আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেয়ের মুখে বাবার অনুভূতি : ‘একবার যদি আইভি বঙ্গভবনে ঢুকত, আমার কষ্ট কমত’

আমার আমি নাই

‘আইভি যদি একবার আমার পাশে বসে গাড়িতে করে বঙ্গভবনে ঢুকত, তাহলে আমার কষ্ট কিছুটা হলেও কমত। বঙ্গভবনে এত মানুষ, এত নিরাপত্তা; শুধু নেই আইভি। আমি আজ সব পেয়েছি; কিন্তু এসব দেখে সবচেয়ে যে বেশি খুশি হতো সে নেই আমার পাশে। তাকে আমি হারিয়েছি। ’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর অনেকবার এভাবেই আইভি রহমানকে ফিরে ফিরে পেতে চেয়েছেন মো. জিল্লুর রহমান।

নিজের অনুভূতিগুলো অকপটে বলেছেন বড় মেয়ে তানিয়া বাখ্তসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। প্রিয় আইভি নেই আজ ছয় বছর। বুকের ভেতর টনটনে ব্যথাটা বহুগুণে বেড়ে যায় সেই দিনটি ঘনিয়ে এলে, যেদিন ঘাতকের গ্রেনেডের আঘাত নিশ্চিত মৃত্যুর পথে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনসঙ্গিনীকে। গত বৃহস্পতিবারও বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় স্ত্রীর কথা স্মরণ করে বিভিন্ন সংকটে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি, আজকের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘কিভাবে ছয়টা বছর পার করলাম, বুঝতে পারিনি। সময় এত দ্রুত চলে যায়! এই তো সেদিনকার কথা, একসঙ্গে মিটিংয়ে গেলাম, অথচ কিভাবে কী হয়ে গেল।

প্রতিটি মুহূর্তে তার অভাব বুঝতে পারি। ’ কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে মাকে হারানোর পর এভাবে বাবার, নিজের ও পরিবারের সবার অনুভূতি বর্ণনা করেছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কন্যা তানিয়া বাখ্ত। নানা কথায় জানিয়েছেন মা-বাবাকে ঘিরে তাঁদের অনেক পুরনো দিনের কথা। কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানালেন গ্রেনেড হামলার মতো নৃশংসতারও। ‘বিয়ের পর মা কলেজে যেত।

আমরা তখন থাকতাম ওয়ারীতে। কলেজ থেকে মায়ের ফেরার সময় হলে বাবা বাসার গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কারণ মা প্রায়ই বাসা হারিয়ে ফেলত। বাসা ছাড়িয়ে চলে যেত অন্য পথে। ’ বলেন রাষ্ট্রপতি-কন্যা তানিয়া।

‘বাবা সব সময় চাইতেন মা টিপ পরুক। আর সেটা অবশ্যই হতে হবে কালো টিপ। মা যদি কোনো দিন টিপ না পরে বেরিয়ে পড়ত, তাহলে বাবা আবার মাকে বাসায় পাঠাতেন টিপ পরার জন্য। ’ এভাবেই তানিয়ার স্মৃতির পর্দায় হারানো দিনগুলো যেন ছায়াছবির মতো ভেসে ওঠে। তানিয়া বলে চলেন, ‘বাবা আমার মায়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন।

তিনি কোন পোশাক পরবেন, কখন ওষুধ খাবেন_সব মাকে সামলাতে হতো। মা-বাবা দুজনেরই ছিল এক অভিন্ন জগৎ। দুজন মিলে এক সত্তা। দুজনই রাজনীতি করতেন। তাঁদের জীবনে ভিন্ন জগৎ বলে কিছু ছিল না।

’ তাঁর ‘ছোট্ট মা’ কিভাবে বড় হয়ে উঠলেন, সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে তানিয়া বলেন, ‘মায়ের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল, নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়। ভাইয়ার জন্মের সময় মা ম্যাট্রিকুলেশন পরিক্ষার্থী ছিল; তাই মা প্রথম বছর পরীক্ষা দিতে পারেনি। যাহোক, পরে আমি আর ভাইয়া যখন স্কুলে যাই, মা যায় কলেজে। এটা আমাদের জন্য খুবই মজার ব্যাপার ছিল। যদিও মাকে অনেক ভয় পেতাম, তার পরও আমরা ছিলাম বন্ধুর মতো।

মায়ের সঙ্গে আমার আর ভাইয়ার বয়সের পার্থক্য খুব বেশি ছিল না। ’ মুক্তিযুদ্ধের সময় তানিয়ার বয়স ছিল ৯ বছর। তবে এখনো মনে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ‘ছোট মা’র রাতারাতি বড় হয়ে ওঠার স্মৃতি। ‘মায়ের মধ্যে প্রথম পরিবর্তন দেখতে পাই ১৯৭১ সালে। তখনই মা যেন প্রথম বাস্তবতা উপলব্ধি করে।

এর আগে মাকে জগৎসংসারের নানা জটিলতার কিছুই বুঝতে দেননি বাবা। আমাদের ছোট্ট আম্মা একধাক্কায় বড় হয়ে গেল যুদ্ধের সময়। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল ভৈরবে প্রথম পাকিস্তানি আর্মি ঢোকে। সেদিনই বাবা বাড়ি ছেড়েছিলেন। তিন-চার মাস আম্মা আমাদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছে।

’ বলেন তানিয়া। জানান, বাবা জিল্লুর রহমান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রীর হাতে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার নোট বাতিল করলে আইভি রহমানকে হাতের চুড়ি বিক্রি করতে হয়। তানিয়া বাখ্ত বলেন, ‘যেহেতু বাবার নামে সেই সময় হুলিয়া ছিল, তাই মা সেটা ব্যাংকে পরিবর্তন করতে যেতে পারেনি। বাধ্য হয়ে মা তার হাতের দুটো সোনার চুড়ি বিক্রি করেছিল আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

আগস্ট মাসের দিকে কুমিল্লার একটি বাড়িতে ছিলাম আমরা। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, মা জেগে বসে আছে। কারণ জানতে চাইলে মা আবার ঘুমিয়ে পড়তে বলেছিল। পরে শুনেছি, সাপের ভয় ছিল ওখানে। তাই মা সারা রাত না ঘুমিয়ে আমাদের পাহারা দিয়েছে।

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে আগস্ট_এ কদিনেই আমাদের ছোট্ট মা অনেক বড় হয়ে গেল। ’ মায়ের মতো রাজনীতির জগতে পা রাখেননি তানিয়া। স্বামী ও একমাত্র কন্যা তানিশা বাখ্তকে নিয়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী তিনি। তানিশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএতে বিবিএ করছেন। থাকেন গুলশানে।

তানিয়া আরও বলেন, ‘মায়ের অভাব বলে বোঝানো যাবে না। আম্মা চলে যাওয়ার পর থেকে যেন আরো বেশি বুঝি তার অভাব। চোখের আড়াল হলেও সব সময় মাকে খুঁজতাম। আজো খুঁজি, যেমন আমার মেয়ে সারা দিন আমাকে খোঁজে। নিজে মা হওয়ার পর মেয়েকে দিয়ে মায়ের অভাবটা আরো বেশি করে অনুভব করি।

’ আইভি রহমানের রাজনীতির উত্তাল জগতে ফিরে গিয়ে তানিয়া বলেন, ‘একাত্তরের পর আম্মা ১৯৭৫ সালে আবার বড় ধাক্কা খেল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কদিনের মধ্যে বাবা জেলে গেলেন। সে সময় বাবার পরিচয় জানার পর কেউ আমাদের বাসা ভাড়া দেয়নি। খালাদের বাসায় ঘুরে ঘুরে থাকতাম। আম্মা অন্য রকম মানুষ হয়ে উঠল সে সময়।

অনেক কষ্ট করেছে, কিন্তু আমাদের বুঝতে দেয়নি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আম্মার যে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সবার চোখে পড়ত, সেটা ওই সময় আমরাই প্রথম তার মধ্যে গড়ে উঠতে দেখি। ’ ‘মুক্তিযুদ্ধের পরই আম্মা আস্তে আস্তে রাজনীতিতে ঢুকে পড়ল। পঁচাত্তরের পর নিয়মিত পার্টি অফিসে যেত। কিন্তু পরিবারকে সময় দিয়েছে ঠিকমতো।

আমার আম্মা ছিল দারুণ ফ্যাশন-সচেতন, শৌখিন ও পরিপাটি। বাসার প্রতিটি জিনিস ছিল গোছালো। গোছাত নিজের হাতেই। বাসায় বাবা খুব কম কথা বলতেন আর আম্মা কথা না বলে থাকতেই পারত না। সবার সঙ্গে খুব সহজে মিশতে পারত।

’ বলে চলেন তানিয়া। ভয়ংকর ২১ আগস্টের কথা স্মরণ করে তানিয়া বলেন, ‘বাবাকে আমরা প্রথম তিন দিন কিছু জানাইনি। বাবা প্রথম শুনলেন ২৩ আগস্ট। সেদিন সন্ধ্যায় বাবা ঘণ্টাখানেক সময় আম্মার পাশে কাটান। পুরোটা সময় আম্মার চুলে হাত বুলিয়েছেন।

সেদিন রাতেই আমরা বুঝতে পারি, আম্মা আর থাকবে না আমাদের মাঝে। ২৪ আগস্ট আম্মা চলে গেল। বাবা একা হয়ে পড়লেন। আরো চুপচাপ হয়ে গেলেন তিনি। আগস্ট মাসটি এলেই তিনি কেমন যেন গভীর শূন্যতায় নির্বাক হয়ে যান।

’ তানিয়া জানান, তাঁর ছোট বোন তনিমা বঙ্গভবনে বাবার সঙ্গে থাকেন। তিনি ও বড় ভাই নাজমুল হাসান পাপন প্রতি সপ্তাহে বাবার কাছে কিছু সময় কাটান। বেগম আইভি রহমানের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক।

এরপর কেটে গেছে ছয়টি বছর। ফিরে এসেছে মায়ের আরেকটি মৃত্যুদিবস। ২১ আগস্টের দগদগে স্মৃতির পাতায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে তানিয়া বলেন, ‘যখনই চোখ বন্ধ করি, দেখি আম্মা ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে বসে আছে। পাশে কেউ নেই। আমরাও নেই।

কিন্তু কেন এমনটা হবে? আম্মা তো রাষ্ট্রবিরোধী কিছু করেনি। গিয়েছিল নিজের রাজনৈতিক আদর্শের কর্মসূচিতে অংশ নিতে। বিনা কারণে আমরা কেন মাকে হারালাম? একটা সময় তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশা করছি আমাদের আম্মার হত্যার বিচার হবে। ’

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.