেন আমদেরকে স্বাগত জানাতে। তারপর দক্ষিণ সুরমা থেকে আসলেন সৈয়দ পবলু ও মোরশেদ।

একে একে বন্ধুদের আসা শুরু হল। ক্রমান্বয়ে আসলেন নবীগঞ্জ থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সাহেদ খান টিটু, সিলেট এম, সি কলেজের সমাজ কল্যাণ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রণি, ইরাক প্রত্যাগত হবিগঞ্জের বিশিষ্ট বাবুর্চি আব্দুল জলিল আকাশ, ফেঞ্চুগঞ্জের শিক্ষক সাইফুল আলম রাজ্ঝাক, সিলেট পিটিআই‌এ কর্মরত সৈয়দ মোহাম্মদ আলী কবির। খালেদ ভাইর অফিসেই জমে উঠল এক অঘোষিত আড্ডা। পরিচিত পর্ব শেষে কখনো ঠান্ডা পানীয় আবার কখনো গরম চায়ের কাপে চুমুক ফাঁকে ফাঁকে আবৃত্তিকার, উপস্থাপক ও কবি গুলজার আহমদ আমাদের প্রথম আড্ডা নিয়ে তার লিখিত কবিতাখানি আমাদের আবৃত্তি করে শোনালেন। ঘড়ির কাটা যখন ৩.০০টা পেরিয়ে তখন আমরা রওনা দিলাম হাকালুকি হাওরের উদ্দেশ্যে।

খালেদ ভাই ও লিমন ভাই পূর্ব থেকেই ভাড়া করে রেখেছিলেন একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা। আমরা নৌকার ছৈ এ উঠলাম। যাত্রার প্রারম্ভে কিছু ছবি ও তুলে নিলাম। যাবার বেলা খালেদ ভাই ও লিমন ভাই দুহাত ভরে নিয়ে উঠলেন আমাদের দুপুরের খাবার, ঠান্ডা পানীয় ও আরো কত কি! সত্যিই তখন মনে এক অজানা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। নৌকাটি যখন খাল পেরিয়ে হাওরে প্রবেশ করলো তখন খালেদ ভাই ঘোষণা দিলেন এবার আমাদের খাবারের পালা।

খোলা আকাশের নিচে চলন্ত নৌকার ছৈ‌এ বসে বন্ধুদের রস রসিকতা পূর্ণ কথা বার্তার ফাঁকে ফাঁকে খাবারের কী যে মজা (!)তা বুজাবার নয়। খাবার শেষে নৌকা যখন হাকালুকির মাঝামাঝি এসে পৌছল, যখন দিগন্ত রেখায় আকাশ আর পানি মিশে একাকার মনে হল তখন মাঝিকে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন খালেদ ভাই। মুহুর্তেই পরিবেশ হয়ে উঠল নিস্তব্ধ। দিগন্ত জোড়া হাওরে এলোমেলো বাতাসে পানির উপর অবিরত মৃদু ঢেউ দেখে এক অজানা ভাল লাগায় হারিয়ে গেলাম। তন্ময় হয়ে উপভোগ করতে লাগলাম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য।

গাং চিল উড়ছে, শত শত জেলেরা নৌকা নিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত। পানির উপরের বিশাল আকাশ আরো মোহনীয়। পুরো আকাশ বুজি এক সাথে আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশাল আকাশে কোথাও সাদা মেঘের আনাগোনা তার উপর একফালি রুপালী চাঁদ, কোথাও কালো মেঘ আবার কোথাও নীলে লীলে সয়লাব। এতসব ভাল লাগার উপদান যখন একসাথে হাজির তখন মন উদাস না হয়ে পারে? হঠাৎ নিরবতা ভঙ্গ করে খালেদ ভাই ঘোষণা করলেন এবার শুরু হবে আমাদের সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই রাজনীতিবিদ নিজাম ভাইয়ের বক্তব্য। তিনি যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক কে ধন্যবাদ জানিয়ে এর মিস ইউজ না করার আহ্বান ও আমাদের আড্ডার সফলতা কামনা করলেন। তারপর ঘোষক, আবৃত্তিকার ও কবি গোলজার আহমদ আবৃত্তি করলেন কয়েকটি কবিতা। একে বারে প্রাকৃতিক পরিবেশে গুলজার ভাইয়ের ভরাট কন্ঠের আবৃত্তি শুনে পুরো যখন হাকালুকি নিস্তব্দ ঠিক তখননি ফেসবুকের আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ অবায়েল আতা গেয়ে উঠলেন "কোন মেস্তরী নাও বানাইল কেমন দেখা যায়/ ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ুর পঙ্খী নায়"। তার গানের সাথে সাথে সকলে মধ্যে কী যে উম্মাদনা! গানে সঙ্গী হলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সাহেদ খান টিটু।

ইতোমধ্যে কানাকানি। আমি চাইতেই হাসাহাসি। সবার একদফা একদাবী। আমার কন্ঠের গান তারা শুনে ছাড়বেই। কী আর করা? অনুরোধে ঢেঁকি গিলা।

শুরু করলাম "বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার কাছে আসে....." যদিও এখন বসন্ত কাল নয় তারপরও দেখলাম গান শুনে বন্ধুদের উন্মাদনা। সবাই যখন একসাথে গেয়ে চলেছে তখন আমি চুপটি মেরে বসে রইলাম। কারণ আমি যদি তাদেরকে গানে সঙ্গ দিতে যাই তাইলে সত্যিই গানের প্রতি অবিচার হবে। এভাবে হাসি ঠাট্টা তামাশায় একসময় সূ্য্যি মামা ডুবতে বসেছে। পশ্চিমাকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ।

মনে হচ্ছে সুয্যিমামা বুজি এ হাওর থেকেই উঠেন আর এখানে অস্ত যান। সূর্যাস্তের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে আমি আর খালেদ ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বন্ধুরা তখন নিজ নিজ ইচ্ছামত আনন্দ ফুর্তিতে মজে রইল। সূর্য ডুবার সাথে সাথে হাকালুকি অন্য একরূপে আমাদের মাঝে হাজির হলো। যথার্থ বিশেষণ খুজে পাচ্ছিনা আমি এসকল দৃশ্যের বর্ণনা লিখার জন্যে।

আমি নিশ্চিত কবি গুলজার ভাই তার কবিতায় তা ফুটিয়ে তুলবেন। সন্ধ্যার কিছুপর আমাদের নৌকার আবার চলতে শুরু করলো। খালেদ ভাই হাওর পারের একটি গ্রাম্য বাজার "ঘিলাছড়া"য় নাও ভিড়াতে বললেন। একসময় নৌকাটি বাজারে ভিড়ল। আমরা বাজারে নামলাম।

সেখানে গিয়ে দেখি আরো অনেক পর্যটক এসেছেন এ হাওর দেখতে। তারা অবশ্য সড়ক পথে এসেছেন শুধুমাত্র দুর থেকে হাকালুকিকে একনজর দেখার জন্যে। তাদের সাথে আমাদের কথা হল। তারা আফসোস করলেন আমাদের মতো নৌকা নিয়ে না আসায়। ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজার।

একটি দোকানে টেলিভিশন চলছে, আর ঝাঁক বেধে আবাল বৃদ্ধ বনিতা টিভি প্রোগ্রাম দেখছেন। ছোট্ট একটি চা স্টলের বাইরে বসে আমরা চা পান করলাম। কিছুক্ষণ বাজারের এপাশ অপাশ ঘুরাঘুরি করে আবার খালেদ ভাইর নেতৃত্বে নৌকায় উঠলাম। নৌকাটি আমাদের নিয়ে চলল আবারো হাওরের মাঝ দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আকাশ ভরা তারা, এক ফালি চাঁদ, মৃদুমন্দ বাতাস আর হাওরের বিশালতায় মুগ্ধ এ তরুনদের মনকে আরো একটু নাড়িয়ে দিতে টিচার রাজ্জাক ভাই গেয়ে উঠলেন একটি প্যারোডি গান-"আমার সুখ নাইরে সুখ পরানের পাখি/ বিশ বিশটা বিয়া করিয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, আমার সুখ নাইরে......." তখন কার পেটে কত হাসি! প্রিয় অবায়েল ও সাহেদ খান টিটু বাকী পথটুকু বিরামহীন গান শুনালেন।

রাত সাড়ে আটটায় আমরা ফেঞ্চুগঞ্জ পৌছলাম। আবারো খালেদ ভাইয়ের অফিসে। আবরো চা পান। আবারো কবিতা। আবারো হাসি, গান তামাশা।

কেউ কাউকে ছেড়ে যাবার তাড়া নেই। মনে হচ্ছে যেন সবাই না যেতে পারলেই খুশি। কিন্তু বাস্তবতাতো ভিন্ন। সবাইকে তো নিজ নিজ ঠিকানায় যেতেই হবে। বিদায় বেলা এক বিসন্নতা ভর করলো সবাইকে।

কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে মন চায় না। তারপরও রাত ১০.৩০ মিনেটে আমরা নিজ নিজ নীড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রিয় পাঠক, আমার এ দীর্ঘ বর্ণনা পড়ার মতো ধৈর্য হয়তো আপনাদের নেই। যারা দয়া করে আমার এ লিখাটি পড়বেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার একটি মাত্র আহ্বান আসুন আমরা তথ্যপ্রযুক্তিকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাই। অনেকের ধারণা ফেসবুক নিছক একটি সময় ব্যয়ের মাধ্যম।

আবার অনেকে ফেসবুককে "ফেকবুক" বলে থাকেন। আমরা চেষ্ঠা করছি এ অপবাদটুকু গুছিয়ে একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আমাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার। পাশাপাশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করে পরিবেশ রক্ষায় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণি ভূমিকা পালন করি। আর তথ্য প্রযুক্তি মানব কল্যাণে ব্যবহার করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.