আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরতি বীমা

লেখালেখির কারখানা

আসমান থেকে নেমে আসা জ্যোসনার ঢল আজ আমার ঘরে ঢুকেছে। কী সৌভাগ্য আমার। আগেও অনেকবার না বলে ঢুকে পড়েছে আমি খেয়াল করিনি। আজও আমার রেগুলার কাস্টমার দেলোয়ার এখানে এসেছিল। তার চলে যাওয়ার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে তাকিয়ে আছি চাঁদোয়ার দিকে।

দেখলাম ঘুলঘুলি দিয়ে ঘরে ঢুকেছে চাঁদের আলো। আলোর ভিতর অগুনতি ধূলা উড়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের শরীরে, মনেও কখন কীভাবে ধূলার আস্তর জমে বুঝতে পারি না। আমার সম্মান নিলামে উঠেছে অনেকদিন। নিশিকাব্যের পংক্তিমালায় আমি বেলী ফুল, রাত বাড়লে সুবাস বাড়ে, রাত ফুরালেই পতনে পতনে হয়ে উঠি পতিত।

আমার স্বামী আছে, সন্তান আছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। যখন আমার স্বামীর প্যারালাইসিস হয় তখন কেউ আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। একটা বীমা কোম্পানিতে কাজ করতাম। এজেন্ট হিসেবে।

আমার কাজ ছিল ক্লায়েন্ট ধরা, বীমা করানো। আমি এখনো কাজ করি, ক্লায়েন্ট ধরি, তবে সেটা নিজে বাঁচার জন্য। আমার পূঁজি আমার শরীর। আমি আরতি (নাম গোপন রাখলাম) আমার আলোয় প্রজ্জ্বলিত রেখেছি আমার সোনার সংসার। লোকে জানে আমি এখনো বীমা অফিসে কাজ করি।

ভুল অবশ্য তারা জানে না, কারণ আমার এই পেশাই তো বাঁচিয়ে দিয়েছে আমার দুই সন্তান আর পঙ্গু স্বামীর জীবন। যখন সত্যিকারের বীমা কোম্পানিতে কাজ করতাম তখন নিজের পরিবারের বীমা আমি করিনি। স্বামী যখন পঙ্গু হলো তখন বুঝলাম আমি বীমাহীন, আমার সন্তানেরা নিরাপত্তাহীন, অকুল সাগরে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। পল্লী সমিতি থেকে ঋণ নিলাম, স্বামীর অপারেশন করালাম। কিন্তু ঘরের চারটি মুখে আহার জুটবে কী করে।

মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। যে চাকুরী করি তাতে তো এই জঞ্জাল টানা সম্ভব না। কাজের খোঁজে, বাড়তি আয়ের আশায় গিয়ে জুটলাম মিনু আপার কাছে। উনি আমাকে সাহস দিলেন, ভরসা দিলেন। তিনি বললেন, আমি থাকতে তোমার চিন্তার কিছু নেই।

আসলেই তিনি আমার সমস্ত চিন্তাকে টুটি চেপে হত্যা করেছেন। আমি তার বাড়িতে দর্জির কাজ করা শুরু করলাম। মিনু আপা আমাকে মেশিন কিনে দেবে বলে আশ্বাস দিল। কিন্তু একদিন এক ঘটনা আমার পুরো জীবনকেই পাল্টে দিল। মিনু আপা বললো, আরতি আমি আজ রাতে বাড়িতে ফিরবো না।

আমার মা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি, হাসপাতালে থাকতে হবে। তুমি যদি আজ আমার এখানে থাকো তাহলে আমার খুব উপকার হয়। আমি ভাবলাম এ আবার এমন কী, আমি রাজি হয়ে গেলাম। মিনু আপা যাওয়ার আগে বলল কেউ একজন আসতে পারে, তাকে যেন আপ্যায়ন করি। রাত তখন ১০ টা কি সাড়ে ১০টা।

দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে, নেড়েই যাচ্ছে। দরজা খুলে দেখি একজন আধা বয়সী লোক। গা থেকে ভুর ভুর করে আতরের গন্ধ বের হচ্ছে, পানের রসে মুখ লাল টকটক করছে। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবীর ভিতর দিয়ে স্যান্ডো গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। দশটি আঙুলে বারোটি আঙটি।

লোকটি ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। আমার আর বুঝতে বাকী রইল না কী ঘটতে যাচ্ছে। মিনু আপাকে ঘটনা খুলে বললে সে বলে, ব্যাপারটা অত খারাপ করে দেখছো কেন। না খেয়ে কে মরতে চায়! যার উপর ভরসা করেছিলাম সেই মিনু আপা আরো বলে, আমি চাইলে সে আমাকে আরো ভাল ভাল খদ্দের দিতে পারে। সামান্য বীমার কমিশনে আমার সংসার চলে না।

না বলি, তারপর কখন সে না হ্যাঁ হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। সময়ে সময়ে কত ধূলা জমলো তার কি হিসাব আছে, জানিনা, হিসাব করতে গেলে মাথা ঘোরায়, বমি আসে। কিন্তু এই পেশার যে ঝুঁকি তা আমি প্রথম জানতে পারি খুলনার রূপসা ডিআইসি থেকে। কীভাবে নিরাপদ যৌন সম্পর্ক করা যায়, কীভাবে যৌনব্যাধি থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায় এসব জানতে পারি। বিভিন্ন কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, সভায় অংশ নিয়ে আমি শিখেছি এইচআইভি/এইডস কী, কেন হয়, কীভাবে এর রাহু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

আমি এখন দুর্জয় নারী সংঘের সদস্য। মানুষের কাছে নষ্ট জীবনেরও যে মূল্য আছে জানতে পেরে ভালো লাগে। আমি এখন জানি আমার জীবনের মূল্য কতটুকু, সুস্থ আমাকে থাকতেই হবে, আমিই তো আমার পরিবারের বীমাস্কিম। জীবনে বেঁচে থাকতে, পরিবারের জীবন রক্ষার্থে যে ঝুঁকিপূর্ণ, অসম্মান আর সমাজের কাছে ঘৃণিত পেশায় নিজেকে যুক্ত করেছি সেটার জন্য তো আমি দায়ী না তবুও মনে ছিল সেই পীড়ন। আমারও এখন বেঁচে থাকার মধ্যে আশা আছে, জীবনের প্রতি ভালোবাসা আছে।

আমি মানুষ, আমারো আছে নিরাপদভাবে, সুস্থতার সাথে জীবন যাপন করার অধিকার। লেখক: মুবিনুর রহমান

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।