আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের গ্রাম পাঞ্চাইত

নাজমুল ইসলাম মকবুল

নাজমুল ইসলাম মকবুল ‘‘আমাদের গ্রাম্য সালিশী বিচার : একাল ও সেকাল’’ শিরোনামে গ্রাম বাংলার সালিশী বিচার ব্যবস্থার ইতিবাচক ও নেতিবাচক এবং সেকাল ও একালের সালিশী বিচারের যে সংপ্তি চিত্র তুলে ধরেছিলাম তা ভিলেজ ডাইজেস্ট, মাসিক আল-ফারুক, সিরাতাল মুস্তাকীম, অলংকার সহ বেশ কয়েকটি পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর সম্মানিত পাঠকদের যথেষ্ট সাড়া পাই, তবে এ পর্যন্ত কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ‘মাসিক বিশ্বনাথ ডাইজেস্ট’ এ ধারাবাহিক ‘‘চিরায়ত বাংলা-৮’’ লিখতে গিয়ে অনেকগুলি বিষয়ের শিরোনাম সামনে এসে ঘুরপাক শুরু করলেও ‘‘আমাদের গ্রাম পাঞ্চাইত’’ শিরোনামটাই অগ্রাধিকার পায়। ‘‘আমাদের গ্রাম্য সালিশী বিচার ঃ একাল ও সেকাল’’ ও ‘‘আমাদের গ্রাম পাঞ্চাইত’’ শিরোনাম দুটি ভিন্ন হলেও বিষয়আশয়ের মিল আছে অনেকটা। তবে গ্রাম পাঞ্চাইতে আরও অনেক রসম রেওয়াজ বা বিষয়আশয় আছে যা প্রায় সকলেরই জানা। আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব তাই সমাজবদ্ধ হয়েই মানব জাতীর বসবাস বিশ্বজুড়ে।

তবে বিশ্বের দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে এমনকি এলাকাভেদেও সমাজবদ্ধতার রকমফের দৃষ্টিগোচর হয় ব্যাপকভাবে। একমাত্র ইসলাম ধর্মেই সামাজিক বন্ধনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং গোটা বিশ্বে একমাত্র মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করেন এবং করছেন। এর মধ্যেও বাংলাদেশে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার প্রবণতা সর্বাধিক বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের সিংহভাগ মানুষ মুসলমান। তাই দেশের প্রতিটি গ্রামেই মসজিদ রয়েছে।

বড় গ্রাম বা পাড়ায় একাধিক মসজিদ রয়েছে এবং শহরাঞ্চলে রয়েছে অনেকগুলি মসজিদ। মসজিদ ভিত্তিক পাড়া বা গ্রাম পাঞ্চাইত গড়ে উঠে সুদুর প্রাচীনকাল থেকে। এক কথায় এদেশে মুসলমানদের বসতী গড়ে উঠার সাথে সাথে লোকালয়ে গড়ে উঠে মসজিদ আর মসজিদকে কেন্দ্র করেই গঠন করা হয় গ্রাম পাঞ্চাইত। সে রেওয়াজ আজও অব্যাহত রয়েছে যা আমাদের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য বলা চলে। বর্তমানে আমাদের দেশের বিশেষ করে সিলেটী প্রবাসীরা বৃটেন সহ বিভিন্ন দেশে মসজিদ নির্মাণ করে মসজিদ ভিত্তিক কিছু কর্মকান্ড অত্যন্ত সফলতার সাথে পালন করছেন যা অনেকটা আমাদের দেশের গ্রাম পাঞ্চাইতের আদলেই পরিচালিত হচ্ছে।

আমাদের গ্রাম পাঞ্চাইতের চমৎকার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন পাড়া বা গ্রামে কোন ঝগড়া ঝাটি মারামারি হলে গ্রাম্য মুরব্বীয়ানরা সালিশ বিচার বা আপোষ নিস্পত্তির মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুরূপে তা সমাধান করে দেন। তবে এেেত্র কোথাও কোথাও কেহ কেহ কিছুটা ছয় চারেরও আশ্রয় যে নেননা তা হলফ করে বলা যাবেনা। যা আমাদের গ্রাম্য সালিশী বিচার নিবন্ধে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। গ্রাম বা পাঞ্চাইতের সবচেয়ে ল্যনীয় বিষয় হচ্ছে একতা।

পাঞ্চাইতের অধীন কেহ অন্য গ্রামের লোক বা বহিরাগত দ্বারা আক্রান্ত হলে গ্রামের সকলে সম্মিলিতভাবে তা মুকাবেলা করতে এগিয়ে আসেন। কারণ তখন তা পাড়ার বা গ্রামবাসী সকলের প্রেস্টিজ ইস্যুতে পরিণত হয়ে যায়। আগেকার যুগে গ্রামে গ্রামে ‘‘হাজরমাইর’’ এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। এমনকি দিন তারিখ ঠিক করেও গ্রামে-গ্রামে, গোত্রে-গোত্রে বা কয়েক গ্রামে মিলেও হাজরমাইর করতেন। বর্তমানে তা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

গ্রাম পাঞ্চাইতের কার্য্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিন্নি সালাদ গরু জবাই বা বিয়ে শাদীতে পাঞ্চাইতের সকলকে পাঞ্চাইতি দাওয়াত দেয়া। জিয়াফত বা বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠান আয়োজনের কয়েকদিন পূর্বে পাঞ্চাইতের মুরব্বীয়ানদের দাওয়াত দিয়ে বৈঠক করে তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা চাওয়া হয় এবং সকলেই সাধ্যমত সহায়তা করেন। শিরনী করলে খতম মিলাদ শরিফ ও শিরনীর দাওয়াত বাড়ী বাড়ী গিয়ে দেয়া হয়, এতে সাধারনত কিশোরদেকেই পাঠানো হয়। তারা বাড়ী বাড়ী দাওয়াত দেয় এই বলে যে ‘‘রাইত ছফিনা খতম, বিয়ানে শিন্নি’’ অথবা ‘‘মাধানে মছিদো মিলাদশরিফ ও শিন্নির দাওত। ’’ উৎসুক অনেকেই জিজ্ঞেস করেন কিজাত শিন্নি রবো ? তখন দাওয়াতী কিশোর বলে আখনী/পোলাও/রি/খিচুড়ী/তুশা অর্থাৎ যিনি যে প্রকারের শিন্নি পাকান ।

তবে বর্তমানে রি, খিচুড়ি, খই, বিস্কুট শিরনীর প্রচলন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে তাই অধিকাংশরাই আখনী শিরনী করেন। কেবল মানুষ মৃত্যুবরন করলে চারদিনের মধ্যে কেহবা চল্লিশ দিনের মধ্যে ফল ফলাদি খই রুটি আখ ইত্যাদি প্রদান করেন। শিরনীর পর পছন্দমতো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও খাতিরের মুরব্বীদের দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়। তবে দ্ররিদ্রদেরকে প্রায়ই উপো করতে দেখা যায়। ইমাম সাহেব ও মুয়াজ্জিন সাহেবকেও দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়নের পর কিছুটা হাদিয়া তোহফা মুষ্টিবদ্ধভাবে প্রদান করা হয় এবং তারাও খুশি হয়ে তা পকেটে পুরেন।

প্রতি বৎসর কার্তিক মাসে পাঞ্চাইতের সকলে মিলে চাঁদা তুলে পাঞ্চাইতি শিরনী করার একটা ব্যাপক রেওয়াজও আছে। উদ্দেশ্য অগ্রহায়ন মাসের ধান বালা-মুসিবত থেকে রা পাওয়ার জন্য ও সুষ্টুভাবে হাত লাগার জন্য শিন্নি মিলাদ শরিফ ও দোয়া দুরুদ করা। গরু জবাই করলে (সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গরু বাটাইয়া দেওয়া) দাওয়াত দেয়া হয় গরু জবর দাওয়াত। পাঞ্চাইতের সকলকে হিসেব করে ছান্দা (বাটি) দেয়া হয় এবং ইমাম ও মুয়াজ্জিন সাহেব যে ঘরে খাবার খান সে ঘরে তাদের আলাদা ছান্দা দেয়া হয়। বাহিরের গ্রামে জিয়াফত বা অন্য কোন দাওয়াত হলে পাঞ্চাইতের সকলে সংঘবদ্ধভাবে যাওয়ার রেওয়াজও আছে।

এছাড়াও এলাকার গরিবদের সম্মিলিতভাবে সাহায্য করা, তাদের বিয়ে শাদীতে সহযোগীতা করা, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন সাহেবকে পালাক্রমে খাওয়ানো, মসজিদ ও এলাকার রাস্তা ঘাটের উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে চাঁদা প্রদান, ইসলাম ও সমাজ বিরুধী কর্মকান্ড ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করন, বহিঃশত্র“র মোকাবিলা, সম্মিলিতভাবে ওয়াজ মাহফিল বা সৃজনশীল কোন অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় ও জাতীয় বিশেষ বিশেষ দিবস উদযাপন ইত্যাদি। প্রায় গ্রামে পাঞ্চাইতি ‘‘গরু বারি’’ অর্থাৎ সারা গ্রামের গৃহপালিত গরু পালাক্রমে একেকদিন একেকজনে একটানা সারাদিন চরানোরও একটা রেওয়াজ আছে। এতে সকলেরই সময়ের সাশ্রয় ও উপকার হয়। গরুরাও দল বেধে একসাথে মনের আনন্দে মাঠে চরে বেড়ায় ও সারাদিন ঘাস খায়। এছাড়া প্রায় গ্রামেই ঝগড়া ঝাটি ও খুন খারাবী নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য কিছু অলিখিত বিধি বিধান থাকে।

যেমনঃ ঝগড়া লাগলে দা, সুলফী, ঝাটা, রামদা তথা ধারালো অস্ত্র বের করলে বা ব্যবহার করলে নির্দিষ্ট পরিমাণে মুচলেকা দিতে হয়। ঝগড়া ঝাটি সালিশের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করার এবং ডিপোজিট আদায়ের পরও আবার ঝগড়ায় লিপ্ত হলে মুচলেকা দিতে হয় ইত্যাদি। পাঞ্চাইতি হুকুম অগ্রাহ্য করলে শাস্তি হিসেবে পাঞ্চাইত থেকে বহিস্কার তথা ‘‘পাচরবাদ’’ দেয়া হয়। অন্যায়ভাবে পাঞ্চাইতের কেহ মিথ্যে মামলায় আক্রান্ত হলে গ্রামের সকলেই সম্মিলিতভাবে তার পে স্ব্যা প্রদান ও সহযোগিতা করেন যা থানা বা আদালতও অগ্রাহ্য করেনা। গ্রাম পাঞ্চাইত ভিত্তিক আরও কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়।

তবে এলাকা তথা স্থানভেদে তা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়। যেমনঃ গ্রামে চোর ডাকাতের উপদ্রব হলে পালাক্রমে পাহারা বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা, অসামাজিক কাজের প্রতিরোধ ও অপরাধিকে স্থানীয়ভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া, চোরাচালান প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া, নির্বাচন এলে গ্রাম ভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ জোট গঠন, সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে ঐক্যবদ্ধভাবে সহায়তা প্রদান প্রভৃতি। গ্রামের কোন লোক মৃত্যুবরন করলে গ্রাম পাঞ্চাইতের সকলে মিলে কবর খনন ও দাফন কাফন কার্যেও সম্মিলিতভাবে অংশ নেয়ার রেওয়াজ সুদুর প্রাচীন কাল থেকে অব্যাহত আছে। গ্রামের কেহ অসুস্থ হলে বা অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় পতিত হলে দেখতে যাওয়া ও সাধ্যমত সহযোগীতা করারও রেওয়াজ আছে। ঈদের ও জুমার জামাতে পাঞ্চাইতের সকলে পাড়ার ঈদগাহ বা মসজিদে সমবেত হয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে জামাত আদায় এবং ঈদগাহ, মসজিদ ও পাঞ্চাইতি গুরুস্থান রনাবেনে সম্মিলিত উদ্যোগও অত্যান্ত প্রশংসনীয়।

কোথাও কোথাও ঈদুল ফিতরের জামাতের পূর্বে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ছাড়েন তাদেরকে কলাগাছ, জুতা বহন, কানে ধরে উঠবস করানো সহ বিভিন্ন হালকা থেকে মাঝারি ধরনের শাস্তিও প্রদান করতে দেখা যায়। মসজিদের মক্তবে সকালে ইমাম সাহেব কর্তৃক ছোট ছোট শিশু কিশোরদের পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া দুরুদ, নামাজ ও মাসলা মাসাইল শিখানোর ব্যবস্থাও অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং আদিকাল থেকেই তা চলে আসছে। এতোসব ইতিবাচক কর্মকান্ডের ভীড়েও কোন কোন এলাকায় গ্রাম পাঞ্চাইতের মধ্যে বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয়আশয় নিয়ে ভয়াবহ কোন্দল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দ্বন্ধ সংঘাত হতেও দেখা যায় এবং কোথাও কোথাও যৎসামান্য কর্মকান্ডে কুসংস্কারও পরিলতি হয় যা ‘‘আমাদের গ্রাম্য কুসংস্কার’’ শিরোনামের নিবন্ধে ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি। পরিশেষে বলা যায় আমাদের গ্রাম পাঞ্চাইতের কল্যাণে অনেক বড় বড় কর্মকান্ড সম্মিলিতভাবে আমরা অনায়াসেই করতে পারি এবং এর ঐতিহ্য আমাদের সমাজ সংস্কৃতিরই অন্যতম অংশ। আমাদের গৌরব গ্রাম পাঞ্চাইতের ঐতিহ্য অুন্ন রেখে সম্মিলিতভাবে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে দুর্নীতি ও কলুষতামুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখা সকলেরই কর্তব্য।

সরকার যে গ্রাম সরকার প্রথা পূণঃপ্রবর্তন করেছেন তা আরও শক্তিশালি করে তাদেরকে দেশ গঠনে আরও সম্পৃক্ত করলে সমাজ ও দেশের উন্নয়ন আরও তরান্বিত হবে বলে মনে করি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।